শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়-১৮ সমাপ্তি

#শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়-১৮ সমাপ্তি
Sadia afrin nishi

বাড়ির বড় লোহার গেটটির সামনে দাড়িয়ে আছি।এই বাড়িতে পা রাখতে আমার এখন আর মন চায় না। সাক্ষর ছাড়া সবকিছু কেমন অগোছালো, নিষ্প্রাণ মনে হয়। একা একা এই ভুতুড়ে বাড়িতে নিজেকে কেমন জানি মনে হয় ভুতের সর্দারনী। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেটের তালা খুলে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাম। ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠে নিজের রুমে চলে এলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পরলাম। বেশি সময় শুয়ে থাকা সম্ভব হল না। ক্ষুধার আভাস পেতেই শোয়া থেকে উঠে অগ্রসর হলাম কিচেনের দিকে। সারাদিন কাজের চাপে খাওয়া দাওয়া করা হয়নি।এখন কিছু না খেলে একদমই চলবে না। ভাত আর আলু সেদ্ধ চাপিয়ে দিলাম চুলায়।সাক্ষরের জন্য খারাপ লাগছে ওই জেল খানার খাবার খেতে হয়তো খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কালই কিছু ভালমন্দ রান্না করে দিয়ে আসবো।

ভাতের সঙ্গে আলু ভর্তা মিলিয়ে খেয়ে নিলাম। তারপর বিছানায় শুয়ে এপিঠ-ওপিঠ করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম।

———————-

ভোরের আলো ফুটতেই উঠে পরলাম। নামাজ পড়ে, কোরআন তেলওয়াত শেষ করে কিছু হালকা নাস্তা করে নিলাম। তারপর সাক্ষরের পছন্দ মতো কিছু খাবার আইটেম তৈরি করে নিলাম। এগারো নাগাদ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরলাম খাবারগুলো নিয়ে।আগে খাবারগুলো সাক্ষরকে পৌঁছে দিয়ে তারপর ইনভেস্টিগেশনে যাব। সাক্ষর যে নির্দোষ তা সবাই জানে। এজন্য ওর কেসটা এখানো কোর্টে চালান দেওয়া হয়নি।এটা অবশ্য অফিসার মাইনুল হাসান স্যারের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তিনি সাক্ষরের ফিউচারের কথা চিন্তা করে সুযোগ দিয়েছেন। সাক্ষরকে এখন কোর্টে চালান করলে কোনো দোষ না থাকা সত্বেও তার রেপুটেশনে দাগ লাগবে এজন্যই তার এই সিদ্ধান্ত।

সাক্ষরকে খাবারগুলো পৌঁছে দিয়ে এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করলাম না তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম ব্যারিস্টারের কাছে। ব্যারিস্টারকে বললাম আমার নেক্সট প্ল্যান সম্পর্কে,,

_”আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে।আমাদের আরও একবার এমপির সঙ্গে কথা বলতে হবে। এমপিকে বোঝাতে হবে আমরা তাকে সাহায্য করতে এসেছি।এমপিকে রাজি করিয়ে তার শরীরে সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে।তাহলে ক্রিমিনালের নাগাল খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব। যেহেতু ক্রিমিনালের নেক্সট টার্গেট এমপি হতে পারে সেহেতু এই প্ল্যানটা যথাযথ হবে বলে মনে করছি।”

আমার কথা শুনে ব্যারিস্টার সাহেবও রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু প্রবলেম তো একটাই আর তা হলো এমপি। তিনি কী রাজি হবেন এমনটা করতে? যে করেই হোক তাকে রাজি করাতেই হবে নয়তো সবার জন্য বিপদ।

———————

অনেক বোঝানোর পর এমপিকে বোঝাতে সক্ষম হলাম আমরা। এমপির মত পাওয়া মাত্র আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে এমপিকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে এমপির শরীরের সঙ্গে সিসি ক্যামেরা ফিট করে দেওয়া হলো এবং সেটার কানেকশন ল্যাপটপের সঙ্গে নিযুক্ত করা হলো। এমপি আমাদের কাজে বিরক্ত হলেও তেমন কিছু বলছেন না কারণ জানের মায়া সবারই আছে।

