সুখের_অ-সুখ,পর্বঃ চার,পাঁচ

#সুখের_অ-সুখ,পর্বঃ চার,পাঁচ
#মম_সাহা
পর্বঃ চার

সুখ কে বাড়ির উঠানে টেনে হাজির করলো তার সৎমা।উনার হাতে সুখের জামাকাপড়ের কালো ব্যাগটা।ভীষণ ক্রোধে ব্যাগটা উঠানের মাঝে ছুঁড়ে মেরে ফেলে চিল্লিয়ে বলল
-‘এখনো কোন আক্কেলে এবাড়ির ভিতর আছিস? কী ভেবেছিস কলঙ্ক নিয়ে এ বাড়িতে থাকবি? কখনোই না।এ বাড়ি থেকে এখনই বের হয়ে যাবি।তোর মতন মেয়েকে এ বাড়িতে এক মুহূর্তেও টিকতে দিবো না।যা বের হ।’

বাড়ি ভর্তি লোক কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।সুখের ফুপি কতক্ষণ চেষ্টা করেছিলো এই মহিলাকে থামানোর কিন্তু কোনো লাভ হলো না। সুখ মাথা নিচু করে কেবল দাঁড়িয়ে আছে।আজ সুখ কাঁদছে না।

সুখকে চুপ থাকতে দেখে দ্বিগুণ ক্রোধে তার সৎমা ধাক্কা দিয়ে উঠোনে ফেলে দেয়।রেদোয়ান নামের ছেলাটা আৎকে উঠে বলে
-‘কী করছে মামী? সুখ কিন্তু এখন একা না,ওর বাচ্চার যদি ক্ষতি হয়ে যায় তখন কী হবে?’

সুখ অবাক চোখে তাকায় রেদোয়ানের দিকে।সুখকে তাকাতে দেখেই রেদোয়ান বাঁকা হাসি দিলো।সুখ বুঝলো আসলে রেদোয়ান এমন মিষ্টি ভাষায় আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করলো কেবল।

সুখের বৃদ্ধা দাদী সুখের কাছে গিয়ে সুখকে ধরে উঠায়।নরম কন্ঠে বলে
-‘বাপ মা হারা মাইয়াটা কোথায় যাইবো বউ? তুমিই তো তার আশ্রয়।’

শাশুড়ির সুখের হয়ে পক্ষপাতিত্ব পছন্দ করলো না সানজিদা বেগম। রেগে গিয়ে বলল
-‘আপনার তো এক পা কবরে গেলো আম্মা,এমন পাপীর হয়ে কীভাবে কথা বলছেন? পরকালের ভয় নেই? পাপীর হয়ে কথা বললে আপনিও পাপী হবেন।একটু তো ভয় করেন পাপের সঙ্গ ছাড়েন,পাপের মুখে থুথু ফেলেন।’

বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগম পড়নের সাদা থান কাপড়টার আঁচলটা টেনে হাসি মুখে বলল
-‘তাহলে প্রথম থু টা তোমার মুখেই মারি বউমা? তোমার সঙ্গ দেওয়ার মতন পাপ এ দুনিয়ায় আর নাই।’

ফুঁশে উঠলো সানজিদা বেগম শাশুড়ির দিকে তেড়ে গিয়ে শাশুড়ির বাহু ধাক্কা দিয়ে বলল
-‘বাহ্ বুড়ি মহিলা আমার টা খেয়েই আমাকেই পাপ বলছেন? আপনিও বের হন বাড়ি থেকে।এই বাড়িতে আপনার ঠাঁই নেই?’

-‘এ বাড়ি থেকে যদি কাউকে বের হতে হয় তাহলে সবার প্রথমে আপনি বের হবেন।’

সুখের এহেন কথায় আকাশ থেকে জেনো পড়ে সানজিদা বেগম। শুধু সানজিদা বেগম না উপস্থিত সবাই ই আকাশ থেকে পড়লো জেনো।সেখানে সুখের দুই চাচা, চাচী আর চাচাতো ভাইবোনও উপস্থিত ছিলো কিন্তু সানজিদা বেগমের এহেন আচরণে কোনো প্রতিবাদ করলো না।কিন্তু সুখের তেজী রুপ তাদেরকেও৷ অবাক করেছে।

