#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_১৯,২০
#আফিয়া_আফরিন
১৯
জীবনটা আসলেই খুব সুন্দর। বিয়ের আগে বোধহয় জীবনের এই মানেটা ধরা যায় না।
মায়া আর ইমনের প্রেমের সম্পর্কটা ছিল গত ছয়-সাত বছরের। অথচ ঐ সয় সাত বছর ততটা স্বর্গীয় ছিল না, যতটা স্বর্গীয় মুহূর্ত কেটেছে বিয়ের ১৫ দিনে।
হুটহাট মাথায় ভুত চাপলে মায়া নিজ থেকে ইমন কে শক্ত করে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। তার বুকে মাথা রাখতেই কেমন শান্তি শান্তি লাগে। পৃথিবীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায় নিমিষেই।
মায়ের এমন হাব ভাব দেখে এমন মনে মনে হাসে আর বলে, “আগে তোকে হাজার অনুনয় করেও কাছে আনতে পারতাম না। আর এখন এত চেঞ্জ! এরকম হবে জানলে তো, আগে বউ বানিয়ে নিয়ে আসতাম।”
“আজ্ঞে মশাই, আগে তোমার প্রেমিকা ছিলাম। এখন তোমার তিন কবুলে বিয়ে করা বউ আমি। বউ হইছি, আর কিছু বেনিফিট পাবা না তাই আবার হয় নাকি?”
ইমন সযত্নে মায়ার কপালে চুমু এঁকে দেয়।
.
.
আজ ইমন রাজশাহী যাবে, তাও আবার এক মাসের জন্য। তার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা, যেটা হবে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে। জামান সাহেব নিজে নিয়ে যাচ্ছেন ছেলেকে। তারা বিকালে রওনা হবে।
সকাল থেকেই মায়ার মন খারাপ। মুখ শুকনো করে ঘরে বসে আছে। ইমনও তখন বাড়ি ফিরল। ভার্সিটি থেকে সে ফর্ম তুলতে গিয়েছিল। ঘরে এসে কাগজপত্র ড্রয়ারে রেখে মায়ার পাশে এসে বসলো।
ইমন ওর হাত ধরে বলল, “তোর মন খারাপ?”
“উহু! মন খারাপ কেন হবে?”
“আমি জানি। আচ্ছা শোন, মন খারাপ করার তো কোনো কারণ দেখছি না? আমি তো মাত্র এক মাস পরেই ফিরে আসবো। এমন তো না যে একেবারে জন্য চলে যাচ্ছি।”
“একেবারে জন্য চলে যাবে কেন? আর যে বলছো মাত্র এক মাসের জন্য যাচ্ছো? একমাস বুঝি মাত্র হলো?” কাঁদো কাঁদো গলায় বলল মায়া।
“আচ্ছা আমার মুখ ভার করে রাখিস না। আমি কি আর যেচে পড়ে যাচ্ছি বল?”
“যাও তো তুমি, আমি মন খারাপ করি নাই।”
“এমন শুকনো মুখে আমাকে বিদায় দিবি?”
“শোনো, আমার না ৩২ টা দাঁত নাই যে, ৩২ টা দাঁতে হেসে তোমায় বিদায় দিবো।”
ইমন কিছু বলল না। এগিয়ে এসে মায়ার হাত দুইটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। তারপর মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ।
ইমন আরো কিছুটা এগিয়ে এলো মায়ার দিকে। দুহাতে মুখটা তুলে, ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে নিলেই, মায়া সরে যায়।
নির্জীব কণ্ঠে বলে, “আগে ফিরে আসো, তারপর।”
উত্তরে ইমন হাসলো।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ সে চলে গেল, রাজশাহীর উদ্দেশ্যে।
.
.
.