আজকে দিনের মতো যে যার বাড়ি চলে গেলাম। এভাবেই দিন চলতে লাগল।ক্যালেন্ডারের পাতায় যোগ হলো আরও তিনদিন। এখন পর্যন্ত আমরা খুনিকে ধরার কোনো ক্লু ই খুঁজে বের করতে পারিনি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশপানে মুখ করে ভাবছিলাম কিছু পুরোনো স্মৃতি ঠিক তখনই ফোনের রিংটোন টা বেজে উঠল। ফোনের স্কিনে ব্যারিস্টার বাবু নামটা দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করে নিলাম। এত সকালে ওনার ফোন করার হেতুটা ঠিক আমার বোধগম্য নহে।ফোন রিসিভ করতেই ব্যারিস্টার বাবু বললেন এমপি সাহেব মিসিং। ব্যারিস্টার বাবুর কথা শুনে আমি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।কারণ আমাদের প্ল্যান হয়তো এবার সাকসেসফুল হতে চলেছে।সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি চলে গেলাম ব্যারিস্টার সাহেবের অফিসে।সেখানে অভিসার মাইনুল হাসান স্যারকেও ডেকে নিলাম।

তিনজন গভীর মনোযোগ নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে আছি। এই জায়গাটা ঠিক কোথায় বুঝতে পারছি না। তার কারণ হলো ল্যাপটপে সবটাই অন্ধকার আসছে। হয়তো এমপি সাহেব যেখানে আছেন সেখানে কোনো পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়নি।এখন আমরা অপেক্ষা করছি কখন আলো আসবে আর আমাদের সামনে সবকিছু কখন পরিষ্কার হবে তারজন্য।

কিছুক্ষণ পরেই চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল।এমপি সাহেবকে এবার আমরা স্পষ্ট দেখতে পারছি। এমপি সাহেব হাত,মুখ বাঁধা অবস্থায় নিচে পড়ে আছে। তার কিছুক্ষণ পরেই এমপির সামনে একজন হুডি পরিহিত লোক এসে বসে পরল। উল্টোদিকে হওয়ায় তার মুখ এখনো আমরা দেখতে পারিনি। লোকটা সামনে যেতেই এমপি সাহেব কেমন ছটফট করতে লাগলেন।এমপি সাহেবের এমন ছটফটানি দেখে সামনের লোকটি উচ্চস্বরে হেসে উঠল তারপর এমপি সাহেবের মুখের বাঁধন খুলে দিল। মুখ খোলা পেয়ে এমপি সাহেব ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে সামনে থাকা লোকটির উদ্দেশ্যে বললেন,,

_তুতততই বেঁচে আছিস। কিন্তু কীভাবে সম্ভব। নুহাশ তো বলেছিল তোকে খতম করে দিয়েছে তাহলে তুই এখানে কীভাবে ? আমার দলের সবাইকে তাহলে তুইই মেরেছিল?

লোকটা হয়তো এমপির কথা শুনে খুব মজা পেল।সে ক্রমান্বয়ে হেসে হেসে বলতে লাগল,,

_বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি। আমার তৈরিকৃত ঔষধের অপব্যবহার করে টাকা কামানো অতটা সহজ নয়। তুই যে দয়ালু এমপি রুপী কতোবড় একজন মুখোশধারী শয়তান তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। তুই আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছিস। আমার লাইফ, আমার ক্যারিয়ার,আমার লক্ষ্য, আমার আবিষ্কার এমনকি আমার কাছ থেকে আমার একমাত্র ভাইকেও আলাদা করেছিস।তোকে আমি বাঁচতে দেব না। তোর মরণ আমার হাতেই অনিবার্য। একে একে তোর সব সেনাসৈন্যদের আমি শেষ করে দিয়েছি। এবার তোর পালা। তোকে নিজের হাতে শেষ করে আমি আমার প্রতিশোধ সমাপ্ত করবো। তোর মৃত্যু হবে সবার থেকে ভয়ংকরভাবে। তোকে মেরে আমি নিজেই পুলিশের কাছে স্যালেন্ডার করব।তোর জন্য অনেকগুলো সম্পর্কের ছেদ হয়েছে, অনেকে বিনা কারণে কষ্ট পাচ্ছে।আমার জীবন তো শেষ হয়েই গেছে তা নিয়ে আমি আর ভাবি না কিন্তু যারা নিষ্পাপ তাদেরকে আমি কিছুতেই আমার মতো পরিস্থিতিতে পরে খারাপ হতে দিব না। সো এবার তৈরি হয়ে নে।তোর মতো জানোয়ারের মৃত্যু এবার আগত। এই দুনিয়া থেকে পাপ মোচনের সময় এবার চলে এসেছে।