সানজিদা বেগম অবাক কন্ঠে বলল
-‘এই এই তোর মুখে বুলি ফুটেছে বেশি? আমি বাড়ি থেকে বের হবো মানে? বেশি সাহস হয়েছে তোর?’
-‘আপনি বাড়ি থেকে কেনো বের হবেন সেটা আশাকরি বুঝতে পেরেছেন,আমি নাহয় খুলে নাই বললাম।আর এ মানুষটাকে বের হতে বলছেন কোন সাহসে? এ বাড়ি উনার ছেলের আপনি বের হতে বলার কে?’

সুখের তেজী কন্ঠে থতমত খেয়ে গেলো উপস্থিত সবাই।সানজিদা বেগম আমতা-আমতা স্বরে বলল
-‘কী বলছিস তুই? পাগল হলি নাকি? এই তোর লজ্জা নেই তাই না? বাপ হীন বাচ্চা গর্ভে নিয়ে ঘুরছিস আবার বড় বড় কথা বলছিস, এ লজ্জায় মরা উচিৎ তোর।গলায় দঁড়ি দে।’

বৃদ্ধ মনোয়ারা ছেলের বউয়ের দিকে এগিয়ে এসে বললেন
-‘যে সত্যিকার অর্থে কলঙ্কীনি সে গলায় দড়ি দিলে খুশি হবে তো বউমা?’

সানজিদা অটল কন্ঠে বলল
-‘হ্যাঁ অনেক খুশি হবো।’

মনোয়ারা এবার লীলার দিকে তাকিয়ে দন্তহীন মুখে মিষ্টি এক হাসি দিয়ে বলল
-‘লীলাবতী তোর মা কী বলেছে শুনেছিস?’

লীলাবতী আকষ্মিক নিজের নাম শুনে চমকে উঠে। তাড়াতাড়ি চলে যায় নিজের রুমে।একে একে সবাই নিজের নিজের ঘরে চলে গেলো,সানজিদা বেগম কিছু না করতে পেরে নিজেও ঘরে চলে গেলো।আপদ বিদেয় করতে না পারার দুঃখে সানজিদা বেগম ফুশঁ ফুঁশ করতে ঘরে চলে গেলেন।

দাদী আফসোসের শ্বাস ফেলে বলল
-‘দেখলা সুখোবতী আমার মাইয়া পোলার কাহিনী? তাগো সামনে তাদের মারে এত অপমান করলো একটা মানুষ একটা কুলাঙ্গারও মুখ খুললো না।মুখ খুললে যদি আমার খাওয়ানোর দায়িত্ব তাদের উপর পরতো সেই ভয়ে।এগুলা আমার গর্ভের কলঙ্ক। বাপের রক্ত শরীরে আছে তো।বুঝলা সুখোবতী “বৃদ্ধা নামক সময়টা জীবনের আরেকটা অপরাধ”। পৃথিবীতে সব মানুষ জেনো বৃদ্ধ হওয়ার আগে মইরা যায়।বাইচ্চা থাইকা মরার চেয়ে একবারে মরা ভালো।বৃদ্ধরা তো অহন কুত্তার আসনও পায় না।বয়স্ক মানুষ মরলে তার পরিবার বাইচ্চা যায়।এ হইলো যুগ।’

সুখ দাদীকে জাপ্টে ধরে।দাদীজান সুখের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল
-‘কিগো মেয়ে,স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসানো শুরু করে দিয়েছো?’

সুখ টলমলে চোখে মুচকি হাসি দিয়ে বলল
-‘দেখিনা একবার বিপরীতে গিয়ে, হয় অতলে তলিয়ে যাবো নাহয় রাজা হবো।’

দাদী হেসে দেয়।মেয়েটা যে এত সহজে শক্ত হবে ভাবতে পারে নি সে।
—–

অন্ধকার রুমে বসে লীলাবতী কারো সাথে ফোনে বাক বিতর্কে যুক্ত।করুন স্বরে লীলাবতী বলছে
-‘আমর বাচ্চার দায়িত্ব তুমি নিবে না? তুমি কী তাকে স্বীকার করবে না?’

