সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৪)

#গল্প১৩৮

#সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৪)

১.
রাত আটটা বাজে, এর মাঝেই কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যাদের খাটুনিটা বেশি। সূর্যও ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে, এই ক্ষেতের কাজটা দারুণ পরিশ্রমের। আধোঘুমেই টের পায় সিপাহি হাঁক দিয়ে নিয়ম করে বলছে ‘দুই’, সাথে সাথে ম্যাট বাবুলের জোর গলা পাওয়া যায় ‘পঞ্চাশ, সব ঠিক’। এরপর সিপাহি হাঁক দেয় ‘তিন’, আরেকজন ম্যাট একই সুরে আরেকটা সংখ্যা বলে উত্তর দেয়।
কারাগারে রাতের বেলা নির্দিষ্ট সময় পর পরই তালাবদ্ধ গেটের বাইরে থেকে এমন করে ওয়ার্ডগুলোর বন্দীর সংখ্যা ঠিক আছে কিনা জানতে চায়। আর ভেতর থেকে দায়িত্বে থাকা পাহারাদার ম্যাটরা জানান দেয় বন্দীর সংখ্যা।

সূর্য দুই নাম্বার ওয়ার্ডে আছে, এখানে ওরা পঞ্চাশ জন বন্দী। জমশের মিয়া ইতিমধ্যে নাক ডাকছে, গ্রামের মানুষ, আগেই ঘুমানো অভ্যেস। ওদের দলের জাহাঙ্গীর অবশ্য রাতে ঘুমোয় না। জমশের চাচার কাছে শুনেছে ও নাকি রাতে ঘুমোলেই ওর সেই অসহায় বোনটার মুখ মনে পড়ে, যাকে ওই পশুরা রেপ করে মেরে ফেলেছিল। সূর্য ভাবে একেক মানুষের একেক কষ্ট। সূর্য ঘুমোতে গেলে প্রথমেই মায়ের কথা মনে হয়, তারপর ধীরে ধীরে পারিজাত আসে, একটা নরম মায়া ঘিরে ধরে, ফেলে আসা সুন্দর মুহুর্তগুলো মনে করে করে ও ঘুমের দেশে চলে যায়। আজকেও তাই হচ্ছে। পারিজাত সবসময় পাশে বসলেই ওর হাতটা টেনে নিত। একটা ভালো লাগায় ওর বুকটা ভরে যেত। যেদিন পারিজাত পাশে বসেছে অথচ ওর হাতটা ধরেনি সেদিন সাথে সাথে মন খারাপ হতো ওর। আর সেটা বুঝতে পেরেই পারিজাত মিটিমিটি হাসত। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে, পারিজাত, তোমার হাতটা খুব মিস করছি!

এই যখন ভাবছে ঠিক তখন ম্যাট বাবুলের গলায় একটা উত্তেজনা টের পায়। চিল চিৎকার করে বলে, ‘এক বন্দীর কাছে গাঞ্জা পাওয়া গেছে।’

মুহুর্তেই কয়েকজন সিপাহি সূর্যের ওয়ার্ডে চলে আসে। ম্যাট বাবুল ততক্ষণে তার কয়েকজন অনুসারী নিয়ে সূর্যেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সিপাহিরা ঢুকতেই ম্যাট বাবুল সরাসরি সূর্যের মাথার নিচে বালিশের মতো করে রাখা কম্বল থেকে কিছু একটা বের করে সিপাহিদের হাতে দেয়। সূর্য কাঁচা ঘুম ভাঙা চোখে তাকিয়ে থাকে, ঠিক কী হচ্ছে ও বুঝতে পারে না। জমশের মিয়াও ঘুম থেকে উঠেছে।

সিপাহিদের একজন এসে জোরে একটা লাথি কষায় সূর্যের গায়ে। ‘উহ’ বলে একটা শব্দ করে উলটে পড়ে যায় সূর্য। আরেকজন সিপাহি এসে ওকে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে, ‘জেলে বইসা মাদক খাও, দাঁড়াও তোমার ব্যবস্থা করতেছি।’