এতটুকু বলে লোকটা ঘুরে তাকাল। উপস্থিত লোকটির মুখ দেখে আমরা সকলেই চরম আশ্চর্য। এটা তো সাক্ষরের ভাই সার্থক। যাকে সাক্ষর নিখোঁজ বলে দাবি করে। তারমানে সার্থক এই খুনগুলো করছে।কিন্তু কেন? কীসের এতো রাগ সার্থকের এমপির ওপর।এমপি কী এমন ক্ষতি করেছে সার্থকের।

গুলির শব্দ কানে বাজতেই ভাবনা থেকে বেড়িয়ে ল্যাপটপে দৃষ্টি দিলাম। আমাদের চোখের সামনেই সার্থক এমপিকে ভয়াবহ মৃত্যু উপহার দিল কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না। শুধু মুখ বুজে চাপা আর্তনাদ করলাম। খুন করা শেষ হলে সার্থক এমপির লাশটা গাড়িতে তুলে নিল।তারপর গাড়ি চালাতে শুরু করল।

ল্যাপটপ বন্ধ করে আমরা সকলে একটা দীর্ঘ-শ্বাস টানলাম। এখন কী হবে তা আমাদের জানা। সার্থক এখন লাশটা নিয়ে সোজা খানায় যাবে তা সে একটু আগেই বলেছে।এজন্য আমরাও এখন থানার উদ্দেশ্যে বেড়নো জরুরি মনে করছি। তিনজন রওনা দিয়ে দিলাম গন্তব্য থানায়।

থানায় পৌঁছে দেখলাম সার্থক পুলিশের সামনে আগে থেকেই স্যালেন্ডার করে বসে আছে। আমরা ঢুকতেই কনস্টেবল এনায়েত এসে অফিসার মাইনুল হাসানকে বলল,,

_স্যার এই লোকটা নাকি খুনি। উনি নিজে থেকে সবটা স্বীকার করছেন। ওনাকে কী এ্যারেস্ট করব স্যার?

অফিসার কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করে বললেন,,

_আমি দেখছি তোমরা তোমাদের কাজ করো।

এখন আমাদের সামনে ক্লিয়ার সার্থকই খুনগুলো করেছে। আসল অপরাধী কে তা তো জানা গেল কিন্তু একটা ব্রিলিয়ান্ট গ্রেটফুল ছেলে কেন এমন বিপথে অগ্রসর হলো তা তো এখনো জানার বাকি আছে। সাক্ষর নিজের ভাইয়ের এমন অবনতি দেখে কেমন রিয়েক্ট করবে সেটাও তো ভাবনার বিষয়। সবকিছু সমাধান হয়েও অনেক কিছু এখানো অন্ধকারে রয়ে গেছে।

চলবে,

#শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়
(সমাপ্তি পর্ব)
Sadia afrin nishi
____________________________

সার্থককে জেল হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল তাকে কোর্টে চালান করা হবে। সাক্ষরকেও মুক্ত করা হয়েছে।সাক্ষর মুক্ত হওয়ার পর আমরা সব ঘটনা তাকে খুলে বলেছি কিন্তু সে তার ভাইয়ের এরুপ অপকর্ম মানতে নারাজ। সাক্ষর শুধু বারংবার সার্থকের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে কিন্তু সার্থক দেখা করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সার্থক বলছে তার যা বলার একবারে আদালতে দাঁড়িয়ে বলবে।

অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে সাক্ষরকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। বাড়িতে এসেও সাক্ষর একদমই স্বাভাবিক নেই।শুধু পাগলের মতো আচরণ করছে একটি বার সার্থকের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সাক্ষরের মতো একজন দক্ষ পুলিশ অফিসারকে সামলাতে কী না আমার মতো একটা পুচকে মেয়ের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের মতো কোনো মতে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সাক্ষরকে ফ্রেশ করে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।এবার আমারও ফ্রেশ হওয়া দরকার।

——————–

আদালতে উপস্থিত সবার নজর এখন সার্থকের দিকে।সার্থকের মুখ থেকেই এবার সত্যিটা জানার পালা। সাক্ষর আমার পাশে বসে ছলছল দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে সার্থকের দিকে। আমি বুঝতে পারছি সাক্ষরের কষ্টটা। বাবা-মা মরা দুই ভাই ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হয়ে চোখের সামনে একজন আরেকজনের শাস্তি কী করে সহ্য করবে?

