সূর্যোদয় #পর্ব_১৮ #কারিমা_দিলশাদ

#সূর্যোদয়
#পর্ব_১৮
#কারিমা_দিলশাদ

আজকে বাংলা বছরের শেষ দিন। কালকে থেকে বাংলার নতুন বছর শুরু হতে যাচ্ছে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কালকে কলেজে অনুষ্ঠান আছে। সেখানে ঐশীর দুটো ডান্স পারফরম্যান্স আছে। একটা দলীয়, একটা একক। এছাড়াও ডিপার্টমেন্টের ম্যামের বদৌলতে তার নৃত্যশৈলী একাডেমি থেকেও একটা ডান্স পারফর্ম করার কথা বলা হয়েছে।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আলপনা আঁকা হচ্ছে সারা কলেজ জুড়ে। ঐশীও সামিল হয়েছে তাতে। এসব কাজে সে বেশ পারদর্শী। ঐশীর সাথে তার ফ্রেন্ডরাও আছে। কেউ আঁকাআকি করছে আবার কেউ বা তাদের সাহায্য করছে। সকাল থেকে এসব করছে। তাই আঁকাআকি থেকে ব্রেক নিয়ে সবাই চা খেতে গেল। সৌরভ আর বিজয় চা আনতে গেলে বাকিরা মুক্তমঞ্ছে গিয়ে বসে। এজ ইউজুয়াল তাদের হৈ চৈ তো চলছেই।

সৌরভ আর বিজয় চা নিয়ে এলে যে যার মতো চা নিয়ে আবার হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠে। একপর্যায়ে ঐশী সৌরভকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ মামা কি হুনতাছি তোমার নামে? তুমি নতুন মামি ধরছো বুজি? দেহাইলাও না… ”

“ আরে বেডি যাহ্।”

“ ওমা যা কি! মামী কিয়ে পড়ে আমরার লগেই?”

“ আরে ভাই কি যে আবুইল্লা ছেরি ভাই। মেজাজ গরম কইরা ফেলায় জানস।”

অনিক বলে,

“ মেজাজ গরম হইতো ক্যা? অহন তো বেডা আরও ঠান্ডা থাকবো। সব ঠান্ডা থাকবো।” — শেষের কথাটা অনিক বিকৃত করে বলতেই সবাই হেসে দেয়।

প্রীতি বলে,

“ সৌরইব্বে ক ছেরি কইনের? আমরার লগে?”

“ আরে না। ক্লাস নাইনে পড়ে। ” — বলতেই সবাই হা হা করে হেসে দেয়।

একটুপর সৌরভ তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠে,

“ হা**লির কতা হুনলেই মেজাজ গরম হইয়া যায়। হেইদিন রাইতের ৩টার সময় ফোন দিছে বুঝলি। ১টার সময় হেইটার লগে কতা কইয়াই হগলে হুতছি। ৩টার সময় ফোন দিয়া তুইল্লা কয় ভিডিও কলে আয়তাম। তে গেলাম। পরে কয় কি অযু করতাম, কইরা হের লগে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তাম বুলি। ক ছ্যা মেজাজটা কিরম খারাপ লাগে?”

সৌরভের কথা শুনে হাসতে হাসতে সবার পেটে খিল ধরে যাওয়ার উপক্রম। বিজয় হাসতে হাসতে বলে,

“ আহ ছ্যাঁকা বন্ধু ছ্যাঁকা। তুই না জানি কি ভাবছিলি।”

একথা শুনে কবিতা বলে,

“ ছি:….”

“ ছি: ছি: করস কেন? আমি তো বিপদের কথা বুঝাইলাম। তুই কোন মাইন্ডে নিছস খারাপ!” — এসব শুনে হাসতে হাসতে বাকিদের চোখ থেকে পানি পড়ার অবস্থা। হাসতে হাসতেই ঐশী সৌরভকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ তে ক্লাস নাইনের নিব্বির কাছ থিকা তুমি আর কি আশা করো। তো পরে নামাজ পড়ছিলি?”

