সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৩)

#গল্প১৩৮

#সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৩)

১.
শীতের দুপুরটা খুব সুন্দর। গোসল করে রোদে পা পেতে বসলে আরাম লাগে। পারিজাত জানালার পাশে বালিশটা পিঠে রেখে হেলান দিয়ে বসেছিল। হাতে একটা ডায়েরি ভাঁজ করে বুকের কাছে ধরা। সূর্যের সাথে পরিচয়ের প্রথম থেকে অনেক কিছুই ও লিখে রাখত। আজ একটা মাস হয়ে গেছে সূর্যের সাজা শুরু হয়েছে। এই ক’টা দিন একটা মুহূর্ত ওকে ভুলতে পারেনি। বার বার ডায়েরিটা খুলে ও পড়ছিল, বিশেষ করে প্রথম দিককার কথাগুলো। ডায়েরিটা পড়তেই মনে পড়ে গেল সেই প্রথম দিনের কথা। পারিজাত ফুল নিয়ে তর্ক হচ্ছিল। কী বিচ্ছু ছেলে, প্রথম দিনই কৌশলে বলে দিল যে সূর্যকে পারিজাত ফুল ভালোবেসেছিল। না পেয়ে সে আত্মহত্যা করে। আর তার ভস্ম থেকেই সৃষ্টি হয় পারিজাত ফুল যা রাতে ফোটে আর সকালে সূর্যের স্পর্শে ঝরে যায়। সূর্যের বলা এই গল্পটা মনে হতেই পারিজাতের বুকটা ভেঙে আসে। আসলেই তো ও সূর্যকে পেল না, ভাগ্য ওর সাথে মুচকি হেসে গতিপথ পালটে দিল। সূর্যকে না পেলে পারিজাত বাঁচে কী করে!?

বাবা মা ধীরে ধীরে ওর বিয়ের কথা তুলছেন। ও শুধু বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে, কেমন করে ওনারা সূর্যকে ভুলে যেতে বলেন। ওকে বাঁচাতে গিয়ে যে ছেলেটা আজ খুনের আসামি তাকে ভুলে যেতে বলছে!! ভাবনাটা আর ভাবতেই পারে না পারিজাত। বাইরে তাকাতেই দেখে আকাশটা মেঘলা হয়ে আসছে, একটু আগের রোদ্রটা আর নেই। হঠাৎ করেই একটা পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সেদিনও আকাশটা মেঘলা, একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। মন উদাস করে ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, ঠিক তখন সূর্যের ফোন এসেছিল, ‘একটু ব্যালকনিতে আসা যাবে?’

পারিজাত অবাক হয়ে নিচের রাস্তায় তাকিয়ে দেখে সূর্য দাঁড়িয়ে আছে। একবার ও শুধু মা কোথায় আছে দেখে নেয়, তারপর চুলটা একটু ঠিক করে ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই সূর্য এক গাল হেসে হাত নাড়ে। পারিজাত ইশারায় জিজ্ঞেস করে, এই অসময়ে কী চায়। সূর্য আবার ফোন করে, নরম গলায় বলে, ‘ভাবলাম, আকাশের সূর্য মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে, আমার পারিজাতের যাতে মন খারাপ না হয় তাই চলে আসলাম দেখা দিতে। সূর্যকে না দেখলে পারিজাতের মন কী ভালো থাকে?’

একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ছুঁয়ে গিয়েছিল, অনেক মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রিয় মানুষটার দিকে..