জর্জের অনুমতি পেয়ে সার্থক বলতে শুরু করল,,

_আমি একজন সহজসরল পড়ুয়া টাইপ ছেলে ছিলাম। সবসময় লেখাপড়া করে দেশের জন্য কিছু করতে চাইতাম। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি সাইন্সের স্টুডেন্ট ছিলাম। ইচ্ছে ছিল গবেষণা করে ক্যান্সারের ঔষধ তৈরি করে দেশের মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করব। প্রায় সম্পন্ন করেও ফেলেছিলাম আমি আমার আবিষ্কার কিন্তু হঠাৎ একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে কিছু মুখোশধারী মানুষ আমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আমি তখন প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে ওরা একটা অন্ধকার রুমের মধ্যে বন্দী করে রাখে প্রায় সাতদিন। না দেয় পানি আর না দেয় খাবার। খাদ্যের অভাবে যখন আমার জান যায় যায় অবস্থা তখন আমাকে সেই অন্ধকার ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় ওই ছদ্দবেশী শয়তান এমপির কাছে। এমপি আমাকে দেখে কেমন পৈশাচিক হাসি হাসতে হাসতে বলল,,_”তোর ভাই সাক্ষর নাকি আমার সব কুকীর্তি ফাঁস করে দিবে। তাহলে আমি কী করে সব মুখ বুজে সহ্য করি বল।আমিও তোকে তুলে নিয়ে এসেছি। এখন তোকে টর্চার করে তোর ভাইয়ের মুখ বন্ধ করব।আর একটা উপায় আছে তোর মুক্তির জন্য। সেটা হলো তোর ওই আবিষ্কার। ক্যান্সারের ঔষধ তৈরির ফর্মুলা যদি তুই আমাকে দিয়ে দিস তাহলে কথা দিলাম তোকে মুক্ত করে দিবো।” এমপির কথা শুনে আমি না না বলে চিৎকার দিয়ে বললাম,_”নাহ আমি আমার আবিষ্কার কিছুতেই তোর মতো শয়তানের হাতে তুলে দিবো না। দরকার হলে প্রাণ দিবো তবুও তোকে ফর্মুলা দিব না।” আমার এই “না” শব্দটাই আমার জন্য কাল হলো।তারপর থেকে শুরু হলো আমার ওপর ওদের নির্মম অত্যাচার।কখনো রড দিয়ে পেটাতো,কখনো কারেন্ট শক দিত,কখনো গরম পানি গাঁয়ে ঢেলে দিত,কখনো লোহার সিক গরম করে ছেঁকা দিত, আরও আরও নানাপ্রকারের ভয়াবহ অত্যাচার করত। আমার আর তখন বাঁচার বিন্দুমাত্র ভরসা ছিল না। কিন্তু একদিন ওই এমপির বাড়ির রাধুনি যে আমাকে মাঝে মাঝে খাবার পৌঁছে দিত তার এসব দেখে আমার প্রতি মায়া হলো।তিনি আমাকে ওখান থেকে পালাতে সাহায্য করলেন।কিন্তু আমার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে আমি এক কদম পা ফেলতে পারছিলাম না। তারপর তিনি আমার এই অবস্থা দেখে আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেবা করে সুস্থ করে তোলে।উনি আমাকে সুস্থ হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে যেতে বলেছিলেন কিন্তু আমি তখন প্রতিজ্ঞা করি আগে আমি সব শয়তানদের শাস্তি দিব তারপর বাড়ি ফিরব।প্রতিজ্ঞা মোতাবেক সব কয়টা অপরাধীকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছি। এখন আমি তৃপ্ত। আমার সেই আবিষ্কার এখনো অসমাপ্তই রয়ে গেছে।জর্জ সাহেব, আপনি যদি অনুমতি দেন তো আমার শাস্তি ঘোষণা করার পর আমি জেলখানায় বসে আমার সেই রিসার্চ কম্পিলিট করতে চাই। আমার বলা শেষ। এবার ডিসিশন আপনাদের। আমি আমার শাস্তির ব্যাপারে কোনো রকম সুপারিশ করব না। আমি জানি আমি অপরাধ করেছি। আমার শাস্তি মৃত্যুদন্ডই হবে। কিন্তু আইনের চোখে আমি অপরাধী হলেও আমার আদালতে তারাই অপরাধী যাদের অপরাধ দমন করতে গিয়ে আমি আজ অপরাধীর খাতায় নাম লিখিয়েছি।

