মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই💙,০২,০৩

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই💙,০২,০৩
#মম_সাহা
পর্বঃ দুই

আকাশে মেঘ গুলো ক্ষাণিকটা তুলোর মতন লাগছে। শরৎ এর আকাশটা ভীষণ আদুরে হয়। দেখলেই মনে হয় ছুঁয়ে দিতে। এমন এক অদম্য ইচ্ছে নিয়ে সেই আকাশ পানে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তিস্তা সাথে হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের সরু পথ দিয়ে। তার সাথে আজ কেবল মাস্টারমশাই আছে। মাস্টারমশাই নিজের সাইকেলটা নিয়ে হাঁটছে গম্ভীরভাবে।

তিস্তা কতক্ষণ মনের মাঝে হাবিজাবি ভেবে হঠাৎ মাস্টারমশাই’কে প্রশ্ন করলো,
-‘আচ্ছা মাস্টারমশাই, আপনারে একটা কথা বললে রাখবেন?’

মাস্টারমশাই ক্ষানিকটা ভ্রু কুঁচকায়। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
-‘উল্টোপাল্টা চাইবি নাকি?’

-‘আপনার সবসময় মনে হয় আমি উল্টোপাল্টা চাই? থাক,লাগবে না।’

তিস্তার এহেন অভিমানে গোপনে হাসে মাস্টারমশাই। শরৎ এর কোমল বাতাসে ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে অভিমানী সপ্তদশী। মাস্টারমশাই কিছু বলে না, কারণ তিস্তা আবার নিজ থেকেই আসবে কথা বলার জন্য।

মিনিট পাঁচ পেরিয়ে যায় তিস্তা চুপ রয়। এখন যে পথটি দিয়ে হাঁটছে তার বা’পাশে একটা মরানদী আছে। মৃত নদী হলেও তার রূপের জেনো অন্ত নেই। তিস্তা মৃত নদীটির দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে,
-‘জানেন মাস্টারমশাই, এ গ্রামে অনেক আগে এক জমিদার বাস করতো, তার নাম ছিলো আনন্দমোহর। উনার সহধর্মিণীর এ নদীটা খুব পছন্দ ছিলো। উনার পছন্দকে আরও সৌন্দর্যময় করে তুলতে নদীটির পাড় চিনাপাথর দিয়ে বাঁধানো হয়। একটি বিশাল বসার জায়গা বানানো হয় সুন্দর করে। আনন্দমোহরে স্ত্রী’র নাম ছিলো মধুসখী,সেই নাম অনুসারে নদীটির নাম রাখা হয় মধুসখী। কিন্তু এই প্রিয় নদীই কাল হয়ে দাঁড়ায় মধূসখী’র। একদিন এ নদীতে ডুবেই সে মানবী মারা যায়। এরপর নাকি প্রায় কত যুগ নদীটি মৃত ছিলো। এর পানি শুখিয়ে চর জেগেছিলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন সবাই’কে অবাক করে নদীটিতে আবার পানি আসলো। নদীটি ভরে গেলো,তার রূপ আরও বেড়ে উঠলো।’

প্লাবন খুব মনযোগ দিয়ে সবটা শুনলো। সে এগুলো জানে। গত দু’বছর যাবত অনেকেই এ নদীটিকে জাদুময় নদী বলে আখ্যায়িত করে। অনেকে তো রাতে এখান দিয়ে আসে না। গ্রামীণ কিছু কুসংস্কার তো থেকেই যায়। তবে সে পুরোনো গল্প নতুন করে তিস্তার মুখ থেকে শুনতে ভালোই লাগছে। তাই সে নিরব শ্রোতা হয়ে সবটা শুনলো। এবার সে প্রশ্ন করলো,
-‘তাহলে তিস্তা, নদীটি আবার মৃত হলো কীভাবে?’