..কথাগুলো মনে হতেই চোখটা ভিজে ওঠে পারিজাতের। দু হাঁটুতে মুখ গুজে মনে মনে হাহাকার করে বলে, সূর্য, তোমাকে ছাড়া তোমার পারিজাত যে সত্যিই বাঁচবে না।

হঠাৎ কাঁধে একটা আলতো স্পর্শ পেতেই পারিজাত মুখ তুলে তাকায়, ভেজা চোখটা মুছে নেয়। নিলুফার বেগম মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘কেন মিছেমিছি কষ্ট পাচ্ছিস। কেসটা তো মিটেই গেছে, তুই তো নির্দোষ। ওই ছেলটার কথা ভুলে যা, তোর জীবনে ওর আর কোনো স্থানই নেই। বিসিএস পরীক্ষাটা ভালো করে দে।’

পারিজাত ব্যথিত চোখে তাকিয়ে বলে, ‘সূর্যকে আমি ভুলে যাব? আমি যাকে ভালোবাসতাম, যে আমাকে বাঁচাতেই খুনে জড়িয়ে পড়ল তাকে ভুলে যাব? আচ্ছা মা, ওইদিন যদি বখাটেরা তোমার মেয়েকে রেপ করত আর সূর্য আমাকে ফেলে পালিয়ে যেত সেটা খুব ভালো হতো তাই না?’

নিলুফার মুখ গম্ভীর করে বলেন, ‘সেটা হয় নাই, আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। কিন্তু সূর্য তো আর ফিরে আসতে পারবে না, বিশ বছর ওই জেলেই পচে মরতে হবে। তার সাথে তোর ভাগ্য তো আর জড়িয়ে নেই। তুই কেন শুধু শুধু তা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাচ্ছিস? তোর বাবা তোর বিয়ের জন্য ছেলে দেখছে, সেটা মাথায় রাখিস। আমি বুঝি তোর কষ্টটা, কিন্তু বাস্তবতা তোকে মেনে নিতেই হবে। যে সূর্য আঁধারে ডুবে গেছে তার জন্য অপেক্ষা করার কোনো মানেই নেই।’

পারিজাত হতভম্ব হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, মা কেমন নিষ্ঠুরের মতো কথাগুলো বলল। মুখটা কঠিন করে বলে, ‘মা, সূর্য আঁধারেই ডুবে যায়, কিন্তু আবার নতুন প্রত্যয় নিয়ে রাত শেষে ঠিক আলো ছড়ায়। আমি ভোর হবার জন্য অপেক্ষা করব, আমার সূর্য ঠিক সব আঁধার কাটিয়ে আলো জ্বালবেই।’

নিলুফার হতাশ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন, ভেবেছিলেন ক’টা মাস পেরোলে মেয়ের মনটা ঠিক হবে। কিন্তু ওর কথা শুনে তা মনে হচ্ছে না, ব্যাপারটা নিয়ে ওর বাবার সাথে কথা বলতে হবে।

মা বেরিয়ে যেতেই পারিজাত চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। মায়ের একটা কথা ও মানবে, সেটা হলো ওকে এবার চাকরিতে ঢুকতে হবে। ইচ্ছে আছে কোনো ভার্সিটিতে পড়ানোর। শিক্ষকতাটা ও ভালোবাসে, সূর্যও ভালোবাসত। আরো একটা জিনিস ভালোবাসত, ইচ্ছে ছিল একটু টাকা জমিয়ে সেই স্বপ্নটা পূরণ করবে। কিন্তু মানুষটাই যে পাশে নেই। মনটা আবার খারাপ হয়ে যায় পারিজাতের।

২.
মেহেরুন্নেসা আজ পুরো বাসাটা একটু গোছাচ্ছিলেন। এই ক’টা মাস শুধু কোর্ট আর বাসায় দৌড়াদৌড়ি। পুরো ঘরটা অগোছালো হয়ে পড়ে ছিল। জীবন বড় কঠিন, মানুষকে সব শোক ভুলে ঠিক খেতে হয়, ঘুমোতে হয়। একটা একটা করে দিন ঠিক পার হয়ে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে দেয়ালে বাঁধাই করা সূর্যের ছবিটা নামিয়ে পরম মমতায় কাচটা পরিস্কার করেন। কী দৃপ্ত মুখভঙ্গি, কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেনি। ছবিটা পরিস্কার করতে করতে হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, আচ্ছা, উনি এই স্কুলের চাকরিটা কেন ছাড়বেন? তাতে কী সূর্যকে সত্যিকারের দোষী সাব্যস্ত করে ফেলা হয় না? তার ছেলে তো একটা মেয়ের জীবন বাঁচাতে গিয়ে একটা পশুকেই না হয় মেরে ফেলেছে। তাতে সমাজের একটা জঞ্জাল তো কমেছে। সমাজ কী অন্যায়ের পক্ষে, না লোক দেখানো ন্যায়ের পক্ষে? আর উনি কিনা ওদের মতাদর্শে হাততালি দিয়ে গা ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন, চাকরিটা ছেড়ে দেবার কথাও বলে এসেছেন!

