মায়াজাল,পর্ব-১

মায়াজাল,পর্ব-১
লামিয়া আক্তার রিয়া

পুরোনো জমিদারবাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছি।চারপাশটা অসম্ভব রকমের নিরবতায় ছেয়ে আছে।হঠাৎ দু-একটা কাকের কর্কশ চিৎকার ছাড়া কোনো পাখির ডাক শুনছিনা।পাশেই উমা বড়বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু ওর দৃষ্টি উপেক্ষা করেই ভেতরে পা বাড়ালাম।

ভেতরে পা দিতেই একপ্রকার স্নিগ্ধতা ছেয়ে গেলো।আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ।উমাও দেখলাম পেছনে।সেও অবাক চোখে চারপাশ দেখছে।

উমা: কি সুন্দর বাড়িরে ইমু!! কিন্তু বাইরে থেকে এমন ভূতুরে লাগছে কেন?

ইমু: ভূত আছে তাই।

উমা: এ্য?

আমার কথায় উমা আৎকে উঠলো।মেয়েটা অনেক ভিতু।নাহ্ মজা করা ঠিক হবেনা।

ইমু: এখানেতো একজনের থাকার কথা ছিলো আমাদের খেয়াল রাখার জন্য।কিন্তু কাউকেই তো দেখছিনা।

লিয়া: ইমু আমরা ভুল করলাম নাতো?

ইমু: কি ভুল?

সামু: এমন জায়গায় কেমন যেন লাগছে।

উমা: আগেই বলেছিলাম না আসতে।

ওদের কথায় বিরক্ত লাগলো।তাই খুজতে লাগলাম‌ কেউ আছে কিনা।

ইমু: কেউ আছেন?হ্যালো?বাড়িতে কেউ আছেন?

উপর থেকে কেমন ক্যাচক্যাচ আওয়াজ হলো।কিছুক্ষন পর দেখলাম‌ সিড়ি থেকে একজন বয়স্ক লোক নামছে।নিচে এসেই যেন একটা ধাক্কা খেলেন তিনি।মুখ রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে।

লোক: আ আম্মা?

ইমু: আপনি এখানের কেয়ারটেকার?

:(নিজেকে সামলে) হ আমি ইদ্রিস মিয়া।আফনারা এই নামেই ডাকতে পারেন।আফনারা শহর দিয়া আইছেন?

ইমু: জ্বী।আমাদের অফিস থেকে এখানে আসার কথা বলা হয়েছে।

ইদ্রিস: আচ্ছা।আফনারা হগ্গোলে উপরে যাইয়া রুম দেইখা ফেরেস হইয়া নেন।আমি খাওন তৈয়ার করি।আফনারা চাইর জনই?

লিয়া: হুম।

সামু: আমরা যে ঘর ইচ্ছা সেটাই‌ নিতে পারবো?

ইদ্রিস: হ পারবেন।খালি ওইযে পুবের একখান ঘর আছে তালা দেওয়া ওইটার কাছে যাইবেন না।

ইমু: কেন?কি আছে ওখানে?

ইদ্রিস: সব কেনোর জওয়াব হয়না আম্মা।আফনারা ফেরেস হইয়া আসেন ।বাকি কতা খাওয়ার সময় কমু।তয় খবরদার ওই ঘরের কাছে জাইবেন না।

এই কথা বলেই ইদ্রিস নামক লোকটি চলে গেলো।আমরাও‌ মাথা না ঘামিয়ে উপরে চলে গেলাম।দুটো রুমই নিবো আমরা।একরুমে দুজন করে।যদিও এটা উমার জন্যই করতে হচ্ছে।

ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে ইদ্রিস যেদিকে গেলো আমরাও সেদিকে গেলাম।কিছুটা যেতেই নাকে খাবারের ঘ্রান এলো।এমনেই এতটা জার্নি করে ক্লান্ত তার উপরে এত সুস্বাদু খাবার দেখে যেন ক্ষুধা আরো কয়েকশগুন বেরে গেলো।কথা না বলে সবাই খেতে বসে গেলাম।খাওয়া শেষ করতেই ইদ্রিস মিয়ার গলা পাওয়া গেলো।

ইদ্রিস: আর কিছু লাগবো আম্মারা?

