#রঙিন_রোদ,পর্ব_৭,৮

#রঙিন_রোদ,পর্ব_৭,৮
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৭

মৃত্তিকা আধো আধো চোখ খুলতেই দেখলো রিনি তার এক হাত ধরে মাথার পাশে বসে আছে আর একটু দূরেই চিন্তিত-মুখে সিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্তিকা চারদিকে তাকিয়ে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বসতে নিতেই হাতের ব্যথায় ছটফট করে উঠল।

-‘আরে আস্তে। এভাবে তাড়াহুড়ো করছিস ক্যান!’

-‘আমি এখানে কীভাবে এলাম! আমি তো একটা অন্ধকার বদ্ধ রুমে ছিলাম! কে আনলো আমায়?’উত্তেজিত কণ্ঠে একনাগাড়ে বলে উঠল মৃত্তিকা।

-‘বদ্ধ রুম! মানে! তুই তো ঢাকার বাস স্টেশনে বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিলি। পরে কেউ একজন তোর ব্যাগ থেকে মোবাইল নিয়ে সিয়াকে কল দেয়াতে সে গিয়েছিল ওখানে। পরে আমি আর সিয়া মিলে তোকে এখানে এনেছি। বাবা- ফুফিকে বলেছি, তুই অসুস্থ তাই হোস্টেল থেকে নিয়ে এসেছি। আগে বল, তুই বাস স্টেশনে কী করতে গিয়েছিলি? আমাকে এর কয়েকদিন আগে মেসেজ দিয়েছিলি সেটা আমি খেয়াল করিনি।’

মৃত্তিকা স্তব্ধ হয়ে রিনির দিকে তাকিয়ে রইল। এসব কী বলছে ওরা! মৃত্তিকা তো একটা রুমে আটকা ছিল। ওখানে সব কথা ও স্পষ্ট শুনেছিল যে তাকে সেদিন রাতে ফ্লাইটে বাইরের দেশে পাচার করবে। কিন্তু এরা কী বলছে এসব!

-‘কী বলছিস এসব?’ মৃত্তিকা কাঁপা কাঁপা স্বরে জানতে চাইলো।

-‘হ্যাঁ রে।’ সিয়া এগিয়ে এসে মৃত্তিকার কথার জবাব দিল।

-‘তোদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমাকে একটা রুমে আটকে রাখা হয়েছিল।’

-‘শোন, তোর মাথায় অতিরিক্ত প্রেসার পড়ায় আজেবাজে বকছিস। লাইট অফ করে কিছুক্ষন ঘুমা। তাহলে দেখবি ভালো লাগবে। মাঝরাতে এসব আজেবাজে বকিস না।’ রিনি মৃত্তিকার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠল। রিনির সাথে তাল মিলিয়ে সিয়াও একই কথা বলে উঠতেই মৃত্তিকা ঝাটকা মেরে রিনির হাত সরিয়ে চিৎকার করে উঠল।

-‘তোরা কী মনে করছিস? আমি পাগলামি করছি?’ বলতে বলতে মৃত্তিকা ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। তার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না।

-‘আমরা কেউই বলছি না যে তুই পাগলামি করতেছিস। আমরা বলছি, তোর মাথায় বেশি প্রেসার পড়ার কারণে মাঝরাতে এমন আজেবাজে বকছিস। একটু ঘুমা। সকালে উঠে ভালো লাগবে। আমরা ফুফিকে অনেক কষ্টে রাতে রুমে পাঠিয়েছি ঘুমানোর জন্য। তিনি তোর চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তুই এসবের কিছুই ফুফি, বাবাকে বলিস না। নাহলে ওরা আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। এখন একটু ঘুমা। দেখবি, সকালে ভালো লাগবে। চল সিয়া।’ বলেই রিনি আর সিয়া লাইট অফ করে রুমের দরজা আটকে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

