মেঘের_উল্টোপিঠ,পর্ব__১৮,১৯

#মেঘের_উল্টোপিঠ,পর্ব__১৮,১৯
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
#পর্ব__১৮

-‘ ঘুম পাচ্ছে? চাইলে আমার কাঁধে ঘুমাতে পারো। ফিস নিবোনা কোনো! ‘

আমি রক্তিম দৃষ্টিপাত ফেললাম পূর্বের পানে। ইনি আসলেই বজ্জাত! একটা কথা ধরে সেই থেকে শুরু করে খোঁচা মেরে যাচ্ছে। অদ্ভুত! মানুষ মাত্রই তো ভুল। অন্তরাল ধাতস্থ করে নিম্ন সুরে বলে উঠলাম,

-‘ আপনার কাঁধে ঘুমানোর কোনো শখ নেই আমার। চাইলে নিজের কাঁধে নিজেই ঘুমান। আর আবার আপনি ফিসের কথা তুলছেন? এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগে বুঝি?’

পূর্ব নিশ্চুপ! নিরবে নিজের কার্য সাধন করছেন। তার দৃষ্টি সামনে। বেশ মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভিং করছেন। সকালের দিকে হুট করে সিদ্ধান্ত হয় সবাই মিলে গ্রামে যাবো। আমার ছুটি চলছে ১০ দিনের। নানুর তীব্র ইচ্ছা তিনি তার নাতীজামাই এবং নাতবউ দেখবেন। মানে অরিন এবং পূর্বকে দেখতে চান। যদিও আগেও এই দু’জনকে তার দেখা হয়েছে তবুও আবার! নানুর ইচ্ছা পূরণ করতে সন্ধ্যায় পুরো পরিবার রওনা দেই গ্রামের উদ্দেশ্যে। আমার এবং পূর্বের পরিবার সহ পূর্বের বন্ধুমহল গ্রাম ঘোরার তীব্র শখ অনুযায়ী তারাও যাচ্ছেন। আমি এবং পূর্ব একা এক গাড়িতে বাকিদের গাড়ি পিছন দিকটায়!

কিয়ৎক্ষণ পর! রোবটের ন্যায় বসে থাকা পূর্ব মানব মুখ খুললেন। রাশভারী কন্ঠে বললেন,

‘ তোমারই তো মতবাদ! ডাক্তার’রা সব বিষয়ে ফিস নিয়ে থাকেন। ইভেন আমি নাকি রোগী দেখার ভিজিট’ও দ্বিগুণ নিয়ে থাকি। সেদিন অরিনের সাথে কথা বলছিলে! শুনেছি আমি। তাই তোমারই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বললাম কাঁধে ঘুমালে ফিস বরাদ্দ থাকবে না। এটা ফ্রী! তবে শুধু তোমার জন্য। আমার কাঁধে তার অধিকার ছাড়া আর অন্য কারো অধিকার হস্তক্ষেপ করার বিন্দু মাত্র অনুমতি ফায়াজ আবরার পূর্ব দিবেনা। ‘

আড়ালে কিঞ্চিৎ হেঁসে অন্যদিকে অবলোকন করি, পূর্ব মানুষটা ভীষণ ত্যাড়া।ঘাড়ত্যাড়া! এইযে সে নিরবে নিভৃতে ভীষণ ভাবে আমায় ভালোবাসেন তা কিছুতেই প্রকাশ করেন না। মেঘের উল্টোপিঠ এর ন্যায়! মেঘ তার উল্টোপিঠ কখনো প্রদর্শন করে? উঁহু! আমরা তা খালি চোখে, ভূমি হতে দেখতেও পাইনা মেঘের উল্টোপিঠে কি আছে?কেমন রঙ তার! পূর্ব তার বাহ্যিক রূপ সহজতর ভাবে প্রকাশ করলে তার উল্টোপিঠ প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক! আমিও দেখবো কিভাবে সে তার অনুভূতি না প্রকাশ করে থাকতে পারে। আমিও কম যাই নাকি?

