মিঠে আলোয়,পর্ব_৩

মিঠে আলোয়,পর্ব_৩
ফায়জা_করিম

অভ্র.. এই নামটা মিঠাইর জীবনে রাজত্ব করেছে ওর পাঁচ থেকে তের বছর অব্দি। তারপর বাবার কারনে অভ্র হারিয়ে গেছে ওর জীবন থেকে।

ঠিক এই কারনে বাবাকে কখনো পুরোপুরিভাবে ক্ষমা করতে পারে না মিঠাই। যদিও মা মারা যাবার পর বাবা ওর নিঃসঙ্গতা দেখে ব্যাথিত হতো।

ঠিক দুদিনের নোটিশে অভ্রর বাবাকে অনাত্র বদলি করে দিয়েছিল ওর বাবা রেজওয়ান আহমেদ। কী, কেন, কোন দোষে তাদের চলে যেতে হচ্ছে বলতে পারেনি অভ্রও, শুধু বলেছিল ওর বাবাকে অফিস থেকে ট্রান্সফার করা হয়েছে, ওদের চলে যেতে হবে খুব দ্রুতই। কোথায়… সেটা মনিরুল আঙ্কেল অভ্রকে বলেননি।

তারপরও মিঠাই, অভ্রর সাথে যোগাযোগের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে.. কিন্তু অভ্রর কোন খোঁজ ও এখনও পায়নি। কিন্তু মিঠাই হাল ছাড়তে নারাজ। যেভাবেই হোক অভ্রকে একদিন ও খুঁজে বের করবে…করবেই।

অথচ এই অভ্রর জন্মদিনের কথাই মিঠাই ভুলে গিয়েছে! যতো নষ্টের গোড়া এই অনন্য ছেলেটা, গত এক সপ্তাহ ধরে ওকে একদম পাগল করে রেখেছে। বাসায় ঢুকেই মিঠাই সোজা ওর বাবাকে ফোন করল।

“কী রে মা? ”

“বাবা আমি অনন্যর সাথে মিট করেছি.. আমার মনে হয় না আমাদের রিলেশনটা রান করবে। প্লিজ বাবা তুমি অনন্যকে মানা করে দাও।”

“শোন মা, তুই অনন্যর সাথে সবসময় একটা নেগেটিভ মেন্টালিটি নিয়ে মিশলে তো ওর সব কিছুই তোর কাছে বাজে মনে হবে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে যার দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। তুই আগে ওর সাথে পজিটিভলি মেশ তারপর না হয় ডিসিশনটা নে.. আমার কাছে ছেলেটাকে সব সময় সৎ আর সরল মনে হয়েছে। ”

“বাবা আমি জানি বাট ছেলেটা আসলেই ডিজগাস্টিং, একদম গায়ে পড়া টাইপ আর তার কথাবার্তা বাবা… একদম, সে ব্রয়লার চিকেনকে বলে পোলট্রি মুরগী… ক্যান ইউ ইমাজিন।”

মেয়ের কথায় রেজওয়ান আহমেদ হো হো করে হেসে ফেললেন,” মারে… এতো ছোটখাট জিনিস ওভারলুক করতে না পারলে জীবনে সুখি হতে পারবি না.. জীবনের পথ খুব অমসৃণ। প্রতিটি বাঁকেই এমন কিছুর মুখোমুখি হবি যেখানে তোকে কম বেশি স্যাক্রিফাইস করতেই হবে, না হলে তোর এই না পাওয়ার ঝুলি এতো বেশি হবে যে, এক সময় তোর পাশে তুই কাউকেই পাবি না.. একদম একা হয়ে যাবি।”

বাবা এই কথাটা মিঠাইকে প্রায়ই বলেন। আসলে মিঠাই ওর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা না থাকলে ওর জীবনটা হয়তো একাকিত্বেই ছেয়ে যাবে। কিন্তু তাই বলে মিঠাই তার মনের বিরুদ্ধে, রুচির বিরুদ্ধে আপোষ করতে পারবেনা.. এটা ওর অস্তিত্বের প্রশ্ন, আর মিঠাইর বন্ধুরা আছে ওকে সব সময় হেল্প করার জন্য। ওদের ভরসাতেই নিজের দেশ ছেড়ে এখানে এম এস করতে এসেছে ও।

