সুখের_অ-সুখ,পর্বঃ দুই,তিন

#সুখের_অ-সুখ,পর্বঃ দুই,তিন
#মম_সাহা
পর্বঃ দুই

সুখের বাবার লাশটা বাড়ি থেকে বের না হতেই ভেসে এলো চাঞ্চল্যকর খবর,তার বোন লীলাবতী সদ্য ইন্টারে পা দেওয়া মেয়েটা প্রেগন্যান্ট আর তার সমস্ত কতৃত্ব সুখোবতীর স্বপ্ন দেখানো মানুষ মসৃনের। এজেনো মরারে আবার মাইরা গেলো।

পুরো বাড়ি যখন বিষন্নতায় ছেয়ে রইল,তখনই এই খবরটা নতুন করে উদয় হলো। বাড়ির বাহিরে খালি জায়গায় আজাদ শেখের মৃত শরীর টা রাখা হয়েছিলো আত্মীয় স্বজন সব সেখানেই ছিলো।সুখ নিজের ছোট বোনটাকে আশেপাশে না দেখে অবাক হয়,ভেবেছিলো ছোট মানুষ হয়তো পুরোটা ব্যাপার মানতে পারে নি।বাবা দুই বোনকে বেশ আদর করতো কিন্তু ছোট বোন সুখকে পছন্দ করতো না যতই হোক সৎ নামক তকমাটা তো তার শরীরে আর সম্পর্কের মাঝে লেপ্টে ছিলো।সুখ তখন উৎসুক হয়ে বাড়ির ভিতরে যায় বোনের খোঁজে।

সুখ যখন লীলাবতীর রুমের সামনে যায় লীলাবতীর খোঁজে তখন লীলাবতীর রুমের ভিতর থেকে কেমন একটা গোঙানির শব্দ ভেসে এসেছিলো সুখ ভ্রু কুঁচকে ফেলে আপনা-আপনি দরজাটা হালকা খোলা ছিলো বিধায় সুখ দরজা টা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। দরজা খোলার পরের দৃশ্য টুকু দেখে সুখ জেনো বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। লীলাবতীর শরীরটা ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে আর ছটফট করছে।সুখ দ্রুত এগিয়ে যায় আর বোনের পায়ের নিচে পড়ে থাকা চেয়ারটা আবার সোজা করে রাখে।গলা থেকে দড়িটা খুলে দেয়।

লীলাবতী জেনো মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছে।নাকে মুখে ভীষণ কাশি আরম্ভ হয়। সুখ দ্রুত গিয়ে পানির গ্লাস টা এনে বোনের হাতে দেয়।লীলা পানিটুকু দ্রুত গতিতে পান করে।পানিটুকু খাওয়া শেষ হতেই লীলা মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে কেঁদে দেয়।সুখ অবাক হয়,ভীষণ অবাক।কারণ লীলা কাঁদার মতন মেয়ে না।যদিও বাবার মৃত্যুর জন্য কান্না করছে ধরে নেয় কিন্তু যা করতে নিছিলো মাত্র সে কাজটার মানে কী? সুখ বোনের হাত সরিয়ে দেয় মুখের সামনে থেকে।ছোট্ট থেকে অপছন্দ করা সুখকে হঠাৎ করেই লীলা জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। সুখ জেনো একের পর এক চমক পাচ্ছে।বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে বলে
-‘তুই কী করতে যাচ্ছিলি লীলা?বাবার মৃতদেহ এখনো বাড়ির চার দেয়ালের ভিতর আছে, যার শোকে বিধ্বস্ত পরিবারের প্রত্যেক টা মানুষ আর তুই কি না আরেকটা শোকে ডুবাতে চেয়েছিলি আমাদের? তোর কী এমন সমস্যা হয়েছে যে এসব করতে চেয়েছিলি? আমাকে বল।’