গাড়ি ইউটার্ন দেয়ার সময় ঘুমে ঢুলতে থাকায় ধাম করে মাথা কাঁচে বাড়ি খায় আমার। মৃদু শব্দে ‘ উহ্’ করতেই মনে হলো গাড়িটা স্থির! আঘাতপ্রাপ্ত স্থান চেপে ধরে পাশে তাকাতে দৃশ্যমান হয় পূর্বের বিচলিত মুখোশ্রী। সিটবেল্ট খুলে হন্তদন্ত হয়ে আমার নিকট এগিয়ে এসে বললেন,

‘ ডাফার গার্ল! কতবার বললাম হুঁশে থাকো নয়তো আমার কাঁধে ঘুমাও। শুনলে না তো! এখন ব্যাথা কে পেলো? আমি না তুমি? ইডিয়ট একটা! ‘

তিনি আমার হাত সরিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান দেখতে ব্যাস্ত হলেন। খানিকক্ষন বাদে সরে বসে বললেন,

‘বেশি ব্যাথা করছে?’

আমি ক্ষীণ সুরে বলি, ‘ উঁহুম! একটু ব্যাথা করছে।’

পূর্ব লম্বা দম ফেললেন। তারপর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা বিরাজমান। হটাৎ তিনি গাড়ির দরজা খুলে ত্রস্ত পায়ে বের হয়ে যান। আমি সেদিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেই। যেখান যাচ্ছে যাক! আপাতত আমার হতে দূরে সরে যাক। রেগে আছেন নিশ্চিত। দেখা যেতে পারে রাগের বসে চার পাঁচটা থাপ্পড় অনায়াসে মেরে দিতে পারেন। পূর্ব মানবের রাগ তো! বলা যায়না! নিশ্চয়তা নেই। কখনো কি করে বসে বোঝা দায়!

নির্দিষ্ট এক সময় বাবদে তিনি ফিরে এসে ‘ ধপ ‘ করে বসে পড়লেন ড্রাইভিং সিটে। আমরা মুক্ত হাত হতে একহাত টেনে নিয়ে নিজের সন্নিকটে আনলেন আমায়। বুক দুরুদুরু করছে ভয়ে! মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলি,

‘ ক..কি করছেন?’

নিরুত্তর সে! মাথার ডান পাশে, আঘাত পাওয়া স্থানে কোমল হাতে কিছু এঁটে লাগিয়ে দিলেন। প্রথমত ঠান্ডার শিউরে উঠলাম দ্বিতীয়ত অনুভব করি ব্যাথাটা গায়েভ! কি আশ্চর্য! নিশ্চিত তিনি অয়েন্টমেন্ট লাগিয়েছেন কোনো। হুট করে তিনি আমায় হেঁচকা টানে নিজের কোলে বসিয়ে দিলেন। আমার ওপর দিয়েই সিটবেল্ট লাগিয়ে তার এক বলিষ্ঠ হাত আমার পিঠে স্থাপন করলেন এবং অপর হাতের বাহু আমার মাথার কাছে রাখলেন। আমি চমকে ছটফট করলে তিনি চোখ গরম করে তাকান! ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললাম,

‘ কি করছেন? এভাবে কোলে বসালেন কেনো?’

শুনশান নীরবতা পালন করা শেষে তিনি নিজ ওষ্ঠাধরের মাঝে ব্যাবধান তৈরি করে বললেন,

‘ চুপচাপ ঘুমাবে এখন। নো মোর ওয়ার্ড’স! আর একটু নড়াচড়া করলে তোমায় চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো। মাইন্ড ইট! ‘

ছটফট করা বন্ধ হলো! তবে হৃদপিণ্ডের দাপাদাপি চলতেই থাকলো। অস্বস্তি হচ্ছে সাথে একরাশ লজ্জা আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরেছে। পূর্বের হুটহাট করা কাজগুলো ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দেয় আমায়। মৌন হয়ে পূর্বের হৃৎস্পন্দন এর শব্দ কর্ণপাত করতে ব্যাস্ত হই! অস্বাভাবিক গতীতে লাফাচ্ছে। নেত্রযুগল বন্ধ করতেই কিছুক্ষণ পর কর্ণপাত হয় পূর্ব মানবের মিহি কন্ঠ! মিহি কন্ঠে তিনি বললেন,

‘ তোমার এই লাজুকরূপ আমায় ক্রমে ক্রমে কন্ট্রোললেস করে দিচ্ছে জানো তুমি? লজ্জা পেলে কাওকে মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগে তা মেবি তোমায় না দেখলে জানতাম না! এখন কি করি বলো তো? আমার যে অনর্থ করতে ইচ্ছে করছে। তোমার মন বিরুদ্ধে গিয়ে আদুরে স্পর্শ একে দিতে ইচ্ছে করছে! নিজেকে কন্ট্রোল করি কি করে বলো তো স্নিগ্ধময়ী? ‘

অতঃপর নিশ্চুপতা! আমি নিভৃতে হাসি। পূর্ব নিশ্চিত ভেবেছিলেন আমি ঘুমে। তাই তার মনের জমে থাকা কথনগুলো অনায়াসে বলে দিলেন। তার প্রতিটা কথা আমার জন্য বিশাল চমৎকার অনুভূতির সাম্রাজ্য!