তিস্তা একটু খুশি হলো। মাস্টারমশাই তার কাছ থেকে কিছু জানবে,শিখবে সেটা যেনো বিশ্বজয় করার আনন্দ দিলো তাকে। সে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
-‘এ নদীটা আবার মৃত বলে ঘোষনা দেয়া হয় প্রায় সতেরো বছর আগে। আমি জন্মানোর পাঁচ দিনের মাথায় নাকি নদীটা মারা যায়। এর চর জেগে উঠে। আমি যখন মায়ের পেটে আসি তখনই নাকি নদীটা তার স্রোত হারিয়ে ফেলে,গতি কমিয়ে দেয়। জানেন মাস্টারমশাই আমার কী মনে হয়?’

মাস্টারমশাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-‘কী মনে হয়?’
-‘আমি জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে নদীটা মারা গেছে। বোধহয় আমি মারা গেলে নদীটা আবার বেঁচে উঠবে।’

প্লাবনের পা টা আপনা-আপনি থেমে যায়। কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছুতেই ক্ষানিকটা নড়ে উঠে সে। ধমক দিতে গিয়েও নিজেতে ধাতস্থ করে বলে,
-‘তাহলে এক কাজ কর, তুই বরং তাড়াতাড়ি মরে যা। তুই বেঁচে থেকে তো কারো কোনো কাজে আসছিস না বরং মরে গিয়ে কাজে লাগবি। এই মৃত নদীটা জীবিত হয়ে গেলে এখানে মাছ চাষ করা যাবে। তারপর কত মানুষ সেই মাছ বিক্রি করে তাদের উদরপূর্তি করতে পারবে। কি বলিস?’

তিস্তা মাথা নত করে কেবল ঘাঁড় কাত করে। যার অর্থ ‘ঠিক আছে’। প্লাবন অবাক হয়। এত ভদ্র মেয়ে তো তিস্তা না।

এদিকে সপ্তদশী তিস্তা’র মনে অভিমানের পাহাড়টা আরেকটু বড় হয়। মাস্টারমশাই’কে সে ঐ কথা টা বলেছিলো যেনো মাস্টারমশাই তাকে ধমক দেয়, ধমক দিয়ে বলে এসব কথা বলবি না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মাস্টারমশাই কিনা তাকে মরে যেতে বললো! মাস্টারমশাই কী বুঝে না? তিস্তার ভীষণ আদুরে লাগে মাস্টারমশাই এর বকা। অভিমান অধিক হওয়ায় চোখের কোণে উঁকি দেয় অশ্রুকণা। সে তাড়াতাড়ি বইয়ের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে ছুট লাগায়।

তিস্তার এহেন কান্ডে প্লাবন বেশ অবাক হয়। পিছন থেকে কয়েকবার ডাক দেয়। কিন্তু কে শুনে কার ডাক। প্লাবনের মনে সামান্য বিষন্নতা কড়া নাড়ে। কিন্তু মেয়েটাকে তখন আহ্লাদ দেখালে সে এসব কথা আবারও বলতো। আর প্লাবনের দেহের মাঝে ছোট্ট হৃদপিণ্ডটায় রক্তক্ষরণ হতো।

____

তিস্তা আজ স্কুল না গিয়ে ফিরে এসেছে। তখন ছুট লাগিয়ে স্কুলে গেট অব্দি গিয়েও স্কুল যায় নি। অন্য রাস্তা দিয়ে বাড়ি চলে এসেছে। হুটহাট মন খারাপ হয় আজকাল। মা বলেছে এ বয়সে ঐ একটু আধটু হয়।

তিস্তা মন খারাপ করে উঠোনের এক কোণে বসে আছে। তার মা তনয়া চুলোয় ভাত বসিয়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে আসে। আদুরে কন্ঠে বলে,
-‘কী হলো আজ তিস্তামনির? সে আজ দৌড়ঝাঁপ করছে না যে? আজ যে তোমার আপাই আসবে সে খেয়াল আছে?’

-‘আমার হুটহাট মন খারাপ করে আম্মা। আমার ভালো লাগে না কিছু।’

-‘এ বয়সে তো মন খারাপ করবোই। বিয়ার বয়স পাড় হইয়া যাইতাছে, অথচ তোমার মা বাপে তোমারে বিয়া দিতাছে না। কত কইরা বুঝাইলাম তাও বুঝে না।’

তিস্তার দাদীর এহেন কথায় তিস্তা ড্যাবড্যাব করে তাকায়। তার বিয়ে করার জন্য মন খারাপ হচ্ছে! ছিঃ এ তাহলে কেমন মন খারাপ!