“বাবা আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।”

“বল মিঠাই।”

“বাবা আমাকে কী যে কোন ভাবেই অনন্যর সাথেই সংসার করতে হবে?” মিঠাই স্বর অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে।

মেয়ের কথায় রেজওয়ান জবাব দিলেন না, বরঞ্চ মৃদু হাসলেন।

“আমি তোমার জীবনের কোন ডিশিসন নেব না, মিঠাই। আমি তোমাকে আয়না দেখাব, আলো দেখাব কিন্তু তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত একান্তই তোমার, তুমি শেষ পর্যন্ত যে ডিসিশন নিবে আমি কষ্ট হলেও তা মেনে নিব।”

এই একটা জায়গায় মিঠাই দুর্বল। ওর বাবা ওর সাথে কখনো রুড আচরন করেন না। বাবা যেমন ওর খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড না তেমনি সে ওর উপর জেলারের মতো আচরনও করেন না। তবে ছোট থাকতে অদৃশ্য একটা গন্ডী টানা ছিল মিঠাইয়ের চারপাশে যেটা দিন দিন শিথিল হচ্ছে.. এই পরিবর্তনটা খুবই সূক্ষ্ম কিন্তু তবু টের পায় মিঠাই।

অনন্যর ফোনটা রিসিভ করে হ্যাঁ নাকি না বলবে বুঝতে পারল না মিঠাই। বাবা নাকি ওকে যেতে বলেছে মিঠাইর সাথে। কী যন্ত্রনা…!! মিঠাই ওর ফ্রেন্ডদের সাথে ক্যাম্পিংয়ে যাবে, আর বাবা ওর ঘাড়ে এই উৎপাতটাকে চাপাচ্ছে… অসহ্য।

“মিঠাই আমি কী ব্যাগ গোছাব না বাদ দিব?”

মন তো চাচ্ছিল.. রাগে কয়টা কিল বসাল মিঠাই বিছানায়। কিন্তু বাবার পছন্দের ছেলে.. ওকে একেবারে না করে দেয়া মানে বাবাকে দুঃখ দেয়া। কিন্তু বাবার পছন্দের এই ছেলেকে ও বিয়ে করতে পারবে না, নো… নেভার।

“মিঠাই আমি অপেক্ষা করছি… কিছু তো বলো।”

“ওকে তুমি রেডি হয়ে চলে আসো, আমরা সন্ধ্যা সাতটায় রওনা হবো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।”

“ওয়াও.. থ্যাংস মিট্ঠু।”

“হোয়াট!! কী বললে তুমি আমাকে?”

“আমি? থ্যাংক্স বললাম। ”

“এটা না.. তুমি আমায় কী নামে ডাকলে মাত্রই?”

“ওহ মিট্ঠু.. মিনার কার্টুন দেখনি ছোট বেলায়, খুব ফেভারিট ছিল কিন্তু বাচ্চাদের।”

“এই নামে আর কোনদিন আমাকে ডাকবে না, খবরদার।”

কড় কড় করে বাজ পড়ার মতো শব্দ মনে হলো….

“ওকে ওকে.. এতো রেগে যাচ্ছো কেন? তোমার সমস্যা হলে অবশ্যই ডাকবো না।”

“হ্যাঁ, আর কখনো ডাকবে না।”

অনন্যর হাসির শব্দ তখনও মিঠাইর কানে বাজছে। এই ছেলেকি আসলেই এতো জলি না ভঙ ধরছে?

“ওকে ফাইন.. কিন্তু এই নামটায় কী প্রবলেম আমি বুঝতে পারছি না। আচ্ছা আমি বরং তোমায় মি..”

