শ্যামাবতী,সূচনা_পর্ব

শ্যামাবতী,সূচনা_পর্ব
লাবিবার_গল্পকথা

নিজের দায়িত্ব এড়াতে ৫ বছর বয়সে বাবা আমাকে ও মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমার আর মায়ের খরচটা না নাকি তার পক্ষে চালানো সম্ভব ছিল না। তাই সে আমাদের একা ফেলে চলে যায়। মা একটা এনজিওতে চাকরি করতো তা দিয়ে যা রোজকার হতো তা দিয়ে আমার পড়াশোনা আর খাওয়া খরচ চালাত। ছোট্ট একটা টিনশেড এর ঘরে থাকতাম আমরা। বাবা ছেড়ে যাওয়ার পর বাড়িওয়ালা দয়া করে তাদের পুরনো এই টিনশেডের ঘরে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু আমার বয়স যখন ১২ তখন মাও আমাকে একা করে চলে যায় না ফেরার দেশে। সে নিজের মুক্তি ঠিকই করে নেয় কিন্তু আমাকে ফেলে রেখে যায় একা করে। মা মারা যাওয়ার পর খুব ভেঙে পড়েছিলাম। মা ছাড়া তো আমার আর কেউই ছিল না। চিত্কার করে কেঁদে ছিলাম সেদিন। কেঁদে কেঁদে মাকে অভিযোগ করেছিলাম স্বার্থপরের মত সে কেন আমাকে রেখে একা চলে গেল। তার সাথে করে তো সে আমাকেও নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু আমার সে কান্নায় কোন কিছুই বদলাল না। না মা ফিরে এসেছিল আর না আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তার কাছে।
এরপর বড় মামা এসে আমাকে নিয়ে যায়। মামার ওখানে থাকতে শুরু করি। মামাতো দুই ভাই বোনের সাথে আমার খুব একটা বনত না। কোন এক অজানা কারণে তারা আমাকে পছন্দ করত না। আসতে যেতে তাদের কাছে কথা শুনতে হত। মামা মামি অবশ্য কখনো কিছু বলেনি তবে মামি যে আমাকে খুব একটা পছন্দ করত না সেটা বুঝতে পারতাম। তবে এসবের মধ্যে আমার পড়াশোনাটা মামা বন্ধ করেনি। গ্রামের একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। পড়াশোনা ভালো হওয়ায় শিক্ষকরাও আমাকে অনেক সহযোগিতা করত। আমাকে তারা ফ্রিতে টিউশনি করাত।

এভাবেই কাটতে লাগলো এক দুই তিন করে পুরো পাঁচটি বছর। এখন আমার বয়স ১৭। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো কিছুদিন আগেই। ফলাফল প্রকাশ হয়ে গেছে। ভালো রেজাল্ট করেছি ৪.৮০। রেজাল্ট পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এবার কলেজে উঠব। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাড়াবো, আরো অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু আমার স্বপ্নকে ভেঙে দিয়ে মামা আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলো। মামাকে বিয়েতে না করার সাধ্য আমার নেই। এতটা বছর তারা আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে চলছে। আর কতই বা তারা করবে? নিজের কাছেও খারাপ লাগে অন্যের ঘাড়ে বসে ভাবে খেতে। কিন্তু আমার যে কিছু করার নেই। তাই মামা বলাতেই বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। আমি রাজি হওয়াতে মামা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে হয়তো ভেবেছিল আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়েতে রাজি হব না। আমি রাজি হওয়ায় মামীও যেন অনেক খুশি হয়ে গেল। তাদের এই খুশি দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। মানুষগুলো তো আমার জন্য কম করল না। সামান্য বিয়ে করাতে যদি তারা এত খুশি হয় তাহলে আমি চোখ বন্ধ করে এ বিয়ে করে নেব।

——————-

পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছি। বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরছে। ভয় ভয়ও লাগছে এইভেবে যদি তারা আমাকে পছন্দ না করে? তাহলে তো মামা মামী খুব কষ্ট পাবেন। এসব যখনই ভাবছিলাম তখনই কানে আসলো একজন খুব মিষ্টি করে বলছেন’

-‘মাশআল্লাহ! মেয়ে ভারি সুন্দর। তো মা কি নাম তোমার?’
এক প্রশ্নে আমি আলতো কন্ঠে উত্তর দেই,

-‘তাহিয়ান ইসলাম তাহি।’
-‘বাহ ভাবি! তোমার মত তোমার নামটাও খুব মিষ্টি।’
পাশ থেকে অল্প বয়সী একটি মেয়ে বলে উঠলো। আমি তখনও লজ্জা আর ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছি।

