#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#সূচনা_পর্ব,০২
#আফিয়া_আফরিন
০১
মাঝরাতে হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শে ঘুমটা ভেঙে গেল মায়ার। চোখ খুলে সামনে থাকা মানুষটির অবয়ব দেখে বুঝল, এটা আর কেউ নয়; নিশ্চয়ই ইমন। চকিত ভঙ্গিতে উঠে বসল সে।
বললো, “তুমি এত রাতে এখানে?”
“দেখি চাপ ঐদিকে, বসার জায়গা তো দিবি নাকি আগে?”
“এই খবরদার, না না প্লিজ। এতগুলো মানুষের মাঝে তুমি আসছো কিভাবে? এক একটা রুম গণরুম হয়ে গেছে।”
“সে গণরুম হোক আর যাই হোক, আমার তোকে পেলেই হবে।”
“দয়া করে এমন পাগলামি কোরো না প্লিজ। কেউ জেগে গেলে কি হবে ভাবতে পারছো তুমি? এভাবে রাত বিরাতে আমার সাথে তোমায় দেখলে রেহাই পাবো না কেউ আর?”
“দেখলে দেখবে। আমরা কি চুড়ি করছি নাকি?”
“উফ বড্ড অবুঝ তুমি।” বিরক্ত হয়ে বলল মায়া।
“আচ্ছা, এখন চল আমার সাথে।”
“এত রাতে? কোথায় যাব?”
“চল বাইরে হাঁটতে বের হব।”
“ধুর, এই রাতের বেলা কোথাও থেকে মদ-গা’ন্জা গিলে টিলে আসেনি তো? যাও ঘুমাতে যাও।”
“তারমানে তুই যাবি না?”
“মোটেও না।”
ইমন বসা থেকে উঠে মায়াকে কোলে তুলে নিয়ে খুব সাবধানে পা টিপে টিপে রুম থেকে বের হল। মায়া এতক্ষন নিঃশ্বাস বন্ধ করেছিল, পাছে নিঃশ্বাসের শব্দে যদি কেউ আবার জেগে ওঠে।
মায়া কি কোল থেকে নামাতে এসে কোমরে হাত দিয়ে বলে, “তোমার কথা যদি কাল ফুপিকে বলে না দিছি? খুব অ’স’ভ্য হয়ে গেছো তুমি!”
“হয়েছি তো হয়েছিই। বেশি কথা বলিস না ছাদে চল।”
মায়া আর কথা না বাড়িয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালো।
.
.
.
বসন্তকালের রাত। চারিদিকে ফুলের গন্ধে মো মো করতেছে। মায়াদের বাড়ির ছাদটা বিশাল বড়। ছাদের চারিপাশে রেলিংয়ে রেলিংয়ে কতকগুলো ফুলের গাছ। সে নানান রকমের, নানান জাতের ফুল। শখের বসে ফুল গাছ কিনে কিনে ছাদ ভর্তি করে ফেলেছে সে। এমনও অনেক ফুল এখানে আছে যেগুলোর নাম জানেনা মায়া, কিন্তু ভীষণ প্রিয়!
ছাদে এসেই মায়া গোলাপ গাছের দিকে এগিয়ে টব থেকে শুকনো গোলাপের পাপড়ি গুলো তুলতে লাগলো।
তা দেখে ইমন বলল, “এভাবে আমায় একটু যত্ন করলেও তো পারিস?”
“কেন তোমায় যত্ন করিনা আমি?”
“কই করিস? কতোদিন পর দেখা। কোথায় একটু ভালোবাসবি, কাছে কাছে থাকবি? তা না, হাজার হাজার মাইল দূরে গিয়ে বসে থাকিস!”
“হু। তোমার তাই মনে হয়?”
“তাছাড়া আবার কি? কতোদিন পর এলাম এখানে। তাও আবার মহুয়া আপুর বিয়ে উপলক্ষে।”
“এখন আমি বলি?”
“কি বল?”