লীলার জেনো বলার মুখ নেই।এই লজ্জার কথা সে কাকে জানাবে? বয়ঃসন্ধির অনুপ্রেরণায় যে পাপ সে করেছে সেই পাপের কথা সে কাকে জানাবে? আদৌ তার বেঁচে থাকাটা যুক্তিযুক্ত তো? বড় বোনের কপাল পুড়াবে বলে বাহিরের ছেলেটাকে বিশ্বাস করেছে,শুধু বিশ্বাস না অন্ধবিশ্বাস করেছিলো যার কারণে নিজের সবটুকু সমর্পণ করেছিলো সেই মানুষটার হাতে আর আজ সেই মানুষ তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে চলে গেছে।সে টেরও পায় নি ঘর শত্রু বিভীষণ ছিলো সেই মানুষ।

লীলাকে চুপ থাকতে দেখে সুখ আবারও প্রশ্ন করলো
-‘লীলা বল কী হয়েছে? তুই এটা কেনো করতে নিয়েছিলি? পাগল হয়েছিস?’

লীলা বোনকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল
-‘আপা রে আমার সব শেষ।সর্বনাশ করে ফেলেছি আমি,বড় সর্বনাশ।নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছি।মসৃন নামের মানুষটাকে বিশ্বাস করেছিলাম।’

হঠাৎ মসৃন নামটা শুনে চমকে যায় সুখ।মনে মনে একটু হোঁচটও খায়।সে ভুল শুনলো না তো?মনের মাঝে উদয় হয় একটা খুব নিম্নমানের ভাবনা পরক্ষণেই আবার নিজেই নিজেকে সামলে নিয়ে ধিক্কার জানায় নিজের মনকে।ব্যাপারটা পরিষ্কার করে জানার জন্য প্রশ্ন করে নিজের বোনকে।করুন স্বরে জিজ্ঞেস করে
-‘লীলা? কী বলছিস খুলে বল।তুই মসৃনকে পছন্দ করিস? নাকি অন্য কিছু?’

লীলা কান্না করতে করতে মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘শুধু পছন্দ করি না আমার ধ্যান জ্ঞান সবটাই তার নামে সমর্পণ করেছিলাম আপা।আর,আর তারই একটা ছোট্ট অংশ ধারণ করেছি নিজের শরীরে।’

সুখ জেনো আকাশ থেকে পড়লো।এটাও শোনার ছিলো শেষমেশ? তারই বোনের এতবড় ক্ষতি করেছে মসৃন?সুখ যে মানুষটাকে বাবার পর আসন দিয়েছিলো সে মানুষটাই সুখের জীবনের সব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ালো?

সুখকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে লীলা শব্দ করে কেঁদে উঠলো।অপরাধী কন্ঠে বলল
-‘আপা আমি মসৃন ভাইকে ভালোবাসি।সেও বলেছিলো সে আমাকে ভালোবাসে তাই তো আমি তার উপর ভরসা করেছিলাম কিন্তু সে আমাকে ধোঁকা দিবে ভাবি নি।সে বলেছিলো সে তোমার উপর কি জেনো একটা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিয়ের নাটক করছে কিন্তু সে বিয়ে আমাকেই করবে আর আমিও তোমাকে অপছন্দ করতাম বিধায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম তার কথায় কিন্তু,,,,’

সুখ নিজের কান চেপে ধরলো।মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘না,আর বলিস না কিছু লীলা আমার যে আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই।তুই কী করলি এটা? এখন কীভাবে বাঁচাবো তোকে আমি?’

লীলা অবাক হয়,অতি অবাক কারণ সে ভেবেছিলো এসব জানার পর সুখ হয়তো সবার আগে তার গালে চড় বসাবে কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে সুখ তাকেই বাঁচানোর চিন্তা করছে? এতটা ভালো মানুষ হয়?লীলার আফসোস আকাশ ছুঁয়েছে। আপুরে পুরো বিয়ে বাড়িতে রিফিউজ করে যখন তাকে বিয়ে করবে মসৃন সেই কল্পনা চোখে ভাসিয়ে সে নিজেকে মসৃনের হাতে দিয়েছিলো।এজন্যেই মানুষ বলে পাপ বাপকেও ছাড়ে না।পরের জন্য গর্ত করছে সে গর্তে নিজেই পরেছে।

লীলার মনে পড়লো মাস খানেক আগের কথা।এক আত্মীয় লীলার চুলকে অসুন্দর বলে সুখের চুলের প্রশংসা করেছিলো।লীলার চুলও তেমন সুন্দর না কিন্তু সুখের চুল কোমড় অব্দি ঘন কালো, প্রশংসাযোগ্য। লীলা তখন তা সহ্য করতে না পেরে নিজের মাকে দিয়ে সুখের এত বড় বড় চুল গুলো কাটিয়ে একদম ছোট করে দিয়েছিলো।এ লজ্জা ঢাকবে কোথায় সে?

