মায়াবিনী মানবী,পর্ব_১৯
হুমাশা_এহতেশাম
–আমার মেয়ের সমস্যা আছে তা জানা সত্ত্বেও কেন তুমি ওকে বিয়ে করতে চাও?
ভারী আর গম্ভীর কণ্ঠে আলআবি কে প্রশ্ন করে বসলেন জুইঁর বাবা ওলিদূন আজাদ।
তার পাশে ই একটু দূরত্বে মারবেল পাথর দিয়ে তৈরি করা বেঞ্চে বসে আছে আলআবি।চোখ তুলে সামনে দৃষ্টি দিতেই সবুজ ঘাসের উপর অনেককেই ব্যায়াম করতে দেখতে পেল আলআবি।অনেক কে আবার হাঁটতেও দেখা যাচ্ছে।একেবারে ত্রিশ থেকে ঠেকিয়ে পঞ্চাশ ষাট বছরেরও মানুষ আছে এখানে। ঘড়ির বড় কাটা টা ঠিক সাত আর আটের মধ্যখানে।ওলিদূন আজাদের প্রশ্নে আলআবি সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলতে লাগলো…
–আঙ্কেল আমরা যে জিনিস টা কে খুব ভালোবাসি অথবা যে জিনিসটা আমাদের খুব প্রিয় আমরা সেই জিনিস টা খুব যত্নের সহিত আমাদের কাছে রাখতে চাই।জুইঁ কে আমি ভালোবাসি। ওর সামান্য কানে না শোনার কারণে ওর প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো কমে যাবে না।জুইঁ কালা হোক,বোবা হোক হাটতে চলতে না পারুক তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।ও যে বেঁচে আছে এটাই আমার কাছে অনেক।
আলআবি তার কথা গুলো শেষ করে ওলিদূন আজাদ এর মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য তার দিকে তাকায়।কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার আলআবি অনুরোধের স্বরে বলল…
–প্লিজ আঙ্কেল আপনি না করবেন না। জুইঁ কে আমি সামলে নিব।হয়তো একটু সময় লাগবে কিন্তু আমি পারব।
ওলিদূন আজাদ এবার মুখ খুললেন। আলআবি কে উদ্দেশ্য করে বললেন…
–তোমার কথায় আমি রাজি তবে ভবিষ্যতে যদি দেখি আমার মেয়ের কোন কষ্ট হচ্ছে তাহলে যেদিন জানব সেদিন ই হবে তোমাদের সংসার জীবনের শেষ দিন।
–ইনশাআল্লাহ এমন দিন কখনোই আসবে না। (আলআবি)
আলআবির কথা শেষ হতেই ওলিদূন আজাদ দাঁড়িয়ে পরলেন। আর আলআবি কে বললেন…
–পরিবার নিয়ে কবে আসছো তা জানিয়ে দিও।
আলআবি ঠোঁটে চওড়া হাসি এনে ওলিদূন আজাদ কে ধন্যবাদ জানালো।ওলিদূন আজাদকে চলে যেতে দেখেই গাড়ি তে বসে থাকা জায়েফ দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়ে আলআবির পাশে এসে বসে পরলো।আলআবির কাধে হাতের ভর দিয়ে বলে উঠলো…
–মাম্মা এতো খুশি ক্যান তুই? তোর ওই না হওয়া গুরুচন্ডাল শশুর কি এমন বলল যে তুই খুশিতে বাক-বাকুম করতাছোস?