ইমু: না না।আচ্ছা ইদ্রিস মিয়া,আপনাকে চাচা বলে ডাকলে কি সমস্যা হবে?

ইদ্রিস: চাচা?কিন্তু-

ইমু: আপনি আমাদের বাবার বয়সের তাই নাম ধরে ডাকতে ভালোলাগেনা।আমরা বরং চাচা বলেই ডাকি।না করবেন না দয়া করে।

ইদ্রিস মিয়া কিযেন ভাবলেন তারপর হাসিমুখেই‌ সম্মতি দিলেন।

লিয়া: চাচা এখানে আশেপাশে এমন নিস্তব্ধ কেন?কেউ আসেনা এদিকে?

ইদ্রিস: না।

সামু: কেন?

ইদ্রিস: তাতো কইতে পারুমনা।তয় সবাই কয় এই বাড়িতে ভূত থাকে।

উমা: ভ ভূত?

ইদ্রিস: হ মাইনষে তাই কয়।

উমা: আ আপনিও ভ ভূত?

উমার কথায় ইদ্রিস মিয়া হেসে ফেললেন।

ইদ্রিস: আমি ভূত হইলে আফনারা এনে জ্যান্ত থাকতেন?কবেই ঘাড় মটকাইতাম।চিন্তা করবেন না আমি ভূত না।তয় পুরানো বাড়ি তাই একটু সাবধানে থাইকেন।আর ওই পুবের দিকে যাইয়েন না তাইলেই চলবো।

ইমু: আর কে কে থাকে এই বাড়িতে?

ইদ্রিস: আমি একলাই।আমার বউ দুইবছর আগে মইরা গেছে।

ইমু: এখানে কয়বছর আছেন আপনি?

ইদ্রিস: অনেকবছর।এই বাড়ি দেহাশুনার কাম আমার।

লিয়া: আপনার ছেলেমেয়ে নেই?

ইদ্রিস: না আম্মা।

ইমু: এই বাড়ির ইতিহাসটা কি চাচা?মানে কতবছর আগের বাড়ি এটা?কারা কারা থাকতেন?এদের শেষ বংশধরের কোথায়?

ইদ্রিস: অনেকটা পথ জার্নি কইরা আইছেন আম্মা।এহন বরং যাইয়া একটু ঘুমান।রাইতও হইয়া গেছে।কালকে সকালে আবার কথা হইবো।

সামু: কিন্তু চাচা-

ইদ্রিস: আর একটা কতা,রাইতে যাই হোক রুমের বাইরে বাইরাইবেন না।আমি এহনি আফনাগো জন্য পানি রাইখা আইতাছি।আর বাথরুমতো আফনাগো রুমেই আছে।তাই বাইরাইবেন না।

উমা: আপনি এমন রহস্য করছেন কেন?

ইদ্রিস: এই বাড়িইতো রহস্যে ভরা আম্মা।যা কইলাম তাই হুনেন,বিপদে পরবেন না।আফনারা ঘরে যান আমি আইতাছি পানি লইয়া।

ইদ্রিস মিয়া চলে গেলেন।আমরা সবাই অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছি।

লিয়া: ইমু এখানে কোনো খারাপ কাজ হয়নাতো?

ইমু: মাত্রই তো এলাম।আজকে এসব ভাবার এনার্জি নেই।কালকে আবার কাজে যেতে হবে।চল এখন ঘুমাই।

উমা: হ্যা বাবা চল চল।বাইরে না থাকাই ভালো।

উমার কথায় সবাই হেসে দিলো।

সকাল…..