ধীরে ধীরে মেহেরুন্নেসার মুখটা কঠিন হয়ে যায়, নাহ, উনি স্কুলের চাকরিটা ছাড়বেন না। প্রয়োজনে সাংবাদিক ডেকে সংবাদ সম্মেলন করবেন। এত বছর ধরে এই স্কুলে পড়িয়েছেন, কত ছাত্র মানুষ হয়েছে ওনার হাতে, একবার জানলে তারাও নিশ্চয়ই পাশে এসে দাঁড়াবে। আর কেউ যদি নাও আসে তাও উনি একাই লড়বেন, কিন্তু চাকরিটা ছাড়বেন না। সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে একটা স্বস্তিবোধ করেন মেহেরুন্নেসা।

সূর্যের ছবিটা দেয়ালে আবার ঝুলিয়ে দেন। কতদিন ছেলেটাকে দেখেন না! এ সপ্তাহেই ছেলেটার সাথে দেখা হবার কথা আছে। সহ্য করতে পারবেন তো সূর্যকে এমন বন্দী অবস্থায় দেখে? ছেলেটা নিশ্চয়ই শুকিয়ে গেছে।

৩.
সূর্য দুপুরে খাবারের পর একটু বসে বিশ্রাম করছিল। ঠিক এসময় একজন এসে খবর দিল ওর সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে। সূর্যর নিশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসে, মা নিশ্চয়ই! কিন্তু মায়ের সামনে দাঁড়াবে কী করে? ইশ মুখভর্তি দাড়ি, মা দেখে ঘাবড়ে না যায়।

সূর্য দূর্বল পায়ে ভিজিটর্স রুমের দিকে এগিয়ে যায়। একপাশে বন্দীরা, অন্যপাশে সাক্ষাতকারীরা। মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা, সবাই যে যার মতো চিৎকার করে কথা বলছে। সূর্য কোনোমতে সামনে এসে দাঁড়ায়, আকুল হয়ে পরিচিত মুখটা খুঁজতেই মেহেরুন্নেসার মুখের উপর চোখ স্থির হয়ে যায়। ‘মা’ বলে চিৎকার করতে গিয়ে সূর্য খেয়াল করে কান্নায় গলা বুজে আসছে, জোরে শব্দ বের হচ্ছে না।

মেহেরুন্নেসা ঠোঁটটা জোরে কামড়ে চোখের জল আটকান, ইশ, সোনার ছেলেটা এমন হয়ে গেছে? গাল দুটো ভেঙে গেছে, মুখ ভর্তি কেমন দাড়ি। গায়ের রঙটাও পুড়ে কেমন কালো হয়ে গেছে। শরীরটা কেমন শুকিয়ে গেছে। আহারে মানিক, অনেক কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই! মেহেরুন্নেসা কান্নার দমকে কথা বলতে পারেন না, নির্নিমেষে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে।

সূর্য চিৎকার করে বলে, ‘মা, একা একা তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে বুঝি?’