“তুমি তো উপলক্ষ বিহীন আসতেই পারো না। তোমার মামার বাড়ি, যখন ইচ্ছা হয় আসবে। সমস্যা কোথায়? তা তো আসবে না। ছয় মাস পর একবার এসে আমার উপর রাগ দেখানো হচ্ছে, তাইনা?”
“থাম। ঝগড়া করার জন্য তোকে এখানে আনিনি আমি। মেয়ে মানুষ যে এতো ঝগড়া কেমনে করে আল্লাহ ভালো জানে? ঝগড়ুটে মেয়ে কোথাকার! মাঝে মাঝে তো মনে হয় একটুও ভালোবাসিস না আমায়!”
মায়া ইমনের চুলের মুঠি ধরে ঝাকুনি দিতে দিতে বললো, “কি বললে? তোমাকে একটুও ভালোবাসি না?”
ইমন মায়ার কথার উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। তারায় তারায় পূর্ণ লাগছে আকাশ টাকে। আজকে কি পূর্ণিমা রাত নাকি? কত্তোবড়ো চাঁদ উঠেছে আকাশে।
ইমন দুই হাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, আমি আপনাকে ভালোবাসি!”
মায়া হাই তুলতে তুলতে বললো, “মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে কি পাগলামি শুরু করছো? সাধে কি আর বলেছি তোমায় ম’দ/গা’ন্জা গিলছো?”
“আনরোমান্টিক কোথাকার! ফালতু কথা বাদ দে তো। আচ্ছা, পড়াশোনার কি অবস্থা তোর?”
“অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আছি। পড়াশোনার কি অবস্থা হতে পারে, ইমাজিন করে নাও।”
ইমন মায়ার কাছে গিয়ে গালে হাত দিয়ে বললো, “তুই সিরিয়াসলি এতো বড়ো হয়ে গেছিস? এতো রড়ো হলি কবে রে? এইতো কয়েকদিন আগেই হাফপ্যান্ট পড়ে চোখের সামনে টইটই করে ঘুরে বেড়াতি?”
“হ্যাঁ। আর ঐ হাফপ্যান্ট পড়া কালেই তুমি আমায় পছন্দ করে বসেছিলে। আজব!”
ইমন হো হো করে হেসে দিলো।
মায়া ইমনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা কাল আপুর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। সকাল সকাল উঠতে হবে। অনেক কাজ আছে। আমি ঘুমাতে গেলাম। তুমি ও যাও, কেমন!”
“আচ্ছা যা। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে আসছি।”
.
.
কোলাহকলে ঘুমটা ভেঙে গেল মায়ার। উঠে বসতেই পাশের রুম থেকে গানের আওয়াজ শুনতে পেল। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
বালিশের কাছ থেকে ফোন হাতে নিয়ে ইমনের ৩২ টা মিসড কল দেখে ঘুম চোখ থেকে উড়ে পালালো মায়ার।
এই ইমন নিশ্চয়ই এখন ছাড়বে। মায়া তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে পাশের রুমে গেল।
এখানেই সবাই আড্ডা মারছে। মায়ার ইমনকে দেখল ইমনের চাচাতো বোন নীলার সাথে বসে গল্প করতে।
মায়া সম্পর্কে ইমনের মামাতো বোন। মায়ার বড় বোন মহুয়া, তারই বিয়ে আজকে। সেই উপলক্ষে ইমন রা ঢাকা থেকে বগুড়া এসেছে। এছাড়া তো কোনো কারণ ছাড়া যাওয়া আসা পরেই না খুব একটা। বগুড়া শহর ঘুরে দেখার শখ, বিধায় ইমনের চাচাতো বোন নিলাও এসেছে।
সেই নীলাকে ইমনের সাথে এমন চিপকে থাকতে দেখে রাগে গাল ফুলাচ্ছে মায়া। ইতিমধ্যে সে কয়েকবার ইমনের সামনে গিয়ে ঘোরাঘুরি করেছে। কিন্তু ইমন তাকে পাত্তাই দিল না। চোখ তুলে তাকালোও না পর্যন্ত একবার।
নীলার সাথে বসে বসে ফোনে কি যেন ভিডিও দেখছে আর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
শেষমেষ রাগের চটে নীলার সামনে গিয়ে বললো, “লিলা আপু, ফুপি তোমায় ডাকছে অনেকক্ষণ ধরে। দেখতো কি বলে? ‘আচ্ছা’ বলে নীলা চলে গেল।
মায়া ইমনের পাশে বসে বলল, “কি? সমস্যা কি তোমার?”
