মনসায়রী’ ১১.

‘মনসায়রী’

১১.
আচারের বাটিটা হাতে নিয়ে চুকচুক আওয়াজ তুলে খাচ্ছে নিতু।
একটু পরপরই আবার আচারের টকে মুখ কুঁচকে উঠছে। ফর্সা গাল লাল হয়ে গেছে ঝালে। টক আচারের সাথে অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে খেতে পছন্দ করে নিতু। ঝালপ্রিয় মেয়ে হলেও স্বভাবে সে বড়ই ভীরু। আচার লেগে মুখহাত ভরিয়ে ফেলেছে সে। পাশেই সায়ন্তিকা বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। দুজনেই খেতে খেতে রাজ্যের গল্প জুড়েছে। মাঝে মধ্যে লিভিং রুম কাঁপিয়ে হেঁসে উঠছে। সায়ন্তিকা তাদের কলেজের একটা ঘটনা বলে যাচ্ছে সমানতালে। কিন্তু, নিতুর নজর সেদিকে নেই। তাঁর ধ্যান জ্ঞান সবকিছু রান্নাঘরের দিকে। অমনোযোগী হতে দেখে সায়ন্তিকা ভ্রু কুচকে বলল,
‘কী হলো কোথায় হারিয়ে গেছিস?’
নিতু মাথা নাড়িয়ে হেঁসে বলল,
‘কই? কিছু না ৷ তুই বল। ‘
সায়ন্তিকা আবারো নিজের কথার ঝুলি খুললো। অথচ, কিছু না বললেও নিতু আঁড়চোখে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে টুংটাং চামচ নাড়ানোর শব্দ। আর মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভাসা মিষ্টি কফির গন্ধ।

একটা টসটসে কাঁচা শসা কচকচ করে কামড় দিয়ে খেতে খেতে জুসের গ্লাসটা ভরে নিলেন জোবাইদা। তাঁর পেছনে বরাবরের মতো সকিনা হেলেদুলে হাঁটছে। এখন ওর কাজ ওটস দিয়ে ড্রাই ফ্রুটস রেডি করা। জোবাইদা সচরাচর রান্নাঘরের দিকে আসেন না। তাঁর রান্নাঘরে আসার সময় হলো, যখন সায়র কিংবা সায়ন্তিকার জন্মদিন বা অন্য কোনো বিশেষ দিনগুলো। এছাড়া তেমন কোনো কাজ এখন নেই। তাঁর মতে, ছেলেমেয়েদের জন্য ছাড়া তিনি তাঁর এতো যত্নের ত্বকে আগুনের ধোঁয়া লাগিয়ে কালো হতে ইচ্ছুক নন। একসময় নিয়মিত রান্নাবান্না করলেও এখন এসব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন তিনি। মাসেক ছয় হলো একটা ‘বিউটি অফ স্কিন’ নামক গ্রুপে জয়েন হয়েছেন। সবার এই নিয়ে সে কী হাসাহাসি! প্রথম বার যখন তিনি এই গ্রুপে যোগ দিলেন। তখন সেখানের প্রায় সবাই-ই কমবয়সী। জোবাইদা সরলমনা মানুষ। অত প্যাঁচঘোচ তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। সেখানে ভর্তি হওয়ার সময় ক্যাশ কাউন্টারের লোক যখন তাঁকে ওখানে যেতে দেখে অবাক হয়ে বয়স জিজ্ঞেস করলো। তখন জোবাইদা ভাবলেন,যদি বয়স বেশি বললে সবাই হাসাহাসি করে! যদি তাঁকে জয়েন হতে না দেয়! ভেবে তিনি নাকের উপর এঁটে থাকা রঙিন চশমা উপরে তুলে বললেন, তাঁর বয়স পঁচিশ বছর। এহেন কথায় সবাই মুখ চেপে হেঁসে উঠেছিলো। থতমত খেয়ে বসেছিলেন জোবাইদা। বয়সটা কী একটু বেশি বলে ফেললেন!

