রঙিন_রোদ,পর্ব_৯,১০

#রঙিন_রোদ,পর্ব_৯,১০
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৯

-‘হ্যালো! শুনতে পাচ্ছেন! আপনি কী মৃত্তিকা? মানে এই মোবাইলের মালিকের বেস্ট ফ্রেন্ড? এই মোবাইলের মালিক অনেক বড়ো একসিডেন্ট করেছেন। উনার এখন অনেক ক্রিটিকাল অবস্থা। মোবাইলটা এতক্ষনে একটু চার্জ হওয়াতে কললিস্টে আপনার নাম্বার আগে পেয়ে কল দিয়েছি।’

মৃত্তিকার কান দিয়ে এতকিছু ঢুকছে না। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘ক… কোন… হা… হাসপাতালে আছে!’

-‘জি, আমি অ্যাড্রেস মেসেজ করছি। আপনি উনার পরিবারকে খবরটা দিয়ে দিয়েন। উনার অবস্থা অনেক ক্রিটি…’

মৃত্তিকা আর কিছু শোনার প্রয়োজনবোধ করলো না। সে মোবাইল নিয়ে কোনোমতেই তড়িঘড়ি করে ঐভাবেই বেরিয়ে পড়লো।

হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছেই মৃত্তিকা সিয়ার ওখানে দৌড়ে গেল। মৃত্তিকা যেতেই ডাক্তাররা মৃত্তিকার সাইন নিয়ে সিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে ফেলল। অবশ্য, ডাক্তাররা আগে পরিবারকে খুজেছিল কিন্তু অবস্থা বেশি ক্রিটিকাল হওয়ায় মৃত্তিকা ডাক্তারদের বেশি জোর করাতে ওরা অপারেশনের ব্যবস্থা করলো। বাইরের থেকে থিয়েটারের কাঁচ দিয়ে ভেতরে তাকাতেই সিয়াকে এরূপ রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ডাক্তাররা তড়িঘড়ি করে ভেতরের পর্দাটা টেনে দিতেই মৃত্তিকা থিয়েটারের বাইরে মেঝেতে বসে পড়লো। চঞ্চল সিয়াকে এমন শান্ত অবস্থায় মৃত্তিকা সহ্য করতে পারছে না।
হঠাৎ খেয়াল হলো সিয়ার পরিবারকে বলা হয়নি। মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি করে সিয়ার পরিবারকে কল দিয়ে সব জানিয়ে রিনিকে কল করে জানাল। কাঁদতে কাঁদতে মৃত্তিকার চোখ-মুখ ফুলে গেছে। সে কাঁদতে কাঁদতে ক্রান্ত হয়ে মেঝেতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুসময় পর থিয়েটারের দরজা খোলার আওয়াজে মৃত্তিকা চোখ খুলেই দেখতে পেল একজন ডাক্তার তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসছে। সে কোনোমতে উঠে ডাক্তারের কাছে যেতেই ডাক্তার জানাল – রোগীর জন্য আর্জেন্ট রক্ত লাগবে কারণ অনেক রক্ত কমে গিয়েছে।
মৃত্তিকার হঠাৎ মনে পড়লো তার আর সিয়ার রক্তের গ্রুপ মিল। তারা সবসময় সেটা নিয়ে গর্ব করে বলতো,সবাইকে বলতো ওরা দুইবোন যার ফলে সবকিছুর সাথে সাথে রক্তের গ্রুপও মিল। মৃত্তিকা উত্তেজিত কণ্ঠে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

-‘আমি দিব রক্ত।’

-‘কিন্তু আপনাকে তো দেখতে অনেক দুর্বল লাগছে। পারবেন?’