কারাগারে কারো কাছে মাদক পাওয়া গেলে কঠিন শাস্তি হয়, সেইসাথে শাস্তির মেয়াদ বেড়ে যেতে পারে। সূর্য কোনোমতে বলে, ‘আমি সিগারেটই খাই না, আর মাদক তো দূরের কথা। আপনারা ভুল করছেন, এটা আমার না। কেউ নিশ্চয়ই এটা আমার এখানে রেখেছে।’

ম্যাট বাবুল বিকৃত গলায় বলে, ‘এহ, ফেরেশতা আইছে। সিগারেট খায় না, গাঞ্জা খায়। এইসব শিক্ষিত পোলা আমার চিনা আছে। এরে এখনই সেলে নিয়া যাইতে হইব। এই গাঁজা ওরই।’

সূর্য কেঁপে ওঠে, কারাগারে সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গা হলো এই সেল। এটা জেলের ভেতর আরেক জেল, এখানে নাকি নির্যাতন করা হয়। আশেপাশে সব কয়েদিরা কৌতুহল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একটা উত্তেজনা সবার মধ্যে। কয়েকজন সিপাহি সূর্যকে ধরে টেনে ওঠায়, তারপর ওকে যখন হাতকড়া পরাবে ঠিক তখন জাহাঙ্গীর লাফ দিয়ে সামনে আসে, কড়া গলায় বলে, ‘এরে ছাইড়া দেন, এই গাঁজা আমার। আমিই আইজ সন্ধ্যায় লুকাই রাখছি ওর কম্বলের নিচে।’

এতক্ষণ যারা এই নাটকটা দেখছিল তারা অবাক হয়ে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকায়, লোকটা কী বোকা নাকি। কেউ এই কথা স্বীকার করে??? এই বেটা তো নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে। সূর্যও অবাক হয়ে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকায়, ও নিজেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। একমাত্র জমশের মিয়া ঠিকঠাক বুঝতে পারেন ব্যাপারটা কী হচ্ছে, আর কেনই বা হচ্ছে।

বাবুল তেড়ছা চোখে তাকিয়ে বলে, ‘জাহাঙ্গীর, কথা কিন্তু বুইঝা শুইনা কইস। এর শাস্তি কিন্তু খুব কঠিন।’

জাহাঙ্গীর নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, ‘আর নিরপরাধ মানুষরে মিথ্যা প্যাঁচে ফেলানোও বড় অপরাধ। এই গাঁজা আমার, ওরে ছাইড়া দেন সিপাহি ভাই।’

বাবুল অবশ্য মনে মনে খুশিই হয়। সেদিনের সেই ঘটনার পর ও সুযোগ খুঁজছিল প্রতিশোধ নেওয়ার। যদিও জাহাঙ্গীরের উপরই রাগ বেশি ছিল কিন্তু ওরে ফাঁদে ফেলতে ভয়ও ছিল। তাই এই সহজ সরল ছেলেটারে বেছে নিয়েছিল। এই লেখাপড়া জানা পোলাটা ওর অর্ডার মানতেই চায় না। কিন্তু এখন যদি জাহাঙ্গীর নিজের ঘাড়ে দোষটা নেয় তাহলে তো আরো ভালো, মনের সুখ মিটিয়ে পিটানো যাবে।

সিপাহিরা একটু দ্বন্দ্বে পড়ে যায়, এই রাতে এমন ঝামেলা। কিছুক্ষণ ম্যাট বাবুলের সাথে কথাবার্তা বলে ওরা সিদ্ধান্ত নেয় জাহাঙ্গীরকে আপাতত সেলে বন্দী করে রাখা হবে, আর কাল কেসটেবিলে সুপার স্যার সূর্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। সূর্যকে ছেড়ে দিয়ে ওরা জাহাঙ্গীরকে ধরে নিয়ে যায়। যাবার সময় সূর্যের অবাক করা চোখের দিকে তাকিয়ে জাহাঙ্গীর একটা চোখ টিপে হাসে।

ওরা চলে যেতেই জমশের মিয়া ওর কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘ভাইস্তা, বড় বাঁচা বাইচা গেলা। এরপর থেকে ওই বাবুলের ব্যাপারে সাবধান থাইকো, ও কিন্তু পিছে লাগছে।’

সূর্য আনমনে মাথা নাড়ে, ও ভাবে কারাগারের ভেতরেও আবার নতুন অপরাধে ওকে জড়িয়ে ফেলবে? এখানেও ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে?