মৃত্তিকা স্তব্ধ হয়ে অন্ধকারে বসে রইল। কেউ ওর কথা বিশ্বাস করছে না। আচ্ছা, সেদিন কী হয়েছিল মৃত্তিকার সাথে! সে তো ওই বদ্ধ রুম থেকে চেয়েও পালাতে পারেনি। সেদিন রাতে মৃত্তিকার ফ্লাইট ছিল। আর ওই ৩২নাম্বার রুমের মেয়েগুলোর কী অবস্থা! ওরা কী পালাতে পেরেছিল না-কি পরিবারের মায়া ত্যাগ করে মানুষের পণ্য বস্তু হিসেবে অন্যদেশে পাড়ি জমিয়েছে! মৃত্তিকার হুট্ করে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো মেয়েগুলোর জন্য! মৃত্তিকা তো বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। মেয়েগুলোও তো কোনো পরিবারের আদরের মেয়ে হতো! তাদের এই অবস্থা! আচ্ছা, মৃত্তিকাকে কে বাঁচিয়েছে! সে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার আগে কেউ একজনকে সেই রুমে ঢুকতে দেখেছিল। সে সময় মৃত্তিকা তো ধরেই নিয়েছিল তার বোধহয় দিন শেষ। তাকে কেউ একজন তাদের কথা অনুসারে নিতে এসেছিল। এরপর চোখ গুলো আর চেয়েও খুলে রাখতে পারলো না। তাদের তীব্র নেশার ফলে মৃত্তিকার চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। এরপর! এরপর আর কিছু মনে ছিল না মৃত্তিকার। কিন্তু কীভাবে মৃত্তিকা স্টেশনে গিয়েছিল? উফফ! মৃত্তিকা আর ভাবতে পারছে না। মাথাটা চেপে ধরে সে বসে রইল। আস্তে আস্তে মাথার তীব্র যন্ত্রনায় মৃত্তিকা শুয়ে পড়লো।

——-

সকাল বেলায় রুমি আহমেদ ঘুম থেকে উঠে আগে মৃত্তিকার রুমে গেল।
রুমে ঢুকতেই বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখলো মৃত্তিকাকে। তিনি মৃত্তিকার বিছানার দিকে এগিয়ে মেয়ের মাথার পাশে বসলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তাকিয়ে রইল। শফিকের এই একটামাত্র অস্তিত্বকে সে সবসময় আগলে রাখার চেষ্টা করে। আজ যদি শফিক বেঁচে থাকতো তাহলে এই মেয়ের অসুস্থতায় বোধহয় প্রাণ টাই দিয়ে দিতো। ছোট বেলায় মৃত্তিকার ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলো ধরে সবসময় আদর-মাখা কণ্ঠে রুমি আহমেদকে ইশারা করে বলতো,
-‘হ্যাঁ রে রুমু! কখন যে আমার এই মেয়েটা বড়ো হবে। আমাকে আধো আধো কণ্ঠে ‘বাবা’ বলে ডাকবে!’
রুমি আহমেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আফসোস! শফি ‘বাবা’ ডাকটা শোনার আগেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। শফি থাকলে কী যে খুশি হতো! একদম বাচ্চা-পনা স্বভাব ছিল শফিক আহমেদের। অথচ আজ সে আকাশের তারা। কে যেন তার ভালোবাসাকে চিরতরে রুমি আহমেদের কাছ থেকে কেড়ে নিল। এখনো ভুলতে পারেনি রুমি আহমেদ। রুমি আহমেদও একা পথ চলা শিখে গিয়েছে। তার চলতে আজ আর কারো প্রয়োজন পড়ে না।
.
.
মৃত্তিকা চোখ খুলতেই দেখলো তার মা জানালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি ঝাঁপসা। মৃত্তিকা একটা মলিন শ্বাস ফেলল। তার মা’কে সে প্রায় সময় এরকম অবস্থায় আবিষ্কার করে। মৃত্তিকা জানে, এখন তার মা বাবা’র স্মৃতিস্মরণ করছে। যতবারই মৃত্তিকা অসুস্থ হয়ে পড়বে ঠিক ততবারই রুমি আহমেদ মৃত্তিকার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কোথায় জানি হারিয়ে যায়। প্রথম প্রথম মৃত্তিকা বুঝতে না পারলেও সময়ের সাথে সাথে এখন বুঝতে শিখেছে। তার মা এখনো বাবা’কে ভুলতে পারেনি। পারবেও বা কীভাবে! তাদের যে প্রেমের বিয়ে ছিল। বিয়ের তিনবছরের মাথায় মৃত্তিকার এক বছর বয়সেই একদিন তার বড়ো ভাই লুৎফর আহমেদ খবর আনলো শফিক আহমেদ মারা গিয়েছে। কে বা কারা যেন মৃত্তিকার বাবাকে হত্যা করে লাশ গায়েব করে ফেলেছে। বাবার কোনো স্মৃতিই মৃত্তিকার মনে নেই। মনে থাকবেও বা কীভাবে! তখন যে মৃত্তিকা অনেক ছোট ছিল। বাবার আদর কী জিনিস মৃত্তিকা কোনোদিন জানতে পারেনি কিন্তু তার বড়ো মামা ঈশান ভাইয়ের বাবা সবসময় মৃত্তিকাকে আগলে রাখতো ;তিনি অনেক আদর-যত্ন করতেন মৃত্তিকাকে। বাবা’র জায়গা নিতে না পারলেও যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন মৃত্তিকার। তাই বাবা’কে তেমন একটা মনে পড়েনি মৃত্তিকার কিন্তু মাঝে মাঝে মা’য়ের এমন খামখেয়ালি স্বভাবের জন্য বাবাকে ভীষণ করে মনে পড়ে। মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকালো।