-‘হ্যাঁ, পারবো।’

মৃত্তিকার জবাব পেতেই ডাক্তার তাড়াতাড়ি করে একটা নার্সকে ডাক দিল। নার্স আসতেই ডাক্তার আবার থিয়েটারে ঢুকে গেল। নার্স মৃত্তিকাকে একটি ক্যাবিনে নিয়ে রক্ত নিতেই মৃত্তিকাকে দুর্বলতা গ্রাস করে যার ফলে নার্স একটি ঘুমের ওষুধ দেয় যাতে মৃত্তিকা ঘুম থেকে উঠেই একটু সুস্থতা অনুভব করে। এরপর নার্স রক্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

নার্স মৃত্তিকার ক্যাবিন থেকে বের হতেই কেউ একজন আড়াল থেকে দেখে সেই ক্যাবিনের দিকে এগিয়ে গেল।
আগন্তুকটি আস্তে আস্তে গিয়ে মৃত্তিকার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মলিন শ্বাস ফেলে এক দৃষ্টিতে মৃত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

-‘কতদিন পরে এই চেহারাটা দেখছি। আজকের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত মৃত্তি। ক্ষমা করে দিও আমায়। আমি না চাইতেও এটা করতেই হলো। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মৃত্তি। চাইলেও কাছে আসতে পারি না। জানো, ভীষণ কষ্ট হয় তোমার দূরে থাকতে। আচ্ছা, ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন হয় মৃত্তি! বড্ড মিস করি তোমায়! আজকে তোমার সবচে কাছের বোন সমান বান্ধবীর এরূপ অবস্থার জন্য আমি দায়ী। না চাইলেও করতে হয়েছে আমায়। ক্ষমা করে দিও আমায় মৃত্তি। আমি যে তোমায় বড্ড ভালোবাসি।’ আস্তে আস্তে কথাগুলো বলতে বলতেই আগন্তুকটার চোখ বেয়ে অশ্রু নির্গত হলো। আগন্তুকটা মৃত্তিকার দিকে ঝুঁকে থাকায় তার চোখের পানি মৃত্তিকার কপালে পড়লো।

কপালের উপর তরল জাতীয় কিছু পড়ায় মৃত্তিকা ঘুমের মাঝেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তার মনে হচ্ছে, কেউ যেন খুব গভীর-ভাবে তার মুখের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। আগন্তুকটার নিঃশ্বাস মৃত্তিকার মুখের উপর আঁচড়ে পড়ছে কিন্তু মৃত্তিকা চাইলেও তার চোখ খুলতে পারছে না। বারবার চাইতেও আবারো গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল।

মৃত্তিকার নড়াচড়া দেখে আগন্তুকটা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। শেষবারের মতো মৃত্তিকার মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

——-

মৃত্তিকা চোখ খুলেই রিনিকে তার পাশে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার নিজের আবার কী হলো! সে শোয়া অবস্থায় ক্যান! আস্তে আস্তে সবকিছু মনে পড়তেই সে তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসল।

-‘রিনি, সি… সিয়া কই?’

সিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই রিনি মুখ পাংশুটে করে ফেলল।

-‘শোন মৃত্তি। সিয়ার বেশি ক্রিটিকাল অবস্থা ছিল যার ফলে ডাক্তাররা চেয়েও তার অবস্থা ভালো করতে পারেনি। তবে চেষ্টায় আছে।’

-‘সোজাসুজি বল রিনি।’

মৃত্তিকার কথা শুনে রিনি মাথা নিচু করে ফেলল।
-‘সিয়ার এক্সিডেন্ট বেশি ভয়ঙ্কর’ভাবে হয়েছে – ডাক্তাররা এমন কল্পনা করতেছেন। শরীরের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। একসিডেন্টের মাঝে সিয়ার পেতে ছুরির আঘাত কোথ থেকে এলো কেউ ভাবতে পারছে না। আপাতত এখানেই তার চিকিৎসা চালাতে হবে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছে।’ এরপর রিনি মাথা নিচু করে আবারও বলে উঠল,’আল্লাহ যদি চান তাহলে সিয়া আবারো আমাদের মাঝে ফিরে আস…’

রিনির কথা শুনে মৃত্তিকা যেন থমকে গেল। তার চোখ দিয়ে অঝোরে ধারায় অশ্রু নির্গত হতে লাগলো। তার কানে একটা মাত্রই কথা বাজছে যে ‘ডাক্তাররা সিয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে ‘ মৃত্তিকা রিনির আর বাকি কথাগুলো না শুনে দৌড়ে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে সিয়াকে আলাদা করে রাখার ক্যাবিনটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পেছন পেছন রিনি এগিয়ে এলো। মৃত্তিকা আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ক্যাবিনে ঢুকে সিয়ার পাশে দাঁড়াল। সিয়ার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। মাথায় ব্যান্ডেজ। শরীরের নানা জায়গায় ব্যান্ডেজ। আজ সিয়া কী শান্তভাবে শুয়ে আছে!