কিয়ৎ বাদে,
কানের নিকট সে তার ওষ্ঠাধর মিলিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

‘ শুভ্রারাণী যখন লজ্জাবতী! স্নিগ্ধ প্রহরের তখন ছড়াছড়ি। একান্ত প্রহরের মাঝে সে প্রণয়ীনি। আমার একান্ত স্নিগ্ধময়ী সে! 💛’

___

তীব্র শব্দে যখন ঘুম আমার ভাঙলো আয়েশী ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভাঙতে নিলে অনুভূত হয় নিজের অবস্থান। গাড়ির দরজার সাথে মাথা এলিয়ে অন্য সিটে পা তোলা আমার। মাথার পিছন দিকটায় পূর্বের জ্যাকেট ভাজ করে বালিশের মতো করে রাখা। যার ফলে কাঁচে মাথা এলিয়ে দিলেও ব্যাথা অনুভব হয়নি!

সটান হয়ে বসে আশপাশে অবলোকন করি। নির্জন চারপাশ! পূর্ব কোথায়? গাড়ি থেকে চট করে নেমে পড়তেই অদূরে খেয়াল হলো পূর্বকে। তার বন্ধুমহলের সাথে দাঁড়িয়ে হেঁসে সেলফি তুলছেন! কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পড়লো আমার। নির্দিষ্ট স্থানে না পৌঁছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এরা সকলে সেলফি তুলছে কেনো?অদ্ভুত তো! চিন্তামগ্ন হয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই অরণ্য ভাইয়া বললেন,

‘ হেই লিটল গার্ল! ঘুম ভেঙে গেছে? ‘

এবার সকলের দৃষ্টি একসাথে আমার ওপর এসে স্থাপিত হলো। একসাথে সবার তাকানো দেখে সঙ্কোচ লাগলো খানিক পরিমাণ! নম্র কন্ঠে বলে উঠি,

‘ জি ভাইয়া। আপনারা এখানে কি করছেন?’

‘ ছবি তুলবো! তাই এখানে গাড়ি থামিয়েছি। ভিউটা দেখো কতো সুন্দর। ‘

অরণ্য ভাইয়া তার ক্যামেরা দিয়ে আশেপাশের ছবি তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। পূর্বের বাকি বন্ধুরা, শুভ, আর্নাদ, তায়িন, সামাদ ভাইয়ারা তারাও ব্যাস্ত ছবি তোলায়। একমাত্র পূর্ব মানব সে ছবি তোলা আপাতত বাদ দিয়ে ফোন গুতাচ্ছেন মনোযোগ সহকারে। আমি তার দিকে এগোই! মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বললাম,

‘ বাকিদের গাড়ি কোথায়? ‘

ফোনের মাঝে চাহনি সীমাবদ্ধ রেখেই তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

‘ আসছে! পিছনে। সবাই আসলে এখান থেকে ব্রেকফাস্ট করে তারপর একসাথে যাবো। ‘

রেস্টুরেন্টের কথা শ্রবণ হতে চারপাশে তাকালাম। অদূরে এক দু’তলা বিশিষ্ট ভবন দাপট নিয়ে দাঁড়িয়ে। বুঝতে বেগ পেতে হলো না ঐটাই মূলত রেস্টুরেন্ট। কারণ চারপাশে তেমন কোনো ভবন বা দোকানের হদিস অব্দি নেই। তারা ভাবী আমায় ডেকে ছবি তুলতে নিয়ে গেলেন। যদিও অনিচ্ছুক ছিলাম তবুও মুখের ওপর ‘ না ‘ বলে দেয়া বড্ড বেমানান।

সবার গাড়ি এক এক করে আসতেই অরণ্য ভাইয়া আর শুভ ভাইয়া আগে ভাগে ছুটলেন রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার করতে। পরিশেষে সকলে সকালের নাস্তা শেষে ফের যাত্রা শুরু হয় গ্রামের উদ্দেশ্যে। এবার আর পূর্বের সাথে বসার সুযোগ হয়নি। আম্মুর সাথে বসেছি অন্য গাড়িতে। ইচ্ছটা আম্মুর, তার সাথে বসতে হবে বাকিপথ!