তনয়া বেশ বিরক্তের স্বরে বলে,
-‘আম্মা,এসব আপনার ছেলে শুনলে কিন্তু আবার রাগারাগি করবে। আপনি ওর সামনে এগুলো বলবেন না দয়া করে।’

বৃদ্ধা মহিলা এবার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে নাতনির কাছে এসে বলে,
-‘হ, এহন আমার কথা তো তোমরা কেউ শুনবা না। সংসারে এহন হইলাম গিয়া আমি পুরাতন ভাঙা থালার মতন, যা কাজে আসে না অথচ ফালাতে পারো না মায়ায়। তাও তোমারে বলি বউ, মাইয়া মানুষের শরীর বাড়ার সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টির লোভ বাড়ে। তাই কাল বিলম্ব না কইরা মাইয়া শ্বশুড়বাড়িতে পাঠাই দেওয়া উচিত।’

তনয়া ক্ষানিক বিরক্ত হয় শাশুড়ির কথায়। এসব কুসংস্কার এখনো তার শাশুড়ি ধরে রেখেছে। মেয়েটার মাথায় এসব ঢুকলে আর পড়াশোনা করবে! এমনেতেই তো প্রচুর দুষ্টু।

তিস্তা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
-‘আম্মা, তোমার শাশুড়ির বিয়ে করার শখ জেগেছে। সেটা তো বলতে পারছে না তাই আমার নামে চালাচ্ছে। কি যুবতী? তাই না?’

তনয়া মেয়ের এমন বেসরম কথায় হেসে উঠে। বৃদ্ধ লতিকা ফোঁকলা দাঁতে একটু হেসে,লজ্জা রাঙা কণ্ঠে একটু শাসনের সুর ঢেলে বললো,
-‘দিনে দিনে গতর বাড়ে আর ইতরামি বাড়ে মাইয়ার।’

তিস্তা দাদীর গাল টেনে দেয়। ফিঁক করে হেসে উঠে তিনজনে। দাদী’কে সে বেশিরভাগ সময় যুবতী ডাকে। কারণ দাদী পছন্দ করে না তাকে কেউ বৃদ্ধ ভাবুক। তিস্তার ডাকে দাদী বেশ আনন্দিত হয়।

______

আজ দুপুর তিনটে বাজার আগেই তিস্তা হাজির পাঠশালায়। পড়নে তার নতুন লাল টুকটুকে গোল ফ্রকটা। তিস্তা’র বয়স সতেরো হলেও দেখতে বেশ বাচ্চাদের মতন ছোট।

প্লাবন সবে স্নান করে এসেছে। খেতে যাওয়ার জন্য রান্নাঘরে যেতেই তার টিনের চালের পড়ার ঘরটি চোখে পড়লো। লাল টুকটুকে ফ্রক পড়া এক কিশোরী মাথা নিচু করে বসে রইল। প্লাবন ক্ষানিকটা অবাক হলো। তিস্তা তো এত তাড়াতাড়ি পড়তে আসার মেয়ে না। প্লাবন নিজের খাবারের কথা ভুলে দ্রুত পায়ে পাঠশালার রুমটিতে চলে যায়। তিস্তার কাছাকাছি আসতে কান্নার শব্দে ভেসে এলো। প্লাবনের বুকটা ক্ষানিক মোচড় দিয়ে উঠলো।

সকালে মেয়েটা রাগ করে আর স্কুলও যায় নি। এখন এখানে কান্না করছে কেনো?সকালের রাগের জন্য কান্না করছে?

ক্ষানিকটা ইতস্ততা নিয়ে প্লাবন ভরাট তবে শান্ত কণ্ঠে ডাক দিলো,
-‘তিস্তা?’

তিস্তার কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। বরং সে কান্নার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। প্লাবন আবারও ডাক দিলো আদুরে কন্ঠে,
-‘তিস্তা,কী হলো তোর?’