নীলার ফোনটা অনেকক্ষণ ধরেই বাজছে। সে পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ফোন সাইলেন্ট করা, বিধায় আওয়াজ কানে পৌঁছাচ্ছে না।
যখন ঘুম ভাঙলো, তখন নিলয়ের ১৮ টা মিসড কল দেখতে পেল। অবাক হল, নিলয় কেন হঠাৎ তাকে এতবার ফোন দিবে? নিলয়ের সাথে তো আর কথা হয় নাই। মায়া আর ইমনের বিয়ের পর থেকে নিলয়ের কাছ থেকে সে ওই সিমটাও ফেরত এনেছে আর বলেছে, “নেক্সট টাইম আর কখনো ওদের কাউকে বিরক্ত করার দরকার নেই। ওর আর ইমনের বিয়ে হয়ে গেছে। ওদের মধ্যে আর নাক গলানোর কোন প্রয়োজন নেই আমাদের। ওরা যেভাবে থাকতে চায়, থাকুক সেভাবে।”
ইমনের বিয়ে হয়ে গেছে এ কথা শুনে প্রচন্ড অবাক হয়েছিল নিলয়।
সে বলল, “তুই এমন ভাবে কথাগুলো বললি যেন আমি নিজে যেচে পড়ে মায়াকে বিরক্ত করতে গেছি! তুই বললি বলেই তো। আমার দোষ কি এখানে? আর শোন আমি এসব বাদ দিছি। এখন আর এসবের সময় কই? একটা সময়ের পর সব কিছুর প্রতি অরুচি চলে আসে।”
নীলা মলিন হেসে বলল, “আমারও বোধহয় ইমনের প্রতি ইন্টারেস্টটা উঠে গেছে।”
“সেটাই তো ভালো। ওর তো এখন বিয়ে হয়ে গেছে, ওর প্রতি তুই ইন্টারেস্টে রেখে তোর কি হবে? অযথাই কষ্ট পাবি! আসলে এটা তোর সাময়িক মোহ ছিল!”
“হয়তোবা।”
সেদিন এই টুকুই ছিল তাদের মধ্যে কার কথা।
অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে নীলা নিলয়কে কল ব্যাক করল। ফোন রিসিভ করতেই নিলয় বলল, “তুই কি খুব ব্যস্ত আছিস?”
“না ব্যস্ত না। ঘুমিয়ে ছিলাম। তাই ফোন ধরতে পারি নাই। কি বলবি বল?”
“কথা ছিল একটু তোর সাথে। ফোনে না, সামনাসামনি দেখা করতে পারবি?”
“কখন?”
“আজকে। এই ধর, বিকেল বেলা।”
“আজকে বোধহয় আর হবে না। শরীরটা ভালো লাগছে না। কাল দেখা করি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবি কি?”
“তোর জন্য হয়তো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হবে না। কিন্তু আমার জন্য অনেক!”
“কি এমন কথা?”
“দেখা কর, তাহলেই বলি।”
“আচ্ছা, কাল বিকেল পাঁচটায়। এড্রেসটা আমি তোকে টেক্সট করে দিচ্ছি।”
“ওকে।”
নীলা ফোন রেখে নিলয় কে কোথায় দেখা করবে, সেই এড্রেসটা টেক্সট করে দিল। গত কয়েকদিন হয়েছে, ইমন মায়া বা ওই বাড়ির কারো সাথে নীলার কথা হয়নি। কথা বলাটা কি তার উচিত?
.
.
ইমনকে ছাড়া মায়ার দিন কি কাটে? সারাদিন কাটে প্রচন্ড অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে, আর পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে। এত অস্থিরতার মধ্যে কি আর পড়াশোনায় মন বসে? সামনে আবার পরীক্ষা।
মায়া মাথা থেকে সব ছেড়েছুড়ে বইয়ে মন বসালো। তার মধ্যে সুহাদাও মায়া কে ঘরের কোন কাজকর্ম করতে দেয় না।
কিছু করতে গেলেই বাধা দিয়ে বলবে, “এটা তোর কাজ করার বয়স না। যা গিয়ে পড়াশোনা কর।”
মায়া উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে আঁকিবুঁকি করছিল।
এমন সময় মিমো এলো। মায়ার হাত থেকে বইটা নিয়ে বলল, “ওমা! তুমি দেখি ভাইয়ার নাম লিখতে লিখতে পুরো বই ভরে ফেলছো!”
মায়া থতমত খেয়ে গেল। আনমনে কখন যে সে ইমনের নাম লিখে ফেলেছে নিজেও জানে না।
মিমো ফের বলল, “এভাবে বুঝি তুমি তোমার রোমিওকে প্রেম নিবেদন করছো?”
“যা সর। লজ্জা শরম নাই তোর? আমি তোর ভাবি, কথাটা মাথায় রাখিস!”