পরদিন সকালেই ওদের কেসটেবিলে হাজির করা হয়। বাবুলের মুখে একটা তৃপ্তির হাসি। সূর্য চিন্তিত মুখে ভাবছে আবার কোন বিপদে ও পড়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর অবশ্য নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। একটু পরেই জেল সুপার নাজিমুদ্দিন আসেন। বেশ লম্বাচওড়া একজন মানুষ, স্বাস্থ্যও অনেক ভালো। এসেই গম্ভীরমুখে বলেন, ‘এই, তোরা অপরাধ করে এখানে এসেছিস জেল খাটতে, তা না করে আবার নতুন অপরাধ করছিস? জানিস না, এতে আবার শাস্তির মেয়াদ বেড়ে যাবে?’

নাজিমুদ্দিনের শেষ কথাটায় সূর্যের বুকটা কেঁপে ওঠে, ওর শাস্তির মেয়াদ বেড়ে যাবে?? তাহলে যে ওর হিসেবটা উল্টোপাল্টা হয়ে যাবে আবার। কেন এমন হয় ওর সাথে বারবার। ইশ, মা জানলে খুব কষ্ট পাবে।

বাবুল ইতিমধ্যে কালকের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করছে, ‘স্যার, এই পোলা লেখাপড়া জানা বইলা দেমাগ বেশি। সেইদিন ক্ষেতের কামে ফাঁকি দিতাছিল, আমি কইতেই কেমন একটা চোখ গরম কইরা তাকায়। সেদিন থেকেই ওরে চোখে চোখে রাখছিলাম, কাইল রাইতে হঠাৎ দেখি ও কম্বলের নিচে কী যেন লুকাই রাখতেছে। তখন সিপাহিদের ডাক দিলাম।’

নাজিমুদ্দিন মনে মনে বিরক্ত হয়, এই ম্যাট বাবুল নিশ্চিত ওই সূর্য ছেলেটার পিছনে লেগেছে। ওর কথাতেই বোঝা যাচ্ছে। কারাগারে এমন ঘটনা মাঝে মাঝে হয়। ম্যাটরা অনেক কয়েদিদের উপর অযথা মাতবরি ফলাতে যায়। নাজিমুদ্দিন এবার সিপাহিদের দিকে তাকাতেই ওরা বলে, ‘স্যার, কাইল রাইতে ম্যাট বাবুল চিৎকার করে বলল যে ওই সূর্য নামের ছেলেটার কাছে নাকি গাঁজা পাওয়া গেছে। আমরা যেয়ে কম্বলের নিচ থেকে একটা পলিথিন মোড়ানো জিনিস উদ্ধার করছি। পরীক্ষা করে দেখেছি, ওইটা গাঁজাই ছিল স্যার।’

নাজিমুদ্দিন ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবেন, তারপর বাবুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলেন, ‘আচ্ছা, সিপাহিরা জিনিসটা উদ্ধারের আগেই তুমি কী করে জানলা যে ওইটা গাঁজা ছিল? একজন কম্বলের নিচে কিছু রাখতেছে সেটা দেখেই তুমি গাঁজা গাঁজা বইলা চিৎকার দিলা?’

বাবুল এবার থতমত খেয়ে যায়, ইশ, চালে বিরাট ভুল হইয়া গেছে। স্যার না উলটা ওরে সন্দেহ করে। মুখটা শুকাই যায় ওর, জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চেটে আমতাআমতা করে বলে, ‘স্যার, এই পোলাটা বালা না। আমি সন্দেহের বশেই কথাটা কইছি। কিন্তু আমার সন্দেহটা তো সত্যিই ছিল।’

নাজিমুদ্দিন এবার পরিস্কার বোঝেন এটা একটা ষড়যন্ত্র, কিন্তু গাঁজা পাওয়া গেছে এটা সত্যি। তবে যার কাছে পাওয়া গেছে সে যে দোষী না এটা নিশ্চিত। একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগছে, এই দোষটা আরেকজন স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে নিচ্ছে। এমন কেসে বরং সবাই অন্যের ঘাড়েই দোষটা চাপিয়ে দেয়। যাই হোক, একটা বিচার তো করতেই হয়। নাজিমুদ্দিন গলা খাকড়ি দিয়ে বলে, ‘যেহেতু কয়েদি জাহাঙ্গীর নিজেই স্বীকার করেছে যে গাঁজাটা ওই রেখেছে, তাই ওকে আগামী সাতদিন সেলে কাটাতে হবে। আর কয়েদি সূর্যকে এবারের মতো ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু এরপর এমন কিছু হলে শাস্তি পেতে হবে।’

সূর্য একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, আবার সেইসাথে একটা অনুশোচনাও ঘিরে ধরে। ওকে বাঁচাতে জাহাঙ্গীর ভাই নিজের ঘাড়ে দোষটা নিল!