-‘স… সি… সিয়া! এই সিয়া। উঠ না বোন আমার। আমরা গুলশানে যাবো। আড্ডা দিবো অনেক।’

সিয়ার কোনো নড়াচড়া না দেখে মৃত্তিকা রিনির দিকে ফিরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘ র… রি… রিনি..এই রিনি! আমার সিয়া আবারো আগের মতো আমার সাথে হেসে খেলে কথা বলবে। সে মজা করছে তাই না? তোরা দুইজনে মিলে প্রতিবারের মতো আবারও আমাকে বোকা বানাতে চাচ্ছিস তাই না? আমি কিন্তু এবার আর বোকা হবো না। তোদের চালাকি ধরে ফেলেছি। সিয়া উঠ।’

মৃত্তিকার কথা শুনে পেছনে রিনি ফুফিয়ে উঠলো। মৃত্তিকা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আস্তে আস্তে সিয়ার শরীরে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে চেষ্টা করলো কিন্তু আজ আর সিয়া চোখ খুললো না।

হঠাৎ ক্যাবিনের দরজা খুলে সিয়ার মা দৌড়ে এসে মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়তেই মৃত্তিকাও ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। তার সিয়া আজ আর তার সাথে মজা করতে আসছে না।

অদূরেই সিয়ার বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সিয়ার মায়ের বেশি কান্না দেখে তিনি তার স্ত্রীর দিকে এগিয়ে স্ত্রীকে থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সিয়ার মা কিছুক্ষন আগেও বেহুঁশ হয়ে ছিল অন্য ক্যাবিনে। হুশ ফিরতেই আবারও মেয়ের কাছে পাগলের মতো ছুটে এসেছে।

একজন নার্স তাদের ডাক দিতে দিতে ক্যাবিনের দরজা খুলে দৌড়ে এসে তাদের উপর বকা-ঝকা করতেই সবাই কন্দনরত চোখে সিয়াকে আরেকবার দেখে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল । সিয়ার মা কাঁদতে কাঁদতে আবারো বেহুঁশের ন্যায় হয়ে পড়লো।

মৃত্তিকা নিজেও তার আগের অবস্থায় নেই। তার বারেবারে মনে হচ্ছে, এইতো সিয়া এখনই শোয়া থেকে উঠে অক্সিজেন মাস্ক ছুঁড়ে ফেলে হেসে বলে উঠবে,’দেখেছো? তোমাদের কীভাবে অতি সহজে বোকা বানিয়ে ফেলেছি!’
তখন মৃত্তিকা দৌড়ে সিয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে এগিয়ে গিয়ে দুইটা থাপ্পড় লাগাতেই সিয়া মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে তার রাগ কমানোর চেষ্টা করবে। এক পর্যায়ে সফলও হবে। মৃত্তিকার রাগ কমে গিয়ে হেসে দিবে।

মৃত্তিকা বারবার সিয়ার ক্যাবিনের দরজার কাঁচ দিয়ে সিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। এই বুঝি সিয়া উঠে যাবে কিন্তু আজ আর মৃত্তিকার ইচ্ছে সফল হলো না। সিয়া উঠলো না। নিশ্চুপভাবে শুয়ে আছে আজ। আজ আর মৃত্তিকার মন খারাপ অবস্থায় হাসাতে চেষ্টা করতে এলো না সিয়া।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১০

‘মৃত্তি,সিয়াকে হয়ত কেউ পরিকল্পিত’ভাবে খুন করার চেষ্টা করেছে। ওই গাড়িটার ড্রাইভার পুরোপুরি সুস্থ, শুধু একটু হাতে ব্যথা পেয়েছে।’

-‘ম… মানে?’

