#রাহেলার রাত দিন
১ম পর্ব
লেখা: #Masud_Rana
মাঝরাতে পানি খেতে উঠে নিজের স্বামীকে মেজো ভাবীর ঘর থেকে বের হতে দেখে চমকে উঠলো রাহেলা। মেজো ভাইয়া ৩ দিন হলো ঢাকায়। এখন ভাবি একা ঘরে। তার স্বামী এত রাতে মেজো ভাবীর ঘরে কী করতে গিয়েছিল বুঝতে কিছু বাকি থাকে না তার।
এই ঘরের দিকে স্বামীকে আসতে দেখেই দরজা বিজিয়ে দিয়ে বিছানায় উঠে ঘুমানোর অভিনয় করলো রাহেলা। তার স্বামী দরজা ঠেলে সন্তর্পণে হেটে এসে বিছানায় তার পাশে শুয়ে পড়লো। রাহেলা এই বাড়ির মেয়ে। তার স্বামী ঘরজামাই। রাহেলা জানে কোনো রকমের কুৎসা রটলেই তাকে সহ তার স্বামীকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিবে ভাইয়েরা। তাই এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বলে না রাহেলা।
পরের দিন সারাদিন মুখ কালো করে রাখলেও তার স্বামী আমজাদকে এই বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করে না সে। তারপরের রাতে রাহেলা আর কিছুতেই ঘুমাতে পারে না। তার বিশ্বাস তার মেজভাই যতদিন শহরে আছে প্রতি রাতেই বোধহয় তার স্বামী মেজো ভাবীর ঘরে গেছে। তার বিশ্বাসকে সত্যি প্রমাণিত করতেই যেন ধীরে ধীরে আমজাদ রাহেলার পাশ থেকে গড়িয়ে মেঝেতে নামল। এরপর পা টিপে টিপে ঘরের দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। রাত এখন কয়টা হবে। ১টা – ২টা।
আমজাদ কোনো কাজ না জোগাড় করতে পারায় ভাইদের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে তারা দুজন। রাহেলা আমজাদের এই অর্থ উপার্জনের অক্ষমতাটাই পুষিয়ে দেয় সারাদিন গাধার মতো বাড়ির কাজ করে। সারাদিন কাজ করায় শরীর এতই ক্লান্ত হয় যে সারারাত মরার মত ঘুমায় রাহেলা। কয়বার আমজাদ লাথি মেরেও রাহেলার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। তাই রাতে যে রাহেলা জেগে থাকতে পারে এমন কোনো ভয়ই তার ছিল না বলা যায়। তা না হলে স্ত্রীকে বিছানায় রেখে কোনো পুরুষের পক্ষে পড়ো নারীর সঙ্গে গভীর রাতে ঘন্টা কাটিয়ে আসা সম্ভব না।
আমজাদ চলে যেতেই। বালিশে মুখ গুজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো রাহেলা। সে তার স্বামীকে কত ভালবাসে। কিনা করে সারাদিন তাকে একটু আরামে রাখার জন্য, বড় ভাইদের কটু কথা থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য। আর সেই নাকি এমন বিশ্বাস-ঘাতকতা করল তার সাথে! আর মেজ ভাবিও যে এমন কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে তা তার চিন্তার বাইরে ছিল।
পরের দুই রাত অনেক চেষ্টা করেও জেগে থাকতে পারলো না রাহেলা। সারাদিনের কাজের ধকলে এতই ক্লান্ত থাকতো যে মাঝরাত পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে জেগে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
তারপরে যখন মেজোভাই চলে এলো তখন থেকে রাহেলা কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। তারও কয়েকদিন পর এক রাতে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছে রাহেলা। অনেক ধাক্কাধাক্কি করে তাকে উঠালো তার স্বামী আমজাদ। ঘুম জড়ানো ক্লান্ত কণ্ঠে রাহেলা বলল :
কী হইছে ? এত রাইতে ডাকেন কেন ?
লাইটটা একটু জ্বালাও তো রাহু।
সারাদিন কাম কইরা কুল পাইনা। উনি আছেন ফুর্তিতে। এখন ঘুমান।
আরে রাহু ! লাইট জ্বালাও না! দেখ কী দেই ।
বিরক্ত হয়েই বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালালো রাহেলা। তারপর চকিতে এসে বসল। আমজাদ তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক জোড়া চুড়ি বের করলো।
আরেকটু কাছে আসো। পড়ায়া দেই।
চুড়িগুলো দেখেই চিনলো রাহেলা এগুলো স্বর্ণের। আর এর মালিক যে মেজো ভাবি ছাড়া আর কেউ না তাও সে ভালো করে জানে। সে ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে বলল:
এগুলা তো মেজো ভাবীর। তুমি পাইলা কই ?
আরে ভয় পাইয়োনা, চুরি করি নাই। মেজো ভাবি আমারে দিছে।
বলো কী ! সে কেন দেবে ?