সকালে উঠে কোনোরকমে ব্রেকফাস্ট করেই সবাই কর্মস্থলে গেলো।গ্রামের একটা স্কুলে টিচার হয়ে এসেছে ওরা।স্কুলে যেতে জমিদারবাড়ি থেকে ১ঘন্টা লাগে।কিন্তু তবুও উমা বাদে বাকি তিনজনের এই জমিদারবাড়িই পছন্দ হয়েছে।উপরমহল থেকেও বাধা দেয়া হয়নি কারন এমন এলাকায় কেউ টিচার হয়ে আসতে চায়না।তাই ওদের চারজনকে পাওয়া ওদের কাছে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো।

স্কুলে এসেই ওরা অবাক হয়ে গেলো।

লিয়া: এত সুন্দর স্কুল তাও টিচাররা আসতে চায়না?কেন?

সামু: কি জানি।আমারতো দারুন লাগছে।

উমা: কিন্তু টিচার না থাকার কারনটা কি?

ইমু: আপারা আপনারা এসব পরে ভাববেন।আপাতত হেডস্যারের রুমে যাই?

লিয়া: হুম হুম চল।

ওরা কথা না বাড়িয়ে দারোয়ানের সাথে হেডস্যারের রুমে এলো।

দারোয়ান: স্যার শহরের ম্যাডামরা আইছে।

হেডস্যার: আরে আসুন আসুন।বসুন আপনারা।রহিম(দারোয়ান) তুমি ওনাদের জন্য চা-নাস্তা দাও।

দারোয়ান: আইচ্ছা।

হেডস্যার: আমি জমিল ইসলাম।এই‌ স্কুলের হেডস্যার।

ইমু: আসসালামু আলাইকুম।আমি ফাবিহা ইমরোজ।

লিয়া: আমি তানহা আনাম লিয়া।

সামু: সুমাইয়া জাহান।

উমা: উর্বশী পাল উমা।

জামিল: পরিচিত হয়ে ভালোলাগলো।আপনাদের তো বেশ ভালো ঘরের মেয়ে বলে মনে হচ্ছে।এখানে শিক্ষকতা করতে আসার কারন কি জানতে পারি?

ইমু: শিক্ষকতা‌ শখ হিসেবে।তবে যখন এখানকার পড়াশুনার করুন অবস্থা জানলাম তখন ঠিক করলাম এখানে আসি।তাছাড়া শহরের কংক্রিট সিমেন্টের বড়বড় বিল্ডিং ব্যস্ত নগরী ছেড়ে মুক্ত বাতাস নিতে এলাম।

জামিল: তা ভালো।তবে শুনলাম জমিদার বাড়িতে উঠেছেন?

লিয়া: জ্বী।

জামিল: এত জায়গা থাকতে ওই ভূতুরে বাড়িতে কেন উঠলেন?

উমা: ভূতুরে মানে?কিছু জানেন আপনি ওখানকার সম্পর্কে?

জামিল: নিজে ভেতরে যাইনি তবে অনেক কথা শুনেছি।রাতে নাকি কিসব হয়।

ইমু: আমরা শোনা কথায় বিশ্বাসি নই মিস্টার জামিল।তাছাড়া আমরা একরাত ওখানে থেকেছি।সমস্যা হলে নিশ্চয়ই হতো?

জামিল: একরাত হয়নি বলেযে প্রতিরাতেই ছাড় পাবেন তেমনটা ভাববেন না।ওখানে বেশ-

ইমু: সরি টু সে বাট আমরা মনে হয় অন্যদিকে যাচ্ছি।স্কুল আর এখানের স্টুডেন্টস সম্পর্কে তথ্য দিলে আমাদের হেল্প হতো।

সামু: তাছাড়া তেমন বাচ্চাওতো দেখলামনা।কোথায় সব?

জামিল: গ্রামে কি পড়ালেখা হয়?মেয়েদের বাড়ির কাজ আর ছেলেদের জমির কাজ।তাদের কথা হলো এত পড়ে লাভ কি?

লিয়া: মানে?আপনি ওদের বুঝিয়ে বলেননি?