-‘ড্রাইভারটার ভাষ্যমতে, সিয়া দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে গাড়িতে উঠে বসছিল। ড্রাইভারটা যাবে না বলা সত্ত্বেও সিয়া জোর করে তাড়াতাড়ি গাড়িটা চালু দিতে বলেছিল। যার ফলে ড্রাইভার অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাড়ি ছেড়েছিল। সিয়া ড্রাইভারকে জোর করে বলার সময় ভীষণ হাঁফাচ্ছিল আর বারেবারে পেছনের দিকে কী জানি দেখছিল। সিয়া তখন অনেক ভয়ে ছিল। গাড়ি ছাড়ার পর সিয়া কাকে জানি কল করে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু হাঁফানোর কারণে কথা স্পষ্ট ছিল না। ঠিক সেসময় কোথ থেকে হঠাৎ করে বিপরীত দিক থেকে একটা বড়ো মালবাহী ট্রাক এসে সিয়াদের গাড়িটাকে ধাক্কা মারে যার ফলে ড্রাইভার সামনের কাঁচে মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারায়। ড্রাইভারের চোখ বুজার আগে দেখেছিল, সেই ট্রাকটা থেকে কেউ একজন তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল। যার ফলে ড্রাইভার সম্পূর্ণ নিশ্চিত, কেউ পরিকল্পিত-ভাবে সিয়াকে খুন করার চেষ্টা করেছে।’

-‘ এ… এস… এসব কী বলছিস তুই রিনি? আ… আমার সিয়া’র সাথে কার এতো শত্রুতা যে তাকে প্রাণে মেরে দিতে চাইছে!’

-‘আজকে কিছুক্ষন আগে সিয়া’র সেইদিনের গাড়ির ড্রাইভারটা খোঁজ নিয়ে হাসপাতালে এসে সিয়ার মা-বাবাকে সব বলে গেল। নাহলে ভাব?ড্রাইভারটা নিজে সামনে থেকে তেমন একটা আঘাত পায়নি অথচ সিয়া! সে পেছনে থাকার পরেও ড্রাইভারের চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে। আর ডাক্তাররা কাল ঠিকই বলেছিল, সিয়ার পেটে ছুরির আঘাত।’

মৃত্তিকা স্তব্ধ হয়ে হাসপাতালের করিডরে ধপ করে বসে পড়ল। তার আপাতত কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সে শুধু মনে-প্রাণে প্রার্থনা করছে, সিয়া যেন খুব তাড়াতাড়ি আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠে।

মৃত্তিকা এখনো হাসপাতালেই আছে। কাল রাতে রিনি হাজার জোর করেও মৃত্তিকাকে বাসায় নিতে পারেনি। তার এক কথা, সে সিয়াকে একা রেখে যাবে না নাহলে সিয়া সুস্থ হয়ে মৃত্তিকার উপর অভিমান করে থাকবে। মৃত্তিকার কারণে রিনিও আর যায়নি। বাসায় ফোন করে বলে দিয়েছে।

————–

-‘হ্যালো স্যার?’

-‘কী অবস্থা ওইদিকে?’

-‘স্যার, আসলে… আমি মেরেছি কিন্তু বেঁচে গিয়েছে ওই মেয়েটা।’

-‘শেষ করে দাও।’ আগন্তুকটি নিজের খারাপ লাগাকে আড়ালে ঢেকে শক্ত কণ্ঠে আদেশ দিল অপর পাশের লোকটাকে।

-‘ওকে স্যার।’

ফোন রেখে আগন্তুকটি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা মলিন শ্বাস ফেলল। এই জীবনে সে অনেক হত্যার আদেশ দিয়েছে কিন্তু আজকের মতো এতটা খারাপ লাগা কাজ করেনি। তার আজ এই কথাটা বলতে গলা কেঁপেছিল। তার বড্ড খারাপ লাগছে আজ কিন্তু সে যে নিরুপায়!