সেই শুরু। এই অবশ্য নতুন নয়। প্রায়ই এমন প্রবণতা দেখা যায় তাঁর মাঝে। লেখক হুমায়ুন আহমেদের বড় ভক্ত। এমনও দেখা যায়, তাঁর লেখা কোনো চরিত্র পড়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে কেঁদে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তখন একমাত্র সায়রই সেই মানুষ যে তাঁকে বাচ্চাদের মতো আদর করে খাইয়ে দেয়।

জুসে আরেক চুমুক দিয়ে জোবাইদা রান্নাঘরে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে হাতের নাড়ানো থামিয়ে মুচকি হাসলো সায়র। আজকে ভার্সিটির অফ ডে। প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিন সায়র সকালের খাবারটা নিজের হাতে বানায়। মন খুব ভালো হলে আয়োজন করে সবকিছু করে। জোবাইদা ছেলের পাশে এসে দাঁড়ালেন৷ সায়র তখন মনোযোগ দিয়ে রান্নায় মশলা মেশাচ্ছে। কখনো বাম হাত দিয়ে শক্ত হাতে কড়াই ধরছে। আবার কখনো নেড়ে নেড়ে চুলোর আঁচ লো করে দিচ্ছে। জোবাইদার মায়া হলো। তিনি গায়ের শাড়ির আঁচল দিয়ে সায়রের ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে, ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

‘সায়ু বাবা আমার! এসব কষ্ট করে কেনো করতে যাও! মাকে বললেই তো করে দিতাম। ‘

সায়র মায়ের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলল,

‘রান্না করা আমার একটা শখ, মা। ‘

‘শখ ভালো কথা। কিন্তু, রোজ রোজ করতে হবে না। সামনে তোমার এক্সাম। পড়াশোনা করো। কিছু খেতে মন চাইলে সার্ভেন্ট আছে। নাহলে, সকিনাকে বলবে। কী সকিনা? পারবিনা? ‘

সকিনা দাঁত বের করে হেঁসে বলল,

‘খুব কইরা পারবো!’

জোবাইদা ওর দাঁতের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নাক ছিঁটকে বললেন,

‘তুই আবারো পান খেয়েছিস তাইনা?’

সকিনা মুখ দুই হাতে চেপে ধরলো। হেসে কথা বলা উচিত হয়নি।
আমতা আমতা করে বলল,

‘এখন ছেড়েই দিছি ম্যাডাম! খালি মাঝে মাঝে অনেক ইচ্ছা করে তখন আরকি। আস্তে আস্তে আরো ছাইড়া দিবো। ‘

‘হুম, ছেড়ে দিলেই ভালো। আর ভাষা শুদ্ধ করার চেষ্টা কর। ‘

‘জ্বে! ‘

‘জ্বে না বল জ্বি!’

ধমক খেয়ে জ্বি জ্বি বলে দৌড়ে গেলো সকিনা। গ্রামের হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়ে সকিনা। বয়স কম হওয়ায় জোবাইদা ওকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের গ্রাম থেকে। প্রথম প্রথম শুদ্ধ ভাষা বলতে গেলে দশবার ভুল হতো। এখন অর্ধেক কথায় শুদ্ধস্বর ব্যবহার করলেও মাঝেমধ্যে ভুল করে বলে ফেলে। সায়র নিঃশব্দে হাসছে সকিনার দৌড়ানো দেখে। জোবাইদা সায়রের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

‘তুমি বেশিক্ষণ থেকো না সোনা। তোমার ফেসে কিন্তু পিম্পল হবে। আমি সার্ভেন্ট পাঠাচ্ছি। তোমাকে সাহায্য করবে। ‘