আলআবি ও জায়েফ এর কাধে নিজের একহাত দিয়ে বলল…
–না হওয়া শশুর কি?শালা এখন থেকে হবু শশুর বলবি।
–কিরে!না হওয়া শশুর থেইকা হবু শশুর হইলো কেমনে?(জায়েফ)
–আয় তোরে ফ্ল্যাশব্যাক থিকা বলি।(আলআবি)
জুইঁকে জুইঁর বাসায় ড্রপ করে আলআবি নিজের বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে সোজা তার বাবার রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।রুমে ঢুকতে ই চোখে পড়ে সিরাজ সাহেব ইজি চেয়ারে বসে হাতে থাকা একটা বইয়ে চোখ বুলাচ্ছেন।রবিঠাকুরের ই কোন একটা বই হবে হয়তো। আলআবি তার সারাজীবনে বাবাকে ওই একজনের ই বই পড়তে দেখেছে।
আলআবি গলা ঝেড়ে ডাক দিয়ে উঠলো…
–আব্বু!
সিরাজ সাহেব বই থেকে চোখ তুলে ছেলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলেন। সিরাজ সাহেব যতই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করুক না কেন তার কাছে তার ছেলেদের আবদার আগে। সবসময় এর মতো তাই আজও বইটা বন্ধ করে দিলেন।ছেলেকে বেডে বসিয়ে দিয়ে নিজেও আয়েশের সহিত বেডে বসে পড়লেন।
আলআবি একে একে জুইঁর ব্যাপারে সব খোলাসা করলো।আলআবির বলা শেষ হতে ই সিরাজ সাহেব বললেন…
–আমার ছোট হ্যান্ডসাম বয় খুব তারাতারি বিয়ে করছে তাই তো?
আলআবি হেসে দিয়ে বলল…
–কিন্তু আব্বু মিয়া রাজি হলেও বিবি তো রাজি না এখনো।
সিরাজ সাহেব ছেলের পিঠ চাপড়ে বললেন…
–হবে হবে।বিবিও রাজি হবে।তোকে একটা আইডিয়া দিতে পারি।শোন তাহলে……………..।
মূলত আলআবির বাবা আলআবি কে জুইঁর বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে বিয়ের জন্য রাজি করানোর বুদ্ধি দেয়।জুইঁ তার বাবার উপর কোন কথা বলে না। তাই জুইঁর বাবাকে রাজি করাতে পারলেই কাজ হবে।
আলআবি তার বাবার কথা মতো ওলিদূন আজাদ এর নাম্বার নিয়ে আজ খুব সকালে কল দেয়।কারণ আলআবি জানে রোজ সকালে জুইঁর বাবা হাঁটতে বের হন।আর আলআবির কাছে ওই সময় টাই ঠান্ডা মাথায় বসে কথা বলার উপযুক্ত সময় বলে মনে হয়েছে।ওলিদূন আজাদ এর সাথে দেখা করবার আগে আলআবি জায়েফ কেও সঙ্গে করে নিয়ে আসে।
আলআবির সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে আরো তিন দিন অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে জুইঁর দিন কালও স্বাভাবিক চলছে।আলআবির কথা জুইঁর মস্তিষ্ক থেকে ধীরে ধীরে লোপ পেতেও শুরু করেছে।
ভার্সিটির ক্যান্টিনে জুইঁ,সাদু আর প্রিন্স বসে আড্ডা দিচ্ছিল।প্রিন্স অন্য ডিপার্টমেন্ট এর বলে একটু আগেই ক্লাসে চলে গিয়েছে। সাদু আর জুইঁর ক্লাস আজকের মতো শেষ।
তাদের বন্ধু মহল এই তিনজন নিয়ে ই।সাদিয়া জুইঁর বাল্যকালের বান্ধবী হলেও প্রিন্স মূলত ভার্সিটি ফ্রেন্ড।তাদের পরিচয় এর সময়কাল মাত্র দুইবছরেরই।
ওয়ান টাইম কফির কাপে শেষ চুমুক টা বসিয়ে পাশের বিনে কাপ টা ফেলতে ই টেবিলে রাখা জুইঁর ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। স্ক্রিনে চোখ রাখতে জুইঁ দেখতে পেল ক্যাপিটাল লেটারে মা লেখা টা জ্বলজ্বল করছে। জুইঁ কলটা রিসিভ করে স্পিকার অন করে দিল। অপর পাশ থেকে জুইঁয়ের মা বলতে লাগলেন…
–জুইঁমনি আজ একটু তারাতাড়ি বাসায় ফিরতে পারবি?