জামিল: চেষ্টা করেছি।এবার আপনারা দেখুন।

ইমু: আচ্ছা এলামতো আজ,আজ স্কুলটা দেখি, যারা আছে তাদের সাথে পরিচিত হই।তারপর বাইরে বের হবো।অন্যকোনো টিচার নেই?

জামিল: একজন স্যার আছে,সে আজ আসেনি।

সামু: কেন?

জামিল: ক্লাস হয়না।একজন নিয়ে কে বসে থাকে?আমি তো হেড তাই নিতান্ত বাধ্য-

ইমু: বাধ্য?এটা আমাদের দায়িত্ব।ক্লাস না করিয়েই সরকারের টাকা খায়?

লিয়া: এমন শিক্ষকদের জন্য এসব গ্রামের এই অবস্থা।

জামিল: আপনারা তো এলেন।এখন তাহলে স্কুলকে নিজের মতো করে চালান।আমিও চাই স্কুলটা ঠিক হোক।চলুন সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

লিয়া: চলুন।

জামিল ইসলাম ওদের চারজনকে নিয়ে স্কুলটা ঘুরলেন।ক্লাস ৫ পর্যন্ত এখানে পড়ানো হয়।সরকারি নিয়ম অনুযায়ি শিশু শ্রেনী থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী এখানে পড়তে পারবে।স্কুলটাও খুব সুন্দর।তবে সব মিলিয়ে স্টুডেন্ট মাত্র ৫০ জন।দারোয়ান আর স্কুল পরিষ্কার করার‌ লোক মিলিয়ে ৪জন আছে।

ইমু,লিয়া,সামু আর উমা সবার সাথে পরিচিত হলো।স্টুডেন্টসরা খুব খুশি ওদের পেয়ে।সবার সাথে কথা বলতে বলতে দুপুর হয়ে গেলো।তাই ওরা সবাইকে বিদায়‌ দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

বাড়িতে ঢুকেই ইদ্রিস মিয়াকে দেখতে পেলো ওরা।

ইদ্রিস: আম্মাজানরা আইয়া পরছেন?জলদি গোসল কইরা আহেন। আপনাগো খাওন বাড়তাছি।

ইমু: চাচা আপনার অনেক‌ কষ্ট হয় তাইনা?

ইদ্রিস: না না মা কি‌ কন?আমার তো এমনেই প্রত্যেকদিন রানতে হয়।আপনাগো জন্য কষ্ট হইবো কেন?

সামু: প্রতিদিন রান্না করতে হয়?টাকা দেয়না দেখাশুনার জন্য?বাইরে থেকে কিনলেই তো পারেন। একা মানুষ কষ্ট করে রান্নাবান্না।

ইদ্রিস: এইটা কোনো ব্যাপার না আম্মা।আপনাগো জন্য কষ্ট হয়না।

ইমু: চাচা আমাদের আপনি করে বলবেন না।তুমি করেই বলেন।

ইদ্রিস: কি কন আম্মা?আপনারা নামিদামি শিক্ষিত মানুষ আর আমি-

ইমু: মানুষতো?আর আমাদের চেয়ে অনেক বড়।তাই তুমি করেই বলবেন।ঠিক আছে?

ইদ্রিস: আইচ্ছা।

ইমু: এবার আমরা যাই।খেয়ে একটু জিড়িয়ে বাইরে যাবো ঘুরতে।আপনিও যাবেন আমাদের সাথে।চল সবাই।

ইমু সবাইকে নিয়ে উপরে চলে যেতেই ইদ্রিস মিয়ার চোখ থেকে টপটপ করে দুফোটা পানি পরলো।

ইদ্রিস: সব আগের মতোই‌ আছে।সে আইসা‌ গেছে।এবার আরেকজনের আসার পালা।আর কষ্ট থাকবোনা এই গ্রামের।আবার সবাই খুশি থাকবো।বড়সাহেব আপনে দেখতাছেন?উপরে বইসা সব দেখতাছেন আপনে?বলেছিলাম না সব ঠিক হইবো?দেহেন বড়সাহেব ঠিক হওয়া‌ শুরু হইছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here