সুখ কতক্ষণ চুপ করে কিছু ভাবলো তারপর লীলার গালটা দু’হাতে আগলে নিয়ে বলল
-‘তুই চিন্তা করিস না লীলাবতী এ কথা কেউ জানবে না।বাড়ি ভর্তি মানুষে গিজ গিজ করছে।এ কথা জেনো কারো কানে না যায়। আমরা যেভাবেই হোক মসৃনের আসল ঠিকানা খুঁজে বের করবো, তোর জীবনটা আধাঁরে হারিয়ে যেতে দিবো না আমি।’

লীলাবতী ছুটে বের হয়ে গেলো রুম থেকে, হয়তো চক্ষুলজ্জায়।সুখ জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।দু’তালার পুরোনো বাড়ি তবে বেশ রাজকীয় একটা ছাপ আছে।দু’তালার জানালা থেকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বাবার লাশটা খুব পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে।বাবার লাশের বিপরীত দিকটায় চাচারা ফুপিরা কিছু নিয়ে কথা বলছে।কথা বলছে বললে ভুল হবে,বেশ তর্কাতর্কি হচ্ছে বলা যায়। আর তর্কাতর্কি টা কি নিয়ে সেটাও জানা আছে সুখের।এ বাড়ির সম্পত্তি এতদিন বাবার কারণেই ভাগ হয় নি,হাড়ি আলাদা হয় নি।আজ বাবার লাশটা বিদায় হওয়ার আগে আলাদা হয়ে যাবে বাবার শখের পরিবার।শখের এই রাজকীয় মহল।এত এত সম্পত্তি তো মানুষটা নিয়ে যেতে পারলো না কিন্তু একদিন এই মানুষটাই নাকি সামান্য টাকার জন্য একটা মেয়েকে বিয়ের আসরে রেখে বিয়ে ভেঙে চলে এসেছিলো,ভাবা যায়?সুখও ভাবতে পারি নি বাবার অতীতের এহেন নিষ্ঠুর আচরণ।বাবাটা যে বড্ড ভালো ছিলো।তার এই জীবনটাতে বাবা আর দাদীই একমাত্র তার পক্ষে কথা বলতো।স্নেহের হাতে তাকে বুকে টেনে নিতো।আজ বাবা নেই বলে একটা সাজানো পরিবারও থাকবে না একসাথে।কী নির্মম পরিহাস!একটা মানুষ ঘুমিয়ে আছে চিরদিনের মতো,সেই ঘুম আর ভাঙবে না কভু।এ দুনিয়ায় এতবছর কাটিয়ে যাওয়া মানুষটার প্রতি উপস্থিত কারো মায়া নেই বরং তার রেখে যাওয়া জিনিসের প্রতি লোভ।ঐ তো সৎমাও চাচাদের সাথে কোমড়ে আঁচল গুঁজে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত।তার স্বামী মৃত সেই শোক পালনের সময় তার নেই এর চেয়ে বড় জিনিস সম্পদ সেটা গুটিয়ে নিজের করে নেওয়ায় সে ব্যস্ত।মৃত মানুষ তো একটু পর চলে যাবে কবরের ভিতরে, মাটির নিচে, তারা তো মাটির উপর থাকবে তাই ভিত্তি টা শক্ত করার এত তাড়া।সুখ দু ফোঁটা চোখের জল ফেলল এই নিবিড় স্বার্থপরতা দেখে।কার জন্য বাবা টা সারাজীবন কষ্ট করে গেলো? এইসবের জন্য? সুখের ভিতর থেকে উগড়ে বেড়িয়ে আসলো আর্তনাদ। যে আর্তনাদ পৃথিবীতে থাকা মানুষদের তাচ্ছিল্য করে বলছে
~”মায়া এখন কমদামী,
মানুষের চেয়ে সম্পদ দামী”