তোমারে একটা কথা কই? কই কই কইরাও এতদিন কইতে পারি নাই শরমে। ভাবছিলাম তুমি আমারে ভুল বুঝবা। কিন্তু তোমারে আমি কী কিছু গোপন করি বলো! ভুল বুইঝো না বউ। মেজো ভাই এইবার ঢাকায় যাওয়ার পর কয়রাত আমি মেজো ভাবীর ঘরে গেছিলাম।
এবার রাহেলার বুকটা কেঁপে উঠলো। এটাতো সে জানে। স্বামীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেয়েও সে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু এমন কথা নিজ থেকে আমজাদ কেন বলছে। কেন তাকে লজ্জ্বা দিচ্ছে। আমজাদ আবার বললো :
মেজ ভাই ঢাকা যাওয়ার পরে মেজ ভাবীর কয় রাত খুব জ্বর হইছিল । কিন্তু তার সেবা করার মতো কেউ ছিল না। তাই ভাবি কইল , দেখ আমজাদ তোরে আমি ভাইয়ের মতোই দেখি। আমার সারাদিন ভালো লাগে খালি একটু দুর্বলতা থাকে। কিন্তু রাত হইলেই জ্বর বাড়ে। তুই কী রাইতে আইসা আমার মাথায় একটু পানি ঢালতে পারবি ?
রাহেলা অবাক হয়ে বলল , আমারে কইতে পারতো। ছোট ভাবি , বড় ভাবি আছে। তোমারে কইলো কেন ? আমারে সারাদিনে জ্বরের কথা একবারও কইল না।
আমজাদ মুখটাকে মলিন করে বলল, দেখলা! সব আমার কপালের দোষ। আমি জানতাম তুমি আমারে সন্দেহ করবা। আমি কী আর মাইনষের বিশ্বাস পাওয়ার যোগ্য ?
রাহেলা এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল , নাগো আমি ঐটা বলি নাই। আমি তোমারে বিশ্বাস করুম নাতো কারে করুম কউ। তুমি ছাড়া আমার আর কেডা আছে ? তুমি আমারে ঠকাইবা ফিরিশতা আইসা কইলেও বিশ্বাস করুম না।
এই না হইলে আমার বউ! শুনো। ভাবীরে কইলাম রাহেলারে পাঠায়া দিব নে। ভাবি কইলো। আহা! বেচারি সংসারটার লাইগা কাজ কইরা সারাদিন মরতাছে তারে আবার রাইতে ত্যক্ত করা কেন ? রাহেলা জানে যে আমি তোমারে ভাই মানি। তুমিই আইসো। রাহেলা কিছুই মনে করবে না জানলেও। ওর মন এত নষ্ট না। তবুও আমি তোমারে কিছু কই নাই ডরে। তাছাড়া বুঝইতো পরের বাড়িতে থাকি। বেশি তর্ক মানায় না। কিন্তু তোমারে কইতে লজ্জা লাগলো বইলা চুপিচুপিই ভাবীর ঘরে ৩ রাত গেছিলাম। পানি না দিলে কী তখন জ্বর ছাড়তো?
রাহেলার চোখ ভিজে উঠে। আহা! তার এই স্বামীকে আর ভাবীকেই নাকি সে ভুল বুঝেছে। কি নোংরা চিন্তাই না করেছে সেই রাতে তার স্বামীকে ভাবীর ঘর থেকে বের হতে দেখে। লজ্জ্বায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে রাহেলার। সে সিদ্ধান্ত নেয় তার সহজ-সরল এই স্বামীকে আর কোনোদিন সন্দেহ করবে না সে। আমজাদ বললো :
আমি সেবা-শুসুস্রা করাতেইতো ভাবি সুস্থ হইয়া গেল। তাইতো খুশি হইয়া দিল এই চুড়ি জোড়া , কইল রাহেলারে দিও। তবে দিনের বেলা এইটা পইরো না , রাহু। বুঝইতো পরের ঘরে থাকি পাঁচ লোকে পাঁচ কথা কইবো।
রাহেলার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা স্বামীর জন্য উৎলে পড়ে যেন। ঘরের আলো নিভিয়ে স্বামীর সঙ্গে মিশে যায় সে।
এই বাড়ির সবচেয়ে অবস্থাপন্ন বলা যায় মেজো ভাই ফরিদকে। তার স্ত্রীও অবস্থা-সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। ফরিদ মিয়ার বড় চালের আড়তের ব্যবসা। গ্রামের দিকে হলেও ফরিদের ঘরটা দেখার মতো। ইট-সিমেন্টের দেয়াল আর টিনের দো-চালা। তার ডানপাশে দুটো ইটের তৈরি ছাপড়া ঘরে থাকে ছোট ভাই বাদল আর বড় ভাই জলিল। তাদের দুটো ঘরের মুখোমুখি উঠান পেরিয়ে একটা টিন আর বাঁশের তৈরি ঘর। এখানেই রাহেলা আর আমজাদের সংসার। রাহেলা খুব চিকন আর কালো হওয়াতে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তিন ভাই অনেক খুঁজেও কোনো পাত্র পায় না। শেষ-মেষ এক ভবঘুরে , ভাদাইমা গোছের এই আমজাদকে ঘর জামাই হিসেবে আনে। ভেবেছিল টুকটাক কিছু কাজে তাকে লাগাবে । কিন্তু সে পুরোই অকর্মা।