গ্রামে পৌঁছাতে বেশ রাত হলো। রাত ৯ টা! সেদিন কার মতো সবার সাথে কথা শেষে যে যার মতো রুমে চলে যায় ক্লান্ত দেহ নিয়ে! তবে পূর্বের গ্যাং আর ভাইয়ারা হুট করেই ছাঁদে চলে গিয়েছিলেন আড্ডা দিতে। সাথে পূর্বও ছিলেন। আমি রুমে এসে হুমায়ুন আহমেদ এর ‘ অপেক্ষা ‘ বইটি নিয়ে বসে পড়ি। যদিওবা তুমুল ইচ্ছে ছিলো ছাঁদে যাওয়ার তবে পরবর্তীতে ইচ্ছেটাকে দমন করে নিয়েছি।

বই পড়তে পড়তে রাত অনেক হয়ে যায়। মূলত পূর্ব মানবকে কিয়ৎ সময়ের জন্য মস্তিষ্ক থেকে সরাতে এই পন্থা অবলম্বন করা। বই তার নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতেই কারো দৌড়ে আসার পদধ্বনি কর্ণপাত হয়! রাত অনেক হয়েছে। এতো রাতে আবার কে আসছে? পূর্ব তো আসার কথা নয়! নানু বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার আগ অব্দি আমাদের আলাদা থাকতে বলেছেন।

পিছনে তাকাতেই দৃশ্যমান হয় অরিনকে। তারা ভাবী পাশেই দাঁড়ানো। অরিন হন্তদন্ত হয়ে বলল,

‘ দোস্ত! পূর্ব ভাই আর তার পুরা গ্যাং’সহ তোর ভাই ছাঁদে মদ খাইয়া টাল হয়ে পড়ে আছে। ‘

আমি বিষ্ফোরিত নয়নে তাকাই। অবাক কন্ঠে বলে উঠি, ‘ কি বলছিস এসব? মদ তাও এখানে? কে আনলো? আর তারা সবকিছু ছেড়ে এই ছাইপাঁশ বা কেনো খেলো? এটা হারাম খাদ্য তা জানেনা? ‘

অরিন লম্বা শ্বাস নিয়ে তারা ভাবীকে ইশারায় কথা বলতে বলল। ভাবী বললেন,

‘ ওদের কোনো দোষ নেই। ওদের জোর করে খাইয়েছে দোল! দু’জন ছেলে মদ এনেছিলো। আমি তাদের চিনিনা হয়তো তুমি চিনবে। ওরা ছাঁদে কথা বলছিলো তখন ওই দু’জন ছেলে ওদের কোকা – কোলার গ্লাসে মদ মিশিয়ে এনে ইচ্ছে করে খাইয়ে দিয়েছে। পূর্ব’রা মনে করেছিলো সামান্য বিয়ার হবে। পূর্ব খেতে চাইনি একদমই। অরণ্য তখন মদ খেয়ে টাল হয়ে ওকে খাইয়ে দিয়েছে। ‘

‘ বিয়ারেও এ্যালকোহল থাকে ভাবী। ওরা তবুও..! নানু, নানা জানলে কি হবে বুঝতে পারছো?’

‘ ওদের সবাইকে ওপরের রুমে আঁটকে রেখেছি।সবাই ঘুমে! কিন্তু পূর্ব তোমার নাম ধরে চিৎকার করছে। তাই বলছি কি দোল..! পূর্বকে আমি তোমার রুমে দিয়ে যাচ্ছি। ওকে একটু সামলে নিও।’

বলেই দু’জন হাওয়া! অতঃপর পূর্বকে দু’জন কোনোরকম টেনেটুনে এনে আমার রুমে বেডে বসিয়ে চলে যেতে যেতে ‘ বেষ্ট অফ লাক ‘বলে দৌড় দেয়! বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি নির্বাক! কোনো কিছু বলার সুযোগ অব্দি দিলোনা আমায়? পূর্ব বেডে বসে ঢুলছেন। শুষ্ক ঢোক গিলে তার নিকট এগিয়ে যেতেই তিনি আমার হাত ধরে টেনে বেডে ফালালেন! আমার গলায় তার মুখ গুঁজে ওষ্ঠাধরের সুক্ষ্ম স্পর্শ একে দিয়ে মাতাল কন্ঠে বললেন,