-‘মা ‘

রুমি আহমেদের হঠাৎ হুশ ফিরতেই তিনি মৃত্তিকার দিকে তাকাল।

-‘হ্যাঁ রে মা । কেমন লাগছে এখন তোর?’

-‘ভালো, মা।’

-‘ শরীরের খেয়াল রাখবি না? হোস্টেলে তো আমি দেখিই না কী খাস না খাস! না খেয়ে এই অবস্থা করছিস শরীরের। কয়েকদিন পড়াশোনা বাসায় বসে কর। ভালো লাগলে হোস্টেলে যাস। এখন আমি কিছু নিয়ে আসি, খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিবি চুপচাপ।’ বলেই রুমি আহমেদ তড়িঘড়ি করে উঠতে নিতেই মৃত্তিকা হাত ধরে ফেলল।

-‘মা, আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। তুমি এতো প্রেসার নিও না তো।’

-‘একদম চুপ। হোস্টেলেও এমন করে রোগ বাধিয়েছিস। ভাগ্যিস, সিয়া ছিল। নাহলে এভাবেই পড়ে থাকলেও তো আমি জানতে পারতাম না।’ বলেই তিনি বেরিয়ে যেতে নিলে দরজা দিয়ে রিনিকে খাবার নিয়ে ঢুকতে দেখে থেমে গেল।

-‘ফুফি, তুমি মৃত্তিকাকে নিয়ে এতো ভেবো না। ওর জন্য আমি আছি। তুমি গিয়ে কিছু খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও। সকাল থেকে তো এখানেই পড়ে আছো।’

রিনি জোর করে রুমি আহমেদকে খেতে পাঠিয়ে দিল।

রুমি আহমেদ যেতেই রিনি খাবারের প্লেট নিয়ে মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে গেল।

-‘আমি খেতে পারবো। আমাকে দেয়।’ মৃত্তিকা রিনির থেকে প্লেট এগিয়ে নিতে চাইলে রিনি না দিয়ে নিজে খাবার খাইয়ে দিতে লাগল মৃত্তিকাকে।

-‘তুই আগে পুরোপুরি সুস্থ হ। তারপর খাইস।’ রিনি রুটি ছিঁড়ে মৃত্তিকার মুখে পুরে দিতে দিতে বলল।

-‘তোর কী মনে হয়? আমি অসুস্থ?’

-‘তাই নয় তো কী! নাহলে স্টেশনে গিয়ে এভাবে কেউ বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে না-কি?’

-‘তোরা আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছিস না। আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল আর আমাকে ওরা সেদিন রাতে বাইর দেশে পাচার করে দিতে চেয়েছিল। এরপর কী হয়েছিল আমি আর জানি না।’

-‘আচ্ছা যা বিশ্বাস করলাম কিন্তু ওরা তোকে কিডন্যাপ করে পাচার না করে স্টেশনে কেন রেখে গেল? সিয়া কয়েকদিনের জন্য তার বাড়ি গিয়েছিল। আসার পথে কল আসাতে সে স্টেশনে গিয়ে তোকে পেল।’