অপরপাশের মানুষটি বাঁকা হেসে বলল
-‘হ্যাঁ স্বীকার করবো আগে যা বলেছি তা করো।’

লীলাবতী কেঁদে দিয়ে বলল
-‘জানো তোমার কথায় ভালোর অভিনয় করতে গিয়ে দেখলাম ভালো হয়ে বাঁচার মাঝে কী তৃপ্তি।ইশ,কেনো যে ভালো হলাম না।খারাপ হয়ে যুগ যুগ বাঁচার চেয়ে ভালো হয়ে একদিন বাঁচার মাঝে রাজ্যের তৃপ্ততা।’

অপরপাশের মানুষটা বিরক্ত স্বরে বলল
-‘তাহলে তুমি ভালো সাজো আর তোমার বাচ্চা নাজায়েজ পরিচয় পাক।’

লীলাবতী আৎকে উঠে বলল
-‘না না তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।’

অপরপাশের মানুষটা উচ্চস্বরে হেসে বলল
-‘এই না হলো রঙলীলা।মাই জান।’

লীলা ফোনটা কেটে নিজের পেটের মাঝে হাত বুলিয়ে ছোট্ট প্রাণটাকে বলল
-‘তুই পাপের ফল হয়ে আসবি না কথা দিলাম।দরকার হয় আমি আরও পাপ করবো।’

______

সুখ উত্তপ্ত রোদে হেঁটে যাচ্ছে।বাবার মৃত্যুর পর এ অব্দি ভার্সিটির চত্তরে পা রাখে নি সে।আজ চারটা দিন পর বাহিরের সূর্যের উত্তপতা পেলো।কলেজ থেকে সুখ যাবে মসৃনের মেসে।যেভাবেই হোক লীলাবতীর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

নিজেদের এলাকার লোকজন কেমন বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সুখের দিকে,সবাই হয়তো ভাবছে এই নির্লজ্জ মেয়ে কীভাবে এই মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হঠাৎই রোদ্র তপ্ত আকাশ ভেঙে কালো মেঘ হানা দিলো।সুখ দ্রুত বড় রাস্তায় উঠে গেলো।টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।সুখ কোনো রকম একটা সিএনজি থামিয়ে উঠে গেলো দ্রুত।সিএনজিতে উঠতেই পাশে তাকাতে চমকে উঠে সুখ।তার পাশেই এক ভদ্র লোক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুখের পানে।সুখও থতমত খেয়ে গেলো।ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল
-‘দুঃখীত দুঃখীত আপনাকে খেয়াল না করেই উঠে গেছি।আমি নেমে যাচ্ছি।’

সুখের কথা থামতেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামলো।সুখ আকষ্মিক আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনে আহাম্মক হয়ে গেলো।সিএনজিতে থাকা লোকটা শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো।সুখ ঘুরে তাকালো।লোকটা হাসি থামিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলল
-‘দুঃখীত দুঃখীত আমি হাসতে চাই নি।আসলে সমস্যা নাই আমার সাথে আপনি যেতে পারেন।আমারও গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়াতে সিএনজি দিয়ে যাচ্ছি।’

সুখ কোনো উপায় না পেয়ে শেষমেশ রাজি হলো অপরিচিত লোকটার সাথে যেতে।নিজের কলেজের ঠিকানা দিতেই সিএনজি ছুট লাগালো নিজের গতিতে। সুখকে এক অস্বস্তিতে ঘিরে ধরলো।কোনো রকম বসে রইলো সিএনজির এক কোণায়। কোনো মতে রাস্তা টা শেষ হলে সে বাঁচে।

________

-‘মসৃন তো এখান থেকে চলে গেছে সেই কবে। এখানে তো ও থাকে না।’

সুখ অবাক হয়।মসৃন যে ফ্লাটে থাকতো কলেজ শেষে সেইখানেই এসেছিলো মসৃনের খোঁজে তখনই রুমমেট এই খবর জানালো।সুখ আবার জিজ্ঞেস করলো
-‘আচ্ছা মসৃন কোথায় থাকতো গ্রামের বাড়ি কই কিছু জানেন?’