‘ লেট’স লাভ ইচ আদার দোলপাখি! কিস মি ফাস্ট! ‘

রাত ৩ টা! নিস্তব্ধ চারপাশ! শুনশান নীরবতা কে ঠেলে মাঝেমধ্যে ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ কর্ণপাত হচ্ছে।নানুদের বাড়ি চার তলা বিশিষ্ট। নানুর বিল্ডিং এর পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটা টিনের ঘর আছে। হটাৎ বর্ষণ শুরু হওয়াতে টিনের চালে পড়া বর্ষণের পানির শব্দধ্বনি আশপাশে বিরাজমান মৌনতাকে চট করে কাটিয়ে দিলো। বজ্রপাতের শব্দ ধরণীতে আছড়ে পড়ছে ক্রমাগত। কালচে আকাশ মেঘবর্ণ রূপ ধারণ করে এখন কমলাটে হয়েছে!

আকাশ’সম চমকে আমি এক ধ্যানে তাকিয়ে পূর্ব মানবের মুখোশ্রী প্রতি! সে স্থির নেই আমার মতো। আমার এক হাত টেনে আলত করে তার ওষ্ঠাধর স্পর্শ করালেন। সর্বাঙ্গ আমার শিরশির করে উঠলো। হিতাহিত কান্ডে আমার মস্তিষ্ক থ! পরবর্তী কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা ক্ষণের জন্য জানাতে ব্যার্থ হলো। হুট করে পুনরায় বজ্রপাতের শব্দধ্বনি কর্ণপাত হতে আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে নিজে বিছানার শীর্ষ প্রান্তে গিয়ে মিশে গুটিশুটি হয়ে বসি। কম্পমান ওষ্ঠাধর, হাত – পা কে শীতল সান্ত্বনা দেয়ার প্রয়াস!

পূর্ব ফ্লোরে পড়তেই ব্যাথাতুর শব্দে ‘ উহ্ ‘করে উঠলো। খানিক বাদে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ঢুলতে ঢুলতে বললেন,

‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড? এভাবে ধাক্কা দিলে কেনো? কিস করতে বলেছি ধাক্কা দিতে নয় ষ্টুপিড! ‘

আমি নিজেকে সামলে বলি, ‘ আপনি রুম থেকে যান। এক্ষুনি! ‘

পূর্ব ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। ঘাড় দুপাশে এলিয়ে ইশারায় ‘না ‘ নির্দেশ করে বসে পড়লেন বেডে। দুই পা মুড়িয়ে নিয়ে! পাশে অবহেলায় পড়ে থাকা আমার নীলচে রঙের ওড়নাটা নিজের নাকের নিকট ধরে লম্বা শ্বাস টেনে ওড়নাটা বুকে জরিয়ে ধরে বললেন,

‘ এই মেয়ে! তুমি জানো তুমি আমার কাছে কি?কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তুমি আমার জীবনে। আমি খামখেয়ালি স্বভাবের ছিলাম। নিজেকে নিয়ে কখনো ভাবিনি। নিজের যত্ন কখনো করিনি! তুমি যেদিন আমার জীবনে আসলে সেদিন থেকে সবকিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেলো। সবকিছু হয়ে গেলো স্নিগ্ধময়! সুশৃঙ্খল! প্রতিটা সেকেন্ড, মূর্হত আমি ‘ তুমি ‘ ছাড়া কিছু ভাবিনা! ভাবতে চাইও না স্নিগ্ধময়ী। নিজের কেয়ার এই জীবনে কোনোদিন না করলেও আমি প্রতিটা মূর্হত আড়ালে, আবডালে তোমায় আগলে রাখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি! ‘

তিনি হটাৎ হুড়মুড়িয়ে আমার কাছে এগিয়ে আসলেন। টেনে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে এক প্রকার ঝাপটে ধরে ফের গলায় মুখ গুঁজলেন। নম্র, শীতলতা মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,

‘ একটু চুপচাপ থাকো তো! আদর করা লাগবে না। আই নিড স্লিপ! অনেকদিন তৃপ্তির ঘুম ঘুমায়নি। আজ ঘুমাবো! নড়বে না। দূরে যাবে না। তাহলে কিন্তু খবর আছে। ‘

পূর্ব মানব নিশ্চুপ হলেন! খানিকক্ষণ বাদে ভারী নিঃশ্বাস গলায় এসে বাড়ি খেলো। বুঝতে বাকি নেই তিনি ঘুমে বিভোর। লজ্জায় কুপোকাত হয়ে গেলেও কেনো যেনো তার থেকে সরতে ইচ্ছে হলো না। তার দেহ থেকে ভেসে আসা পারফিউমের গন্ধ আমার নেত্রযুগলে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ঢেলে দিলো।

___

‘ মা, তুই এতো সকালে গোসল করেছিস কেনো?’