তিস্তার তবুও নড়চড় নেই। প্লাবন এবার ইতস্ততা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তার ডান হাতটা তিস্তার বাহুতে রাখতেই তিস্তা ভয় পেয়ে ছিটকে দূরে সরে গেলো। ভীত কণ্ঠে বললো,
-‘আমি আর এ জামা পড়বো না। আমি আর ছুটোছুটি করবো না। আমি আর ওর সামনে যাবো না। নোংরা মানুষ। সবাই নোংরা।’

তিস্তার আচমকা বলা কথা গুলো প্লাবনের মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতে একটু সময় লাগে। কিন্তু বোধগম্য হতেই শরীরটা একটু কেঁপে উঠে। অনাকাঙ্খিত ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তিস্তা এসব কথা বলছে কেনো!

প্লাবন ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলে,
-‘কী হয়েছে তিস্তা? কে কী বলেছে তোকে? আমায় বল। কী হয়েছে?’

তিস্তার ততক্ষণে হেঁচকি উঠে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। সে মাস্টারমশাই এর দিকে তাকায়। চোখ গুলো লাল হয়ে ফুলে গেছে। মাস্টারমশাই’কে দেখে ভিতরের সব কান্না বের হয়ে আসে। অভিযোগের স্বরে বলে,
-‘সবাই খারাপ মাস্টারমশাই। অনেক খারাপ। জানেন আমার গাল, পেট, ঘাড় ধরেছে ও বাজে ভাবে। খুব খারাপ ওর হাত।’

প্লাবন আৎকে উঠে। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
-‘কে? কে ধরেছে তোর গাল?’

তিস্তা ফুপিয়ে কেঁদে দেয়। অস্ফুটস্বরে বলে,
-‘দু-দুলাভাই।’

#চলবে

[যেহেতু উপন্যাস টা একুশ শতকের প্লটে না। কয়েক যুগ আগের প্রেক্ষাপটে সেই সূত্রে সামান্য কুসংস্কার আনা হবে। কেবল আগের যুগের মানুষের ধারণা তুলে ধরার জন্য। আর প্রতিটা কাহিনীর পিছে অবশ্যই রহস্য আছে। রহস্য ছাড়া অহেতুক কিছুই এখানে আসবে না। অতঃপর সবাইকে জানাই ভালোবাসা। ]

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই 💙
#মম_সাহা

পর্বঃ তিন

ফুলোফুলো চোখ দুটি কিছুক্ষণের বিবর্তনে উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ। প্লাবন দূর হতে উচ্ছ্বাসিত মুখ খানা দেখে তৃপ্তির হাসি হাসে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
-‘আর খাবি তেঁতুল আচার?’

তিস্তা শেষ পর্যায়ের আচার টুকু মুখে পুরে নেয়। অমৃতের ন্যায় অতিরিক্ত স্বাদে চোখ দু’খানা বন্ধ হয়ে আসে। তিস্তার এমন মুখ ভঙ্গি দেখে চাপা হাসে প্লাবন। আচারের প্রতি তারও ভীষণ লোভ হচ্ছে তিস্তার খাওয়ার অভিনয় দেখে।

তিস্তা মুখের আচার টুকু শেষ করে আঙ্গুল গুলো চাটতে চাটতে বললো,
-‘নাহ্ মাস্টারমশাই, আর খাবো না।’
-‘তবে কী আমি আচারের বয়াম রেখে আসবো?’

তিস্তা মাস্টারমশাই এর কথা শুনে তৎক্ষনাৎ আচারের বয়ামটা ছিনিয়ে নেয়। প্লাবনের কাছ থেকে একটু আড়াল করে বলে,
-‘নাহ্, এই আচার আমি বাড়ি নিয়ে যাবো। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু যদি পরে আবার খেতে ইচ্ছে করে তখন আমি কী করবো? তাই এটা আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। যেদিন আমার খাওয়ার ইচ্ছে শেষ হয়ে যাবে সেদিন দিয়ে যাবো।’

-‘তোর ইচ্ছে শেষ হওয়ার আগে না আবার আমার আচার শেষ হয়ে যায় দেখিস।’

মাস্টারমশাই এর এমন কথায় তিস্তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
-‘আপনি কী চাচ্ছেন আমি এখন রাগ করে আচার না নিয়ে চলে যাই?’