“ ধুর বেডি…. ধমক দিছিলাম। হেইটা নিয়া আরেক প্যান্দানি।”

এটা শুনে হাসির ফোয়ারা যেন আর থামে না।

———————-

এরইমধ্যে স্মৃতি একটা মেয়ের সাথে আসে হাতে কিছু ব্যাগ নিয়ে। ঐশীই বলেছিল কিছু দরকারি জিনিস নিয়ে আসতে।

স্মৃতি এখন বাসায় যাবে, তাই জয় তাকে নিতে আসবে। সেজন্য সে ঐশীদের সাথেই বসে জয়ের আসার অপেক্ষা করতে থাকে। ওইদিনের রাতের কথার পর জয় আর স্মৃতির মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক যাচ্ছে না। স্মৃতি এখন জয়ের সাথে দরকার ব্যতীত কথা বলে না। সে জয়ের সাথে রাগ করেছে। যদিও জয় বেশ কয়েকবার তার রাগ ভাঙতে এসেছে। তবে লাভ হয় নি৷ জয় কিছু জিগ্যেস করলেই সে উত্তর দেয়। জয়ও কয়েকদিন ধরে আবার চুপচাপ হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পর জয় আসে। ততক্ষণে ঐশীরা আবার কাজে লেগে পড়েছে। মূল ভবনের সামনে তখন তারা আলপনা আঁকছিল। স্মৃতিও তাদের সাথে ছিল। জয় এগিয়ে যায় তাদের কাছে।

ঐশী তখন মাটিতে বসে একমনে রংতুলি দিয়ে রং করছিল। সাধারণ একটা থ্রি পিছ গায়ে, খোঁপা করা চুল, মুখের সামনে এক গাছি চুল উড়ছে। এতে করে ঐশীর ডিস্টার্ব হচ্ছে। আর সে বিরক্তি নিয়ে বাম হাতের উল্টো দিক দিয়ে তা বারবার সরাচ্ছে। জয়ের ইচ্ছে করছে নিজের হাতে চুলটা কানের পিছে গুঁজে দিতে।

অতি সাধারণ একটা বিষয়। অথচ এই অতি সাধারণ বিষয়টাই জয়ের কাছে অসাধারণ লাগছে। তার দেখতে ভালো লাগছে। বেশ অনেক্ক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় প্রীতিই প্রথম জয়কে খেয়াল করে। প্রীতি বলে,

“ আরে ভাইয়া আপনি? কখন এলেন?”

জয় হালকা হেসে জবাব দেয়,

“ এইতো মাত্রই এলাম। স্মৃতিকে নিতে এসেছি।”

ততক্ষণে বাকিদের সাথে ঐশীও জয়ের দিকে তাকায়। জয় আবার ঐশীর দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। চোখাচোখি হতেই দুজন দুজনকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। আর ঐশী হাসিমুখে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ কালকে কলেজে আপনার পান্তা ভাতের দাওয়াত রইলো ডাক্তার সাহেব। আসবেন না?”

“ দেখি চেষ্টা করব।” —জয়ও হেসে জবাব দেয়। আর কিছু বলবে তার আগেই স্মৃতি এসে বলে,

“ ভাইয়া তাড়াতাড়ি চল। আমার মাথাব্যাথা করছে। ”

একথা শুনে জয় স্মৃতির দিকে তাকায়। তবে স্মৃতির মুখ দেখে মনে হচ্ছে না তার মাথাব্যাথা করছে। মুখে একটা সূক্ষ্ম অভিমানের রেখা। জয় তারদিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে স্মৃতি জয়ের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ আসল কথা বলতে না পারলে আমার আপুর সাথে এত গদগদ করার দরকার নেই। হুহ্।” — বলেই হনহন করে গেটের বাইরে চলে গেল।

আর জয় কোমড়ে হাত দিয়ে বিরক্তি নিয়ে স্মৃতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর আবার ঐশীর দিকে তাকায়। তাকিয়ে দেখে ওই মেয়ে তার নিজই কাজে মত্ত। আরও একবার স্মৃতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঐশীর দিকে তাকায়। না পারতে ঐশীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইকের কাছে গিয়ে দেখে স্মৃতি মুখ ফুলিয়ে এক সাইডে দাঁড়িয়ে আছে। জয়ও মুখ ফুলিয়ে গিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়। আর মনে মনে স্মৃতিকে একশটা গা’লি দেয়। ব’দমাশ মেয়েটার জন্য আরেকটু কথা বলতে পারলো না।

————————–

পরেরদিন,

আজকে পহেলা বৈশাখ। বাঙালির উৎসব৷ বাংলা আজকে নতুন রঙে নতুন ঢঙে সেজেছে।

আজকে অনেক সকাল সকাল ঐশী বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে নৃত্যশৈলিতে যাওয়ার জন্য। নিজেকে রেডি হতে হবে। বাকিদেরও রেডি করতে হবে। যদিও যে যার মুখের সাজটা পার্লার থেকেই সেজে আসবে। কিন্তু ঐশী পার্লারে যাবে না। সে এসব পছন্দ করে না। নিজেরটা সে নিজেই সাজবে। সাথে আরও কয়েকজন আছে। ওরাও নিজেরাই সাজবে।