সায়র কিছু বলল না। সে জানে রান্নাঘর থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত জোবাইদা অস্থির হয়ে ছুটাছুটি করতে থাকবেন। রান্না প্রায় শেষ। আর পাঁচ মিনিট লাগবে ডেকোরেশন করতে। টিস্যু পেপার দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বের হলো সায়র। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতলটা নিয়ে সোফায় বসলো। নিতু চমকে উঠলো। আচার লেগে থাকা হাত দুটো নিজের বুকে চেপে ধরলো। হৃৎস্পন্দন থেমে গেলো মনে হচ্ছে। পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। কাঁপা চোখে ডান দিকে তাকালো সে। সায়র ঢকঢক করে পানি গলায় ঢালছে। গলার ক্রমাগত উঁচু হওয়াটা ঘোর লাগিয়ে দিলো নিতুর। মনমস্তিষ্ক হরতাল শুরু করছে। এতো কাছে বসে আছে কেনো ছেলেটা! ছেলেটা কী জানে, তারা পদধ্বনিও নিতুকে শিরায় শিরায় কাপিয়ে তোলে! জানে না। এই যে বান্ধবীর বাসায় ঘনঘন আসা নিতুর। দুই তিন দিন পরপরই যে অবাধ্য মনের পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ছুটে আসে সে। নিতুর মন আছে, যেদিন প্রথম বার সায়রকে দেখলো। তখন সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে উঠেছে। সদ্য কিশোরী মন তাঁর। নিতুর মা জোবাইদার ভালো বান্ধবী হওয়ায় সেইদিন নিতুকে সঙ্গে করে এই বাড়িতে এসেছিলো। সায়ন্তিকাও ভালো বান্ধবী হয়ে গেলো ধীরে ধীরে।
সায়ন্তিকা তাঁকে নিয়ে ছাঁদে ঘুরিয়ে আনতে গেছিলো। দুজনে ছাদে গিয়ে উঠতেই দেখলো ছাদের এক কোণায় একটা হাতা কাটা গেঞ্জি আর হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট পড়ে সিগারেট খাচ্ছে। সিগারেট জিনিসটা নিতুর খুব বাজে লাগতো। সেই প্রথম বার মনে হলো, সিগারেট জিনিসটা কেউ যদি সবচেয়ে সুন্দর ভাবে খেতে পারে তাহলে এই ছেলে। মুখে খানিকটা সিগারেট ছুঁইয়ে ফু দিয়ে একটা শৈল্পিক ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছাড়ছিলো। মাতালের মতন তাকিয়ে দেখছিলো নিতু। সায়র ওদেরকে দেখা মাত্রই সিগারেট ফেলে পা দিয়ে পিষে একটা সেন্টার ফ্রুট মুখে দিয়ে সাবলীলভাবে এগিয়ে এসেছিলো। সায়ন্তিকার মাথায় হাত বুলিয়ে নিতুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো মেয়েটা কে। সায়ন্তিকা নিতুর নাম বলার পর সায়র সামান্য হেঁসে চলে গিয়েছিলো। সেই হাসি কখনোই ভুলতে পারবেনা নিতু। তারপর থেকে প্রায়ই একটু সময়ের জন্য সায়রকে দেখতে আসে লুকিয়ে। মাঝে মাঝে ভাবে, মনের কথাটা সায়রকে বলে দিবে। চিৎকার করে বলে দিতে,
‘সায়র, আপনার এই সিগারেট খাওয়ার এই চমৎকার দৃশ্য আমি সারাজীবন দেখতে চাই। প্লিজ! আমাকে আপনারা সিগারেট সঙ্গী বানাবেন?’
বললে নিশ্চয়ই সায়র তাঁকে পাগল বলে হাসবে। তাঁকে পাবনায় ভর্তি করে দিয়ে আসবে। এসব ভেবে মিটিমিটি হাসছে নিতু। সায়ন্তিকার ধাক্কায় কল্পনা ভেঙে বাস্তবে ফিরে আসলো সে। হকচকিয়ে দেখলো জোবাইদা, সকিনা এমনকি সায়রও তাঁকে ড্যাবড্যাব করে দেখছে। কী হলো বুঝতে না পেরে সায়ন্তিকার দিকে তাকালো। সায়ন্তিকা অবাক হয়ে বলল,
‘এমন হাসছিস কেনো তুই? ‘