প্লাবন হতভম্ব হয়ে যায় এহেন প্রশ্নে। ক্ষাণিকটা হোঁচট খায় মনে মনে। ব্যতিব্যস্ত স্বরে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তিস্তা বয়ামটা নিজের ব্যাগে রাখতে রাখতে বলে,
-‘আপনি এমনটা চাইলেও কিছু করার নেই। কারণ, আচারটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আপনাকে এর জন্য আমি পড়া শিখে দিবো। কেমন?’

প্লাবন এবার শব্দ করে হেসে দেয়। মেয়েটা এত বাচ্চা বাচ্চা কথা কেনো বলে? একটু আগেও এই ছোট্ট মেয়ে টা কেমন যেনো বড় হয়ে গিয়েছিল, ভীষণ অচেনা এক নারীতে রূপান্তরিত হয়েছিলো। কতটা ধৈর্য সহকারে সামলাতে হলো তাকে!

প্লাবন তিস্তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললো,
-‘তোর আপা জানে, তাই না? তুই তোর আপাকেই প্রথম বলেছিলি খারাপ স্পর্শের ব্যাপার টা?’
-‘হুম। আমি সবার আগে আপারেই বলছি। দুলাভাই নষ্ট পুরুষ। আমি আপারে অনেক বলেছি কিন্তু, কিন্তু আপা আমাকে চর লাগিয়েছে মাস্টারমশাই। অনেক জোরে মেরেছে।’

শুকনো চোখ গুলো কথার পরিপ্রেক্ষিতে জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। প্লাবনের ভীষণ অবাক লাগলো তিস্তার আপার ব্যবহারে। সে অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘তোর আপা আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি তোকে? আর কিছু বলে নি?’
-‘হ্যাঁ বলেছে তো, আপা কান্নাও করেছে। আপা বলেছে এ কথা বাড়ির কাউকে না বলার জন্য। তাই তো আপনারে বললাম মাস্টারমশাই। আপনি আর কাউকে বলবেন না কেমন? আপা কষ্ট পাবে। আপা বলেছে, এ কথা আমি কাউকে বললে তার সংসার ভেঙে যাবে। তখন গলায় দঁড়ি দেওয়া ছাড়া নাকি উপায় থাকবে না৷ দুলাভাই রে সে অনেক ভালোবাসে।’

কথা শেষ করে মন খারাপের বিষন্নতায় ডুব দেয় তিস্তা। প্লাবন হতাশার শ্বাস ফেলে বললো,
-‘এটা ভালোবাসা না রে, যে ভালোবাসা অন্ধ বানিয়ে দেয়,হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সেটা ভালোবাসা না। তোর আপা’র সংসার করার লোভ তার স্বামী’কে আরও এক ধাপ এই নোংরামির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। বাঙালী নারী জাত ভাবে সংসার বিহীন তারা কিছু না, তাই হাজারো নোংরামি সহ্য করেও সংসার রাখার জন্য মরিয়া হয়ে যায়। আচ্ছা একটা কাজ করবি তিস্তা?’

তিস্তা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। বিষন্ন স্বরে বলে,
-‘কী কাজ মাস্টারমশাই?’
-‘তোকে তোর দুলাভাই সবার আড়ালে স্পর্শ করেছে তাই না?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘তাহলে তাকে শাস্তিটা সবার আড়ালে তুই ই দিবি। পারবি না?’

প্লাবনের কথা তিস্তার বোধগম্য হয় না। সে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-‘কি শাস্তি দিবো? আর দুলাইভাই আমার বড়।’

প্লাবন কিছুটা রেগে যায়। ভরাট কণ্ঠে বলে,
-‘বড় বলে তুই শাস্তি দিতে চাস না আর সে তোকে নোংরা চোখে দেখুক সেটা তোর ভালো লাগবে?’

তিস্তা ডানে বামে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ তার ভালো লাগবে না। প্লাবন এবার আশ্বাসের স্বরে বললো,
-‘তোর আপা’র অন্ধত্ব তুই ঘুচাবি। আর দুলাভাই এর নোংরামিও তুই দূর করবি। পারবি না?’

