শুভ্র_রঙের_প্রেম পর্বঃ১৪
#রুবাইদা_হৃদি
সোডিয়ামের সাদা মিশ্রিত হলদেটে আলো চারদিকে বিরাজ করছে৷ নিস্তব্ধতার কোনো শব্দ নেই তবে হৃৎপিন্ডের শব্দ যেন সব ছাপিয়ে ভয়ংকর আওয়াজ তুলছে৷ আমার দৃষ্টি অস্থির৷ কিন্তু উনার দৃষ্টি আমাতে নিবদ্ধ সেটা খুব করে বুঝতে পারছি৷ আমি অস্থির কন্ঠে বললাম,
–‘ কেন এসেছেন?? ‘
–‘ ইচ্ছা হয়েছে তাই! ‘
–‘ সেই ইচ্ছাটা কি?? অকারণে তো আর ইচ্ছা হয় না স্যার! ‘
আমি মাথা নত করেই কথা বলছি৷ উনার গভীর দৃষ্টি আমাকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়! কিছুক্ষণ একদম নীরব আবার৷ দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে৷ পাশের বিল্ডিংয়ের দারোয়ান চাচার বিরক্তিকর নাক ডাকার তীব্র শব্দ পরিবেশ ভারী করে তুলেছে৷ আমি পেছনে ঘুরে বাসার দিকে তাকালাম৷ মনের মাঝে দুরুদুরু করছে৷ কেউ দেখে নিলে ভালো চোখে দেখবে না৷ আমি রাগী সুরে আবার বললাম,
–‘ আপনি আমার শিক্ষক এইজন্য সম্মান প্রদর্শন করছি৷ এমন হুট করে কোনো শিক্ষক রাতের বেলা ছাত্রীর সাথে দেখা করতে আসে না নিশ্চয়?? ‘
আমার কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠলেন উনি৷ আমি ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম৷ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে হাতের মধ্যে হাত গুজে নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন ৷ মৃদু ঠান্ডা বাতাসে তার চুল গুলো তিরতির করে উড়ছে৷ চারদিক বোধহয় থমকে গেছে৷ ক্লান্ত চোখ গুলো এখন সজীব৷ তিনি হাসি বজায় রেখেই বললেন,
–‘ সেই সম্পর্ক ভার্সিটির বাউন্ডারির ভেতর আটকে আছে৷ ‘
আমি ভড়কে গেলাম! বলেন কি উনি?? ঝাঁঝালো কন্ঠে উত্তর দিলাম,
–‘ আর সেই বাউন্ডারি ক্রস করে বাসা পর্যন্ত এসে পরেছেন! ‘
–‘ আমি তো বাউন্ডারি বহু আগেই ক্রস করেছি৷ আর সেটা এখন মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে৷ তুমি বুঝতে পারো?? ‘
তার শীতল কন্ঠের কথা তীরের মতো বুকে বিঁধলো আমার৷ আমি জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘ ইম্পোর্ট্যান্ট কথা বুঝি এইটাই?? শেষ হয়েছে বলা?? আমি চলে যাচ্ছি তাহলে!’