“আমার তো কোন সমস্যা নাই। সমস্যা তো তোর। এভাবে পায়চারি করছিস কেন আমার সামনে?”ফোন টিপতে টিপতেই ইমন উত্তর দিল।
মায়া ইমনের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললো, “নীলা আপুর সাথে এত কিসের ভাব তোমার?”
“কি আজব ধরনের কথা? ভাব কই করলাম? তোকে কতবার ফোন করেছি জানিস, কুম্ভকর্ণ কোথাকার!”
“হ্যাঁ ঠিকই তো, আমি তো এখন কুম্ভকর্ণ। কালকে আবার কুমড়ো পটাশ বানিয়ে দেবে আমায়। থাকো তুমি তোমার নীলাকে নিয়ে।”
বলেই মায়া উঠে চলে গেল। অসহায় চোখে মুখে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো ইমন।
এরই নাম মেয়েমানুষ। কি কথার অর্থ কিভাবে নেয়!
তার মধ্যে মায়া কেমন জানি নীলাকে একদমই সহ্য করতে পারে না?
.
.
.
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বেলা পেরিয়ে গেলো। এই সময় পর্যন্ত মায়া ইমন এর সাথে একটা কথাও বলে নাই। দেখা হলেই মুখ বাঁকিয়ে চলে এসেছে। ইমন যে কথা গুলো মায়া কে উদ্দেশ্য করে বলছে, মায়া সেগুলো গিয়ে নীলাকে বলছে।
এই যেমন একটু আগেই মায়াকে বললো, “মায়া, এক গ্লাস পানি দিয়ে যা তো আমায়।”
মায়া সুন্দর করে নীলাকে গিয়ে বলল, “নীলা আপু, ইমন ভাইয়া তোমার কাছ থেকে এক গ্লাস পানি চাইছে।”
‘ইমন ভাইয়া’ সম্মোধন শুনে ভুরু কুঁচকে তাকালো ইমন। কিন্তু কিছু বলল না। শুধুমাত্র উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ইমনের পিছু পিছু মায়া ও দৌড় দিল, কিন্তু ততক্ষণে ইমন মেইনগেট পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে।
মায়া মনে মনে বলল, “ইস রে, ক্ষেপছে মনে হয়।”
রাত আটটা বাজলেও ইমন ফিরে এলো না। সবাই আগামীকাল বিয়ে নিয়ে গল্প গুজব করছে। মায়া ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে রাস্তায় মাথা পর্যন্ত পুরোটাই দেখা যায়। কিন্তু অনেকক্ষণ পরেও ইমনের দেখা পেল না। মায়া ছাদে কিছুক্ষন পায়চারি করে নেমে এলো। নামার সময় ডেকোরেটিং এর লোকদের দেখে অবাক হল।
জিজ্ঞাসা করল, “আপনারা এত রাতে?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম। আপনার বাবা বললো বারোটার মধ্যে ছাদ টা পুরো ডেকোরেশন করে ফেলতে। কাল সকালে নাকি সময় পাওয়া যাবে না।”
“বিয়ের স্টেজ ও কি এখনো সাজাবেন?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম।”
“কাঁচা ফুল তো, নষ্ট হয়ে যাবে না?”