সেই দিনের প্রায় ১ মাস পর বাড়িতে বিরাট উৎসবের মতো আয়োজন হলো। রাহেলার ছোট ভাইয়ের ২টা আর বড় ভাইয়ের ৩ টা সন্তান হলেও মেজো ভাই বিয়ের ৪ বছর পরেও সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি। মেজো ভাই আরেকটা বিয়ে করবেন কিনা এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছিলেন। যে স্ত্রী তাকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারবে। মেজো বউকে তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হতো। ঠিক এই সময়েই আনন্দ সংবাদটা পেল সবাই। মেজো বউ অন্তঃসত্ত্বা। মেজো ভাইয়া আর ভাবীর আনন্দ দেখে কে! এই উপলক্ষেই এই উৎসব আয়োজন।
রাহেলা যখন আনন্দের সাথে আমজাদকে এই খবরটা দিল তখন সে সামান্য একটু মুচকি হেসে বলল ভালোইতো। শুনছিলাম কোন ফকিরের কাছ থেকে পানি পড়া নিছে । ফকিরটা কামেল।
আশায় রাহেলার চোখও জ্বলজ্বল করে ওঠে। বিয়ের ৫ বছর হলো সেওতো সন্তানের সুখ পায়নি। সেও কী যাবে নাকি সেই ফকিরের কাছে । কোথায় থাকে সে ?
তার সপ্তাহ খানেক পর এক সন্ধ্যায় একটা চাদরে পেঁচিয়ে কিছু জিনিস নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে রাহেলা আমজাদকে। সে কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় চাদরের ভেতর কী? আমজাদ ফিসফিস করে বলে , দরজা বন্ধ করে আসো।
চকির ওপর চাদর নামিয়ে প্যাচ খুলতেই রাহেলার চোখ ছানা-বড়া হয়ে যায়। এত গহনা সে এক সাথে জীবনে কখনো দেখেনি। তার সাথে ওগুলো কী ? ৫০০ টাকার নোট না ! কতগুলো ওখানে ? রাহেলার বিস্ময় কাটতেই চাইল না। আমজাদ হাত ধরে তাকে বিছানায় বসালো। বললো :
মেজো ভাবী দিছে।
রাহেলা অবাক হয়ে বলল , শুধু জ্বরের সময় মাথায় পানি ঢেলে দেওয়ার লাইগা এত কিছু দিল ?
দূর বোকা! ভাবীরে ঐ ফকিরের পানি পড়াতো আমিই আইন্না দিলাম। তখনই নাকি ভাবি মনে মনে নিয়ত করছিল এইবার যদি সুখের মুখ দেখে তাইলে তার অর্ধেক গয়না আমাগো দিয়া দিবে। আমাগো আর দাসী-বান্দির মতো এই বাড়িতে থাকা লাগবে না। আমরা ঢাকা যামু। নতুন কইরা সংসার শুরু করমু।
রাহেলার বিস্ময় এখনো যাচ্ছে না। সত্যি ভাবি অর্ধেক দিয়া দিল ? মেজো ভাইয়ে জানে ?
দূর বোকা! সে কী তাইলে দিত ! তারে এসব জানানের কাজ নাই। কালকেই আমরা ঢাকা যামু। তোমার নতুন সংসার হইবো।
রাহেলা খুবই সহজ-সরল মেয়ে । জটিলতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক , জানা-শোনা নেই। মেজো ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার স্বামীর মেজো ভাবীর ঘরে যাওয়া , সামান্য এই কারণে ভাবীর এত গহনা দেওয়া , তার পরেই তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়া, এই বাড়ি থেকে তাদের দূরে চলে যাওয়া এইসব এর মাঝে যে জটিলতা কিছু থাকতে পারে তা তার চিন্তা শক্তির বাইরে।
সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার নিজের একটা সংসার হবে , সেখানে সেই হবে পরিচালক। এই চিন্তার পুলকেই সে শিউরে ওঠে। সারারাত মন নাচতে থাকে।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্বামীকে তার পাশে না দেখে সে চমকায় না। ভাবে গেছে কোথাও আশেপাশে। ঘরের আলনার নিজের জামা-কাপড় , সব গহনা আর সারারাত ধরে নতুন সংসারের চিন্তায় ডুবে থাকা রেহানার স্বপ্নকে সাথে করে নিয়ে, রাতেই যে আমজাদ এই গ্রাম , জেলা আর তার থেকে অনেকদূরে চলে গেছে তা বুঝতে তার দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন পাথরের মূর্তির মতো এই দারিদ্র ঘরের চকিতে বসে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না।
চলবে . . . . .