শুভ্র_রঙের_প্রেম পর্বঃ১৩

শুভ্র_রঙের_প্রেম পর্বঃ১৩
#রুবাইদা_হৃদি

চারদিকে কোলাহল! আমি স্তব্ধ হয়ে সামনে থাকা মানুষটার দৃষ্টি উপেক্ষা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ আমাকে নিস্তব্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামনে এগিয়ে এসে শান্ত কন্ঠে বলল,
–‘ গত দুইদিন কোথায় ছিলে?? ‘
শান্ত কন্ঠের গাম্ভীর্যতা বুঝতে আমার একদম সময় লাগলো না৷ আমি চোখ তুলে তাকালাম৷ আশেপাশে তাকিয়ে রাহাতকে খুজলাম৷ আমাদের থেকে একহাত দূরেই বট গাছের পাশেই রাহাত দাঁড়িয়ে আছে আমার সাথে চোখাচোখি হতেই ইশারায় বোঝায়, ” আমি কিছু বলি নাই!” আমি সাহস নিয়ে সরাসরি মুখে হাসি টেনে বললাম,
–‘ নীতির বাসায় ছিলাম আব্বু! ‘
আব্বু সরু চোখে তাকিয়ে আছে৷ শাসনের সময় শাসন আর ভালোবাসার ক্ষেত্রে মন উজাড় করে ভালোবাসতে পারে আব্বু৷ তবে মিথ্যা বলা একদম অপছন্দের তালিকায়৷ আমার উক্ত মিথ্যা কথা যে কোনো মূহুর্তেই ধরা পরে যেতে পারে ভেবেই ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো৷ আমার মাথায় হাত দিয়ে গম্ভীর কন্ঠেই আবার বলল,
–‘ মাথায় আঘাত পেয়েছো কি করে?? নীতির বাসায় কার অনুমতি নিয়ে গিয়েছো?? আব্দুল মান্নান স্যার কাল আমাকে না বললে সম্পূর্ণ ব্যাপার এড়িয়ে যেতে এতো বড় হয়ে গেছো তুমি??’

আমি আবারও রাহাতের দিকে তাকালাম ও কি বুঝলো কে জানে! শুধু আবারো ইশারায় বলল, ” চালিয়ে যা আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি! ”
আমি আবারো শুকনো ঢোক গিলে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললাম,
–‘ ওর বাসায় কেউ নেই এইজন্যই গিয়েছিলাম আর তুমি তো জানোই ওর আব্বু অসুস্থ তাই…! ‘
–‘ বাসায় চলো! এই অসুস্থ শরীর নিয়ে হলে থাকতে হবে না৷ ‘
–‘ বাসায় গিয়ে রেস্ট নেওয়া বেটার বাট সামনে তোমাদের সেমিস্টার এক্সাম! প্রিপারেশন তো জিরো৷’ স্নিগ্ধ স্যার পাশ থেকে বলতেই আমার বুকের মাঝে ধড়ফড় করে উঠে৷ এই বুঝি আব্বু সব ধরে ফেললো৷ লোকটার আবার কথা বলতে হবে কেন?? দাঁড়িয়ে আছেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন তা নয়৷ আব্বু মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই আমি আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
‘ আ..আ..আমাদের ই..ংরেজি স্যার৷ ‘ আমার কথা শুনে স্নিগ্ধ স্যার আড়চোখে তাকিয়ে আছেন৷ তারপর আব্বুর দিকে তাকিয়ে মুখে হাসিরে রেখা টেনে বিনম্র ভাবে বললেন, ‘ আসসালামু আলাইকুম ! ভালো আছেন?? ‘
আব্বু যেন মূহুর্তে গলে গেলো৷ সালামের জবাব দিয়ে গলার স্বর নরম করে বলল,
–‘ ইংরেজিতে ওর মনোযোগ কেমন?? ‘