জেল সুপার স্যার যাবার আগে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই ছেলে, তুমি লেখাপড়া কত দূর করেছ?’

সূর্য একটা বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে, ‘ইংরেজিতে গ্রাজুয়েশন করেছি।’

নাজিমুদ্দিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তারপর মনে করে, আরে হ্যাঁ, এখন মনে পড়ছে। একে তো রাইটারের কাজ দেওয়ার কথা ছিল। কারাগারে যারা শিক্ষিত মানুষ তাদের সাধারণত লেখালেখির কাজটা দেওয়া হয়। কিন্তু তখন তাড়াহুড়ায় আর হয়ে ওঠেনি। নাজিমুদ্দিন তার এসিস্ট্যান্টের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই, ছেলেটাকে সামনের মাসের এক তারিখ থেকে রাইটারের কাজ দিও।’

শেষ কথাটায় বাবুল হিংসায় জ্বলে ওঠে, এ দেখি শাপে বর হলো এই ছেলেটার। রাইটারের কাজ তো আরামের কাজ। রুমের ভেতর আরাম করে শুধু লেখালেখির কাম। ইশ, ও যে কেন লেখাপড়াটা শিখে নাই!

সেদিন কেসটেবিলের পুরো ঘটনাটা শুনতেই জমশের মিয়া খুশি খুশি গলায় বলে, ‘ভাইস্তা, বিশাল কাম হইছে। তোমার আর ক্ষেতে কোদাল নিয়া কষ্ট করতে হইব না। আর ওই ম্যাট বাবুল এখন তোমার উপর বেশি মাতবরি ফলাইতে পারব না।’

সূর্যের মুখে অবশ্য খুশির কোনো চিহ্ন দেখা যায় না, চিন্তিত গলায় বলে, ‘কিন্তু জাহাঙ্গীর ভাই যে সাতদিন সেলে থাকবে।’

জমশের মিয়া হেসে বলে, ‘শোনো, এমুন কেসে এত কম শাস্তি হয় না কখনোই, আর তুমিও মাফ পাইতা না। সুপার স্যার ঠিক বুঝছে এতে তোমাগো দোষ নাই, তাই এমন কম শাস্তি দিছে। আর জাহাঙ্গীরের এমন শাস্তি খাটার অভ্যাস আছে।’

সূর্য তাও স্বস্তি পায় না, ওই ম্যাট বাবুল যেমন হিংস্র, ঠিক অত্যাচার করবে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের উপর।

সাতদিন পর জাহাঙ্গীর যেদিন আবার ওয়ার্ডে ফিরে ওকে দেখে সূর্য চমকে ওঠে। এই ক’দিনেই অনেক শুকিয়ে গেছে। একটা চোখ একটু ফোলা, একটু খেয়াল করলে মুখে জখমের চিহ্নটা বোঝা যায়। সূর্য দৌড়ে এসে জাহাঙ্গীরকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে, শংকিত গলায় বলে, ‘ভাই, তুমি ঠিক আছ তো? ইশ, কী অবস্থা করেছে ওরা।’

জাহাঙ্গীর একটা প্রাণখোলা হাসি দেয়, ‘আরে কিছুই হয় নাই আমার, আপনি শুধু শুধু ভয় পাইছেন। আমি ঠিক আছি। ভাবছিলাম তো আরো কঠিন শাস্তি দিব। তা আপনি তো কয়দিন পরই রাইটারের কাজ করবেন, আমাদের কিন্তু মিষ্টি খাওয়াতে হবে।’

জমশের মিয়াও তাল মিলিয়ে বলে, ‘অবশ্যই খাওয়াইতে হইব।’