“মনে আছে আমার ভাবিজান। আর আমি হলাম তোমার কু’ট’নি ননদিনী। মাঝে মাঝে তো একটু কু’ট’না’মি করবোই তাই না বলো?”
মায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।
মায়া মিমো কে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে টিভি ছেড়ে বসল। দুজনে টিভি দেখছে, সেই সময় সুহাদাও পাশে এসে বসলেন।
মিমো মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপু কি সৌভাগ্য তোমার! ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে হয়ে ভালোই হয়েছে।”
“কেনো?”
“আরে ভাইয়া তোমার সম্পর্কে এক দিক দিয়ে ফুপাতো ভাই। এখন তুমি ফুপাতো ভাই বিয়ে করছো, তোমার শাশুড়ি তোমার ফুপি। ইচ্ছে করলেও তোমার শাশুড়ি তোমায় বাপের বাড়ির খোঁচা দিতে পারবে না। বুঝনা, তোমার বংশ তুলে কথা বললে, নিজের দিকেই সেটা ফিরে আসবে।”
মায়া হেসে ফেলল। সুহাদা জামান নিজেও হেসে উঠলেন।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে এক কাজ করি, তোকেও তোর ফুপাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেই। তুই তো কাজে কর্মে এমনিতেই অষ্টরম্ভা! তোকেও তোর ফুপি আর খোঁচা মেরে কথা বলতে পারবে না।”
মিমো হেসে বলল, “সরি মাই ডিয়ার আম্মু! রোহন ভাইয়াকে আমি কখনোই বিয়ে করছি না। বাবারে বাবা, কি রাগ ওর। সামনে যেতেও হাত পা কাঁপে। আর একটা ধমক দিলে তো কথাই নেই। ইমন ভাইয়ার থেকেও এক লেভেল উপরে। আল্লাহ ভালো জানে, ওরে বিয়ে করে কোন মেয়ের কপাল পোড়ে।”
মায়া বলল, “তুই বিয়ে করেই, নিজের কপালটা পুড়িয়ে আয়না!”
“এহ, শখ কত!” মুখ ভেটকিয়ে বলল মিমো।
.
.
নীলা পার্কে এসে বসেছে, নিলয়ের জন্য। সে একটু আগে আগেই এসেছে। বাসার মধ্যে একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাই নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান থেকে ঘুরে ফিরে এখানে এসে বসলো।
আধা ঘন্টার মাথায় নিলয় চলে এলো। সে এসে নীলার পাশে বসলো। নীলা এক পলক তাকালো নিলয়ের দিকে। তারপর অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
বলল, “কি বলবি বল?”
নিলয় ইতস্তত করছিল। ভারি ভারী নিশ্বাস ফেলছে। নীলা ওর দিকে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল। বলল, “কি হয়েছে তোর? এমন নার্ভাস ফিল কেন করছিস?”
“না মানে, তেমন কিছু না।”
“তেমন কিছু না মানে কি? তোর কি শরীর খারাপ? এই অবস্থায় না এলেও পারতি। ফোনে আমাকে জানিয়ে দিলেই তো হতো।”
“নাহ না। যত যাই হোক, আসবো বলেছি যখন তখন তো আসতেই হবে আমাকে। আর আমার শরীর খারাপ না। দৌড়ে এসেছে তো এই জন্য। তোর সাথে যে আমার কথা আছে, যেভাবেই হোক আসতে তো হতোই আমাকে।”
“তো বলনা? কি বলবি?”
“কেমন আছিস?”
নীলা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এইটা বলার জন্য আসছিস তুই?”
“না আরো কিছু বলবো তো। আই এম ফিল সো নার্ভাস!”
“এক কাজ কর তুই, দুই মিনিট চুপচাপ শান্ত হয়ে বস। নার্ভাসনেস কমুক, তারপর যা বলার বলবি।”
নিলয় আর কিছু বলল না। অপেক্ষা করতে লাগলো দুই মিনিট শেষ হওয়ার জন্য। চোখের পলক না পরতেই কেমন গচ্ছিত সময়টুকু শেষ হয়ে গেল।
নীলা বলল, “বল এখন। যা বলার নকশা কম করে সরাসরি বলবি।”
“পড়াশোনার কি অবস্থা তোর?”