–‘ বেশি ভালোও বলা যায় না আবার খারাপের খাতায় ফেলা যায় না৷ ‘

–‘ আপনি দেখিয়ে দিয়েন ভালো ভাবে৷ ‘ আব্বুর কথা শুনে হাফ ছাড়লাম আমি৷ যাক আমাদের তাহলে একসাথে দেখেন নি৷ তবে তাদের কথাবার্তা শুনে ক্লাস থ্রির বাচ্চাদের কাতারর ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছে আমার !
আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি৷ ভার্সিটি সম্মেলনে আব্বু এসেছিলো৷ প্রতিবছর আসেন৷ আব্দুল মান্নার স্যার যিনি আমাদের ভিসি সে আর আব্বু ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলেন৷ এখনো আছেন৷ সেই জন্যই আব্বুকে যেকোনো ফাংশনে আলাদা ভাবে ইনভাইট করা হয়৷
এইসব বিষয় গুলো একদম আমার মাথায় ছিলো না৷ কাল মনে হয়,স্যার ফোন দিয়ে বলেছেন৷
–‘ চলো বাসায় ফেরা যাক৷ ‘
–‘ তুমি যাও আমি রাহাতের সাথে দেখা করে আসছি৷ ‘ আমার কথা শুনে আব্বু স্নিগ্ধ স্যারের থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেলেন৷ আমি রাহাতের দিকে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে থমথমে গলায় উনি বলে উঠলেন,’ বাসায় না গেলে হয় না?? ‘
আমি চমকে উঠলাম৷ কেমন ব্যাকুল কন্ঠ! সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো৷ হঠাৎ কেন এতো ব্যাকুলতা উনার কন্ঠে৷ আমি না বোঝার ভান করে বললাম, ‘ কেন?? ‘
–‘ সেমিস্টারের চাপ সামলাতে পারবে তো?? ‘
–‘ পারবো৷ ভালো থাকবেন স্যার! আর ধন্যবাদ আমার খেয়াল রাখার জন্য৷ ‘
–‘ নিজের খেয়াল রেখো৷ ‘
উনার কথার পৃষ্ঠে কি জবাব দিবো খুজে না পেয়ে আমি এগিয়ে গেলাম৷ অনুভূতি আবার জড়ো করবো! দু’হাত মেলে দাঁড়াবো! শুধু সময় গুলো নিজেদের রঙে মেতে উঠুক৷
_________________________________
প্রকৃতি কেমন উদাস৷ চারদিকে উদাসীনতা৷ আমি ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছি৷ ঝিমিয়ে থাকা গাছ গুলো দমকা হাওয়ায় কেঁপে উঠছে ৷ শুভ্র প্রেমিক স্নিগ্ধ স্যার??কিন্তু কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়৷ আমার মনের মাঝের সুপ্ত অনুভূতি গুলো সতেজ৷ সেই অচেনা অজানা মানুষটাকে হুট করেই অনুভূতি নামক বেড়াজালে বেঁধে ফেলেছি৷
নীতির সাথে আলোচনা করতে হবে৷ তবে মানুষটা যদি স্নিগ্ধ স্যার না হয়?? তাহলে কি আমি বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারবো??
মনের আজগুবি কথা গুলো শুনে নিজেই হেঁসে উঠলাম৷ সম্পর্কের নাম নেই সেটার আবার বিচ্ছেদ৷
–‘ ওই একা একা কার সাথে হাসছিস৷ ‘ আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম রাফিন এসে দাঁড়িয়েছে৷ ক্লাস টেনে পড়া বড় ভাই আমার৷ যে কেও দেখলে বলবে আমার বড় ভাই! গুণে গুণে আমার চেয়ে চার বছরের ছোট৷ ও আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে৷ আমি উদাস ভাবে বললাম,
–‘ তোর বউয়ের সাথে! ‘
–‘ মাথা ফাটালি কি করে?? ‘
আমি সরাসরি ওর দিকে তাকালাম৷ মূহুর্তেই ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘ হঠাৎ আমার জন্য এতো দরদ?? ‘