জ্যাম না থাকায় পৌঁছেও গেল তাড়াতাড়ি। গিয়ে দেখে ইতোমধ্যে কয়েকজন এসে দাড়িয়ে আছে। সে গিয়ে তাড়াতাড়ি গেইট খুলে দেয়। ওদেরকে হলরুমে রেডি হতে বলে নিজে পাশের রুমে চলে যায়।

পাশের রুমটা এখন আর খালি নেই। ঐশী রুমটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে ফেলেছে। একপাশে তোষকের উপর চাদর বিছানো। তার উপর বিভিন্ন ধরনের কোশন। একপাশে প্লাস্টিকের একটা ছোট্ট ওয়ারড্রব। তারপাশে লম্বালম্বি বড় একটা আয়না। অন্যপাশে একটা ছোট্ট বুকশেলফ। যা দেয়ালের সাথে সেট করা। তার সামনে বরাবর ছোট্ট একটা মিনি বেতের টেবিল আর দুটো চেয়ার রাখা। ঘরের শোভাবর্ধনের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছ। আর কিছু নান্দনিক জিনিসপত্র। ছিমছামের মাঝেও অনেক সুন্দর। কাজ ব্যতীত দিনের অনেকটা সময় এখন এখানেই কাটায় ঐশী।

আশা, প্রীতি আর কবিতাও এসে পড়েছে। ওরা বাকিদের তৈরি হতে সাহায্য করে, আর ঐশী নিজে নিজেই তৈরি হয়ে নেয়।

সাদা লালের সংমিশ্রণের লেহেঙ্গা গায়ে জড়িয়ে লিপস্টিক আর কাজল আইলাইনার দিয়ে নিজেকে তৈরি করে নেয়। যদিও চোখের আইলাইনার কাজল আশা দিয়ে দেয়। তার দ্বারা এসব সম্ভব না। চুলগুলোকে খোঁপা করে তাতে বেলীফুলের মালা জড়িয়ে নেয়। আজকে ঐশীকে দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে।

এরপর কলেজের জন্য রিকশায় করে বেরিয়ে পড়ে।

———————-

আজকে সবাই নিজেকে নানান রঙে সাজিয়েছে। কলেজের ভিতরে অডিটোরিয়ামের সামনের জায়গাটুকুতে স্টুডেন্টরা বেশকিছু স্টল বসিয়েছে। বিজয়, সৌরভ, অনিক এরাও পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ, আরও বেশ কিছু বাঙালি খাবার ও পিঠার স্টল সাজিয়েছে। এসব কাজে বাকিরা তাদের সাহায্য করেছে।

ওরা গিয়ে দেখে অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গেছে। প্রথমেই নৃত্যশৈলি একাডেমির পক্ষ থেকে একটি দলীয় নৃত্য প্রদর্শন করা হয়। এর অল্প কিছুক্ষণ পর ঐশীর দলীয় এবং একক নৃত্যের প্রদর্শন হয়। সবই ভালোই ভালোই শেষ হয়ে যায়।

ঐশী পারফরম্যান্স শেষে অডিটোরিয়ামের বারান্দায় এলে তার ফ্রেন্ড এবং তার একাডেমির স্টুডেন্টরা সবাই তাকে আশপাশ থেকে জেঁকে ধরে খুব প্রশংসা করে। এরমধ্যে স্মৃতিও এসে তার অনেক তারিফ করতে থাকে।

অনুষ্ঠান যখন প্রায় শেষের পথে তখন ঐশীরা তাদের ডিপার্টমেন্টে চলে যায়। সেখানে গিয়ে নিজেদের মতো বকবক করতে থাকে। আজকে কে কি করেছে না করেছে। যেহেতু তারা আজ ভাগ ভাগ করে ছিল। এক ভাগ স্টলে তো এক ভাগ অডিটোরিয়ামে। এরমধ্যে অনিক ঐশীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ দোস্ত যাই কস তোরে আজকে ভালাই দেহা যাইতাছে বুঝলি। হাঁচা কতা। ওই মোড়ের সামনে যে পাগলাটা বয় না? ওই মামায় দেখলে তোরে পাক্কা উঠায় লইয়া যাব আজকে।”

একথা বলেই অনিক দৌড় আর তার পিছে ঐশীও। অল্প কিছুটা যেতেই ঐশী একজনের সাথে ধাক্কা খেতে খেতেও বেঁচে যায়।

#চলবে……………….

(কপি করা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here