নীলা কোমরে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রেগে বলল, “এই, এই তোর ইম্পরট্যান্ট কথা? এই কথাটা বলার জন্য তুই আমাকে এতো দূর থেকে ডেকে নিয়ে আসছিস? কি আজব!”
নিলয় আরো নার্ভাস হয়ে গেল। দুই হাত দিয়ে মুখ মুছে নিল।
নীলা চলে যেতে নিল। নিলয় তখন ওর হাত ধরে আটকালো।
ধরা গলায় বলল, “আমি তোকে ভালবাসি রে, নীলা!”
.
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
#মায়াবন_বিহারিনী 🖤
#পর্ব_২০
#আফিয়া_আফরিন
নীলার সমস্ত পৃথিবী থেকে থেকেই কেমন যেন দুলে উঠছে বারবার। নিলয়ের মুখ থেকে ‘ভালবাসি’ কথাটা শোনার পর সে চলে এসেছিল। কোন জবাব দেয়নি। আর জবাব দেওয়া তো দূরে থাক, পেছন ফিরে তাকাওনি পর্যন্ত। আচ্ছা নিলয় তাকে ভালোবাসে কেন? সে তো খুব খারাপ। ইমন আর মায়াকে আলাদা করার জন্য কত কাহিনী করলো। এরপরও কি তার মত মেয়েকে কেউ ভালবাসতে পারে?
যদি সে খুব খারাপ মেয়ে না হতো, তাহলে হয়তো ঠিকই নিলয়ের ভালবাসায় সাড়া দিতে পারতো। আজ বুকের ভেতর এমন উথাল পাথাল কেন লাগছে?
এমন কেন মনে হচ্ছে বারবার, ‘ নিলয় নামের ওই ছেলেটিকে তার সারা জীবনের জন্য চাই। একমাত্র নিলয় তার ভাঙ্গাচোরা জীবনটাকে জোড়া লাগিয়ে দিতে পারবে।’
কিন্তু কিভাবে সম্ভব? নিলয়ের প্রতি সে এত সহজে কেন দুর্বল হয়ে পড়ছে? ইমনের বেলায় তো কখনো এমন হয়নি। ইমন কখনো তাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি বলেই কি এমন হয় নাই? কিন্তু সে তো ইমনকে ভালবাসতো। তাহলে কিভাবে এত তাড়াতাড়ি ইমনকে ভুলে নিলয় কে মনে জায়গা দিতে পারে?
অথচ নিলয় ভালোবাসার কথা বলার আগ পর্যন্তও, সে এক সেকেন্ডের জন্যও নিলয়কে নিয়ে কিছু ভাবে নাই। কিন্ত, এই মুহূর্তে বুকের ভেতর যে ঝড়ের তাফালিং চলছে, তার নিরাময় হবে কবে?
প্রচন্ড আফসোস হচ্ছে নীলার। কেন সে অযথাই মায়া আর ইমনের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ঢুকলো? কেন একটা ভালো সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য এভাবে উঠে পড়ে লাগলো?
পৃথিবীটা এত কঠিন কেন? মানুষ এত অসহায় কেন? নীলার এই অসহায়ত্ব ঘুচবেই বা কবে?
.
.
.
“তারপর বলো, তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে সবচেয়ে রোমান্টিক কাহিনী টা বলো?”
“ছিঃ, কি নির্লজ্জ হয়ে গেছিস তুই মিমো? সম্পর্কে কিন্তু আমি তোর ভাবি হচ্ছি।”
“তুমি আমার সাথে এত ফর্মালিটি কেন দেখাচ্ছো? আর একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করো না। তোমাকে যেটা বলতে বলেছি সেটা বলো। আমি তো আজকে তোমাদের রোমান্টিক কাহিনী শুনবোই। আমাকেও তো একটু রোমান্টিসিজম শিখাও!”
“আমাদের মধ্যে কোন রোমান্টিক কাহিনী হয় নাই আজ পর্যন্তও। সম্ভবত তোর ভাই আস্ত একটা আনরোমান্টিক মানুষ।”
“ভাইয়ার কথা ছাড়ো। তুমি নিজে কি?”