মৃত্তিকা আবারো কিছু বলতে নিতেই সিয়া তৈরী হয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল,
-‘শোন মৃত্তিকা। তুই ইদানিং সারাদিন পড়াশোনা বেশি করছিস তাই মাথায় অতিরিক্ত প্রেসার পড়ার ফলে এমন করছিস। এসব ভুলে যা। কয়েকদিন বাসায় থাক। আমি তোকে নোট দিয়ে যাবো। পরে সুস্থ হলে হোস্টেল যাইস। আমি যায়, ক্লাস আছে। তুই নিজের খেয়াল রাখিস।’ বলেই সিয়া রিনির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘রিনি, ওর খেয়াল রাখিস।’ বলেই মৃত্তিকাকে কিছু বলতে না দিয়ে সিয়া তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল।

মৃত্তিকা একটা মলিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না। কাউকে সে বোঝাতে পারছে না। সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। কেন তারা মৃত্তিকাকে আগের জায়গায় রেখে গেল!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৮

এখন মৃত্তিকা পুরোপুরি সুস্থ তবে ওই ঘটনাটা এখনো তাকে খুরে খুরে খায়। তবুও সেটা সে মাথা থেকে ঝেড়ে পড়াশোনায় মন দিতে চায়। এতদিন সে মা-রিনিদের জোরাজুরিতে বাসায় ছিল। প্রতিদিন সিয়া এসে বা মোবাইলের মাধ্যমে নোট পাঠিয়ে দিতো। কিন্তু মৃত্তিকা আজ আর মানবে না। তার হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে। অনেক পড়া এখনো বাকি। এমনিও ঈশান ভাইয়ের কথার অনেক অমান্য করে ফেলেছে, এখন থেকে আর করবে না। যথারীতি ব্যাগ গুছিয়ে বের হওয়ার আগে রিনির সাথে ড্রয়ইং-রুমে খেতে বসতেই দেখলো আরশি রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেকদিনের জন্য কোথাও যাচ্ছে। আরশির পেছন পেছন তার মা-বাবা বের হচ্ছে। তার মা আঁচলে মুখ ঢেকে চোখের পানি নিয়ে মেয়েকে বিদায় দিচ্ছে।
মৃত্তিকা আর রিনি কিছুই বুঝলো না। হঠাৎ কোথায় যাচ্ছে আরশি! আরশির পরিবার ঈশান ভাইয়ের বিয়ে ভাঙার পর থেকে বাসার কারো সাথে তেমন কথা বলে না যার ফলে আজ সে কোথায় যাচ্ছে সেটা মৃত্তিকা-রিনি ধরতে পারছে না।

আরশি দেশের বাইরে পড়াশোনা করে। তার বিয়ে উপলক্ষে খুশিতে দেশে এসেছিল। সে আগে থেকেই ঈশানকে পছন্দ করতো। ভেবেছিল, বিয়ের পর আর দেশের বাইরে যাবে না। এখানেই বাকি পড়াশোনাগুলো শেষ করে ফেলবে কিন্তু তা তো হলো না।

আরশি দরজার সামনে গিয়ে রিনির দিকে এগিয়ে এলো।

-‘আমি যায় রিনি। ভালো থাকিস।’

-‘কই যাচ্ছ আরশি আপু?’ রিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশি ছলছল চোখে মলিন হাসলো। আরশির এই মলিন হাসি দেখে মৃত্তিকার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে জানে, এই হাসির পেছনে কতটা বেদনা লুকিয়ে আছে। মৃত্তিকার আরশির জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু মৃত্তিকার কিছুই যে করার ছিল না তখন। ছোটকাল থেকেই আরশি রিনি-মৃত্তিকাকে বড়ো বোনের মতো আগলে রাখতো। ভিনদেশে যাওয়ার পরেও রিনি-মৃত্তিকার প্রতি আরশির ভালোবাসা একটুও কমেনি। আরশি অনেক আগে থেকেই ঈশানকে পছন্দ করতো কিন্তু কোনোদিন মুখ ফুটে লজ্জায় বলতে পারেনি।

-‘আগে যেখানে ছিলাম এখন আবার সেখানেই পাড়ি জমাচ্ছি।’ আরশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।

-‘ইংল্যান্ড?’ রিনির চেহারায় বিস্ময় সাথে মৃত্তিকাও অবাক দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকিয়ে রইল।

-‘হ্যাঁ, রে।’

-‘তুমি তো আর যাবে না বলছিলে ওখানে!’