“না। আমরা সব ব্যবস্থা করে দিব।”
“আচ্ছা।”
মায়া নিচে নেমে এলো। কিন্তু ইমনের কোন খোঁজ খবর নাই। ফোন দিলেও ফোন ধরে না, কেটে দেয়। অবশেষে সহ্য করতে না পেরে ফুপিকে গিয়ে বলল,
“ইমন ফেরে নাই ফুফি?”
“কই ইমন?”
“বাহিরে গিয়েছিল তো একটু আগে, মানে সেই দুপুরের পর। ফেরে নাই এখনও?”
“জানিনা তো আমি। মনে হয় আশেপাশেই আছে।”
“এত রাতে কোথায়?”
“ওর স্বভাবই এমন। রাত বিরেতে টুপ করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। অভ্যস্ত হয়ে গেছি রে মা, তাই আর কিছু বলি না।”
সেই সময় মায়ার মা জাহানারা বেগম পাশ থেকে বললেন, “বেয়াক্কল, ইমন তোর থেকে তিন বছরের বড় নাম ধরে ডাকছিস কোন আক্কেলে?”
মায়া সাথে সাথে মুখ কালো করে ফেললো। একটু আগে এই ভাইয়া ডাকের জন্য রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। আবার ভাইয়া ডাকলে মায়াকে সোজা খুন করে ফেলবে।
.
.
বারোটার মধ্যে সবাই ঘুমোতে চলে গেল। যদিও কেউ কেউ এখনো জেগে জেগে গল্প করছে। কাল সকালে বিয়ের বিশাল বন্দোবস্ত আছে।
মায়া লুকিয়ে লুকিয়ে ছাদে উঠলো। বেশ সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে ছাদটা। তাজা গোলাপের ঘ্রাণে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়! সেই সময় ইমন কে দেখতে পেল, বাড়ির দিকে আসতে।
উপর থেকে ডেকে ইশারায় বলল ছাদে আসতে। ইমন ছাদে এলে দুজন মিলে স্টেজের উপর বসে।
মায়া মেকি রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কই ছিলে? এতক্ষণ পর বুঝি বাড়ির কথা মনে পড়ল?”
ইমন উত্তর দিল না।
মায়া ফের প্রশ্ন করলো, “এখনো রাগ করে আছো আমার উপর? সরি। আচ্ছা, কান ধরব বলো?”
“না কান ধরতে হবে না। তুই বস চুপচাপ।”
ইমন আলতো করে মায়ার কাধে মাথা রাখলো।
মায়া বললো, “বললে না তো, কোথায় ছিলে এতক্ষন?”
“এই আশেপাশে ঘুরলাম একটুখানি।”
তারপর সামান্য হেসে বলল, “সারা পৃথিবী ঘুরে এসে দেখ না কেমন তোর শহরে এসে আটকে যাই! তোর মায়ায় পড়ে যাই বারবার!”
মায়া ইমন এর গালটা আলতো টিপে দিয়ে বলল, “উহু, এত কিছুর দরকার নেই আমার। আমি শুধু চাই দিন শেষে তোমারও ঘরে ফেরার টান থাকুক।”
.
.
.
.
চলবে……..
#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_০২
#আফিয়া_আফরিন
সকাল সকাল সবাই যখন বিয়ের কাজে এইদিক ঐদিক ছোটাছুটি করছে, ইমন তখন সুযোগ বুঝে মায়াকে এক সাইডে টেনে নিয়ে এলো।
বললো, “এতো ব্যাস্ত মানুষ তুই? আমার জন্য একটু ও সময় নাই তোর?”
“কাজের মধ্যে ভিত্তিহীন কথা বলো না তো।”
“বললাম না। এখন চল, আমরা দুইজন ছবি তুলবো।”
“আচ্ছা চলো। আমি কি মানা করেছি নাকি?”