মায়া করুন মুখ করে বসে রইলো আর ভাবতে লাগলো, আদৌ কি তাদের মধ্যে এমন কোন রোমান্টিক কাহিনী হয়েছিল, যেটা একটু অন্যরকম। মিমো কে বলার মতো।
তারপরেই হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলো। মিমের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, “শোন আমরা যখন ঢাকা থেকে বগুড়া চলে এলাম, তখনকার কথা। অবশ্য তার বেশ কিছুদিন মানে বছর দুয়েক পরের কথা। রাত বারোটার সময় আমি ইমনের সাথে কথা বলে ফোন রাখছি। তার ঘন্টা দুয়েক পরে ফোন বেজে উঠলো। আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ফোন হাতে নিয়ে দেখি ইমন ফোন করছে। কাঁচা ঘুম ভাঙানোর জন্য প্রচন্ড রাগ লাগলো। ফোন তুলে দিলাম এক কড়া ধমক। তখন ও একটু মন খারাপ করে বলল, ‘ধমকাচ্ছিস কেন এমন করে?’
উত্তরে আমি বললাম, ‘ মএই রাত বিরেতে ঘুমের সময় ফোন কেন দিছো? ঘুম নাই তোমার? একটু আগেই না কথা বললা।’
‘মশার কামড় খাচ্ছি। ঘুমানোর জায়গা নাই।’
‘মানে কি? কোথায় তুমি?’
‘তোর বাড়ির পিছনে!’
তারপর আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিলাম। মানে ইমনের কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমার বাড়ির পিছনে এত রাতে মানে কি? তার মধ্যে ও এক জায়গায় আমি এক জায়গায়। এমনিতেই ওর স্বভাব ছিল কারণে অকারণে চাপা মারা। স্বভাবতই আমি এবারও তাই ভেবেছিলাম। তবুও কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিলো। ইমন তো আর এত রাতে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে মিথ্যা কথা বলবে না! তাই উঠে বেলকনিতে গিয়ে দেখি ওমা সত্যিই ইমন। আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। আমাকে তো তখন নিচে নামতে হবে। ঘরের দরজা খুলে বাইরে বের হতে নিলে, আব্বু আম্মু বুঝে যাবে। তাই আমার রুমের দরজা ভেতর থেকে ছিটকানি দিয়ে, বেলকনি গ্রিল থেকে নিচ পর্যন্ত পাঁচটা ওড়না বাঁধলাম। তারপর সুড়ৎ সুড়ৎ করে নিচে নামলাম। ইমনকে অনেকদিন পর দেখে আনন্দ লাগছিল, তার থেকেও বেশি লাগছিল ভয়। তখন তো আরো ছোট ছিলাম আমরা।”
মায়া থামলো। মিমো বললো, “ভাইয়া আমাদেরকে না জানিয়ে এতদূর চলে গেল? বাসায় কি বলেছিলো?”
“আমি জানিনা এত কিছু। জিজ্ঞেস করার সময় হয়ে ওঠে নাই।”
এমন সময় মিমোর ফোনে ঋদ্ধর ফোন আসে। সে ফোন হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
যাওয়ার আগে মায়া কে বলেছে, “এক মিনিট, আসছি আমি।”
মায়া ফিরে গেল আবারও সেই স্মৃতিতে। মায়া নিচে নেমেই ফের ইমনকে ধমক দিয়ে বলেছিলো, “পাগল তুমি? কখন আসছো?”
“এইমাত্র এলাম তো। আর পাগল হবো কেন? তোর সাথে দেখা করতে আসছি আমি।”
“আসলেই। তোমার মাথা মনে হয় গেছে। হায় আল্লাহ! আম্মু আব্বুকে কি বলবে তুমি? কেন আসছে এখানে?”
“আজব? মামা-মামী জানবে কি করে? আমি তো তাদের সাথে দেখাই করবো না। আমি তো তোর সাথে দেখা করেই চলে যাব।”
ইমনের এহেন পাগলামি দেখে মায়া মাথায় হাত দিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ল। ইমন ও পাশে বসলো।
“তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো, জানিস! থাকতে পারলাম না আর। চলেই এলাম।”
মায়া চুপ।
“রাগ করেছিস আমার ওপর? কথা বলবি না? তাহলে বলে দে, আমি চলে যাই। যাবো?”