———-
সন্ধ্যা কেটে গিয়ে চারদিকে ধীরে ধীরে রাতের নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরছে। আস্তে আস্তে দিনের আলো ঢেকে গিয়ে গুটগুটে আঁধারে পরিণত হচ্ছে চারপাশ। মৃত্তিকা হাসপাতালের একটা ক্যাবিনের সামনে দরজাতে হেলান দিয়ে মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে চোখ বুজে আছে।

আজ দুইদিন কেটে গিয়েছে অথচ সিয়ার জ্ঞান ফেরার নাম-গন্ধ নেই। রিনিকে মৃত্তিকা জোর করে সকালের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটা যেতে চায়নি কিন্তু মৃত্তিকার জোরাজোরির ফলে বাধ্য হয়ে গিয়েছিল। আর কয়দিনই বা এখানে থাকবে! মৃত্তিকা কোথাও গিয়ে মন বসাতে পারবে না বিধায় এখানে রয়ে গিয়েছে। সে জানে, বাসায় অথবা হোস্টেলে গেলে প্রতি পদে পদে সিয়ার কথা মনে পড়বে। তার চেয়ে এখানে সিয়ার পাশে থেকে মনকে শান্ত রাখতে পারলেই হলো। মৃত্তিকা নিজেকে সামলে নিবে। পাশের ক্যাবিনে সিয়ার মা দুর্বল অবস্থায় শুয়ে আছে আর সিয়ার বাবা ভারাক্রান্ত মনে বসে আছে। তাদের একটা মাত্র মেয়ের আজ এই অবস্থা মানতে পারছে না। মৃত্তিকার আজ কেন জানি মন ভীষণ খারাপ। কেন- সেটার উত্তর মৃত্তিকার কাছে নেই। সিয়ার সাথে কাটানো সবদিন’গুলো তার ভীষণ করে মনে পড়ছে।

মৃত্তিকার পাশের দরজা খোলার আওয়াজ হতেই দেখলো, সিয়ার ক্যাবিন থেকে নার্স বের হচ্ছে। এই নার্সগুলোর কারণে মৃত্তিকা তার সিয়ার কাছে যেতে পারে না। আজকের সম্পূর্ণ দিন মিলে একবারও সিয়াকে কাছ থেকে দেখতে পারেনি মৃত্তিকা। আজ সে সুযোগ হাত-ছাড়া করবে না।
নার্স বেরিয়ে যেতেই মৃত্তিকা আস্তে আস্তে মেঝে থেকে উঠে দরজার কাঁচ দিয়ে সিয়ার দিকে তাকালো। সে আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ক্যাবিনে ঢুকে সিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। শোয়া অবস্থায় সিয়াকে দেখতে একদম নিষ্পাপ লাগছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে! একদম পুতুলের মতো।

-‘স… সিয়া… এই সিয়া?’

-‘জানিস? আজ কী হয়েছে? তুই তো সারাদিন শুয়ে থাকিস তাই বাইরের কোনো কথা’ই শুনতে পাচ্ছিস না। আর কয়দিন এভাবে আমার সাথে কথা না বলে থাকবি বল? নার্সগুলো সারাদিন তোর পাশে থাকে। আমাদের একটু ঢুকে দেখতেও দেয় না তোকে। তাই আজ নার্স একটু করে বের হতেই চুরি করে ঢুকে গিয়েছি। ভালো করেছি না বল?’ বলতে বলতেই মৃত্তিকা হেসে উঠল। সে জানে, আজও সিয়া থেকে সে কোনো প্রতিউত্তর পাবে না কিন্তু তবুও সে একের পর এক আজকের ঘটা সব কথা সিয়াকে শোনাতে লাগলো। তার আশা, যদি প্রতিদিনের ন্যায় সিয়াকে মৃত্তিকার সম্পূর্ণ দিনের রুটিন না পড়ে শোনায় তাহলে একদিন সিয়া সুস্থ হয়ে উঠে মৃত্তিকার উপর রাগ করে গাল ফুলিয়ে বলবে,’আমি সুস্থ থাকলে তুই তোর সম্পূর্ণ দিনের কথা আমাকে না বলে থাকতে পারতিস না অথচ আমি অসুস্থ হয়ে শুয়ে যাওয়ার পর তুই আমাকে তোর দিনের রুটিন শোনাসনি। কেন রে? আমি শুয়ে গিয়েছি বলে! অথবা আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর পাবি না বলে? আমি ভীষণ রাগ করেছি তোর উপর।’ তখন মৃত্তিকা হেসে সিয়াকে জড়িয়ে ধরলেই সিয়া হেসে দিবে। মুহূর্তের মধ্যে সিয়ার সব রাগ ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।