রুমমেট ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘না তেমন কিছু তো জানিনা।আমাদের এক বড় ভাই দু’মাস আগে মসৃনকে আমাদের বাসায় দিয়ে যায়। তারপর ছেলেটা তত মিশুক না তাই কিছু জানতেও পারি নি।’

সুখ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে।দু’মাস আগেই মসৃনের সাথে তাদের আলাপ হয়েছিলো।সব তাহলে প্ল্যান মাফিকই ছিলো।সুখ আবার জিজ্ঞেস করলো
-‘আচ্ছা আপনার ঐ বড় ভাইয়ের ঠিকানা দেন বা ফোন নাম্বার আমি যোগাযোগ করতাম।’

এবারও ছেলাটা নম্র স্বরে বলল
-‘না আপু বড় ভাইয়া এখন দেশে নেই যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই।সে বাহিরের দেশে গেছে।সে দেশে আসলেই আপনার সাথে যোগাযোগ করতে বলবো।’

সুখ আর কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই রুমমেটের ছেলেটা ডাক দিয়ে বলল
-‘আপু মসৃনকে আমি এতটা খারাপ ভাবতে পারি নি।মানুষ চেনা সত্যিই কঠিন।আপনার সাথে ও কাজটা ভালো করে নি।বিয়েটা ভেঙে ও কাপুরুষের পরিচয় দিলো।’

সুখ আর কিছু বলে নি।চুপচাপ বের হয়ে গেলো।কিছু না করেও আজ তার দারুণ বদনাম চারপাশে। উপরওয়ালার দুনিয়াতে সত্যি প্রকাশ পাই ই একদিন কেবল ধৈর্য ধরতে হবে।

একদিকে একজন সুখের ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠলো,একদিকে একজন সুখকে ধোঁকা দিয়ে দিব্যি সুখেই আছে হয়তো,আরেকদিকে একজন প্রভাতে বৃষ্টিতে ভেজা এক অপরিচিতার মুগ্ধতায় হারিয়ে গেলো।আর হাজারো গোপন তথ্য লুকিয়ে আছে সুখের আড়ালে।সুখের অতীতটা সত্যিই কী শক্ত অতীত না সবটাই কেবল মিথ্যে ঘেরা?

#চলবে

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ পাঁচ

যখন মসৃনের দেওয়া ক্ষত সামলাতে ব্যস্ত সুখোবতী তখনই খুবই উপকার করতে উপকারী মন নিয়ে হাজির হয় তার ফুপি লিলুয়া। সুখের ভবিষ্যৎ বাচ্চা আর সুখের কথা ভেবে তার ছেলে রেদোয়ানের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয় লিলুয়া।

সুখোবতীর বাবা মারা গেছে আজ প্রায় একমাস হতে চলল।পরিস্থিতি কিছুটা যখন স্বাভাবিক তখনই সেই স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে অস্বাভাবিক করতে হাজির হয় লিলুয়া।

আজ শুক্রবার, সকাল সকাল লিলুয়া হাজির হয় তার ভাইয়ের বাড়ি।সব ভাই আর ভাবীদের একত্র করে ড্রয়িং রুমে আলোচনায় বসে।সেই আলোচনার মধ্যমনি সুখ।কথাবার্তার এক পর্যায়ে লিলুয়া সুখের সৎমায়ের পানে তাকিয়ে বলল
-‘ভাবী আমি একটা আবদার নিয়ে এসেছি।’

সানজিদা বেগম ভ্রু কুঁচকায় কিন্তু একটু পর গদোগদো কন্ঠে বলল
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ লিলু বলো না কী আবদার?’
-‘আসলে ভাবী সুখের তো কপাল টা পুঁড়ালো সেই ছেলে, এখন ওর দায়িত্ব কে নিবে? তাই আমি একটা সমস্যার সমাধান বা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি বললেই হয়।’

বাবার বাড়িতে লিলুয়ার সম্মানও বেশ ভালো কারণ লিলুয়ার স্বামী বেশ সুনামধন্য ব্যবসায়ী, রাজ প্রাসাদের মতন ভীষণ বড় বাড়ি।লিলুয়ার বড় শ্বশুর বাড়ি,লিলুয়াকে বাবার বাড়িতে এত আপ্যায়ন দিতে পেরেছে।আজকাল সমাজটাই এমন।টাকায় সম্মান এনে দেয়,ভালোমানুষির দাম নেই।