মেহেরুন্নেসা মাথা নেড়ে গলা উঁচু করে বলেন, ‘আমার কষ্ট নেই। তুই এমন শুকিয়ে গেছিস কেন। আমি তোর জেল একাউন্টে টাকা দিয়ে গেছি। ভালোমন্দ কিনে খাবি।’

একটু পরেই সাক্ষাতের সময়টা শেষ হয়ে যায়। সূর্য একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে তারপর বাইরে বের হয়ে আসে। মেহেরুন্নেসা আকুল হয়ে ছেলের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকেন, বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। এত কাছে পেয়েও ছেলেটাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে পারলেন না, মা হয়ে এই কষ্ট সইবেন কী করে।

সূর্য মন খারাপ নিয়ে ওর কাজের জায়গা সেই বাগানটার দিকে এগোয়। মায়ের কী দুশ্চিন্তা ওকে নিয়ে এখনো! ওর তো শাস্তি হয়েই গেছে। মায়ের মুখটা এই ক’দিনেই কেমন শুকিয়ে গেছে, বয়সটা যেন বেড়ে গেছে। সূর্যের হঠাৎ ভয় লাগে, মা যদি ওর চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ে? ভাবনাটা ভাবতেই ওর মনটা দূর্বল হয়ে যায়। না, কোনোভাবেই এটা হবে না।

সূর্য আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সেই পারিজাত গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। এই পৃথিবীতে ওর দুইজন প্রিয় মানুষ। মায়ের মুখটা দেখতে পেয়ে আরো একটা মুখ দেখার তৃষ্ণাটা টের পায় বুকের ভেতর। কতদিন পারিজাতকে দেখে না ও। একটা সময় প্রতিদিন না দেখলে মনটা অস্থির হয়ে থাকত। আর আজ! আচ্ছা, প্রিয় মানুষের মুখে কী থাকে আসলে? দেখলেই মন শান্ত হয়ে যায় কেন? প্রিয় মানুষের মুখে ভালো লাগার সব উপাদান বুঝি থাকে? একটা ছোট্ট নিশ্বাস নিয়ে ভাবে পারিজাত কী কখনো আসবে ওকে দেখতে!

৪.
পারিজাত ক’দিন ধরেই ভাবছিল সূর্যের সাথে দেখা করতে যাবে। কিন্তু একটাই সমস্যা, সূর্য এখন কোন জেলে আছে এটা ওর জানা নেই। মাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও জানতে পারেনি। বাবা নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু বাবা তো ওকে কোনোদিনই বলবে না যে ওর সূর্য কোথায় আছে। এদিকে সেই ঘটনার পর থেকে একটা বছর ও বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, ফেসবুকটাই আনস্টল করে রেখেছে। এখানে যন্ত্রণা আরো বেশি, সবাই সহানুভূতির ছলে কষ্টটা আরো বাড়িয়ে দিয়ে যায়। আত্মীয় স্বজনরা তো আরো এক কাঠি উপরে। অনেকে তো এটাও সন্দেহ করে ওই ছেলেগুলো ওকে রেপ করেছে, কিন্তু পারিজাত তা লুকিয়েছে। কী যে লজ্জা, নিজেকে গর্তে লুকিয়ে রাখে ও সবসময়। পরিচিত মানুষ এখন ওর কাছে ভীষণই সংকোচের। তাই সবাইকে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলে। কিন্তু সূর্যের খোঁজ ও পায় কোথায়?

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা বুদ্ধি ওর মাথায় আসে। আচ্ছা, যে থানাতে খুনের মামলাটা হয়েছিল সেখানে তো খোঁজ নিলে একটা তথ্য জানা যাবে। কথাটা মনে হতেই একটা আনন্দ ছুঁয়ে যায়, সূর্যকে খুঁজে বের করতেই হবে।