-‘আমাদের মেয়েকে খুব পছন্দ হয়েছে ভাইজান। আপনাদের যদি আমাদের ছেলে পছন্দ হয়ে থাকে এবং আর কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা আজি মেয়েকে নিজেদের ঘরে তুলে নিতাম। ঘরের লক্ষী ঘরে তুলতে বেশি দেরি করতে চাইনা।’

এমন কথা শুনে আমি আস্তে করে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালাম। দেখলাম মাঝ বয়সী একজন সুন্দরী মহিলা বসে আছেন। মিষ্টি করে হেসে তিনি মামার সাথে কথা বলছেন বিয়ের ব্যাপারে। মনে মনে ভাবলাম এটাই বুঝি আমার শাশুড়ি! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাথা আবার নিচু করে নিলাম। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তারা কী মনে করবে তাই ভেবে।

-‘ছেলেকে আর নতুন করে কি দেখব আপা। রাহাতকে তো আমরা আগে থেকেই চিনি। আমাদের ওকে এমনিতেই পছন্দ। নতুন করে আর দেখতে হবে না। আর বিয়ে তেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখন থেকে তাহি আপনাদের মেয়ে। আপনাদের যখন ইচ্ছা তখনই নিয়ে যেতে পারেন। আপনারা চাইলে আজই বিয়েটা হোক আমাদের এতে কোন আপত্তি নেই।’

মামার এমন উত্তরের তারা সবাই সন্তুষ্ট হলেন। ছেলে যেহেতু তাদের সাথে আসেনি তাই ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করতে হলো। অবশেষে পাত্র কাজিসহ আরো দু তিনজন ব্যক্তি এসে হাজির হলেন। প্রায় রাত ৮ টার দিকে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। তবে এখনো আমি আমার স্বামীকে দেখি নি। দেখার সুযোগটা হয়ে ওঠেনি তবে মামীর মুখে শুনেছি সে দেখতে নাকি যথেষ্ট সুদর্শন। মামি এটাও বলেছে আমার বিয়ে খুব ধনী পরিবারে হয়েছে। হ্যাঁ সে দিন আমি যখন স্কুলে যাচ্ছিলাম তখন রাস্তায় আমার শাশুড়ি মা আমাকে দেখেছিলেন। তখনই নাকি তার অনেক পছন্দ হয়েছিল আমাকে। এরপর খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে আমার ব্যাপারে। তারপরে সে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন মামার কাছে। বাকিটা তো আপনারা জানেন।

রাত দশটার দিকে খাওয়া-দাওয়া শেষে আমার শাশুড়ি আমাকে বলে রেডি হয়ে নেওয়ার জন্য। আজি তারা আমাকে নিয়ে যেতে চান। মামা তাদের সবাইকে অনেক রিকুয়েস্ট করে আজ রাতটা থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা থাকতে পারবে না। রাহাত মানে আমার স্বামী তিনি আর্মি অফিসার। আজ বিয়ের জন্য সে একদিনের ছুটি নিয়েছিল। যেহেতু এখান থেকে শহরে যেতে হবে আমাদের সেহেতু প্রায় সাত-আট ঘণ্টা জার্নি করতে হবে। তাই তারা এই রাতেই বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মামাও এখানে আর কিছু বলতে পারেন না। তবে আমি চলে আসার সময় মামা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলেন। মামির চোখেও আমি প্রথমবার নিজের জন্য পানি দেখেছিলাম। একদিন তার কাছে থাকায় হয়তো মায়া জন্মে গিয়েছিল। মামা মামিকে সালাম করে তাদের থেকে বিদায় নিয়ে আমিও রওনা দেই নিজের নতুন গন্তব্যে।

গাড়িতে বসে আছি, পাশেই আমার সদ্য বিবাহিত স্বামী ড্রাইভ করছেন। এই গাড়িতে শুধুমাত্র আমরা দুজনে আছি বাকিরা অন্য একটা গাড়িতে করে আসছেন। আমার খুব আফসোস হচ্ছে কারন আমি এখনো আমার বিয়ে করা বরের মুখ দেখতে পাইনি। আড়চোখে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু অন্ধকারে ঠিকভাবে কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ করেই রাহাত গাড়ির ভেতর লাইট অন করে দিল।

-‘আমাকে দেখতে চাইছো সেটা আমাকে বললেই হত! তাহলে আগেই লাইট অন করে দিতাম।’

হঠাৎ এ হেন কথায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। হাতেনাতে ভাবে ধরা পড়ে যাব কোনোভাবেই বুঝতে পারিনি। লজ্জায় মাথা কাটা গেল। লোকটা কি করে বুঝবো যে আমি তাকে আর চোখে দেখছিলাম! অন্ধকারের জন্য আমিতো দেখতে পাইনি তাকে তাহলে সেই করে দেখল আমি তাকেই দেখছিলাম!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here