মৃত্তিকা এসব ভাবতে ভাবতেই হাসতে লাগলো। এরপর আরো কিছু মনে পড়তেই সিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলো। হঠাৎ মৃত্তিকা খেয়াল করলো, সিয়া হাত নাড়াচ্ছে। মৃত্তিকা প্রথমে চোখের ভ্রম মনে করে পাত্তা না দিলেও পরে যখন সিয়া ধীরে ধীরে চোখ খুলে তার দিকে তাকালো তখন মৃত্তিকা খুশিতে হেসে সিয়ার কপালে এলোপাতারি চুমু দিতে দিতে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘স… এই সিয়া। ত..তুই উঠছিস? আমি জানতাম তুই উঠবি। তুই আমাকে ফেলে কোথাও যাবি না। দাঁড়া আন্টিকে ডেকে নিয়ে আসি। একটু অপেক্ষা কর।’ বলেই মৃত্তিকা হেসে পেছন ফিরে সিয়ার মা-বাবাকে ডাকার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিতেই পেছন থেকে সিয়া তার হাত ধরে ফেলাতে মৃত্তিকা থেমে গেল।

মৃত্তিকা ফিরে সিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো সিয়া মৃত্তিকা’কে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে আর তাকে ইশারা করে তার কাছে ডাকছে।

মৃত্তিকা হাসি-মুখে সিয়ার একদম কাছে এগিয়ে যেতেই সিয়া তার ক্যানেলা লাগানো কাঁপা কাঁপা হয়ে মুখের অক্সিজেন মাস্কটা খোলার চেষ্টা করছে। হাতে ক্যানেলা লাগানোর ফলে তার হাতে রক্ত উঠে গিয়েছে সেদিকে সিয়ার খেয়াল নেই। সে মৃত্তিকাকে ইশারা করে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।

মৃত্তিকা তাড়াহুড়ো করে সিয়াকে থামিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘ক…কী করছিস সিয়া? হাতে ব্যথা পাবি তো। মুখের অক্সিজেন মাস্ক কেন খুলছিস!’

সিয়া মৃত্তিকার উত্তেজিত রাগী রাগী কণ্ঠ দেখে দুর্বল অবস্থায় কন্দনরত চোখে ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা আনতে চেষ্টা করলো।
সিয়ার চোখ গড়িয়ে অঝোরে ধারায় অশ্রু নির্গত হচ্ছে। মৃত্তিকা তার একদম কাছে এগিয়ে যেতেই সিয়া কাঁপা কাঁপা হাতে তার অক্সিজেন মাস্কটা টেনে খুলে হাঁফাতে লাগলো। তা দেখে মৃত্তিকা রেগে সিয়ার মুখে জোর করে মাস্কটা পড়িয়ে দিতে গিয়ে সিয়ার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কিছু শুনে থমকে গেল।

-‘আ… আ…মার স.. ময় খ.. খু… ব কম। ত… তুই সাবধানে থাক… থাকিস মৃত্তি।’

মৃত্তিকা হুশে নেই। কী বলছে এসব সিয়া!
সিয়ার শ্বাস ক্রমশ ভারী হচ্ছে। সে কোনোমতে শ্বাস টেনে হাঁফাতে হাঁফাতে শোয়া থেকে উঠার চেষ্টা করলো।

-‘ত… তু… র স.. সামনে অনে… ক ব… বিপদ। সা…সাব… ধা… নে থা… কিস।’ বলতে বলতেই শুয়ে পড়লো সিয়া। সিয়া শুয়েই কাঁপা কাঁপা হাতটা মৃত্তিকার দিকে বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। মৃত্তিকাকে ছোয়ার আগেই সিয়া শুয়ে আস্তে আস্তে চোখ বুজে ফেলল।

মৃত্তিকা সিয়াকে চোখ বন্ধ করে ফেলতে দেখে উত্তেজিত কণ্ঠে সিয়াকে ছুঁয়ে ডাকতে লাগলো। সিয়াকে চোখ না খুলতে দেখে মৃত্তিকা দ্রুত ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে পাগলের ন্যায় ডাক্তারকে ডাকতে লাগলো। ডাক্তার তাড়াহুড়ো করে এসেই সব পরীক্ষা করে দেখে একটা মলিন শ্বাস ফেলল। তাদের সব চেষ্টা বিপলে গেল।

#চলবে ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here