আম্মুর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর! চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে ঝাড়া বাদ দিয়ে পিছন ফিরি। বিচলিত দৃষ্টি নিয়ে আম্মু আমার দিকে এগিয়ে আসলো। কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ কি হলো? বল! ‘

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘ এটা কেমন প্রশ্ন আম্মু? তুমি জানোনা গ্রামে আসলে আমি সকাল সকাল গোসল করি? আর তোমার কন্ঠ, চেহারার এ অবস্থা কেনো? কিছু কি হয়েছে? ‘

‘ হয়েছে বলতে! হয়ে গেছে। তোর নানী ওদিকে কেলেংকারী কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে! ‘

‘ মানে?কেনোও?’

আম্মু কন্ঠের খাদ নামিয়ে বললেন,

‘ পূর্ব রাতে নাকি তোর রুমে মাতাল হয়ে গিয়ে তোর সাথে জবরদস্তি করছিলো? তোর সিহা মামী আছে না? তার বড় ছেলে শোভন! সে খুব বাজে একটা ভিডিও দিয়েছে যেখানে পূর্ব তোর সাথে জবরদস্তি করছিলো তা উল্লেখ আছে। এটা দেখে তোর নানী রেগে আছে খুব। একে সে পূর্বকে আগে থেকে তেমন পছন্দ করতো না পূর্ব গম্ভীর, রগচটা দেখে তার ওপর এখন এই কাজ! সে পূর্বকে তোকে ডির্ভোস দিয়ে বলছে শোভনের সাথে বিয়ে দিবে। ‘

সিহা মামীর নাম শুনে মাথায় যেমন রক্ত চাপলো আমার। তার ওপর শোভনের করা কর্মে রাগের বশে মাথার রগ ফেটে যাওয়ার উপক্রম। চেঁচিয়ে বলি,

‘ আম্মু! শোভন একেই তো আমাদের অনুমতি ছাড়া রুমে ভিডিও করলো তার ওপর তার সাথে বিয়ে? নানু এই ছোট কারণে আমায় পূর্বকে ডির্ভোস দিতে বলছি! মানে যাচ্ছেতাই! আমার জীবন, আমি কি করবো না করবো তা একান্ত আমার ব্যাপার এতে অন্যকেও কেনো বাম হাত ঢুকাবে? আর পূর্ব আমার সাথে জবরদস্তি করেছে এটা কি সেই শোভন বলেছে? আশ্চর্য! এত বড় মিথ্যা বলে তার লাভ কি হচ্ছে? ‘

‘ আস্তে মা! চিল্লাস না। বাড়ি ভর্তি মানুষ। গ্রামের সব মানুষ উঠোনে। তারা কেও তো জানতো না তোদের বিয়ের কথা। সবাই উল্টো জো ধরে বাড়ি তে পুলিশ নিয়ে এসেছে। আচ্ছা দোল, পূর্ব কি এখনো তোর ঘরে? ও কি সত্যিই..’

আম্মুর মুখের কথায় লাগাম টেনে বলি,

‘ তুমি এই কথা বলতে পারলে আম্মু? আশ্চর্য তো! হয়েছে কি তোমাদের? পূর্বসহ কাল ওর বন্ধুদের কেও জোর করে কোল ড্রিংকস বলে মদ খাইয়েছে। ওদের কোনো দোষ নেই! পূর্ব আমার রুমেই ছিলো। ঘুমে! আর জবরদস্তি মানে কি?পূর্ব আমার হ্যাসবেন্ড আম্মু! ‘

আম্মু তপ্তশ্বাস ফেলে বলল, ‘ গ্রামের রীতি তুই জানিস না মা। যা পূর্বকে ডেকে নিচে নিয়ে আয়! ‘

আম্মু চলে গেলো চটজলদি। আমার আশপাশ এখনো ঘোরাচ্ছে। এসব কেমন কাহিনি? সিহা মামীর কুটনৈতিক বুদ্ধি হবে এটা নিশ্চিত। নিজের ছেলের সাথে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় এখন অপকর্ম রটাচ্ছেন।