সানজিদা বেগম যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতন খবর পেলো।খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললেন
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ লিলু বলো না কী খবর? কী প্রস্তাব?’
-‘আসলে ভাবী আমার ছেলে রেদোয়ানের জন্য আমরা একটা ভালো মেয়ে খুঁজছি আর সুখ যেহেতু আমারই ভাইয়ের মেয়ে আমরা ওকে কাছ থেকে দেখেছি তাই আমি চাচ্ছি আমার ভাইঝিকে আমার বাড়ির বউ করে নিতে।’

লিলুয়া যে এমন প্রস্তাব দিতে পারে উপস্থিত কেউ ভাবতেই পারে নি।আকষ্মিক বজ্রপাত হলো মনেহয়।সানজিদা বেগমের হাসিহাসি মুখ নিকোষ কালো আধাঁরে ছেয়ে গেলো। লিলুয়ার মেঝো ভাই সৈকত ইসলাম অবাক কন্ঠে বলল
-‘তুই কী পাগল হলি লিলু? যদি ভাইয়ের মেয়েকে বউ করে নিতে হয় তাহলে তো আমার মেয়ে শুকতারা আছে, ছোটনের মেয়ে দিপা, লীলাবতী আছে।ওরা তো সুন্দরীও।সুখের কপালে তো কলঙ্কের কালী সেই কালীতে নিজেদের সম্মানও বিভীষিকাময় করে তুলতে চাইছিস? আমরাই তো পারছি না ওকে উগড়ে ফেলতে, গলায় কাটার মতন বিঁধে আছে জেনো। ওর জন্য লজ্জায় বাইরে যেতে পারি না।সবাই ছিঃ ছিঃ করে।’

লিলুয়া নিজের দাদাকে একবার ভালোভাবে পরখ করে বেশ শান্ত স্বরেই বলল
-‘তুমি হয়তো ঠিক আমার কথা বুঝো নি ভাইজান। আমি বলেছি ভালো মেয়ে সুন্দরী মেয়ে না।আর সুখও অবশ্য মাশাল্লাহ। তোমাদের ওগুলো মেয়ে? কথার যা শ্রী এদের বাড়ি নিলে আমাদের পথে বসতে হবে।’

সবাই ই লিলুয়ার কথায় ফুঁশে উঠলো।সানজিদা বেগম রুষ্ট চোখে চেয়ে বলল
-‘নাহ্ লিলু সুখও তোমার ভাইঝি ওরাও তোমার ভাইঝি।তুমি এই কলঙ্কীনি মেয়েকে এত মাথায় তুলছো আর বাকিদের খারাপ বলছো?
-‘ভাবী চাঁদেরও আলো আছে তারাদেরও আলো আছে।তারাদের কিন্তু কলঙ্ক নেই আর চাঁদের কলঙ্কে লেপা তার ঐশ্বর্য তবুও কিন্তু চাঁদ চাঁদই আর তারা তারাই।চাঁদ কেবল একটা আর তারা অগণিত।’

সানজিদা বেগম কতক্ষণ অমত পোষণ করলো।সে এ বিয়ে দিবে না আসলে সুখের জন্য তথাকথিত এত ভালো সম্বন্ধ সে মানতে পারছে না।কোনো রকম ভাবে না পেরে অবশেষে লিলুয়া বললো
-‘ভাবী রেদোয়ানের বাবা বলেছে এই বিয়ের যাবতীয় খরচ তার আর তোমাদেরও যা খরচ হবে তারজন্য আট লাখ টাকা তোমার হাতে সে তুলে দিবে।তোমরা চাইলে এক শুক্রবারে ঘরোয়া ভাবেও এই আয়োজন সেড়ে ফেলতে পারো।’

এবার টাকার কথা শুনে লোভে সানজিদা বেগমের চোখ চকচক করে উঠলো।সে আর এক মুহূর্তও ব্যয় না করে দ্রত গতিতে সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়ে বলল
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি রাজি।আসলে কয়দিন হলো তোমাদের ভাইকে হারিয়েছি এখনই বিয়ের আয়োজনের সামর্থ্য আমার নেই তাই না করছিলাম যেহেতু তোমরাই যাবতীয় খরচ দিবে তাহলে আর আপত্তি করে কী লাভ।’

