মিঠে_আলোয়,পর্ব_৪
ফায়জা_করিম
তারমানে অভ্র ছেলেটাকে তুমি আর কোনদিন দেখোনি?
না।
হমম.. তাহলে এখন তুমি কী করতে চাও?
একটা জিনিসই চাই, অভ্রর সাথে দেখা করতে চাই।
কিন্তু ধরো যদি এমন হলো যে অভ্র কারো সাথে ইনভলভ হয়ে গিয়েছে তখন?
এই প্রশ্নটা যে মিঠাইর মাথায় আসে না তা নয় কিন্তু এটা নিয়ে ও খুব বেশি ভাবতে চায় না। এমন যে হবেই তাতো নাও হতে পারে,এমনও হতে পারে যে অভ্রও ওকে খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না।
এক কাজ করলে হয় না, তোমার বাবার কাছে অভ্রর কোন ঠিকানা আছে কিনা.. মানে তোমার কথামতো আঙ্কেলই যেহেতু ওর বাবাকে ট্রান্সফার করিয়েছিলেন।
এতোদিন ওখানে ওদের থাকার কথা না তাছাড়া
বাবা জানলেও আমাকে সেটা বলবে না। আমি আগেও বেশ কয়েকবার বাবার কাছে বিষয়টা তুলেছি আর বাবা সুন্দর করে বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছে।
মেয়েটার জন্য মায়া হলো… না পারছে বাবার মতের বিরুদ্ধে যেতে আর না পারছে বাবার পছন্দকে মেনে নিতে।
“আচ্ছা আমি কী আঙ্কেলের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কোন আলাপ করবো?” অনন্য জানতে চাইল।
“না প্লিজ.. এটা আমার আর আমার বাবার সিক্রেট ব্যাপার , এর মধ্যে তোমার ইনটারফেয়ার করা বাবার পছন্দ নাও হতে পারে.. তাছাড়া কথাটা আমার পক্ষ হয়ে বললে জিনিসটা খুব বাজে দিকে মোড় নিতে পারে। মনে হতে পারে আমি নিজের বাবাকে সম্মান করিনা.. আসলে ব্যাপারটা খুব কমপ্লিকেটেড অনন্য, আমি জিনিসটা কাউকে বোঝাতে পারিনা।”
আচ্ছা.. এখন চলো আমরা ফিরে যাই, নাহলে হয়তো তোমার বন্ধুরা আমাদের সত্যি সত্যি কাপল মনে করতে পারে।
মিঠাই কাপড় ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল।
এই প্রথম অনন্যকে ঠিক ততোটা বিরক্তিকর মনে হলোনা মিঠাইর। এই প্রথম নিজের মনের বাইরেও একটা মানুষকে ভরসা করে, নিজের মনের কথাগুলো বলল ও।
লেক একপাশে রেখেক ক্যাম্পিংয়ের জন্য তাবু ফেলল ওরা সবাই মিলে। মোট চারটা তাবু… এক একটায় চারজন করে। লাঞ্চের পরে পাখি দেখা ছাড়াও নানা রকম গেমে ব্যাস্ত সময় পার করল সবাই।
সন্ধ্যায় তাবুর বাইরে ওদের আড্ডাটা বসল। মমর বয়ফ্রেন্ড হেনরি দারুন বারবিকিউ করে। মম আর হেনরিকেই এই দায়িত্ব গছিয়ে দিল সোহান। ওর এখন গানের বাই উঠেছে… টুংটাং না করতে পারলে ওর এখন হবে না।
“কী ব্যাপার বস… মন খারাপ?” অনন্য এসে পাশে বসল ধপ করে।
“কী! আমি তোমার বস?”
“ওই আরকি… তুমি কী গান পছন্দ করো ?”
“করি.. কেন?” মিঠাই অবাক হলো অনন্যর প্রশ্নে। ছেলেটা সব উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে খালি।
কার গান?
আরিজিৎ এর শুনি, জাস্টিন বিবার..
বাংলা গান শোন না?
তাও শুনি.. কিন্তু রবীন্দ্র সংগীত শুনলেই আমার শুধু ঘুম পায়।
ভাল তো… একদম ড্রাগসের মতো। আরাম করে ঘুমিয়ে যাবে।
হমম.. আচ্ছা তুমি কী সারাক্ষণ ওইসব ফসিল টসিল ঘাটতে থাক?