পরদিন মাকে ইউনিভার্সিটির কথা বলে পারিজাত বের হয়। বহুদিন পর বাসা থেকে বের হলো। সেই দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনাটা ঘটার পর থেকে একা বের হতেই দিত না ওকে। ওর নিজেরও ভয় করত ভীষণ। সেই দিনের ঘটনাটা মনে করলে ভয়ে এখনো গা শিউরে ওঠে, একটা আফসোসে মন ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে। ও যদি ওইদিন সূর্যকে জোর করে দিয়াবাড়ির ওই দিকটায় কাশফুলের সাথে ছবি তুলতে না যেত! কী সুন্দর নীল একটা শাড়ি পরেছিল ও! সূর্য বার বার ওকে নীল প্রজাপতি বলছিল আর মুগ্ধ চোখে দেখছিল। হঠাৎ করেই কিছু বখাটে ছেলে কোথা থেকে যে উদয় হলো। ওদের চোখে একটা লোভাতুর দৃষ্টি ছিল, এত বিশ্রী করে ওকে দেখছিল। সূর্য রুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ওরা দলে চারজন ছিল। একজন পারিজাতকে টেনে কাশফুলের ঝোপে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। ভীষণ ভয়ে ও বার বার সূর্যের নাম ধরে ডাকছিল। সূর্য অসহায়ের মতো বার বার মার খেয়ে ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। শেষ দিকে হঠাৎ একটা পড়ে থাকা লাঠি পেয়ে সূর্য ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এলোপাতাড়ি লাঠির আঘাতে হঠাৎ একটা ছেলের মাথায় জোর আঘাত লাগে। তীব্র চিৎকার করে ছেলেটা পড়ে যেতেই দলের অন্যান্যরা সূর্যকে ছেড়ে দেয়।।পারিজাতকেও ছেড়ে ওই ছেলেটা দৌড়ে আসে।

ততক্ষণে সূর্য লাঠি হাতে এক রুদ্র মূর্তি, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। পারিজাত কোনোমতে ওর কাছে আসতেই সূর্য ওকে একহাতে শক্ত করে ধরে। তারপর লাঠিটা বাগিয়ে ধরে আস্তে আস্তে পিছু হটে। ততক্ষণে কিছু লোক এদিকেই আসছে। ওরা দু’জন আর কোনোদিকে না তাকিয়ে মূল রাস্তায় ওঠে একটা রিক্সা নিয়ে পালিয়ে চলে আসে। সেদিন পারিজাত পুরোটা রাস্তা সব সংকোচ ভুলে সূর্যকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল। আর সূর্য শক্ত হাতে পারিজাতের বাহু ধরে পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিল। পারিজাত ফিসফিস করে বলেছিল, ওই বখাটে ছেলেটা কী মরে গেছে?

সূর্য অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছিল। একটা ভয় পারিজাতকে ঘিরে ধরে, ছেলেটা যদি মারা যায়! বুকের ভেতরটা কে যেনো খামচে ধরে, ওর সূর্য সাথে ও নিজেও যে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাবে। কথাটা ভাবতেই পারিজাতের হাত পা দূর্বল হয়ে আসে। সেদিন ও সূর্যকে আর কিছু বলেনি। কিন্তু পরদিন খবরটা যখন খবরের কাগজে আসে তখন টেনশনটা আর ধরে রাখতে পারেনি। সাথে সাথে সূর্যের হলে ছুটে গেছিল। সূর্য ওকে দেখেই বলেছিল, ‘পারিজাত, তুমি কেন এসেছ আমি জানি। হ্যাঁ, ওই বখাটে ছেলেটা খুন হয়েছে। তুমি একদম চিন্তা করো না, তোমার নাম কিছুতেই আসবে না। খুনটা তো করেছি আমি।’

পারিজাত হাহাকার গলায় বলে, ‘চুপ, একদম চুপ। খবরদার এই কথা মাথায়ও আনবে না। একদম ভুলে যাও, আমরা যে ওখানে গিয়েছিলাম তা তো কেউ জানে না। আর ওই বখাটেগুলো তো আমাদের চেনেও না। পুলিশ কিছুতেই আমাদের খুঁজে বের করতে পারবে না।’

সূর্য একটা মলিন হাসি হেসে বলে, ‘পারিজাত ওরা এতক্ষণে আমার খোঁজ পেয়ে গেছে। যেকোনো মুহুর্তে পুলিশ এসে পড়বে এখানে। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাও প্লিজ।’

পারিজাত ভাঙা গলায় বলে, ‘এসব কী বলছ সূর্য, পুলিশ এত দ্রুত জানল কী করে সব?’