লিলুয়া বাঁকা হাসলো।কোন রোগের কোন ওষুধ সে জানে তাই সঠিক জায়গায় সঠিক ওষুধটা দিলো।আর আমরণ পাপের বোঝা বহন করার চেয়ে একটু পূণ্য করে যদি সে বোঝা কমানো যায় সেটাও ভালো ।

এর মাঝেই হুলস্থুল কান্ড শুরু হলো।আজই সুখকে আংটি পড়িয়ে যাবেন ফুপি।এসবই এতক্ষণ সুখের অনুপস্থিতিতে হয়েছিলো অবশেষে যখন সুখের প্রয়োজন হলো তখন সুখের দাদীকেই সুখের ফুপি পাঠালো কারণ একমাত্র দাদীই সুখকে রাজি করাতে পারবে।

সুখ ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ শেষ করে পড়াশোনা করেছে কিছুক্ষণ তারপর আবার ঘুমিয়েছিলো।দাদী ধীর পায়ে সুখের রুমে গেলো, সুখ তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলো।দাদী সুখের পাশে গিয়ে বসলো।এতটুকু একটা মেয়ে কিন্তু দুনিয়ার সকল কষ্ট জেনো তার পায়ের নিচে অবতীর্ণ হয়েছে। যেনো বিধাতা ঠাট্টার হাসি হেসে বলছে
~”সুখোবতী নারী তুমি
দুঃখ তোমার বাসভূমি।”

দাদী হতাশার শ্বাস ফেলে খুব নরম স্বরে সুখের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো
-‘ও সুখোবতী উঠো,বেলা হইলো যে।আকাশ পরিষ্কার হইছে লগে বোধহয় তোমার ভাগ্যও পরিষ্কার হইবো।উঠো।’

দাদীর এমন কথার মানে ঘুমিয়ে থাকা সুখের বোধগম্য হয় না কিন্তু ঘুম ভাঙে ঠিকই। ঘুম ভাঙতেই সে ধড়ফড় করে উঠে বসে।দাদী ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল
-‘ধীরে উইঠো,ভয় পাইছো লাগে? আমি খেয়াল করছি ঘুমাও না রাইতে আবার মাঝে মাঝে ঘুমের মাঝে কেমন জানি করো।’

সদ্য ঘুম থেকে উঠা সুখের মস্তিষ্ক তখনও সচল হয় নি।তাও কতক্ষণ চুপ থেকে মস্তিষ্ক আর চোখের ঘুম কাটিয়ে নিভু নিভু কন্ঠে বলল
-‘বাবার মৃত্যুর পর থেকে ঘুমাতে পারি না দাদীজান মনে হয় কে জেনো ঘুমের মাঝেই মারতে আসতাছে।চোখ মেলে তাকিয়ে থেকেও মানুষ চেনা যাচ্ছে না সেখানে ঘুমিয়ে থাকলে কেউ মেরে ফেলবে এমন ভাবনা আসাটাও স্বাভাবিক। প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করি মরে যাওয়ার কিন্তু সেই প্রার্থনায় বেঁচে থাকার কী যে সুপ্ত আশা।একটু নিজের সুখ নামটার স্বার্থকতা দেখার কী যে তৃষ্ণা দাদীজান।এ জনমে মিটবে তো আমার সেই তৃষ্ণা?’

দাদী সুখের মাথায় হাত বুলিয়ে দন্তহীন মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল
-‘এইবার তোমার নামের স্বার্থকতা পাইবা সুখোবতী। সময় যে হইলো স্বার্থকতা পাওয়ার।’

সুখ দাদীর কথার সঠিক মানে বুঝে না।প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘কী বলছো দাদীজান? কিসের সময় হয়েছে?’
-‘তোমার সুখ পাওনের সময় হইছে গো সুখোবতী। তোমার জন্য রাজপুত্র আইছে।’