এবার খোলাসা হলো সব রহস্যের জাল। সবার চোখে পানি। এখন জর্জ সাহেব কী রায় দিবেন তা সবারই জানা। এতগুলো খুন করে কেউই ছাড়া পেতে পারে না। আইন আইনের নিয়মেই চলবে। আইনের কাছে আপন-পর ফ্যাক্ট নয় ফ্যাক্ট শুধু ন্যায়-অন্যায়। সার্থক যদি আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে সাক্ষরের সাহায্য নিয়ে অপরাধীদের শাস্তি দিত তাহলে তার জীবনে হয়তো আবার সুখের দিন ফিরে আসত। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। অন্যায়ের শাস্তি তাকেও পেতে হবে।

শেষমেষ জর্জ রায় দিয়েই দিলেন। রিসার্চের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। রিসার্চটা তাকে জেলে বসেই করতে হবে। জেলের একটা ঘর তার রিসার্চের জন্য বরাদ্দ করা হলো। রিসার্চ যতদিন চলবে সার্থকের জীবন ততদিন টিকে থাকবে। তারপর সব শেষ।

——————–

জীবন এগিয়ে চলছে জীবনের নিয়মে।সময় এগিয়ে চলছে সময়ের নিয়মে।আর আমরা এগিয়ে চলছি মনের সাথে যুদ্ধ করে। সার্থকের রিসার্চ কম্পিলিট হয়ে গেছে আরও দুমাস আগে তারপর তার ফাঁসি। ফাঁসির আগ পর্যন্ত সার্থক সাক্ষরের সঙ্গে একটিবারও দেখা করে নি।হয়তো অভিমান জন্মে ছিল ভাই হয়ে কেন তাকে রক্ষা করতে পারল না প্রথম থেকে। সাক্ষর এখন আর আগের মতো নেই। নিজের কাজের প্রতিও কোনো ইন্টারেস্ট দেখায় না। হয়তো ভাইকে রক্ষা করতে না পারার অক্ষমতার জন্যই তার এই বেপরোয়া ভাব। আমাকেই এখন সবদিকটা দেখতে হচ্ছে। সরকার থেকে নিজের কাজের জন্য পরিপূর্ণ সার্টিফিকেট পেয়েছি। একটা আলাদা অফিস আছে আমার। সারাদিন সাক্ষরের দেখা শুনা করে কাজে কনসালট্যান্ট করার সময় খুবই কম পাচ্ছি। সার্থকের জন্য আমারও প্রচুর খারাপ লাগে। একটা সহজ সরল ছেলের এমন নির্মম পতন সত্যিই গ্রহণের অযোগ্য।

🍁পরিশিষ্টঃ
__________

পেটে হাত রেখে ব্যথায় ছটফট করছি।আজকে আমার ডেলিভারি ডেট। সেদিনের পর থেকে কেটে গেছে ছয়টি বছর। এখন সবকিছুই স্বাভাবিক। আমাদের একটা তিন বছরের কন্যা সন্তান আছে আর এবার কে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য তা শুধু ওপর ওয়ালাই জানেন।তবে ছেলে মেয়ে যাই হোক আমরা তাতেই খুশি। সাক্ষর এখন পুরোপুরি আগের মতো হয়ে গেছে তবে প্রায়ই মধ্যরাতে বেলকনির করিডোরে দাড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে দেখি।হয়তো সেই পানি সার্থকের নামে ঝরে। আমিও তাকে আটকাই না। মনের ভেতরে কষ্ট চেপে না রেখে তা কান্নার মাধ্যমে বিসর্জন দেওয়াই ভালো। তাতে অন্তত মনটা একটু হালকা হয়।

সুস্থ সবল একটা ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় আমি। সাক্ষর খুব চিন্তায় ছিল আমাকে নিয়ে। বিগত কিছুদিন ধরে আমি এই অসুস্থতার সময়েও কাজ করে গেছি। একদম গোয়েন্দাগিন্নির মতো সবদিক নিজহাতে সামলাই।আমার মেয়ের নাম সাক্ষী আর ছেলের নামটাও মেয়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সাম্য রাখলাম। সাক্ষী খুবই ভদ্র এবং বুদ্ধিমতী। সাক্ষর বলে সাক্ষী নাকি আমার মতো স্বভাব পেয়েছে।এখন শরৎকাল। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো রাশি রাশি শুভ্ররঙা মেঘের আনাগোনা। আমি এক দৃষ্টি নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছি তখনই পেছন থেকে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আমাকে দু-হাতে আঁকড়ে নিল।আমি আকাশের দিকে চেয়ে থেকেই কিঞ্চিৎ হাসলাম।সাক্ষর আমার কাঁধে মুখ গুজে দিয়ে বলল,,