“মিমো কে ডেকে নেই। ওই আমাদের ছবি তুলে দিবে।”
ইমন, মায়া, মিমো মিলে ছাদে স্টেজের দিকে গেলো। মিমো ইমনের একমাত্র ছোট বোন। মিমো আর মায়ার বড় বোন মহুয়া ই শুধুমাত্র জানে ওদের সম্পর্কের কথা।
সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল আরো কয়েক বছর আগে। কিন্তু দুজনের অব্যক্ত ভালোবাসা বা ভালোলাগা যেটাই হোক না কেন, সেটা ছিল সেই ছোটবেলার!
মায়ারা তখন ঢাকা থাকতো। ইমন আর মায়া দুজনের বাসাযমই ছিল পাশাপাশি। মায়ার রুমের বেলকুনি দিয়ে ইমনের রুম দেখা যেত। দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত শত গল্প করতো, অবশ্য গল্পের থেকে ঝগড়া টা বেশি হতো। তখন তাদের বয়সটা নেহাতই অনেক কম ছিল।
বাড়ির পেছনে ছোট্ট একটা বাগান ছিলো। শাঁন বাঁধানো পুকুর ঘাট ছিলো। একদিন তো ইমন মায়া কে ইচ্ছে করে পুকুরে ধাক্কা দিয়েই দৌড়। পরে অবশ্য নিজে এসেই তুলেছিল। ততক্ষণে মায়া তো পানি খেয়ে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছিল।
এমনই ঝগড়াঝাঁটি করে চলছিল দশটা বছর। তারপর ইমনের জন্মদিনের দিন উপলব্ধি করলো মায়া, ইমনকে সে ভালোবাসে! ইমনের নিজের চাচাতো বোন নীলা, এই মেয়েটাকেই সহ্য করতে পারে না মায়া। কেমন যেন গায়ে পরা স্বভাবের! অবশ্য সবার সাথে নয়, শুধুমাত্র ইমনের সাথে।
ইমন যদিও ব্যাপারটা হালকা ভাবেই নেয়। কিন্তু মায়ার ধারণা নিলা ইমনকে পছন্দ করে।
মায়া এখনো পর্যন্ত ইমনকে এই বিষয়ে কিছু বলে নাই, যদি তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। পরে দেখা গেল, মাঝখান থেকে ইমন নীলার ভাই বোনের সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে গেলো।
মায়ার বয়স যখন ১৫ বছর, ইমনের বয়স তখন প্রায় আঠারোতে ছুঁই ছুঁই। সেই তখন থেকে সম্পর্কের শুরু। তার প্রায় দুই বছর পরই মায়ার বাবা আমজাদ ইসলাম ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হয়ে বগুড়া চলে আসেন।
দূরত্বটা শুধুমাত্র স্থানগত দিক দিয়েই বেড়েছিল। সম্পর্কের দিক দিয়ে সামান্য একটুও বাড়ে নাই।
ভালোবাসা টা ঠিক আগের মতই ছিলো। তবে সামনাসামনি দেখা হয় হয়তো বছরে তিন কি চার বার। তবুও এই ছয় বছরের সম্পর্কে কখনও তারা ব্রেকআপ করে নাই। হয়তো রাগারাগি করে, মান অভিমান করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু কেউ কাউকে ছেড়ে তো আর থাকতে পারে না। পুনরায় মিল হয়ে যায়।
.
.
.
মিমো ইমন আর মায়ার ছবি তুলে দিতে দিতেই নীলা এসে হাজির।
বললো, “তোমরা একা একা ছবি তুলছো? আমিও তুলবো।”
মায়া বললো, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি ছাড়া তো ফ্রেম অসম্পূর্ণ। আসো তাড়াতাড়ি।”
অতঃপর নীলা এসে ইমন আর মায়ার মাঝখানে দাঁড়ালো। মায়া প্রচন্ড বিরক্ত হলো, কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখলো।
মনে মনে বললো, “ফাজিল মেয়ে কোথাকার! আসছে, কাবাব এর মধ্যে হাড্ডি হতে।”
নীলা তাদের সাথে ছবি তুলতে তুলতে মায়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তুমি একটু সাইডে দাঁড়াবা মায়া প্লিজ। আমি আর ইমন তাহলে ছবি তুলতাম একটু।”
ইমন আর মায়া দুজনেই আড়চোখে তাকালো মায়ার দিকে। মায়া হাসিমুখ করে সরে দাঁড়ালো। ইমন এখানে না ও করতে পারছে না। যত যাই হউক বোন বলে কথা! নীলাকে তো আর না করা যায় না। কিন্ত, সব টেনশন মায়াকে নিয়ে, এই মেয়ে যে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করে আল্লাহ ভালো জানে?