তারপরেও মায়া কিছুক্ষণ নির্বিকার থাকলে ইমন তার মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নিয়ে উঠে পড়ে। মায়া তার হাত ধরে থামায়। ইমনকে বসিয়ে ওর বুকের সাথে হেলান দিয়ে নিজেও বসে।
“আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে বলে এসেছ, তো এখন চলে যাচ্ছ কেন? দেখো আমায়!”
“তুই তো কথাই বলছিস না। আমি আসায় কি রাগ করেছিস?”
“না? কিন্তু খুব খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, আমার জন্য তুমি কত দূর থেকে চলে আসছো। খুব কি দরকার ছিল আমার জন্য এত কষ্ট করে এতদূর আসার?”
“তোকে দেখতে এসেছি। তোকে দেখার জন্য বুকের ভেতরটা কানকাটা মাছের মত ছটফট করছিলো। আমি এসেছি আমার নিজের প্রয়োজনে। তোর দর্শনে নিজের অতৃপ্ত চোখ দুটোকে সান্ত্বনা দিতে। তাহলে তুই এখানে নিজেকে ব্লেইম কেন দিচ্ছিস? আর সবচেয়ে বড় কথা কি জানিস? তোকে দেখার জন্য কখনোই আমার কষ্ট হয় না। বুকের মধ্যে শান্তি শান্তি লাগে!”
মায়া তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো। নিজেকে কেমন যেন খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিলো। এত বেশি ভালোবাসা ও টিকবে তো তার কপালে?
ইমন আর মায়া সেইবার সারা রাত ধরে ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে গল্প করেছিলো। নিস্তব্ধ রাত আকাশ বাতাস ও সাথে ছিলো। তারপর ইমন ভোর হলে চলে আসে।
.
.
অতিতের এমন সুন্দর মুহূর্ত মনে পড়লেই চোখ দুটো কেমন ঝাপসা হয়ে আসে, নিজের অজান্তেই। চিরচেনা সেই মানুষটা পাশে থাকলেও তাকে ঘিরে থাকা এমন সুখময় কিছু অতীত বারবার মনের চিলেকোঠায় কড়া নারে। বারবার মনে হয় তাকে নিয়ে যদি আবার সেই সোনালী প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু সব সময় বোধহয় সবকিছু সম্ভব হয় না, অর্থাৎ সম্ভব হতে নেই। বর্তমানে যেটুকু আছে সেটুকু নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়, ভালো থাকতে হয়।
মায়ার ভাবনার অবসান হল মিমোর ডাকে।
মিমো বললো, ” আপু নীলক্ষেত যাবে?”
“কেন? ওখানে কি তোর শ্বশুর বাড়ি? নাকি রিদ্ধ ফোন করে ওখানে দেখা করতে বলেছে?”
“উফ, কোনোটাই না। রিদ্ধ আমায় একটা ফাটাফাটি বইয়ের নাম সাজেস্ট করেছে। সেটা কিনতে যাবো।”
“কি বই?”
“হুমায়ূন আহমেদের ‘বাসর’ ওই বইটা।”
মায়া হি হি করে হেসে বলল, “কাহিনী কিরে তোর? তুই যেরকম বাসরের কাহিনী চাচ্ছিস, সেরকম কোন কাহিনী না কিন্তু। নামটাই শুধু ফ্যান্টাসি ধরনের। আমিও পড়ছি বইটা। বাস্তবিক ধরনের কাহিনী। মনে হয় না, তোর মনের মত হবে।”
“দেখো আপু এসব কিন্তু একদম ঠিক না। তুমি সব সময় আমায় এরকম করে পঁচাও। শুধুই উল্টাপাল্টা কথা বলে। যেমনি হোক না কেন, আমি পড়বো।”
“হ্যাঁ। বয়ফ্রেন্ড বলেছে পড়তে তো হবেই।”
“যা ইচ্ছা তাই মনে করো। কিন্তু তুমি এখন আমার সাথে চলো। যাও গিয়ে রেডি হও।”
রেডি হয়ে মায়া আর মিমো দুজনেই বের হল। রিকশা নিয়ে সোজা চলে এলো নীলক্ষেতের বিশাল বইয়ের দোকানে।
মিমো খুঁজে খুঁজে তার কাঙ্খিত বইটি পেয়ে গেল। বইটি কিনে মায়াকে বলল, “চলো দুজনে মিলে ফুচকা খেয়ে আসি।”
“এখানে ফুচকা কোথায়?”