_”এমনি এক শরতের দিনে তুমি আমার জীবনে এসেছিলে। তারপর কতগুলো শরত পেরিয়েছে। এখানে যেমন এই #শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায় ভেসে ভেসে মেঘেদের আসা যাওয়া চলে ঠিক সেভাবেই আমাদের জীবনেও কখনো সুখ কখনো, দুঃখ এসে ভীড় জমায়।তোমাকে পেয়ে আমি পূর্ণ। তুমি আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা নিহুপাখি।অনেক বেশি ভালবাসি তোমায়। কখনো হারাতে চাই না।”

সাক্ষরের কথা শুনে মৃদু হাসির রেখা টেনে বললাম,,
_আমিও ভালবাসি খুব খুব খুব বেশিই ভালবাসি। আপনি হারাতে চাইলেও কখনো আপনাকে হারাতে দিব না। আপনি আমার জীবনের সুখের প্রদীপ। আপনাকে ছাড়া তো আমি অন্ধকারে ডুবে মরব।

_এসব কথা বল না নিহুপাখি। তুমি আর বাচ্চারা ছাড়া আমার এখন আর কেউ নেই। তোমরাই আমার সব।মরার কথা মনের ভুলেও মুখে উচ্চারণ করবে না।

_আচ্ছা করব না এখন সরুন তো বাচ্চারা কী করছে চলুন দেখি গিয়ে।

_হুম চলো

——————–

আজ শুক্রবার। আমার আর সাক্ষরের দু’জনেরই অফিস ছুটি তাই বাচ্চাদের সাথে করে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছি। সারাদিন খুব আনন্দে কাটল দিনটি। সাম্য এখনো কথা বলতে পারে না শুধু হাত নেড়ে হেসে হেসে খেলা করে। ঘুরাঘুরি শেষে সাক্ষর বলল, “তোমাদের আজকে এক জায়গায় নিয়ে যাব চলো।” সাক্ষরের অফার শুনে সাক্ষী বলল, আমলা কুতায় দাবো পাপা(আমরা কোথায় যাব পাপা)।সাক্ষর বলল,,গেলেই দেখতে পাবে সোনা।

সাক্ষর আমাদের সার্থকের কবরের সামনে এনে দাড় করাল। আমি কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইলাম কবরটির দিকে। সার্থক ঘুমিয়ে আছে চিরতরে। আমার ছোট্ট মেয়েটি কী বুঝল কে জানে, সেও হেঁটে গিয়ে কবরের মাটি আলতো হাতে স্পর্শ করল। রক্তের টান বলে কথা। সার্থক বেঁচে থাকলে কতই না সুন্দর একটা ফ্যামিলি হতো আমাদের।সাক্ষী, সাম্যকে সে নিশ্চয়ই অনেক আদর করত।সাক্ষরও চেয়ে আছে এক ধ্যানে কবরের দিকে।সার্থকের পছন্দের কিছু কাঠগোলাপ সাক্ষর আগে থেকেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল।এখন সেগুলো সুন্দর করে তার সমাধিতে পরিয়ে দিল।ভাইয়ের চোখের জল আর কাঠগোলাপে সজ্জিত হলো আরেক ভাইয়ের সমাধি। আমি ছোট্ট সাম্যকে বুকে জড়িয়ে আর সাক্ষীকে এক হাতে আঁকড়ে ধরে নিরবে চোখের জল ফেলছি।

মানুষের জীবন বরই বিচিত্রপূর্ণ, আজ আছে তো কাল নেই। আমার বাবা-মা,দাদু,পালিত বাবা,সার্থক তাদের ছাড়াই আমাদের জীবন এগিয়ে চলছে। আপন মানুষগুলোর জন্য কষ্ট হয়, ভীষণ রকম কষ্ট হয় তবু্ও তা নিরবেই সয়ে যেতে হয়। আমরাও ঠিক এভাবেই হয়তো একদিন #শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায় ভেসে হারিয়ে যাব ওই দুর নীলিমার দেশে।

————–সমাপ্ত———–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here