সূর্য এবার হাসে, আন্তরিক গলায় বলে, ‘আচ্ছা, কালকেই আমি ‘পিসি’ থেকে টাকা তুলব, তারপর মিষ্টি কিনে খাব আমরা।’

মা প্রতি মাসেই নিয়ম করে টাকা পাঠান যা কারাগারের পিসি বা প্রিজনার ক্যাশে জমা থাকে। সব বন্দীদের একটা করে পিসি থাকে। আত্মীয় স্বজনরা টাকা পাঠালে এখানে জমা থাকে। আবার সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া বন্দিরা কাজ করে যে টাকা পায় তাও জমা হয়। কারাগারের ভেতরে ক্যান্টিনে সব কিছুই কিনতে পাওয়া যায়, দাম একটু বেশি।

একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে সূর্যের, জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবতেই ইতস্তত গলায় বলে, ‘আচ্ছা জাহাঙ্গীর ভাই, একটা জিনিস জানার দারুণ কৌতুহল হচ্ছে। আপনি আমার দোষটা কেন নিজের ঘাড়ে নিলেন?’

জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর বিষন্ন গলায় বলে, ‘আমি আপনার কেসটার কথা জানি, নিজের মানুষরে বাঁচাইতা গিয়া আপনি খুন করছেন। তারে অসম্মান হইতে দেন নাই। আপনি আমার কাছে অনেক বড় মাপের মানুষ। আমি পারি নাই আমার বোনের সম্মান রক্ষা করতে। আমার বোনটারে ওরা অসম্মান কইরা মাইরা ফেলছে, আমি বাঁচাইতে পারি নাই।’

শেষ কথাগুলো বলতে বলতে জাহাঙ্গীর কেঁদে ফেলে, ভাঙা গলায় বলে, ‘আমার তো শাস্তির মেয়াদ অনেক বেশি। আপনার বয়স এখনো কম, আর শাস্তির মেয়াদও। এর মাঝে যদি এই মাদক কেসে পড়তেন তাইলে আপনার শাস্তির মেয়াদ আরো বাইড়া যাইত। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে, আপনি মনে হয় জানেন না। জেলে কেউ যদি ভালোভাবে থাকে তার শাস্তি চাইর ভাগের এক ভাগ মওকুফ কইরা দেয়। মনে করেন আপনার শাস্তি হইছে বিশ বছর, তাইলে আপনার পাঁচ বছর শাস্তি মওকুফ হইয়া যাইতে পারে। তাই ভাবলাম, আপনি যেনো এই প্যাঁচে না পড়েন। পাঁচটা বছর আগে জেল থেকে বাইর হইতে পারেন।’

সূর্য কথাগুলো শুনছিল, আর ভাবছিল পৃথিবীতে কত ধরনের মানুষই না আছে। আমাদের চারপাশে এমন সাধারণ চেহারার মানুষের মাঝেও যে অনেক বড় মনের মানুষ লুকিয়ে আছে তা হয়তো আমরা বুঝতেও পারি না। ওকে চেনে না জানে না এমন একটা মানুষ ওর জন্য দোষটা নিজের করে নিল আর সাতটা দিন শাস্তি পেয়ে আসল। অন্যায় অত্যাচার হাসিমুখে সহ্য করেছে। আচ্ছা, মানুষ এত মায়াময় হয় কেন!

২.
পারিজাত ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে মেইলগুলো চেক করছিল। কয়েকটা জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছে, কিন্তু সুখবরটা আসেনি। একটা চাকরি খুব দরকার। তা না হলে বাবা মা যেভাবে ওর পিছে লেগে আছে তাতে ওর দমবন্ধ হয়ে আসছে। সেদিন থানাতে যাবার ঘটনাটা বাবা জানার পর থেকে ওর উপর নজরদারিটা আরো বেড়েছে। বাবা সেদিন যেন ভীষণ আঘাত পেয়েছেন, স্তম্ভিত গলায় বলেছিলেন, ‘যে বিপদ থেকে তোকে বাঁচিয়ে আনলাম, তুই সেই বিপদে আবার সেধে পা দিচ্ছিস! ওই ছেলে জেলে, ও যদি ফিরেও আসে ততদিনে কম করে ১৫ টা বছর পার হয়ে যাবে। একটা খুনের আসামি তখন কী করবে? কোথাও চাকরি তো দূরের কথা কিছুই করতে পারবে না। সমাজে ওর পরিচয় একটা খুনী ছাড়া আর কিছুই না।’

