সূর্যোদয় #পর্ব_১১ #কারিমা_দিলশাদ

#সূর্যোদয়
#পর্ব_১১
#কারিমা_দিলশাদ

ইলোরা ইয়াসমিন ও স্মৃতি তারা দুজনেই ইলোরা ইয়াসমিনের কলিগের বাসায় এসেছে। সাথে তাদের আরও জন কয়েক কলিগও আছে। যারা আপাতত লিভিং রুমের সোফায় বসে নিজেদের মতো গল্প করছে। জয় আর স্মৃতির সাথে দেখা হওয়ার পর আরও অনেকগুলো দিন চলে গেছে আর ইলোরা ইয়াসমিনকে তো সে তাদের বাসাতেই প্রথম এবং শেষবার দেখেছিল। ঐশী তাদের দেখে কিছুটা অবাক এবং কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে।

অস্বস্তিবোধটা ইলোরা ইয়াসমিনকে দেখে৷ তাকে দেখে অস্বস্তি কেন হচ্ছে তা তার জানা নেই। সে রুমে যাবে কি না বুঝতে পারছে না। দরজাটা খোলাই ছিল আজকে। কি মনে করে যেন ঢুকেই পড়ে রুমে। তাকে দেখে সবার নজর তার উপর পড়লে সে এবার একটু ভড়কে যায়। তবে মৃধার মা তাকে দেখে আন্তরিকতার সহিত মুচকি হেসে বলে,

“ আরে ঐশী যে। তোমার ছাত্র-ছাত্রীরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে যাও।”

এই কথারই যেন অপেক্ষা ছিল ঐশীর। সে যেই রুমে পড়ায় সে রুমে যেতে নিলেই আবার মৃধার মা তাকে থামিয়ে দেয়। আর ঐশীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ঐশী এরা আমার কলিগ। ভাবলাম আজকে সবাইকে নিয়ে একটু আড্ডা টাড্ডা দেই।”-সাথেই বাকি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আর ও হচ্ছে ঐশী। মৃধা, অথৈ আর আয়ানের হোম টিচার। বেশ ভালো পড়ায়। দারুণ একটা মেয়ে।”

ওনার কথায় ঐশী জো’রপূর্বক একটা মুচকি হাসি দিয়ে সবাইকে সালাম দেয়। এর মধ্যে স্মৃতির দিকে নজর যেতেই দেখে স্মৃতি তাকে দেখে হাত নেড়ে হাই বলছে। ঐশীও তার দিকে তাকিয়ে একটা হাত নেড়ে, পড়ানোর উদ্দেশ্য রুমে যেতে নিলে আবার মৃধার মা তাকে থামিয়ে দেয়। আর আজকে ওদের একটু কম পড়াতে বলে।

ঐশী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বিনাবাক্য ব্যয়ে চলে আসে। এসে মৃধাদের পড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে মৃধার মা স্মৃতিকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। আর ঐশীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ঐশী মা থাক আজকে আর পড়াতে হবে না। ও স্মৃতি। ওকে চেনো নিশ্চয়ই? মেয়েটা একা একা আমাদের মাঝে বোর হচ্ছে। ও একটু তোমার সঙ্গে থাকুক। আজকে বরং ওদেরকে নিয়ে একটু গল্প করো। ঠিক আছে। তোমার কোনো সমস্যা নেই তো??”

এভাবে কে কাকে তার সমস্যার কথা বলে? আজকে যখন পড়াতে হবে না তখন ঐশীকে বলে দিলেই পারতো। এখন অযথা এখানে এতগুলো অচেনা মানুষের মাঝে বসে টাইমপাস করতে হবে। যদিও স্মৃতি মেয়েটা তার চেনা পরিচিত, ভালোই লেগেছে। তবে পড়াতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়লে মনে হয় কারো পার্সোনাল স্পেসে বাগ’ড়া দিচ্ছে। ভীষণ আনইজি লাগলেও মুখে এক ফোয়ারা হাসি রেখে বলে,

“ না না আন্টি কোনো সমস্যা নেই আমার।”- এরপর স্মৃতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ স্মৃতি বসো তো এখানে।”

ঐশীর কথায় মৃধার মা হালকা হেসে চলে যায়। আজকে পড়তে হবে না দেখে বাচ্চারাও খুশি। অথৈই আর আয়ান হাতে যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছে। মুখ থেকে তাদের খই ফুটছে। ঐশীর অস্বস্তিটাও বেশিক্ষণ থাকলো না। মৃধা আর স্মৃতির সাথে কথায় বেশ জমে গেল।