“দয়া করে আমাকে মিঠাই বলেই ডাকবে, অন্য কোন নাম আমাকে স্যুট করেনা, আর আমি ভীষন অপছন্দও করি।”

“ফাইন… আমি সাতটায় তোমার বাসার সামনে হাজির হয়ে যাবো।” ফোনটা কেটে দিল অনন্য।

♦️♦️♦️♦️♦️♦️♦️♦️

নর্থ ক্যালিফোর্নিয়ার ফেইয়েটভেলে ওরা যখন পৌছাল তখন রাত দশটা। হোটেল খুঁজে পেয়ে রুম এলটমেন্ট নিতে নিতে আরও একঘন্টা গেল। এবার শুরু হলো অনন্যর খাবার নিয়ে কচড়া। সে ইতিমধ্যেই মিঠাইর দুই বান্ধবীকে হাত করে নিয়েছে। রাস্না আর সারা দুজনেই খুব সুন্দর অনন্যর পক্ষ হয়ে মিঠাইকে বকা দিচ্ছে.. বাইরে বাইরে মিঠাই সেটা হাসিমুখে গিললেও ,অনন্যকে চোখ রাঙ্গাতে একদম ভুলছে না। কিন্তু এই ছেলে ওর শাসনের তোয়াক্কা না করেই ওর বন্ধুর দলটাকে নিজের ফেভারে নিয়ে নিচ্ছে। অসম্ভব বিরক্ত লাগতে লাগল মিঠাইর।

“এরকম এটম বোম্ব হয়ে আছিস কেন? ”

সোহানের প্রশ্নে মাথা নাড়ল মিঠাই।

” দেখছিস না.. কি রকম উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, বাবার অনুরোধ নাও করতে পারলাম না।”

মিঠাই যে অনন্যর উপর ক্ষেপে আছে বুঝতে পারছিল সোহান কিন্তু অপরিচিত হলেও লোকটাকে মন্দ লাগছে না ওর। আঙ্কেল বোধহয় একে মিঠাইর গলায় বানতে চান আর মিঠাই তাতে রাজি হচ্ছে না। মেয়েটার কেন যে এতো কমপ্লেক্স ভিতরে ভিতরে… সবকিছু নিয়ে বাড়তি টেনশন করে, ভীষন ইনসিকিউরড থাকে।

“আমার মনে হয় তুই একটু বেশি নেগেটিভলি নিচ্ছিস ব্যাপারটা, সে এতোটাও খারাপ না। ”

“আমার তো ক্লাউন মনে হচ্ছে।”

“কেন?” সোহান হাত দুটো সোফার উপর ছড়িয়ে আরাম করে বসলো।

“কেন জানতে চাইছিস? চেনেনা, জানেনা রাস্নার সাথে দাঁত কেলিয়ে গল্প করছে। এই লোকের আসলেই কোন আক্কেল বোধ আছে বলে আমার মনে হয়না।”

“তো বেচারা কী করবে? তুই তো পাত্তাই দিচ্ছিস না, মুখ পাথরের মতো শক্ত করে বসে আছিস। তাই বাধ্য হয়েই হয়তো রাস্নাকে সঙ্গ দিচ্ছে। আচ্ছা উনি কী আঙ্কেলের চয়েস তোর জন্য?”

“এরকম কেন মনে হলো তোর?”

“কারন তুই ওনার উপর সেই লেভেলের বিরক্ত হচ্ছিস আর… তোর চেহারা অলরেডি তার জন্য বহুত পজেসিভনেস শো করছে।”

“মোটেই না, আমি রাসকেলটাকে পারলে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। ”

মিঠাইর রাগ দেখে সোহান হাসল। মিঠাইকে এখন বোঝাতে গেলে শুধু উল্টো বুঝবে, কিন্তু সোহান স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অনন্যর সাথে রাস্নার হাসাহাসি মিঠাইর মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু এই মেয়ে বড়ো জেদি হার স্বীকার করবে না।

মিঠাইদের আসল ট্রিপটা শুরু হলো পরদিন সকালে…গন্তব্য গ্রীন লেকস স্টেট পার্ক। দুদিনের ক্যাম্পিং করার পারমিশন রয়েছে ওদের। ওখানে পৌছতেই খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠলো দর্শনার্থীরা সবাই।

“ইশশ… কী সুন্দর পানি, আমি তো নামবই নামব,” রাস্না রীতিমতো লাফাতে লাগল।

“আমি তো বোটিং মাস্ট,” ইয়াসির ওর হাতের মাসল দেখাল।

এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে ওদের পনের জনের গ্রপের প্রায় সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