রুমে এসে পূর্বকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই মিললো। হাতে থাকা লেবু পানির গ্লাসটা পাশে রেখে তার পাশে গিয়ে বসি। হাত দিয়ে দুই তিনবার জোরে ধাক্কা দিতেই চট করে চোখ খুললেন। অতঃপর চোখমুখ কুঁচকে উঠে বেডে হেলান দিয়ে বসলেন। মাথা চেপে ধরে উদ্বেগ নিয়ে বললেন,

‘আমার এতো মাথা ব্যাথা করছে কেনো?’

লেবু পানি রাখা গ্লাসটা তার হাতে তুলে দিয়ে ইশারায় তাকে বলি সম্পূর্ণটুকু শেষ করতে। চোখ মুখ কুঁচকে গ্লাসের সবটুকু শেষ করে বললেন,

‘লেবু পানি? ‘

আমি ম্লান হেঁসে বললাম, ‘ আপনি একজন টিচার, তার ওপর ডাক্তার! তবুও আপনি মদ খেলেন। লজ্জা লাগছে না? ‘

পূর্ব চমকে তাকালেন। মুখোশ্রী থমথমে করে রাশভারী কন্ঠে বললেন,

‘ কিসব বলছো? মাথা ঠিক আছে? আমি কেনো এ্যালকোহল খেতে যাবো? ‘

‘ অহ আচ্ছা! আপনি খাননি? অরণ্য ভাইয়া যে কাল আপনাকে জোর করে কিছু খাইয়েছিলো তা মনে আছে? ‘

পূর্ব আমতা আমতা করে বললেন, ‘ হ্যা।বাট ওটা তো বিয়ার ছিলো। ইভেন তবুও আমি খেতে চাইনি!’

‘ বিয়ার না ঐটাই মদ ছিলো। আর বিয়ারের এ্যালকোহল থাকে। আচ্ছা যাইহোক! ড্রেস চেঞ্জ করে এসে নিচে চলুহ জলদি। কাল যা করেছেন তার খেসারত দিতে হবে না? ‘

পূর্ব তার নেত্রযুগল বড় বড় করে বললেন, ‘ মানে?’

বদলে মুচকি হেঁসে তাকে ঠেলেঠুলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেই। পরবর্তী ধাক্কা এতো সহজে যে হজম হবেনা তা নিশ্চিত। সিহা মামী কোনো নরমাল ব্যাক্তি নন! প্যাচের রাণী সে। তিল থেকে কথা তাল অব্দি গড়াতে সে বেশ পটু।

___

শান্ত পরিবেশ! পূর্ব নিজের রক্তিম দৃষ্টিপাত কোনো রকম নেত্রযুগল বন্ধ করে লুকিয়ে রেখেছে। রাগে রীতিমতো তার হাত – পা প্রবল কাপছে! কিন্তু সে চুপ। তার এই নিশ্চুপতা আমার ভালো লাগলো না।পরিস্থিতি তার বিপক্ষে অথচ তিনি চুপ?

সবাই কটু কথা বলছে পূর্বকে নিয়ে। আমার সাথে জবরদস্তি করেছে সে, আমায় আঘাত করেছে! বিবাহিত হওয়া সত্বেও দূরে থাকার রীতি ভঙ্গ করে সে আমার নিকট এসেছে, মদ্যপান করেছে! কটু কথার সাথে কয়েকজন তাকে গালিও দিয়েছে। পূর্বের বাবা – মা তাদের চুপ করাতে ব্যার্থ! আমি জোরালো কন্ঠে ধমক দিয়ে, কথা শুনিয়ে। যুক্তি দিয়েও কাজ হয়নি! নানু, নানা দুজনে একদম মৌনতা পালন করছে। পূর্ব এরমধ্যে শুধু একবার বলেছেন, ‘ আমি শোভনের সেই ভিডিও দেখতে চাই। দোলার সাথে জবরদস্তি করেছি। ওকে আঘাত করেছি সেই ভিডিওটা আমি দেখতে চাই! ‘

শোভন ভিডিওটা দেখায়নি। কুলাঙ্গার বলে পূর্বকে ধমক দিয়েছে। আমি সেই সময় রেগে হাত উঁচু করে শোভনকে থাপ্পড় দিতে গেলে সে মাঝপথে আমার হাত খপ করে ধরে বলল,