–‘ কয়দিন পর আব্বু তোর বিয়েশাদি দিয়ে দিবে৷ বুঝিস না,আমার তো একটা দায়িত্ব আছে৷ শেষে দেখা গেলো,মাথা ফাঁটা মেয়ে কেও বিয়েই করলো না৷ ‘
রাফিনের কথা শুনে দুম করে পিঠে কিল বসিয়ে দিলাম৷ সব সময় আজাইরা কথা বলে৷ আমার হাতের মার খেয়ে হেসে উঠলো জোরে৷ তারপর ফিসফিস করে বলল,’ গোপন সংবাদ দেই৷ মায়ের ফুপু মানে ওই ফ্যাসফ্যাসে মহিলা তোর জন্য জাপানি ছেলে এনেছেন৷ এইবার বোধহয় বিয়েটা হয়েই যাবে৷ ‘
আমি ওর কথায় পাত্তা দিলাম না৷ সারাদিন এইসব নিয়েই পরে থাকে৷ ও আমার থেকে এই বিষয়ে জবাব না পেয়ে দমে গেলো৷ কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে যাওয়ার জন্য পাঁ বাড়িয়েই একটানে আমার চুলে খোঁপা খুলে দিয়ে দৌড়ে পালালো৷ আমি চিৎকার করে উঠতেই নিচে নামতে নামতে বলল,’ তোর মাতা ভোজনের জন্য ডাকে৷ ‘
আমিও ওর পিছে দৌড় লাগাই৷ আজ ওর মাথার একটাও চুল আস্ত রাখবো না৷ মাথা ব্যথায় টনটন করছে তার মধ্যে টান ঝমঝমিয়ে মাথা ব্যথা দ্বীগুণ হারে বেড়ে গেলো ৷ হঠাৎ করেই মনে হলো কেও বলল,’ নিজের খেয়াল রাখতে পারো না?? ‘
আমি ঘুরে তাকালাম৷ স্পষ্ট স্নিগ্ধ স্যারের আওয়াজ৷ কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই৷ তবে কি আমিও ভালোবেসে ফেলছি তাকে?? এইজন্যই এমন হচ্ছে??
____________________________
–‘ আম্মু আমি কাল যাবোই যাবো ভার্সিটি! ‘
–‘ তোর আব্বু জানে৷ ‘ আম্মুর জবাব শুনে বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে এলো৷ গত দুইদিন যাবৎ নাটক শুরু হয়েছে৷ বুঝি না ভার্সিটি কেন যেতে দিচ্ছে না৷ আর এইদিকে নীতি ফোনের উপর ফোন দিচ্ছে ৷ আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে কাট কাট গলায় বললাম,’ কাল সকাল হবে আর এই বাড়ি ছেড়ে আমি চলে যাবো৷ বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি! ‘
–‘ একদম চুপ! বেশি বেড়েছিস৷ ‘
–‘ কাল আমি যাবোই যাবো৷ ‘
বলেই হনহন করে রুমে ঢুকে দরজা ঠাস করে লাগিয়ে দিলাম৷
–‘ ভেঙে ফেল তোর বাপের টাকায় কেনা৷ ‘
আমি জবাব দিলাম না৷ মনের মাঝে শূন্যতা বিরাজ করছে৷ গত চারটা দিন বাড়িতে একদম মন টিকছে না আমার৷ বিষাক্ত লাগছে সব৷
আমি মাথায় হাত দিয়ে বেডে বসতেই মোবাইল উচ্চশব্দে বেজে উঠে৷ নীতির নাম দেখে রিসিভ করেই খিটখিটে মেজাজে বললাম, ‘ ফোন দিচ্ছিস কেন?? ‘
–‘ দোস্ত,স্নিগ্ধ স্যার তোর খোজে তিনবার আসলো৷’
বিষ্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে গিয়েছে৷ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘ কেন?? দরকার কি?? ‘
–‘ ইম্পোর্ট্যান্ট কি যেন বলবেন৷ ‘
গলার স্বর নরম করে বললাম, ‘ আর কিছু বলেছেন?? ‘
–‘না! শুধু তোর নাম্বার আর বাসার এড্রেস নিয়ে গেছেন৷ ‘
আমি একলাফে বেড থেকে নেম দাঁড়ালাম৷ জোরে ‘ কি! ‘
–‘ স্যার মেবি তোদের বাসায় যাচ্ছে৷ ‘
আমি ফোন ছুড়ে ফেললাম৷ বাসায় আসছেন মানে?? কি বলতে আসছেন৷
আজ কিছু একটা হবেই হবে!! আমি তো কাল ভার্সিটি যেতাম তাহলে! ধূর সে কী ভাবে জানবে আমি কাল যাবো৷
আসলে কি বলবো বাসায়?? এতো ব্যাকুল কেন উনি?? কি এমন ইম্পোর্ট্যান্ট কথা যা বাড়ি বয়ে এসে বলবেন??