“তুমি কী করবে মিঠাই.. তোমার বন্ধুরা তো দারুন এনজয় করছে,” পাশে বসে মিঠাইকে প্রশ্ন করল অনন্য।

“আমিও করছি, ওদের দেখছি,” কাটাকাটা স্বরে জবাব দিল মিঠাই।

” মাই গড… তুমি কী এখনও আমার উপর রেগে আছ? আমি কিন্তু তুমি বলার পর থেকে রাস্নাকে আর একটুও সময় দেইনি।”

ঝট করে অনন্যর দিকে তাকাল মিঠাই, ” বার বার একই প্রশ্ন করার কোন মানে আছে? আর আমি বিরক্ত এটা তোমাকে কখন বলেছি, যতো খুশি গল্প করো, টাইম দাও আমার কোন প্রবলেম নেই।”

উত্তরে শুধু মিটমিট করে হাসল অনন্য। মিঠাইর মনে হলো এই ছেলের হাসি রোগ আছে। কাজে, অকাজে সে শুধু শুধুই হাসে।

“আমরা দুজনে বরং বসে না থেকে চলো লেকের পাড় ধরে একটু হেটে আসি।”

মিঠাই সত্যি করার মতো কিছু পাচ্ছিল না আর অনন্য হাজার হলেও ওর গেষ্ট, শেষ পর্যন্ত তাই অনন্যর পিছু পিছু হাটতে লাগল ও।

লেকের পানির রং এতো স্বচ্ছে, এতো সুন্দর.. যে মিঠাইর ইচ্ছে হচ্ছিল পানিতে পা ডুবায়।

“এই লেকটা মেরিমিকটিক ধরনের,” পানিতে একটা ছোট্ট ঢিল ছুড়ে মারল অনন্য।

“মানে!”

“এর পানির স্তরগুলো কখনোই একটা আরেকটার সাথে মেশে না.. এই কারনে এদের পানি সব সময় স্বচ্ছে থাকে। সাধারন জলাশয় গুলোতে ওয়েদার চেঞ্জের সাথে সাথে ইকোসিস্টেম মেইনটেইন পারপাস কিছু চেঞ্জ আসে, কিন্তু মেরিমিকটিক হ্রদগুলোতে তা হয় না।”

“ওহ… ” ঈষৎ ভ্রু কুঁচকে তাকায় মিঠাই। এই ছেলে হয় দুনিয়ার আজাইরা সব গল্প বলে নয়তো নিজের জ্ঞান জাহির করতে থাকে, বিরক্তিকর ।

“সেদিন তোমাকে ওয়াটার বিয়ারের কথা বলছিলাম মনে আছে? ওসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আমাকে বিভিন্ন ধরনের জলাধার, পানির ধরন, এসব স্তর গুলোতে জমে থাকা ফসিল এগুলো নিয়ে পড়তে হয়েছে।”

“ওহ,” মহা বিরক্ত লাগছে এখন মিঠাইর।

“তুমি বোধহয় বোর ফিল করছো।”

“একদম না,” মেকি একটা হাসি দিল মিঠাই। বোর! ওর নিজেরই এখন ফসিল হয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।

“আচ্ছা মিঠাই.. মনে করো আমাদের মধ্যে আর কোন ধরনের রিলেশন গ্রো করলো না, তাহলে তোমার সম্মন্ধে জানার আমার আর কোন রাস্তা রইল না, তাই না?”

“মানে?”

“তুমি মানে তো শুধু তোমার বর্তমান নও, তোমার অতীত, তুমি ভবিষ্যতের কাছ থেকে কী চাও সবটা। আমি কী এস এ ফ্রেন্ড সেটা জানতে পারি? না মানে যদি তুমি সাফোকেটেড ফিল না করো তাহলে…”

“এরকম কোন সম্ভাবনা কী আদৌ আছে? তুমি কী পারবে এই বিয়ে ঠেকাতে।”

“তুমি চাইলে অবশ্যই পারব। আমি জোর করে কোন বোঝা চাপানোর পক্ষে না। ”

“হমম,” মিঠাই ভাবনায় ডুবে গেল।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here