__________

পুরো বাড়িময় আবারও একটা গুঞ্জন রটে গেলো।ভীষণ ঝড় গেলো সুখের উপর।কলঙ্কীনি তকমা লাগলো তার শরীরে।সবার মুখে মুখে একটাই বুলি “মেয়েটা মায়ের মতনই চরিত্রহীনা”। আর এ বুলির কারণ হলো সুখ নাকি অন্তঃসত্ত্বা।

ভীষণ মার খেয়ে সুখ যখন বিছানার এক কোণে পড়ে রইল তখন টেবিলের কোণে থাকা তার ফোনটা বেজে উঠলো।ব্যাথায় রক্তাক্ত হওয়া শরীরটা নিয়ে খুব কষ্টে উঠে দাঁড়ালো ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো অপরিচিত নাম্বার। খুব কষ্ট করে রিসিভ হতেই অপরপাশ থেকে কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া আসলো না।সুখ কতক্ষণ হ্যালো হ্যালো করতেই অপরপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেলো।সুখ ছোট্ট শ্বাস ফেলে খাটে গিয়ে বসতে নিলেই জানালা দিয়ে কিছু একটা তার ঘরে এসে পড়লো।সুখ ভ্রু কুঁচকালো। ধীরে ধীরে জানালার কাছটাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে কারো দেখা পেলো না, পায়ের কাছে পাথর মুড়ানো একটা সাদা কাগজ পেলো। যেখানে লিখা
-‘সুখোবতী সুখের হোক,
তার অ-সুখে আমার অসুখ।’

সুখ অবাক হয় চিরকুট কে দিলো? আর তার পরিবারই বা এই প্রেগন্যান্সির ভুল খবর কীভাবে জানালো? সে বলে নি,আর লীলাবতীও বলবে না নিশ্চয়।তাহলে বলেছে টা কে?

#চলবে

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ তিন

হঠাৎ করে জ্বলতে থাকা জায়গা গুলোতে ঠান্ডা অনুভব হতেই চমকে উঠে সুখ।তার ব্যাথার স্থানে ব্যাথা দেওয়ার মানুষ তো অভাব নেই কিন্তু ব্যাথা দূর করার মানুষের যে ভীষণ অভাব।সেই অভাব হীনতার মরুভূমিতে এমন মলম লাগানোর মানুষ কে এলো?

সুখ অনুভব করলো একটা রুক্ষ শুষ্ক হাত অনবরত তার পিঠে,ঘাড়ে কিছু একটা মালিশ করে দিচ্ছে যার জন্য এতক্ষণ জ্বলে যাওয়াটা হঠাৎ করে ঠান্ডা হয়ে গেলো। সুখের মনে পরলো এখনো তার বাড়িতে একজন মহিলা বাকি আছে যার রুচি থেকে এখনো সুখ নাম মানুষটা উগড়ে যায় নি।ষাটোর্ধ্ব মনোয়ারা বেগম আজও সুখোবতীর সুখের আশায় দ্বার খুলে বসে থাকে।আজও নিজের কুঁচকে যাওয়া শরীর আর বার্ধক্যের ভাড় নিয়েও সুখকে সমস্ত দুঃখ থেকে আড়াল করতে চায়।তার দাদীজান আজও তাকে আগলে রাখতে চায় দুঃখ নামক বড় হিমালয় থেকে।

রুমে সুখ আর তার দাদী বাদে আরেকজনের উপস্থিতিও টের পায় সুখ কিন্তু ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করে না।একটা বিশাল কামরায় নীরবতার জালে জড়িয়ে থাকে তিনটি মানুষ,তিনটি মানবী।একজন বয়সের ভাড়ে বৃদ্ধ প্রায়,একজন দুঃখের ভাড়ে ক্লান্ত আর,আরেকজনে পাপের ভাড়ে কুঁজো।