পারিজাত মুখ নিচু করে বলেছিল, ‘আমার কাছে ও একজন মহান মানুষ, আমার সম্মান, আমার জীবন ও বাঁচিয়েছে। আমি ওকে ছাড়া আমার জীবনে আর কাউকেই ভাবতে পারি না।’

পারিজাতের বাবা আশরাফ সাহেব তিক্ত গলায় বলেছিলেন, ‘তুমি বাস্তবতাটা টের পাচ্ছ না। সূর্য যখন ফিরে আসবে, তখন তুমি জীবনের পথে অনেক দূর এগিয়ে থাকবে। ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলে হয়তো তুমি ততদিনে এসোসিয়েট প্রফেসর হয়ে যাবে। কিন্তু বিপরীতে সূর্য তখন পিছিয়ে পড়া একজন মানুষ, ও কখনোই তোমার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। একটা হীনমন্যতা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। এই গ্যাপটা কিছুতেই মিলিয়ে যাবার নয়। এখন যে আবেগ ধরে রেখেছ, সেই আবেগ কিন্তু তখন থাকবে না। কিংবা তুমি ভালোভাবে চাইলেও সূর্য হয়তো জীবনের এই পিছিয়ে পড়াটা মেনে নিতে পারবে না।’

সেদিন বাবার কথাগুলো শোনার পর পারিজাত অনেক ভেবেছে। কথাগুলো সত্য। সূর্যের আত্মসম্মানবোধ যেমন টনটনে তাতে নিশ্চিত ও কাছে আসবে না। এত বছর পর ফিরে পিছিয়ে পড়া জীবনের দৌড়ে ও নতুন করে মানিয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু সেটা পারিজাত হতে দেবে না। ও এমন একটা কিছু করে রাখবে যাতে সূর্য পিছিয়ে না যায়, মাঝপথ থেকেই যেনো দৌড়টা শুরু করতে পারে। আর সেটা করতে হলে পারিজাতকে সবার আগে চাকরিতে ঢুকতেই হবে, সূর্যের জন্য নতুন পথ তৈরি করতে হবে।

৩.
ক্লাশ টেনের ‘ক’ শাখার ছেলেরা মনোযোগ দিয়ে অংক ক্লাশে অংক করছে। মেহেরুন্নেসা আনমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবেন গত কয়েকটা মাস কী যুদ্ধটাই করতে হলো স্কুল কমিটির সাথে। কিন্তু মেহেরুন্নেসা এতটুকু ভেঙে পড়েনি। শেষ দিকে অনেক অভিভাবক, শিক্ষক ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। ছেলের জন্য মাকে চাকরি হারা হতে হবে কেন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। আসলে ওরা এই সুযোগে ওদের নিজের লোককে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মেহেরুন্নেসার দৃঢ়তায় সেটা আপাতত সম্ভব হয়নি। কিন্তু ওরা সুযোগ পেলেই আবার চেষ্টা করবে, সূর্যের জেলে যাবার ব্যাপারটা ঠিক কাজে লাগাবে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা ছাত্রের দিকে চোখ পড়ে। ছেলেটা উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। মেহেরুন্নেসা চেয়ার থেকে ওঠে ধীরে ধীরে ওর সামনে এসে দাঁড়াতেই ছেলেটা থতমত খেয়ে ওর দিকে তাকায়। মেহেরুন্নেসা ছেলেটার খাতার দিকে তাকাতেই দেখে কয়েক লাইনের একটা কবিতা লেখা। কিছু বলতে যেয়েও চুপ করে যান, হঠাৎ করেই সূর্যের কথা মনে পড়ে যায়। সূর্যও কবিতা লিখতে ভালোবাসত। সাথে অনেক অনেক গল্পও লিখত। লেখালেখি ছিল ওর নেশার মতো। দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোতে মাঝে মাঝে ওর লেখা ছাপা হতো। আচ্ছা, কারাগারের বন্দী জীবনে ও লেখালেখি ছাড়া বেঁচে আছে কী করে? একটা মেয়েকে ভালোবাসত, সেও নেই এখন। তাহলে আমার সূর্যের দিন কাটে কেমন করে?

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২১/০২/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here