সারাক্ষণ না.. তবে ওটা আমার পিএচডির সাবজেক্ট, না চাইলেও পড়তে হয়।
আচ্ছা এসব জেনে কী হবে বলতো? মনে করো একসময় ছিলই না হয় বড়ো বড়ো দাঁতওয়ালা ম্যামথ অথবা বিশাল দৈত্যের মতো ডাইনোসর.. কিন্তু এখন তো আর তারা নেই। তাহলে তাদের নিয়ে এতো পড়াশুনা করে কী হাসিল হবে? অযথা ওসব একশ বছরের মমি নিয়ে নাচানাচি।
মিঠাই যে ওকে ইচ্ছে করে খোঁচাচ্ছে বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না অনন্যর। মিঠাই নিজেও সাইন্সের ছাত্রী আর একজন সাইন্সের ছাত্রী জানবেনা ফসিল কেন গুরুত্বপূর্ণ গোটা মানব সভ্যতার জন্য এটা ইম্পসিবল। তবে অনন্য ওর এসব কথার ধার কাছ দিয়েও গেলনা। উল্টো মিঠাইকে প্যাচে ফেলে দিল।
ঠিক তুমি যেমন কোন আশা নেই জেনেও অভ্রকে দেখতে চাও, ওর সাথে দেখা করতে চাও… ঠিক তেমনি একদল কৌতূহলী মানুষ নিজেদের শেকড়ের সন্ধান করতে চায়, এতে কারো কোন লাভ ক্ষতি নেই।
উত্তরটা বুমেরাং এর মতো লাগল মিঠাইর কাছে। অনন্য বোধহয় ঠিকই বলছে, লাভ লস যাই হোক মিঠাই আসলে অভ্রকে দেখতে চায়।
বয়ঃসন্ধি কালে বন্ধুত্বের যে আবরনে ওদের সম্পর্কটা ঢাকা ছিল সেটা আসলেই ওর জীবনে কোন গুরুত্ব বহন করে কিনা… না জানা পর্যন্ত কোন শান্তি নেই মিঠাইর আর মিঠাই এই অন্তর্জ্বালা থেকে মুক্তি চায়।
রাতের খাবারটা ওরা ওখানে বসেই খেল। সোহানের গিটারের টুংটাং শব্দ আর হালকা উচ্ছল হাসির আভাস গ্রুপের সবাইকে সতেজ করে রাখল বেশ অনেকটা সময়।
ক্যাম্পফায়ারের আগুনের লালচে আভায় মিঠাই তখন স্বপ্নের জাল বুনছে। সত্যি যদি এ জীবনে অভ্রর সাথে আর একবার দেখা হয় তাহলে ঠিক কী কী করবে ও? নিজের ভাবনায় এতোটাই ডুবে গিয়েছিল মিঠাই যে তাবুর গা বেয়ে কখন যে আটপেয়ে প্রানীটা ওর পিঠে এসে নেমেছে বুঝতেই পারেনি ও। হঠাৎ চামড়ায় অদ্ভুত শিরশিরে একটা অনুভূতি হতেই চিৎকার করে উঠল মিঠাই।
কী হয়েছে?
সবার আগে অনন্যই এসে আকড়ে ধরল মিঠাইকে৷ মিঠাইর খানিকটা দূরেই বসে ছিল সে।
ভয়ে তখন কথা বলতে ভুলে গেছে মিঠাই, ওর পুরো শরীর এমন ভয়নক ভাবে শক্ত হয়ে যাচ্ছিল যে অনন্য দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেও ওকে স্বাভাবিক করতে পারলনা। পরে মিঠাইকে রীতিমতো ঝাঁকাত লাগল অনন্য। আধো ঘুমে ঢুলতে থাকা গ্রুপের অন্যান্য সদস্যরাও ততক্ষনে ওদের দিকে উঠে আসছে মিঠাইর চিৎকার শুনে।
মিঠাই কী প্রবলেম আমাকে না বললে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না… তুমি এতো জোরে চিৎকার করলে কেন..কী দেখে ভয় পেলে আমায় বলো।
স্পা… স্পাইডার আমার গলা বেয়ে.. মাগো..
কোথায়!
আমি মরে যাচ্ছি অনন্য.. বাবাকে বলো আমাকে মাফ করে দিতে।
তোমার মাথা কী খারাপ হয়ে গেছে.. বলি মাকড়শা কোথায়?
আমার জা…
অনন্য টের পেল ওর হাতের উপর মিঠাইর সেন্সলেস বডিটা.. উপায়ন্তর না পেয়ে অন্য কেউ আসার আগেই মিঠাইর জামার ভিতর হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট সাইজের মাকড়সা পেল ও। বন্যপ্রানী গুলো অনেক সময়েই খুব বিষাক্ত হয়, তবে এটাকে দেখে ততটা ভয়নক মনে হলোনা।
সোহান কল করে দ্রুত একজন ডাক্তারকে নিয়ে আসল… সে দেখে জানাল মিঠাই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে, তাছাড়া মাকড়সাটা মিঠাইকে কামড়ানোর সুযোগ পায়নি।
মিঠাইর যখন জ্ঞান ফিরল রাত তখন ঠিক তিনটা।
“সরি… ”
তাবুতে ওর পাশে অনন্যকে বসে থাকতে দেখে ভীষন সংকোচ বোধ হলো মিঠাইর। ছেলেটাকে বুঝতে আসলেই বোধহয় ওর ভুল হয়েছে। অনন্য যথেষ্ট রেসপন্সেবল আর কেয়ারিং। মিঠাইর মনে হলো এবার বোধহয় ও হেরে যাবে বাবার কাছে।
সরি কেন?
তুমি না থাকলে আজ হয়তো আমি মরেই যেতাম।
ভয়ে!
“হয়তো তাই,” মাথা নিচু করে হাসল মিঠাই। ও সত্যি খুব ভয় পায় স্পাইডারকে।
অনন্য মিঠাইর মুখটা দেখছিল। আলোকিত একটা মুখ স্বল্প আলোর বন্যাতে ভেসে যাচ্ছে… অনন্যর কেমন দুঃখ হতে লাগল, মনে হলো মেয়েটা ওর কারনে দুঃখ পাচ্ছে না তো?
চলবে…..