নীরবতা ভেদ করে অনেক বছরের জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মহিলাটা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো
-‘মাইয়া মানুষের জীবন মানেই খড়ঁকুটো, সময়ের স্রোতে গাঁ ভাসাইয়া চলতে হইব তাদের।কখনো মাইনা নিতে হইবো,কখনো মানাইয়া নিতে হইবো কিন্তু এই মাইনা নেওয়া আর মানাই নেওয়ার মাঝখানে যখন সমীকরণ অমিল হইয়া যায় তখন সেই স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসানোই উচিৎ।তুমি সারাজীবন সব মাইনাই নিবা আর কেউ তোমার দিক দেখবো না হেইডা তো হইতে পারে না।মাইয়া বইলা কী বাঁচার শখ জাগে না? কহনো কহনো বাঁচার লাইগ্যা স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসানো উচিত। হ,হয়তো স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসাইয়া হাল শক্ত না রাখতে পারলে তুমি অথৈ জলে হাবুডুবু খাইবা হয়তো একসময় তলায় যাইবা গভীর সমুদ্রে কিন্তু যদি বিপরীতে গাঁ ভাসাইয়া কূল পাইয়া যাও তাইলে তুমিই রাজা।কি কইছি বুজছো সুখোবতী?’

সুখ কিছু বলে না দাদীজানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে।কথা গুলা জেনো সে অনুভব করতে ব্যস্ত।আচ্ছা দাদী স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসানো বলতে কী বুজিয়েছে? এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা? কিন্তু আদৌও সে টিকতে পারবে তো? স্রোতের বিপরীতে হাল শক্ত করে না ধরলে যে অতলে হারিয়ে যাবে।আচ্ছা এমন বাঁচা থেকে একবার নিয়ম ভেঙে নাহয় হারিয়েই গেলো আর নাহয় রাজার মতন বাঁচলো।

ঘরের মাঝে এবার রিনরিনে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।এই বিভীষিকাময় কালো আধাঁর রাতে এই কান্নাটা জেনো কেমন ভয়ানক শোনাচ্ছে।সুখ এই কন্ঠের অধিকারীাে চেনে।

দাদী এবার সুখের হাতটা ধরে উঠিয়ে বসালো,একটা কৌটা থেকে মলম টুকু বের সুখের হাতের মাঝে ঘষতে লাগলো আর সেখানেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলতে লাগল
-‘মাইয়া মানুষের অলঙ্কার কী জানো সুখোবতী? তার চরিত্র।সেই চরিত্ররে পরিষ্কার রাখতে হইবো পানির মতন।চাঁদ এত সুন্দর জিনিস কিন্তু আমরা চাঁদের মতন চরিত্র পরিষ্কার রাখার কথা কহনো বলমু না কারণ চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। পানির কোনো কলঙ্ক নাই কেবল আছে পবিত্রতা তাই পানির মতন রাখবা চরিত্র।আর যদি চরিত্রের থাইকাও তোমার কাছে অন্য কোনো জিনিস বড় হইয়া যায় তাহলে তোমার কাল বিলম্ব না কইরা সেই দিনই মইরা যাওয়া উচিত।গলায় কলসি বাইন্ধা পানিতে ঝাঁপ দেওয়া উচিত। শরীর যেমন বস্ত্রহীন নগ্ন তেমনই চরিত্রহীন নারী নগ্ন।এই নারীর বেঁচে থাকা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়।’

সুখ চোখ তুলে এবার দাদীজানের দিকে তাকায়।অতঃপর তার খাটের সাথেই দাঁড়ানো লীলবতীর দিকে তাকায়।দাদী কখনোই তাকে এমন ধারা কথা বলবে না তাহলে দাদী কি লীলাবতীকে এসব বলছে? সুখ আৎকে উঠে, না না সে কলঙ্কীনি হোক কিন্তু লীলার শরীরে সেই তকমা লাগতে দিবে না।

সুখ কিছু বলার আগেই লীলাবতী কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে যায়। দাদীজান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না বরং আরেক দফা মলম নিয়ে সুখের হাঁটুর মাঝে মেখে দিচ্ছে।সুখ অবাক কন্ঠে বলল
-‘দাদীজান তুমি ওসব কী বললে?’