-‘যার জন্য আসলাম তাকেই পেলাম না। এখানে থেকে আর লাভ কী বল! চেষ্টা করবো আর না আসার এখানে। আমি যে এতো তাড়াতাড়ি অনুভূতিটা ভুলতে পারবো না। চোখের সামনে এগুলো সহ্য করতে পারবো না। অনেক আগে থেকে সেখানে একেবারের জন্য থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ভেবেছিলাম এই বিয়ের পর এখানেই থেকে যাব। পাপা, মাম্মাও কয়েকমাসের মধ্যে আমার এখানে চলে আসবে একেবারের জন্য। আশা করি, সমস্যা হবে না। দোয়া করিস আমার জন্য।’ আরশি মৃত্তিকার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রিনির উদ্দেশ্যে জবাব দিল। এরপর চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা কী বুঝে আরশিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।

-‘আরশি আপু। তুমি আমাকে বড়ো বোনের মতো সবসময় আগলে রেখেছিলে। তুমি আমার সাথে কথা না বললে আমি থাকতে পারবো না। তোমার চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারছি না। বিশ্বাস করো, তোমার চোখের পানি দেখে আমার বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। সেদিন আমার কোনো দোষ ছিল না আপু। আমাকে দরকার হলে ছোটবেলার মতো মেরে-কেটে শাসন করো তবুও আমার সাথে কথা না বলে থেকো না আপু প্লিজ।’

আরশি মৃত্তিকার দিকে ফিরে মাথায় হাত বুলিয়ে মলিন হাসলো।

-‘এই পাগলী! বড়ো বোনে কোনোদিন ছোট বোনের কথায় রাগ করে থাকতে পারে! এখানে তো তোর দোষ নেই। সেদিন আমি রাগের মাথায় সবার সাথে সাথে তোকে দোষারোপ করেছি কিন্তু কয়েকদিন যেতেই বুঝেছি সেখানে তোর কোনো দোষ ছিল না। সব আমার নিয়তি। ঈশান হয়ত আমার কপালে ছিল না ;তাই তো এতো আয়োজনের পরেও তাকে আমি পেলাম না।’

-‘আপু, আমাদের ছেড়ে আবার চলে যাচ্ছ যে!’

-‘আমার যে যেতেই হবে। তোরা নিজেদের খেয়াল রাখিস, ভালো থাকিস বোন। তোদের উপর আমার কোনো রাগ নেই। আমি যায় রে।’ বলেই আরশি রিনি-মৃত্তিকাকে দুই’হাতে জড়িয়ে ধরে এরপর একে একে সবার সাথে আলাপ শেষ করে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে।

মৃত্তিকা আরশির যাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমন বোন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মৃত্তিকা না চাইতেও অনেক বড়ো কষ্ট দিয়ে ফেলেছে বোধহয় আরশিকে।

আরশি যেতেই রিনি মৃত্তিকার কাঁধে হাত রেখে খাবারের দিকে ইশারা করলো। মৃত্তিকা চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো।

এরপর রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো হোস্টেলে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ব্যাগ নিয়ে মা’কে আর বাসার বাকি সবাইকে বলে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। রিনি সাথে আসতে চেয়েছিল কিন্তু মৃত্তিকা যেতে পারবে বলে চলে এসেছিল। রিনি আবার এতো পথ কষ্ট করে আসবে- যাবে ;সেটা মৃত্তিকা চায়নি।
.
.
কেটে গেল আরো কয়েকটা দিন। সময় চলে যাচ্ছে আপন-গতিতে। মৃত্তিকা নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত এখন। আদিবের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে পড়াশোনায় মন দিয়েছে। আর কোনো অঘটন সে চায় না। ঈশানের আদেশ মেনে চলার চেষ্টা করছে। এখন সে ঈশানের অর্ধাঙ্গিনী। না চাইলেও ঈশান তার স্বামী। স্বামীর কথা মেনে চলা উচিত।

আজ ক্লাস আছে। তাই মৃত্তিকা সকাল সকাল উঠে কিছু বানিয়ে খেয়ে নিল। আর বাকি কিছু সিয়ার জন্য রেখে দিল। সিয়া তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছে কিছুদিনের জন্য। গ্রামে তার চাচাতো বোনের বিয়ে। মৃত্তিকাকে কাল রাতের দিকে বলেছিল, সে হোস্টেলে ফিরে আসার উদ্দেশ্যে রাত দশটার বাসে উঠেছে। মৃত্তিকা তৈরী হয়ে ক্লাসে যাওয়ার আগে সিয়া’কে কল করার উদ্দেশ্যে মোবাইল হাতে নিতেই স্ক্রিনে সিয়ার নাম ভেসে উঠলো। তা দেখে মৃত্তিকা মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে মাত্রই কল করতে মোবাইল নিয়েছিল। মৃত্তিকা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে রুমের দরজা আটকাতে আটকাতে সিয়ার কল রিসিভ করল।