দাদীর কথায় চমকে গেলো সুখ।রাজপুত্র আসছে মানে? সে বিস্ফোরিত নয়নে বলল
-‘রাজপুত্র আসছে মানে? কে আসছে?’
-‘তোমার ফুপির ছেলে রেদোয়ান দাদুভাই তোমার রাজপুত্র গো।উঠো নিচে চলো তোমার ফুপি তোমাকে তার ঘরের বউ কইরা নিয়া যাইবো।উঠো দেখি।’

সুখ যেনো আকাশ থেকে পড়লো।সকাল বেলা সকালে এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে।শেষমেশ বাঁদড়ের গলায় মুক্তার মালা হবে সে? নাহ্ এ কিছুতেই হতে দিবে না।সুখ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল
-‘নাহ্ দাদীজান এসব কী বলছো! এটা কখনোই হবে না।রেদোয়ান ভাইয়ার সাথে আমি? না না অসম্ভব।’

দাদী মুখ কালো করলো তারপর অসন্তুষ্ট স্বরে বলল
-‘কোনো কিছুই অসম্ভব না।তোমার সবকিছু মাইনা যে তোমারে গ্রহণ করতে চায় তারে মাইনা নেও।জীবন তোমারে ভালো কিছু দিতে চাইতাছে। যাও হাত মুখ ধুইয়া আসো তাড়াতাড়ি।’

সুখ অনড় বসে রইলো।আর যাই হোক রেদোয়ান নামক মানুষটার সাথে সন্ধি সম্ভব না।কোনো একদিন রেদোয়ান ভাই এর ভালোবাসা প্রত্যাখান করেছিলো সে যার তেজ এখনো মিটাচ্ছে রেদোয়ান তাহলে আজ এসব কেন? সেই প্রতিশোধের জন্য নাকি ভালোবাসা টা এ অব্দি আছে বলে?

সুখকে চুপ থাকতে দেখে দাদী নিবিড় স্নেহে নাতনিকে বললেন
-‘সবাই তোমারে ভুইলা নিজের স্বার্থ খুঁজচ্ছে।আমি বুড়িই পারি নাই তোমারে ভুইলা একলা থাকতে।আইজ আছি কাইল নাই,যাওয়ার আগে তোমার পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত কইরা দিতে চাই।এই বুড়ির অনুরোধটা রাখো।তুমি চইলা যাও এ বাড়ি ছাইড়া।দেহো বাইরের আকাশ যেমন স্বচ্ছ হইছে পরিষ্কার একদম, তোমার জীবনও এমন পরিষ্কার আর সুখে ভরপুর হবে।যাও রেডি হও আমি আইতাছি।’

মনোয়ারা বেগম শুষ্ক হাত পা গুটিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলেন দরজার বাহিরে তখনই সুখ বাহিরে তাকিয়ে দেখে বাহিরের সাদা স্বচ্ছ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো,আচমকা ভীষণ বাতাস শুরু হলো,ধূলোবালিতে ভরে উঠলো পুরো ঘর,এসব জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে ঝড় আসার পূর্ব মুহূর্ত। শুধুই কী প্রকৃতির ঝড় আসবে নাকি সুখের জীবনেও আসতে চলেছে নতুন ঝড়?

__________

হাতে একটা ছুড়ি নিয়ে অনবরত একটা ছবির উপর কেউ আঁচড় কাটছে আর পাগলের মতন বিড়বিড় করতে করতে বলছে
-‘আমি ঠকেছি কিন্তু হারবো না।এক বিয়ের আসরে অপমানে জর্জরিত সুখোবতী আবার বিয়ের আসরে বসার আগেই ঝলসে যাবে তার পৃথিবী। তার জন্য আমার সুখের এক অংশ আমি ত্যাগ করবো না।তাতে যাই করা লাগে করবো।

________
অন্যদিকে রেদোয়ান ক্ষীণ স্বরে মাকে প্রশ্ন করলো
-‘আচ্ছা আম্মু, তুমি সুখপখির সাথে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছো কেনো?’

ছেলের প্রশ্নে লিলুয়া আফসোসের শ্বাস ফেলে বলল
-‘পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য।’

রেদোয়ান অবাক আর চমকে যায়। কিসের পাপের কথা বলছে তার মা?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here