ইমন ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে কেটে পড়লো।
কিছুক্ষণ পর মায়া মিমোকে নিয়ে ছাদে উঠলো।
মিমো বললো, “আপু, গাজরা তো কেনা হলো না? আমরা শাড়ির সাথে কী মাথায় দেবো?”
“ওহো। এটা মাথা থেকে বের হয়ে গেছে। সমস্যা নাই। এখান থেকে ফুল ছিড়ে নিয়ে নিজেরা বানিয়ে নেই।”
“আচ্ছা। গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুল নেই!”
“হ্যাঁ, নে।”
তারপর ইমন কে উদ্দেশ্য করে বললো, “তুমিও ফুল নিবা নাকি? নীলা আপুর জন্য? লাগবে নাকি ফুল?”
“তোরে আমি!”
“কিচ্ছু করতে পারবা না।”
বলেই মায়া হাসতে হাসতে চলে গেলো।
দুজনে ফুল তুলে নিয়ে নিচে এলো। সুইয়ে সুতো বেঁধে রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে গাজরা বানালো।
একটু পর যেহেতু অনুষ্ঠান শুরু হবে, মায়া রেডি হতে লাগলো। ততক্ষণে পার্লারের লোকেরা এসে মহুয়াকে সাজানো শুরু করে দিয়েছে।
মায়া রেডি হতে হতেই দরজায় টোকা পড়লো। দরজা খুলে দিতেই দেখলো ইমন দাঁড়িয়ে আছে।
সে বললো, “আসবো?”
মায়া কানের দুল পড়তে পড়তে বললো, “পারমিশন নেওয়া লাগে? আসো।”
ইমন ভিতরে ঢুকে খাটের উপর বসলো। মায়া তখন চুলের নিজের হাতে বানানো গাজরা টা লাগাচ্ছিল। কিন্তু বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।
তাই দেখে ইমন বললো, “হেল্প লাগবে?”
“কিসের?”
“আয়। এখানে আয়। আমি ঐটা লাগিয়ে দিচ্ছি।”
মায়া বাঁধা না দিয়ে ইমনের সামনে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। ইমন খুব যত্ন করে খোঁপায় গাজরা টা লাগিয়ে দিলো। তারপর মায়াকে সামনের দিকে অর্থাৎ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো।
নিজের কোমড়ে দু’হাত রেখে ঠোঁট উল্টিয়ে মায়াকে আপাদমস্তক পরখ করতে লাগলো।
তারপর চিন্তিত মুখে বললো, “কি যেন একটা মিসিং?”
“কি?”
“সেটাই তো বুঝতে পারতেছি না।”
হুট করে মনে পড়ল। ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা টিপের পাতা থেকে একটা টিপ কপালের মাঝ বরাবর পরিয়ে দিয়ে বলল, “এইতো এখন পারফেক্ট। সুন্দর লাগতেছে।”
মায়া হাসলো। ইমু নাম্বার আরেকটু কাছে এস এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে স্বতন্ত্র নেশালো চোখে তাকালো। এই ভরা দিবস রজনীতে তার, বিবশ বিবশ ঘোর হচ্ছে।
ইমন কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া প্রশ্ন করলো, “কি হলো? তাকিয়ে আছো কেন এভাবে?”
“অপ্সরীর মতো সুন্দর লাগছে তোকে। আজ ইচ্ছে হচ্ছে চরিত্রহীন হতে!”