-‘হ্যাঁ রে, সিয়া! কই তুই? ঢাকা এসে গে…’

-‘মৃত্তি…তো…তো…কে…’
সিয়া মৃত্তিকাকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই হাপাতে হাপাতে উত্তেজিত কণ্ঠে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বেশি উত্তেজনার কারণে কথা সম্পূর্ণ করতে পারছে না।

মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে সিয়ার কথা বোঝার চেষ্টা করছে কিন্তু পুরোপুরি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। মেয়েটার আজ কী হয়েছে।

-‘সিয়া। কী হয়েছে! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তোর কথা। কী বলতে চাচ্ছিস?’

-‘ আ… আমার… তো… তোকে গুরুত্বপূর্ণ ক…’ সিয়া হাপাতে লাগলো।

-‘আচ্ছা, তুই এসে রিলেক্স হয়ে বলিস। এতো কষ্ট করে বলতে হবে না। আমি ক্লাসে যাচ্ছি, তোর মুখ থেকে এসে সব শুনবো। সাবধানে আ…’ মৃত্তিকার কথার মাঝখানে’ই অপরপাশ থেকে কল কেটে গেল। দ্বিতীয়বার কল লাগাতেই মোবাইল বন্ধ শুনালো। মৃত্তিকা তা দেখে মাথা নেড়ে আপনমনেই ‘পাগলী’ বলে বিড়বিড় করে উঠলো। মেয়েটাও বাসা থেকে এতো দূরে আসতেছে অথচ মোবাইলটা ঠিকমত চার্জ দিয়ে আনতে পারল না। কথার মাঝখানে সিয়া’র মোবাইল বন্ধ হয়ে যাওয়া-আজকের নতুন ব্যাপার নয়। যখন থেকেই সিয়ার সাথে পরিচয় মৃত্তিকার তখন থেকেই এমন। মেয়েটা কোনসময় মোবাইলে পুরোপুরি চার্জ দিয়ে রাখতো না। প্রথম প্রথম মৃত্তিকার বিরক্ত লাগলেও সময়ের সাথে সাথে সয়ে গেছে। সে আর কিছু না ভেবে মোবাইলটা ব্যাগে রেখে রুম লক করে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
.
.
ক্লাস শেষ করে মৃত্তিকা রুমে এসে ফ্রেস হয়ে রান্নাঘরে কিছু খাওয়ার উদ্দেশ্যে গেল। সকালে সিয়ার জন্য যা খাবার বানিয়ে রেখে গিয়েছিল সেসব আগের মতো আছে দেখতেই মৃত্তিকার টনক নড়লো। সিয়া কী এখনো আসেনি! সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ালো কিন্তু মেয়েটার আসার নাম-গন্ধ নেই। এতক্ষন তো লাগার কথা নয়! সিয়ার গ্রামের বাড়ি ঢাকার বাইরে অন্য জেলাতে হওয়াতে বাসে করে যেতে হয়। সর্বোচ্চ ৭ ঘন্টা লাগে স্টেশনে পৌঁছাতে। এরপর স্টেশন থেকে হোস্টেলে ফিরতে আধ-ঘন্টা মতো লাগে। আজ এখনো এলো না কেন ভাবতে পারছে না মৃত্তিকা! সে তাড়াতাড়ি সিয়াকে কল করার উদ্দেশ্যে মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো ঠিক সেসময়ে সিয়ার নাম ভেসে উঠেছে। মৃত্তিকা মোবাইল রিসিভ করে কড়া ভাষায় কিছু বলতে নিতেই অচেনা কারো কণ্ঠস্বর শুনে থমকে গেল। মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে কান থেকে মোবাইল নামিয়ে দেখলো। না, এটা সিয়ারই নাম্বার। কিন্তু অচেনা মানুষের কণ্ঠ কেন! মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে মোবাইল কানে ধরতেই ওইপাশ থেকে কিছু একটা বলতেই মৃত্তিকা স্তব্ধ হয়ে গেল।

#চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here