দাদীজান পায়ের দিকে তাকিয়েই বলল
-‘তোমার থেইকা জীবনডা আমি বেশি দেখছি।আর এত বেশী কিছুই দেখছি যে মাঝে মাঝে অনেক কিছু প্রকাশ না করতে পারার কষ্টে মইরা যাইতে ম্যালা মন চায়।লীলাবতী সেদিন ডিম ভাজির গন্ধ শুইনা বমি করছিলো,কাইল যখন তোমার বিয়ের রান্নাবান্না চলছিলো তখনও মাংসের ঘ্রাণ শুইনা বমি করছে।গত পরশু অর্ধেক আমের আঁচাড় সে শেষ করছে।কি ভাবছো তুমি? চুল গুলা আমার বাতাসে পাঁকছে? তোমার চেয়ে বেশি এই দুনিয়া দেখছি তাই “ক” কইলে কলকাতা বুঝি।’

সুখ জেনো এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলো না।দাদীজান সবটা বুঝতে পেরেছে? যাক অন্তত এই মানুষটা টাকে ভুল বুঝে নি।

সুখ দাদীকে জড়িয়ে ধরে।দাদীর শরীর থেকে কেমন জেনো একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসে।আচ্ছা এটাকেই কী মা মা ঘ্রাণ বলে?

সুখ দাদীকে জড়িয়ে ধরে বলল
-‘দাদী এই মিথ্যে অপবাদ টা কে ছড়ালো গো?’
-‘আমি জানিনা।হঠাৎ কইরাই বাড়িতে গুঞ্জন উঠলো তুমি নাকি পোয়াতি। আর তারপরই তোমার ডাইনী মায়ের অত্যাচার।’

সুখ আর কিছু বললো না কেবল ছোট্ট শ্বাস ফেলল।কে করেছে এই নিকৃষ্ট কাজ?কার এতে লাভ?

দাদী সুখের মাথাটা বুলিয়ে দিয়ে বলে
-‘এত মাইর খাইয়াও তুমি প্রতিবাদ করো না ক্যান?আমি তো বুড়া মানুষ, কয়দিন পর কবরে চইলা যামু তাই ঝামেলা করতে ভয় হয় যদি বাইর কইরা দেয় কিন্তু তুমি তো মাত্র যৌবনে পা দিছো নিজের হইয়া প্রতিবাদ করতে পারো না? এখনকার যুগের মাইয়া হইয়াও এসব সহ্য করো?জানো তোমার দাদাজান অনেক খারাপ মানুষ আছিলো।হেই অহন মইরা গেছে এইসব কওন ভালা না কিন্তু তোমার লাইগা কইতাছি।তোমার দাদাজানের কর্মের জন্যই তো তোমার এ’দশা।সে-ই তো তোমার বাপেরে বিয়ার আসর থেইকা তুইলা আনছিলো।টাকার লোভ আর নারীর লোভ ছিলো তার প্রচুর।”যে পুরুষের নারীর প্রতি থাকে ঝোঁক,সে পুরুষ কোনো নারীর না হোক” সেই পুরুষ মানুষ বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভালো।যখন তোমার ফুপি পেটে তখন শুনি সে আরেকটা বিয়া করবো তারপর আমি ঝামেলা কইরা আমার বাপের বাড়ি চইলা আহি। হেই আমলে এত গুলা ছেলেমেয়ে লইয়াও যদি আমি এমন প্রতিবাদ করতে পারি তাইলে তুমি পারবা না কেন?’