–‘ পালিয়ে বেড়াচ্ছো! নিজের মনের অনুভূতি গুলো থেকেও পালিয়ে বেড়াবে? ‘
–‘ ম..মা.. নে?? ‘
–‘ বাসায় যাও৷ ‘ আমি চমকে উঠলাম গম্ভীর আওয়াজে৷ আমি কি সত্যিই পালিয়ে বেড়াচ্ছি? উঁহু! একদম না৷ মনের মাঝে সংরক্ষিত ভাবে অনুভূতি গুলো আছে৷ তবে প্রকাশ কেন পাচ্ছে না?? আমি ঠায় দাঁড়িয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বললাম,
–‘ যাবো না! আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর চাই৷ আর সেটার উত্তরদাতা আপনি৷ ‘
–‘ উত্তর নেই কোনো৷ ‘ উনি নিরলসভাবে উত্তর দিলেন৷ মূহুর্তেই রাগ চওড়া হলো আমার৷ তবুও নিজেকে সামলিয়ে আবার বললাম, ‘ তাহলে এখানে কেন এসেছেন?? ‘
–‘ তোমার জন্য ৷ ‘
উনার সোজাসাপটা উত্তর শুনে মনের মাঝে উত্তাল হাওয়া বয়ে গেলো৷ আমি অনবরত কাঁপছি৷ আমার দিকে তাকিয়ে উনি ভ্রুকুটি করে বললেন,
–‘ ঠান্ডা রোগীদের মতো ঠকঠক করছো কেন?? ‘
–‘ আ..আপ..নি আমার জন্য এসেছেন ৷ ‘
উনার বাঁকানো ভ্রু জোড়া আরো বাঁকিয়ে বললেন,
–‘ তাহলে আর কার জন্য আসবো?? ‘
–‘ কারণ কি?? ‘
আমার প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হলেন উনি৷ বিরক্তি কন্ঠে বললেন,
–‘ দেখতে ইচ্ছা হয়েছে এসেছি৷ অসুস্থ ছিলে তো তুমি৷ এইটাই কারণ৷ ‘
উনার উত্তর শুনে হতাশ হলাম আমি৷ মনে মনে অন্য কোনো উত্তরের আশায় ছিলাম ৷ আমি হতাশ কন্ঠেই, ‘ ওহহ ‘ বলতেই উনি আমার পাশ ঘেষে দাঁড়ালেন৷ আমি মূহুর্তেই দূরে সরে এলাম৷ আমার অস্থিরতা দেখে উনি হাসছেন৷ চাঁদের আলোয় তার হাসি অদ্ভুত মোহময় লাগছে! মনে হচ্ছে চাঁদের সমস্ত কিরণ তার হাসি মুখে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে৷ আমি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি তাকে৷
–‘ দেখা শেষ?? ‘ বললেন উনি৷ আমি লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম৷ লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে৷ নিজেকে নিজে গালি দিলাম৷
–‘ কাল সকালে যেন তোমায় ভার্সিটি দেখতে পাই৷ ‘
–‘ যাবো না আমি৷ ‘
আমার মিনমিনে কন্ঠ শুনে শান্ত কন্ঠে বললেন,
–‘ তুমি কাল যাবে৷ দেট’স ফাইনাল এন্ড লাস্ট ডিসিশন! ‘
তার কথা গুলো কেমন আদেশের মতো আর যা শুধুমাত্র আমার উপরেই প্রতিফলিত করেন৷ আমিও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে ‘ হ্যাঁ ‘ বলতেই উনি ভুবন ভুলানো হাসি দেয়৷ যার অর্থ,সে স্বার্থক৷
–‘ রুমে যাও এখন৷ ‘
–‘ আপনি সাবধানে যাবেন৷ ‘
আমি নিজে বলে নিজেই চমকে উঠলাম৷ একরাশ লজ্জা আর নীরবতা ঘিরে ধরলো আবার৷ আমি ঘুরে এক দৌড়ে বাসার ভেতর চলে এলাম৷ হৃৎপিন্ডের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ কানে এসে লাগতেই আবারো লজ্জায় মুড়িয়ে গেলাম৷ গেইট লক করেই উপরে নিজের রুমে আবারো একছুটে গেলাম৷ জানালার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি সে এখনো চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় আমার জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন ৷ যে চোখে হাজার না বলা ভালোবাসা লুকায়িত! তবে প্রকাশের অপেক্ষা ৷
_____________________________
–‘ কাল গিয়েছিলেন স্নিগ্ধ স্যার? কি বলেছেন উনি?? তোকে প্রপোজ করেছেন?? কী ভাবে করেছেন?? ‘
–‘ থাম দোস্ত,এইবার প্রাণ ভরে দম নে তারপর আবার শুরু কর৷ ‘
–‘ ধূর! বল না৷ তোদের প্রমের শুরুর মেইন দায়িত্ব কিন্তু আমি পালন করেছি৷ সেই হিসেবে কিছু গিফট প্রাপ্য আমার৷ ‘