কথায় কথায় স্মৃতি ঐশীর ডান্স ক্লাসের খবর জানতে চাইলে ঐশী স্টুডেন্ট বেশি হওয়ায় বড় রুম নেওয়ার কথাটাও জানায়। সাথে এটাও জানায় সামনের মাস থেকে নতুন ব্যাচ শুরু করতে যাচ্ছে। ঐশীর কথায় স্মৃতি বেশ আফসোসের সাথে বলে,

“ জানো আপু আমারও না খুব শখ ছিল নাচ শেখার। নাচতে আমার খুব খুব খুব ভালো লাগে। একবার মাকে বলেছিলামও কিন্তু পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে আম্মু না করে দেয়। এরপর আর কখনো সে কথা মুখেও আনি নি। তবে তোমার নাচের ক্লাসের কথা শুনে আমার এখন খুব শিখতে ইচ্ছে করে জানো। কিন্তু…. ” – বলেই চুপ হয়ে যায় স্মৃতি।

যতক্ষণ স্মৃতি তার শখের কথা বলছিল তখন তার মুখের চমকটা দেখার মতো ছিল। এখন কেমন মনমরা হয়ে গেল। যা একদম ভালো লাগলো না। তবে সে কিছু বললোও না। কিই বা বলবে সে। কিছু বলতে গেলে কেউ ভাববে তার নাচের ক্লাস আছে তাই সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য বোধহয় এসব কথা বাচ্চাগুলোর মাথায় ঢুকাচ্ছে ঐশী। আর তাছাড়াও সামনে এইচএসসি পরীক্ষা স্মৃতির, এই সময় এসব আবদার করলে স্বাভাবিকভাবেই কোনো পরিবার কক্ষনোই মানবে না৷ তাই এখানে ঐশী কিছু না বলাটাই বেটারভাবে। কেবল স্মৃতির মাথায় হালকা হাত বুলিয়ে দেয়।

একটু পর স্মৃতি উচ্ছাস নিয়ে বলে,

“ আপু তুমি একটু আম্মুর সাথে কথা বলবে? তুমি বললে আম্মু মানতেও পারে।”

এতোক্ষণ ঐশী যেসব ভেবে চুপছিল তাই এখন এই পা’গল তাকে করতে বলছে। ঐশী বলে,

“ না স্মৃতি। আমি এই বিষয়টা বললে মোটেও ভালো দেখায় না। কারণ দেখো এখন আমার একটা ডান্স ক্লাস আছে আমি এখন এসব বললে লোকে ভাববে আমি আমার ডান্স ক্লাসে ভর্তি হওয়ার জন্য লোকেদের এপ্রোচ করছি। বিষয়টা মার্কেটিং হিসেবে ঠিক হলেও, তা মোটেও ভালো নজরে কেউ নিবে না৷ আর তাছাড়া তুমি এখন ফার্স্ট ইয়ারে। এরপর তো তোমার এইচএসসি পরীক্ষা। এখন এসব বললে সেটা মোটেও আন্টি মানবে না৷ তাই কি স্বাভাবিক না বলো?
পরীক্ষাটা যদি খারাপ হয় তখন?”

স্মৃতি ঐশীর কথায় ভেবে দেখে কথাটা আসলেই ঠিক। তার ঐশী আপু কিছু বললে সবাই তাই ভাববে। আর তার আম্মুও এখন কিছুতেই তাকে এখন এসব শিখতে দিবে না। তারমানে তার শখটা কেবল শখই থেকে যাবে ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

বিষয়টা দেখে ঐশী স্মৃতিকে হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

“ মন খারাপ করে না বোন। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়৷ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তুমি নিজে নিজেও তো ডান্স প্র্যাক্টিস করতে পারো? এখন আপাতত তুমি পড়ায় মনোযোগ দাও হ্যা?”

“ এতদিন তো নিজে নিজেই ভিডিও দেখে দেখে শিখতাম। তবে টিচার আর ভিডিও দেখে নিজে নিজে শিখা এক হলো বলো?”