সুখ নিস্তেজ কন্ঠে বলল
-‘কারণ তোমার বাবার বাড়ি নামক জায়গা টা শক্তি ছিলো আর আমার সেটা দুর্বলতা।’

মনোয়ারা বেগম আর কোনো কথা বললেন না।সুখের পাশে শুয়ে পড়লেন।সুখ বৃদ্ধ দাদীর উষ্ণ বুকে মুখ গুঁজে রইল একটু শান্তির খুঁজে।এই সম্বলহীন বৃদ্ধাই যে এই তরুণীর সম্বল।

দরজার বাহিরে এমন দৃশ্য দেখে কেউ একজন অনুশোচনায় কেঁপে উঠলো।সুখোবতীর সুখের বীজটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছে তো সেই।নিজের কাছের মানুষের পাপ ঢাকতে এক আকাশ সমান পাপ সে করে ফেলেছে।

_________

মাথার উপর সূর্য যখন তার উত্তপ্ত তেজ ঝাড়তে ব্যস্ত তখন সেই তেজী সূর্যের নিচে থাকা এক নিস্তেজ মানবী তার জীবনটা আবার স্রোতের বিপরীতে ভাসানোর পরিকল্পনায় ব্যস্ত।

দু’তলার রুমটা দিয়ে বাড়ির উঠানটা খুব ভালো করে দেখা যাচ্ছে।কাল এখানেই বাবার লাশটা রাখা ছিলো।হঠাৎ বুকের মাঝে চিনচিনে কষ্ট হানা দিলো সুখের।তার এই পৃথিবীতে কেহ নেই।হঠাৎ সুখের পাশে তার ফুপি লিলুয়া এসে দাঁড়ালো।

সুখ ফুপিকে দেখে চোখের জলটা মুছে ফিরে তাকালো।লিলুয়া পরম যত্নে ভাইয়ের মেয়ের চোখটা মুছে আলতো হাতে মুখটা দুই হাতের মাঝে নিয়ে বলল
-‘কাঁদছিস কেন সুখপাখি? তোর বাবা নেই তো কী হয়েছে এই যে আমি আছি।তোর দাদী আছে।পৃথিবীতে তুই একা নেই।কিন্তু তোর গর্ভে যে শিশুটা বড় হচ্ছে তার কী হবে? বাবা বিহীন সে এই পৃথিবীতে আসবে কী পরিচয়ে?’

সুখের কলিজায় কথা গুলো তীরের মতন লাগে।যে কলঙ্ক সে করে নি সেই কলঙ্কের কালি দিয়েই তার সারা শরীর লেপানো। পরক্ষণেই আরেকটা কথা তার মাথায় আসে,সত্যিই তো তার না হোক লীলাবতীর সন্তানের কী পরিচয় দিবে সে?খুব দ্রুতই মসৃন যে জায়গায় থাকে সেখানে যেতে হবে।লীলাবতীর সন্তানকে পরিচয় দিতে হবে।

সুখ তাড়াতাড়ি নিজের উড়না টা নিয়ে শরীরে জড়িয়ে টাকার ব্যাগটা হাতে নিয়ে যেই না ঘর থেকে বের হতে যাবে অমনিই তার ঘরের সামনে হাজির হয় তার ফুপাতো ভাই রেদোয়ান।সুখ আকষ্মিক রেদোয়ানকে দেখে থমকে যায় অবাক কন্ঠে বলে
-‘আপনি?’

রেদোয়ান বাঁকা হেসে ফিসফিস কন্ঠে বলল
-‘তোমার সর্বনাশ দেখতে এলাম সুখপাখি।মা যখন বলল তোমার বিয়ে ভেঙে গেছে, আর তুমি গর্ভবতী বিশ্বাস করো নিজেকে এত খুশির সময় আর আটকে রাখতে পারলাম না।চলে আসলাম তোমার বিধ্বস্ততা দেখতে।’

সুখ দু’কদম পিছিয়ে যায়। এই যে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কুশ্রী হৃদয়যুক্ত মানুষটা তার ফুপির ছেলে।মানুষ না জেনো জানোয়ার।

ততক্ষণে সুখের ফুপি এগিয়ে এসে বলল
-‘কোথায় যাচ্ছিস সুখপাখি? আর রেদোয়ান তো কাল বিকেলেই এসেছিল তুই তখন রুমে ছিলি বিধায় দেখিস নি।’

সুখ থমকে গেলো।দুঃখ বুঝি কম ছিলো যে নতুন করে আরেকটা দুঃখ হাজির হলো?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here