নীতির উল্লাসিত মুখ দেখে ত্যক্ত হয়ে উঠেছি আমি৷ আসার পর থেকে লাগাতার এক কথাই বলে চলেছে৷ পরশ স্যারের ইম্পোর্ট্যান্ট দর্শনের ক্লাসে নাইনের বাংলা ক্লাসের মাঝে ফিসফিস করে বলেই চলেছে ও৷ আমাকে আবার খোঁচা মেরে দাঁতে কেলিয়ে বলল, ‘ বল না৷ ‘
–‘ এই নীতি ক্লাস থেকে বের হও ! ফিসফিস শ্বশুর বাড়ি গিয়েও করতে পারবে তবে আমার ক্লাসে না৷ ‘ পরশ স্যার চশমা নাকের ডগায় এনে জোরে ধমকে বললেন৷ স্যারের ধমক খেয়ে নীতি আমার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ঘুরে যাই৷ আবার চট করে ঘুরে দাঁত বের করে হেসে বললাম, ‘ প্রেমের শুরুর গিফট টা দারুণ তাই না দোস্ত?? ‘
আমার কথা শুনে কিড়মিড় করে নীতি বলল,
–‘ দিন আমারো আসবে৷ ‘
আমি ওর কথায় পাত্তা দিলাম না৷ ও ক্লাসের বাইরে যেতেই হাসি চওড়া করে ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় ঠোঁট উঁচু করে চুমু দিলাম৷
পাশেই জোরে চেনা কন্ঠের আওয়াজে কেও কেঁশে উঠে৷ আমি দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে তাকিয়ে দেখি স্নিগ্ধ স্যার৷ সে মারবেলের মতো চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ নীতি হাসিতে ফেটে পড়লেও পরশ স্যারের ভয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হেসে চলেছে৷
আমি দ্রুত ব্যাগ দিয়ে মুখ ঢেকে বিপদের দোয়া পড়া শুরু করে দিই৷ আর কেও দেখার ছিলো না আল্লাহ?? শেষে কিনা উনিই??
লজ্জায় মনে হচ্ছে,মাটি তুমি ভাগ হয়ে যাও আমি একা একাই আসছি তোমার কাছে৷
____________________
পশ্চিমের খোলা জানালা দিয়ে মৃদু বাতাস জানান দিচ্ছে,শীতের দাপট এখনো আছে৷ দো-তলা ভবণের একদম শেষ পর্যায়ের ক্লাস টা আমাদের৷ আজ ইংরেজি ক্লাস একদম শেষ পিরিয়ডে! ক্লাসে হাতে গোণা চারজন আছে৷ আমি,নীতি একদম দরজার কোণায় বসেছি যাতে আমাকে স্নিগ্ধ স্যারে মুখোমুখি না হতে হয়৷
বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটাচ্ছে৷ লজ্জায় মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে৷ ঠান্ডা মৃদু বাতাসেও ঘেমে যাচ্ছি বারেবারে৷
নীতি মুখ ফুলিয়ে বসে আছে! সাথে আমিও৷ ক্লাস করবো না ভেবে যেতেই ও আটকে দিয়েছে ৷ এইজন্য আমি রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে বসে আছি৷
হাতের ঘড়িতে সময় দেখছি! আর একটু পরেই সেই মুখের সামনাসামনি হতে হবে৷ সকালের সেই ঘটনার পর আমি হাসফাস করছি৷ লজ্জাজনক ঘটনা!
–‘ আসসালামু আলাইকুম! ‘ শীতল কন্ঠের সালাম শুনে বাকি তিনজন জোরে জবাব দিলেও আমি মিনমিন করে জবান দিলাম যাতে কেও শুনতে না পায়৷ দরজা দিয়ে পুরোটা ঢেকে আছি! এই সাইডে না আসলে আমাকে চোখে পরার কথা না উনার কিন্তু সব আশায় পানি ঢেলে দিয়ে উনি বললেন,
–‘ আজ স্টুডেন্ট কম! ক্লাস নিবো না সবাই চলে যাও৷ ‘
তার উক্ত কথা শুনে আনন্দে মনে মনেই লাফিয়ে উঠলাম! কিন্তু আনন্দ বেশিক্ষণ টিকলো না৷ আবারো সেই গম্ভীরতা বজায় রেখে বললেন,
–‘ হৃদি কাম টু মি! ‘
তার ডাক শুনে জমে গেলাম আমি৷ আমি অসহায় চোখে নীতির দিকে তাকাতেই ও ব্যাগ নিয়ে দ্রুত চলে গেলো৷
আবার কোন মুসিবত পরলাম?? এই লোকের দরকার টা কি আমার সাথে আবার??
সকালের ঘটনার রেশ এখনো টানতে হবে ভেবেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো৷ আল্লাহ হেল্প মি!
চলবে…..
~” কেমন সব নিস্তেজ আপনারা! ঝিমিয়ে গেছে পাঠকমহল৷ খুজে পাচ্ছি না আপনাদের৷ কেন পাচ্ছি না??
ভুল-ক্রটি ধরিয়ে দিবেন আর ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন~♥