নিতু মাথা নাড়িয়ে কিছু হয়নি বলল। মনে মনে নিজেকে বকে চুপচাপ বসলো সে। সায়র নিজের হাতে খাবার সার্ভ করছে।
সবার খাবার বাটিতে রাখলেও, শুধু জোবাইদার বাটিটা নিজের হাতে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে হাসলো। তারপর মোবাইলে কারো সাথে কথা বলতে বলতে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো। নিতু সায়ন্তিকার কানে ফিসফিস করে বলল,

‘সায়ন্তি, তুই আমাকে একটা কথা বল তো। তোর ভাই সবসময় এতো মুডি ভাব নিয়ে থাকে। আমি আসলাম, আমাকে জিজ্ঞেসও করলো না কিছু। সবার বেলায় গম্ভীর। একমাত্র আন্টির সাথেই দেখি হেঁসে মজা করে কথা বলে। কেনো আমরা সবাই কী তাঁর শত্রু?’

সায়ন্তিকা তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘ধুর! শত্রু হবো কেনো? ভাইয়া সবার সাথেই এমন ভাবে কথা বলে। ভাইয়া স্বভাবতই এমন। খুব চাপা স্বভাবের। নিজের মনের কথা কাউকে টের পেতে দেয়না। তাঁর মনে কখন কী চলে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। আর মাকে তো চিনিসই। মা আমার থেকেও ছোটদের মতো আচরণ করে। এছাড়াও মা আর ভাইয়ার আলাদা একটা বন্ডিং আছে। ভাইয়া যেমন মাকে অনেক ভালোবাসে। তেমন মা-ও ভাইয়াকে ছাড়া কোথাও একা গিয়ে শান্তি পান না। আমি ছোটবেলা থেকেই এমন দেখেছি। ‘

নিতু বুঝার মতো করে বলল,

‘আমি তোদের পরিবারের মানুষ গুলোকে না দেখলে জানতামই না, আপন মা ছেলে না হয়েও এতো ভালোবাসা থাকতে। এটা আমার কাছে অনেক অসম্ভব লাগে জানিস!’

সায়ন্তিকা মুচকি হেসে বলল,

‘অসম্ভব না। ভাইয়া সবসময় বলে,যেখানে মনের টান বেশি সেখানে পরিস্থিতি কোনো বাঁধাই না। ‘

চলবে –
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।

(এবার কিছু কথা বলি পাঠকদের। ‘মনসায়রী’ কোনো থ্রিলার রহস্যময় গল্প না। এটা আমার জন্য এক ধরনের প্রি টেস্ট। মনসায়রীর পর একটা অন্য রকম উপন্যাস আসবে। সেটা লেখার জন্য অনেকটা সময় নিচ্ছি আমি। নিজের স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্যই মূলত। মনসায়রী একটা সাদামাটা সামাজিক ও রোমান্টিক গল্প। এটা খুব বেশি ছোট বা বড় হবে না। এজন্যই আমি কাহিনি একটু আস্তে ধীরে এগিয়ে নিচ্ছি। তবুও প্রতিটা পর্ব ১০০০ শব্দের বেশি। আর গুটিকয়েক পাঠক বলছেন, কিছু বুঝতে পারছেন না কনফিউশান লাগে। আর আমি এটা বুঝতে পারছি না এখানে কনফিউশান লাগার কী আছে! রহস্য তো একেবারেই নেই। তাহলে? রোদসীর পাঠকমহল গ্রুপটা কিন্তু পাঠকের রিভিউ এর জন্যই। কিন্তু দুঃখজনক, গ্রুপে গল্পের রিভিউ পোস্টই নেই। আপনাদের সবাইকে অনুরোধ, একবিন্দু পরিমাণ কনফিউশান থাকলে গ্রুপে পোস্ট করুন। আমি নিজে সবটা বুঝিয়ে বলবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here