‘ সুন্দরীর হাতে এসব থাপ্পড় মানায় না! আদর মানায়! ‘

কথাটা আস্তে বলেছিলো শোভন। পূর্ব, সায়ান আর অরিন বাদে কারো কানে পৌঁছায়নি। ভাইয়া তেড়ে আসতে নিলে মাঝপথে পূর্ব এসে স্থির দৃষ্টি ফেলে আমার হাত ছাড়িয়ে নেন। শোভনের ফোন কেড়ে নেন চোখের পলকে। ভিডিওটা স্ক্রিনেই ছিলো। লক করা নেই ফোনে! ভিডিওটা যে ফেইক তা দুর্দান্ত ভাবে প্রমাণিত করে দিলো সে সেকেন্ড এর মাঝে। গঠনমূলক যুক্তি অনুসারে তেজী কন্ঠে বললেন,

‘ ভিডিওটা ইডিটেড এটা প্রুফ’ড! তার থেকে বড় কথা একজন অপরিচিত ছেলে একজন মেয়ের রুমের ব্যাক্তিগত মূর্হত অগ্রাহ্য করে ভিডিও করলো আপনারা সেই বিষয় তুলে না ধরে আমাকে উল্টোপাল্টা গুজব আরোপ করে গালি- গালাজ করছেন?বিবেকে বাঁধা উচিত! আর দোল আমার লিগ্যালি ওয়াইফ। ওর সাথে এক রুমে থাকা জায়েজ আছে আমার। আর রইলো মদ খাওয়ার বিষয়! এটা আমরা ইচ্ছাপূর্বক খাইনি বরং জোর করা হয়েছে। এটাও শীগ্রই আমি প্রমাণ করে দিবো। আর কিছু বলার আছে আপনাদের? ‘

সকলে মৌন! এতক্ষণ যারা দাপট দেখিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছিলেন তারা আস্তে আস্তে ফাঁক দেখে কেটে পড়ছেন। এতোটা তুচ্ছ বিষয়ে পুরো গ্রামের লোক জরো হওয়ার পিছনে যে নিশ্চয়ই শোভনের কোনো হাত আছে তা নিশ্চিত আমি! পূর্ব সবাইকে নিশ্চুপ দেখে বললেন,

‘ওকে ফাইন! আর কারো কিছু বলার নেই যেহেতু, আমি আমার ওয়াইফ কে নিয়ে এখনি চলে যেতে চাচ্ছি! ‘

বাক্যের ইতি টেনে তিনি আমার নিকট আসলেন। আশপাশ না দেখে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। পরিবারের সবাইকে নানা – নানু বাহিরে আসতে দেননি। তাদের ভিতরে আঁটকে রাখ হয়েছে। সঙ্কিত হয়ে বললাম,

‘ পরিবার সবাই কি আমাদের সাথে যাবে না?’

সে নিরুত্তর! মুখোশ্রী ভীষণ থমথমে। আমার আর কথা বলার সাহস হলো না। বরঞ্চ লজ্জা লাগলো! কষ্ট হলো! এখানে এসে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে জানলে পূর্ব’সহ বাকিদের কখনোই এখানে আনতাম না। পূর্ব আমায় গাড়িতে বসিয়ে স্প্রীডে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। গ্রাম থেকে বেড়িয়ে জেলায় এসে গাড়ি সাইড করে থামিয়ে হুট করেই পূর্ব মানব আমায় তার উষ্ণ আলিঙ্গনে আমন্ত্রণ জানিয়ে আগলে নেন! কানের নিকট ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,

‘ আমরা আজ আবার বিয়ে করবো। আবার তোমায় তিন কবুল বলে নিজের রুহ এর সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবো! পুরো শহরকে জানাবো তুমি শুধু আমার। একান্তই আমার রাণী! ‘

স্পষ্টত উপলব্ধি করি তার হাত পা কাঁপছে। ওষ্ঠ জোড়া অব্দি কম্পমান! আমি আলত সুরে বলি,

‘ এতোটা হাইপার হয়ে যান কেনো আমায় নিয়ে সর্বদা? ভালোবাসেন আমায় পূর্ব? ‘

‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা শোনার জন্য অন্তরাল ছটফট শুরু করলো। কিন্তু আমার ধারণা সে পাল্টে দিয়ে যা বললেন তা শুনে ক্ষনিকের জন্য আমি স্তম্ভিত হয়ে রইলাম!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here