সূর্য ম্লান হেসে বলে, ‘কোনো অপরাধই চাপা থাকে না। আমার আইডি কার্ড পাচ্ছি না। আমি শিউর, কাল ধস্তাধস্তির সময় ওটা ওখানেই পড়ে গেছে। আমি মানসিকভাবে তৈরি। কিন্তু চিন্তা একটাই, মা কী করে বাঁচবেন। মায়ের যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই।’

পারিজাতের হঠাৎ করেই মনে হয় ওর আকাশটা আজ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যাতেই সূর্য গ্রেফতার হয়। পারিজাতকেও পুলিশ ধরত, কিন্তু ওর বাবা আশরাফ চৌধুরী নিজেই পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাই অযথা ওকে আর হয়রানি করেনি। যদিও কেস হয়েছিল, কিন্তু সূর্যের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির জন্যই মূলত ও এই কেস থেকে বেঁচে যায়।

ইশ, জীবনের বাঁকে এমন দুঃস্বপ্ন ঘাপটি মেরে ছিল ঘুণাক্ষরেও ও বুঝতে পারেনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভারকে গাড়িটা থামাতে বলে। এই থানাতেই মামলা হয়েছিল, ওকে অনেকবারই আসতে হয়েছে। বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল ওরা। আজ এতদিন পর আবার এখানে আসা, একটা বিতৃষ্ণার স্মৃতি। একটা সংকোচ নিয়ে ও থানায় ঢোকে।

ডিউটি অফিসার হাফিজ ওকে দেখেই চিনতে পারে, সালাম দিয়ে বসায়। একজন কন্সটেবলকে চা দিতে বলে তেলতেলে একটা হাসি দিয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, আপনি হঠাৎ থানায়। সেই কেসের তো রায় হয়ে গেছে।’

পারিজাত ঠোঁট কামড়ে ইতস্তত করে বলে, ‘হুম, তা হয়েছে। আমি আসলে একটা তথ্য জানতে এসেছিলাম আপনার কাছে। আপনি কী বলতে পারেন এই কেসের আসামি আয়ুস্মান আহসান সূর্য কোন জেলে আছেন।’

পুলিশ অফিসার হাফিজ সতর্ক হয়, ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘সেটা জেনে আপনি কী করবেন?’

পারিজাত গম্ভীরমুখে বলেন, ‘আমি একটু ওনার সাথে দেখা করব।’

হাফিজ মাথা নেড়ে বলেন, ‘ম্যাডাম, আমি আপনাদের ব্যাপারটা জানি। আপনি ওনাকে ভুলে যান, নতুন করে জীবন সাজান।’

পারিজাতের রাগ হয় ভীষণ, উষ্ণ গলায় বলে, ‘আমি কী করব সেটা আপনাকে না ভাবলেও চলবে। আপনি শুধু আমাকে এটুকু বলেন যে সূর্য কোন জেলে আছে।’

হাফিজ রাগ করে না, শান্ত গলায় বলে, ‘ম্যাডাম আপনি এখানে আসবেন সেটা আমাদের স্যার মানে আপনার বাবা অনুমান করেছিলেন। আমাদের আগেই সতর্ক করা আছে এই ব্যাপারে। তাই এটা আমরা বলতে পারি না।’

পারিজাত স্তম্ভিত হয়ে যায়, বাবা এখানেও না করে রেখেছেন! এরা তো ওকে কিছুতেই সূর্যের কথা বলবে না। একটা অক্ষম রাগ ওকে ঘিরে ধরে। এক মুহুর্ত আর দাঁড়ায় না ও থানায়। ফিরতে ফিরতে ভাবতে থাকে, ওর সূর্যকে কেউ ওর কাছ থেকে দূরে রাখতে পারবে না। ও ঠিক সূর্যের কাছে পৌঁছে যাবে, পারিজাত যে সূর্যের জন্যই ফোটে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১৬/০২/২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here