মায়া ইমনের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো, “ইশ, যাও।”
“যাও বললেই চলে যাব নাকি?”
“তোমাকে আমি পিটুনি দেবো!”
ইমন মায়ার গালে নিজের গাল ঘষে দিয়ে বললো, “সে দেখা যাবে, কে কাকে পিটুনি দিবে?”
তারপর চলে গেল। মায়া দাঁত কিড়মিড় করে বললো, “দিলো আমার মেকআপ নষ্ট করে!”
.
.
.
.
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে, কোনে বিদায় দিতে দিতে রাত দশটা পার হয়ে গেল। মহুয়া বিদায়ের আগে মায়ের সেকি কান্নাকাটি। যত যাই হোক একমাত্র বোন বলে কথা।
ইমন তো এক পর্যায়ে বলেই উঠেছিল, “মেয়ে মানুষের স্বভাবই হচ্ছে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদা!”
সবাই হেসেছিল। শুধুমাত্র মায়া কান্না থামিয়ে চুপচাপ ছিল। হয়তো নিজের আত্মসম্মান রক্ষার্থে। যদিও ইমন কথাটা ফাজলামি করেই বলেছিল।
মহুয়া রওনা দেবার পরও কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর্ব চললো।
নীলা বারবার ইমনের সাথে হাসি ঠাট্টা করছে, ক্ষণে ক্ষণে হাত ধরছে। কোন কিছুই চোখ এড়াচ্ছে না মায়ার। কেমন কেমন জানি লাগছে, আবার পর মুহূর্তে মনে হচ্ছে সেই হয়তো বেশি সন্দেহ করে ফেলছে। নীলা তো ইমনের বোন। হাত ধরতেই পারে, স্বাভাবিক ব্যাপার। তবুও বিষয়টা তার স্বাভাবিক লাগছে না। ভালো লাগছে না। বহু কষ্টে এই ওই বুঝ দিয়ে নিজের মনকে সামাল দিচ্ছে।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ইমন মায়াকে মেসেজ দিয়ে ছাদে আসতে বলল।
মায়া ছাদে আসতেই ইমনকে দেখতে পেলো, রেলিংয়ে হেলান দিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।
পা টিপে টিপে ইমনের কাছে এগিয়ে এসে দু কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল। হঠাৎ এমন করায় ইমন চমকে গেলো।
এই দিক ফিরে বললো, “ও তুই!”
“কেন আমায় ডাক পাঠিয়ে, অন্য কাউকে আশা করছিলে বুঝি?”
“আরে পাগলি না। অন্য কাউকে আবার আশা করব? তুই হঠাৎ এমন করলি ভয় পেয়ে ভুত মনে করছিলাম। তারপর পেছন ফিরে দেখি তুই।”
“হে হে। আমি ভুত!”
“হ্যাঁ অবশ্যই। আচ্ছা শোন, তুই কি আজকে নীলার সাথে ছবি তোলা দিয়ে রাগ করছিস?”
“আরেহ না। ও তো তোমার বোন হয়। আমি রাগ করবো কোন দুঃখে?”
ইমন ঠোঁট উল্টালো। বললো, “বাব্বাহ! এত বুঝলি কবে থেকে? মাঝেমধ্যে যে ক্ষ্যাপা খেপিস তুই?”
“ওর গায়ে পড়া স্বভাব আমার একদম ভালো লাগে না।”
“তেমন কোন ব্যাপার না রে। তুই অহেতুক সন্দেহ করছিস।”
“আচ্ছা যাও আর করব না। আমারও তাই মনে হয়, আমি একটু বেশি বেশি করছি।”
“এইতো কি সুন্দর বুঝে গেছিস। লক্ষী মেয়ে!”
বলেই ইমন মায়ার কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দিল।
.
কিছুটা দূর থেকে সেটাই নজরে পড়ে গেলো নীলার। দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে রাগে ফুঁসতে লাগলো।
.
.
.
.
চলবে…….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]