আমি চুপিচুপি ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছি৷ এখান থেকে স্পষ্ট মেইন রোড দেখা যায়৷
কাঁপা হাতে মোবাইল দেখলাম,১০ঃ১৩ বাজে! বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটা শব্দ হচ্ছে৷ আব্বু ভালো চোখে দেখবে না বাসায় আসাটা৷ আমি ওড়না টেনে আরো মাথা ঢেকে নিলাম৷ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি আর দোয়া করছি রাত বারোটা যেন পার হয়ে যায় আর সে যেন না আসে৷
আমার আশায় বালি ঢেলে দিয়ে বাসার সামনে সাদা রঙের গাড়ি শব্দহীন ভাবে দাঁড়ায়৷ আমি স্কার্টটা শক্ত করে ধরি!
মনে হচ্ছে সে আমার গুপ্ত প্রেমিক! যে কেও দেখলে সর্বনাশ হবে৷
গাড়ির দরজা খুজে সে দাঁড়ায়৷ ধূসর রাঙা শার্টটা আজ কুঁচকানো৷ হাতা ফোল্ড তবে অগোছালো৷ সোডিয়ামের আলোয় এক নজর দেখে আমার বুকের মাঝে ধড়াস করে উঠে৷ কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে৷
আমার ভাবনার মাঝেই সশব্দে ফোন বেজে উঠতেই কেঁপে উঠি আমি৷ নিচে তাকিয়ে দেখি সে ফোন হাতে ব্যস্ত চোখে চারদিকে কাউকে খুজছে৷
ফোন তুমুল আওয়াজ তুলে থেমে গেলো৷ আবার বেজে উঠতেই আমি ভড়কে গিয়ে রিসিভ করি৷ তাকিয়ে দেখি উনি হাসছেন৷ আজকের হাসিতেও ক্লান্তি ভরা৷ যেন কত জনমের ক্লান্তি তার ঠোঁটে ভীর করেছে৷ আমি কানে নিতেই ওইপাশের দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসলো৷ সেই উষ্ণ নিঃশ্বাস মনে হচ্ছে আমার,চোখ-মুখ ছুঁয়ে দিলো৷ আমি আবারো কেঁপে উঠলাম৷ কিন্তু কিছু বললাম না৷ ওইপাশে থেকে ক্লান্তি মাখা গলায় সে বলে উঠলো,
–‘ একবার আসবে! আবদার টা রাখবে? ‘
আমার কি হলো কে জানে! উনার স্নিগ্ধ কন্ঠে হু হু করে কেঁদে উঠলাম৷
যাওয়া ঠিক হবে?? কিন্তু আমার যে যেতেই হবে৷ আবদার রাখবো কিন্তু আবদার টা জীবনের পাতায় আছড়ে পড়বে কে ভেবেছিলো???

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here