স্মৃতির কথার জবাব নেই ঐশীর কাছে। স্মৃতিকে বলা কথাগুলো ঐশী কেবল ওকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্যই বলেছে৷ মানুষ নিজে মানতে পারুক আর না পারুক, কিছু পারুক আর না পারুক। অন্যকে স্বান্তনাটা খুব ভালোই দিতে পারে।

ঐশী আর স্মৃতির ভাবনার মাঝেই মৃধা বলে,

“ আমার তো গান শেখার খুব ইচ্ছা। ছোট থাকতে একবছর শিখেওছিলাম। তবে পরে পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে আব্বু আম্মু আর শেখায় নি।”

মৃধার কথায় ঐশী ভাবে সবার মাঝেই না জানি এমন কত শখ অপূর্ণ হয়ে থাকে। এসব নিয়ে শেষ বয়সে আফসোস ছাড়া কিছুই হয় না৷

ঘরে যেন এক গুমোট ভাব ছেয়ে গেছে। ঐশী, স্মৃতি আর মৃধা ছাড়াও যে রুমে আরও দুজন আছে তা তারা ভুলেই গেছে যেন। রুমের এই গুমোট ভাবটা যাদের একদম পছন্দ হচ্ছে না। ওদের চুপ থাকতে দেখে আয়ান বলে,

“ কি হলো তোমরা চুপ হয়ে গেলে কেন? কথা বলো।”

“ অন্য কথা বলো। তোমাদের এসব কথা তো আমাদের ভালো লাগছে না।”- অথৈ এর কথায় ওরা তিনজনেই হেসে উঠে। আর আবার কথায় মত্ত হয়ে যায়।

———————–

হাসি আড্ডায় অনেকটা সময় পার হলে ঐশী বাসায় যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে। তখন মৃধার মা ঐশীকে রীতিমতো পাকড়াও করে ফেলে। তিনি না খেয়ে ঐশীকে কোনোভাবেই আসতে দিবে না৷ অনেক জো’রাজুরির পর ঐশী অল্প কিছু খেয়ে বের হয় বাসার উদ্দেশ্য।

আসার আগে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। ইলোরা ইয়াসমিনকে যখন বলে,

“ আসি আন্টি ভালো থাকবেন।”

তখন ইলোরা ইয়াসমিন ঐশীর কাছে এসে তার মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে নিজের হাতে চুমু খায়। আর বলে,

“ সাবধানে থেকো মা, ভালো থেকো। দোয়া করি অনেক বড় হও। ”

তার কথায় ঐশী কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তার এতো আত্মীয় স্বজন। রক্তের সম্পর্কের আপনজন, তার বাবা মাও কখনো তাকে এভাবে আদর করে দোয়া করে নি। ঐশী ইলোরা ইয়াসমিনের কথায় কেবল মলিন মুখে হালকা একটা মুচকি হাসি দেয়।

এরপর স্মৃতি এসে তাকে জ’ড়িয়ে ধরে বলে,

“ আবার দেখা হবে আপু। তুমি কিন্তু আমাদের বাসায় যাবে একদিন।”

ঐশীও স্মৃতিকে অত্যন্ত যত্নের সহিত কিছু কথা বলে বিদায় নেয়। আর যেতে যেতে ভাবে। হাতেগুনা এক-দুই দিনের দেখা সাক্ষাতে মানুষগুলো কতো আন্তরিকতার সহিত কথা বলে। যেন না জানি কতদিনের চেনা জানা সম্পর্ক। কিছু মানুষের সাথে ১০ বছর চেনা জানা থাকলেও তাদের সাথে ততটা মিল মোহাব্বত হয় না যতটা কিছু মানুষের ১ঘন্টার আন্তরিকতার জন্য সৃষ্টি হয়।

———————–

রাতে জয় বাসায় আসলে সবাই মিলে যখন রাতের খাবার খেতে বসে তখন স্মৃতি আবার ঐশীর বিষয়ে আলাপ তুলে।

“ ঐশী আপু কি ভালো তাই না আম্মু? আমার তো তাকে অন্নেক ভালো লাগে।”

স্মৃতির কথায় ইলোরা ইয়াসমিন কেবল ‘হুমম’ বলে উত্তর দেয়।

আর এদিকে ঐশীর নাম শুনতেই আরেকজনের মাথায় কথাটা ধাক্কা দেয়। নামটা মাথায় ধাক্কা দিল না মনে তা উপরের আল্লাহ আর সেই ব্যক্তি নিজেই ভালো জানে।

#চলবে…………

( কপি করা নিষেধ। কেউ কপি করবেন না। তবে শেয়ার করতে পারেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here