“আর একটু সামনে এগিয়ে গেলেই পাবো।”
“আচ্ছা চল।”
তারা সামনের দিকে যেতে উদ্যত হলেই, পেছন থেকে কারো ডাকে থেমে যায়। মায়া আর মিমো দুজনেই পেছন ফিরে তাকায়। ওমা! নীলা। নীলা ওদের দিকে এগিয়ে এলো।
হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো তোমরা?”
মিমো বিড়বিড় করে বলল, “ডাইনি, শাকচুন্নি, পেত্নীরে দেখলে নাকি কেউ ভালো থাকে?”
মায়া ওকে হাতের কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে থামালো। তারপর নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?”
“আমিও ভালো আছি। অনেকদিন পর দেখা হল তোমার সাথে। তারপর বলো, কি খবর?”
মিমো আবার বিরবিড়িয়ে বললো, “শাকচুন্নির শনি জীবন থেকে গেলে দিনকাল তো ভালোই কাটবে।”
মায়া এবার কড়া চোখে তাকালো মিমোর দিকে। সে চুপ করে গেল।
মায়া নীলাকে বলল, “বলছি সব। তার আগে চলো কোথাও বসি। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়?”
তারা তিনজন মিলে রাস্তার ওপাশে একটা কফি শপে গিয়ে বসলো। তিনজনই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ।
নীলা জিজ্ঞেস করলো, “ইমন তো এখানে নেই তাই না?”
“না। ওর পরীক্ষা তো। রাজশাহী গেছে।”
“হ্যাঁ শুনলাম। ফিরবে কবে?”
“পরীক্ষা শেষ হলে।”
“ও। তো এখানে হঠাৎ কি কাজে?”
“বই কিনতে এলাম। মিমোকে তার ফ্রেন্ড একটা বই সাজেস্ট করেছিলো, সেটা কিনতেই আসা। তুমি হঠাৎ এখানে?”
“আমিও বই নিতে এসেছি। আচ্ছা চলো না আমাদের বাসায়। মা দেখলে খুশি হবে তোমাদেরকে।”
“যাব আরেক দিন।”
“না প্লিজ। আজকে চলো। ইমন ও তো নেই, বাড়ি ফিরে কি করবে? তার চেয়ে চলো আমাদের বাসায় দুদিন থেকে আসো।”
মায়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তারপর ফোনে মেসেজের টুংটাং আওয়াজ ভেসে এলো কর্ণ-কুহরে। ফোন হাতে নিয়ে দেখল মিমোর মেসেজ। সে তাকালো মিমোর দিকে। পাশেই তো বসে আছে মেয়েটা, তাহলে মেসেজ কেন পাঠালো?
মিমো চোখের ইশারায় মেসেজটা পড়তে বলল।
মায়া পরলো, “খবরদার মায়া আপু, নীলা আপুর সাথে একদম তার বাসায় যেতে রাজি হয়ো না। বলা যায় না, বিষ বা ইঁদুর মারার ঔষধ দিয়ে তোমায় মারার প্লানও করতে পারে।”
মায়া রাগের ইমোজি দিয়ে ফোন রেখে দিল। নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি চলো ঘুরে আসো।”
“আমি তো যাই। তুমি আজ চলনা? এত তাড়া কিসের ফেরার জন্য?”
সূর্য তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। ডুবু ডুবু প্রায়। পাখিগুলো নীড়ে ফেরার প্রয়াসে উড়াউড়ি আরম্ভ করেছে। চারদিক তাকিয়ে দেখলো মায়া কেমন নিরব কলরব, গোধূলি বেলা হঠাৎ করে মায়ার মনে কেমন বিষন্নতার সৃষ্টি করল। শুধু মনে হচ্ছে এই সময় ইমন কে পাশে পেলে ভালো লাগতো, শান্তি লাগতো।
সে মলিন কন্ঠে নীলাকে বলল, “আজ আর যাওয়া হবে না গো। বাড়ি ফিরতে হবে। ওই বাড়িতে আমার ও যে না হওয়া একটা সংসার পড়ে আছে!”
.
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]