পাশ থেকে সাদিয়া জুঁইকে একটু জোরে আওয়াজ তুলে বলল…
–আন্টি জিজ্ঞেস করছে আজকে তুই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারবি কিনা?
জুঁই তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল…
–মা যদি কোন জরুরী কাজ থাকে তাহলে বলো। আর না হলে কারো সামনে আমি সং সেজে বসে থাকার জন্য তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারব না।
জুইঁর মা প্রতি উত্তরে বললেন…
— সঙ সেজে বসে থাকতে হবে না। বাসায় মেহমান আসছে, তুই ভার্সিটি শেষ করে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবি। এখন আমি রাখছি অনেক কাজ আছে আমার।
জুইঁর জবাবের আশায় বসে না থেকে জুইঁর মা কল কেটে দিলেন। জুঁই সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো…
–ওই শেষে কি বলল রে?
— তোর মার কি আর বলার আছে। বলল তোরে বিয়ে দিয়া জামাই বাড়ি পাঠাইলে ই আন্টি নাকি একটু শান্তি পায়।(সাদু)
–ফাইজলামি করিছ না তারাতাড়ি ক মা কি বলছে।(জায়েফ)
–বলতাম নট (বলব না)।বললে কি দিবা আগে তা ক।(সাদু)
জুইঁ ইশারায় সাদুকে কাছে আসতে বলল আর মুখ দিয়ে বলল…
–আয় কানে কানে বলি।
সাদু তার কান জুইঁর মুখের কাছে নিয়ে আসতেই জুইঁ জোরে চিৎকার করে বলল…
–কচু দিমু!
হঠাৎ কানে তীব্র আওয়াজে সাদু ছিটকে দূরে সরে গেল।ক্যান্টিনে বসেই দুই রমনী তাদের চুল ছেঁড়াছিঁড়ি যুদ্ধে নেমে পরলো। এদের ছোটকাল থেকে মারামারি করার অভ্যাসটা বড় হয়েও রয়ে গিয়েছে।
এই দুই বান্ধবী যখন ক্লাস নাইনে ছিল তখন ফুটবল খেলা চলছিল।সাদু ছোট থেকেই ব্রাজিল সাপোর্টার আর নেইমার ভক্ত। কিন্তু এদিকে জুইঁ আর্জেন্টিনা সাপোর্টার আর মেসি ভক্ত।একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে দুই বান্ধবী নেইমার মেসি নিয়ে লংকা কান্ড বাধিয়ে ফেলেছিল। একজন এর বক্তব্য ছিল নেইমার সবচেয়ে ভালো আরেকজনের বক্তব্য ছিল মেসি সবচেয়ে ভালো।
ভার্সিটি শেষে জুইঁ বাসার সামনে আসতেই গ্যারেজে খালুর গাড়ি দেখতে পায়।সাদু অবশ্য বলেছিল মেহমানদের কথা। জুইঁ তাই ভেবে নিল হয়তো খালা খালুরা আসবে বলেই তার মা তাকে তারাতাড়ি বাসায় ফিরতে বলেছে।
সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠে কলিং বেল চাপতেই জুইঁর খালামনি দরজা খুলে দিল।জুইঁ খালামনিকে দেখে ব্যাপক খুশি হলো। বাসায় অবশ্য মেহমান আসলে জুইঁ সেদিন খুব খুশি থাকে।দরজা আটকে ভিতরে ঢুকতেই ড্রইং রুম কাপিয়ে একটা সুর বেজে উঠলো…..
য়াআ হাহাহা…….
এমন বিখ্যাত সুর জুইঁর চিনতে কিঞ্চিৎ পরিমাণে ভুল হলো না।
চলবে………….