তিস্তা’র হঠাৎ কী জেনো হলো। চোখ দু খানা চকচক করে উঠলো। ভীষণ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললো,
-‘পারবো মাস্টারমশাই।’

মেয়ে মানুষকে সৃষ্টিকর্তা আলাদা শক্তি দিয়ে হয়তো বানায়। তারা যতটা অবুঝই হোক নিজের নিরাপত্তা বেশ ভালো ভাবে বুঝে। তিস্তাও সেই স্বত্তার বাহিরে না।

হঠাৎ উঠোন থেকে চওড়া কণ্ঠের ডাক ভেসে এলো,
-‘মাস্টারমশাই, বাড়িত আছেন নি? মোড়ল সাহেব আইছে আপনার সাথ দেখা করার জইন্ন।’

প্লাবনের কপাল কুঁচকে যায়। মোড়ল সাহেব তার সাথে দেখা করতে আসছে কেন? হঠাৎ?

তিস্তাও অবাক দৃষ্টিতে মাস্টারমশাই এর দিকে তাকায়। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
-‘মোড়ল সাহেব আপনার সাথে দেখা করতে কেনো আসছে মাস্টারমশাই?’

প্লাবন মাথা নাড়িয়ে “জানিনা” বলে বড় টিনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্লাবনের মাও দুপুরে খেয়ে ভাত ঘুম দিয়ে ছিলো। কিন্তু মোড়লের নাম কানে যেতেই ভীষণ ঘুম যেনো কোথায় উবে গেলো। সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘর থেকে বাহিরে বেরিয়ে এলো।

তখন শরৎ এর নরম দুপুর। গ্রামে দুপুর বেলাটা থাকে বেশ নিস্তব্ধ। মোড়ল সাহেব’কে দেখে প্লাবন বেশ সম্মানের সাথে সালাম করে। বিনীত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
-‘আপনি এখানে যে? কোনো প্রয়োজন থাকলে আমাকে ডাকতে পারতেন।’

মোড়ল সাহেব তার সাথের চাকরটার কাছ থেকে হুঁকা পান করে। হুঁকার ধুয়ো আকাশে উড়িয়ে দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে,
-‘এই গেরামে তো অনেক মাস্টারই আছে। কিন্তু আমার মাইয়া কঙ্কণা’র তোমারেই লাগবো পড়ার জন্য। তুমি সময় কইরা গিয়া পড়াইয়ো। টাকা পয়সার ব্যাপার নিয়া ভাবতে হইবো না।’

প্লাবন তার মাধুর্যতা ময় কণ্ঠে আরও বিনীত ভাব ঢেলে বলে,
-‘শিক্ষকদের পড়ানোর বিনিময়ে যেটা দেওয়া হয় সেটাকে সম্মানী বলে, টাকা পয়সা না। আর আপনি তো জানেন দুপুরে আমার একটা শিক্ষার্থীদের দল আছে যাদের আমি পড়াই। সেটা ছুটি দিতে দিতে সন্ধ্যা নামে এরপর তো আর পড়ানো সম্ভব না। আপনি বরং কঙ্কণা’রে এসে পড়ে যেতে বইলেন।’

প্লাবনের কথা শুনে প্লাবনের মা হুঙ্কার দিয়ে বলে,
-‘কাকে কী বলছো,প্লাবন? মোড়াল সাহেব যেখানে এত বড় প্রস্তাব দিচ্ছে সেখানে তোমার না করা টা বেমানান।’
-‘এটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত বিষয় মা। আপনি কিছু বলবেন না আশা করি!’

প্লাবনের কথায় তার মা চুপ হয়ে গেলেও মোড়েলের সাথে থাকা তার চাকরটা চোখ রাঙিয়ে উঠে। ধমকের স্বরে বলে,
-‘আফনে ভূঁইয়া বাড়ির মাইয়ারে পড়াইতে পারবেন না? এত সাহস কই থেইকা আসে আপনার? গেরামে টিকতে পারবেন তো?’

মোড়ল সাহেব বিশাল এক ধমক দিলে লোকটাকে। শাসানোর ভঙ্গিতে বললেন,
-‘তোর এত সাহস কই থেইকা আসে? আমি তো কথা কইতাছি। মাস্টার গো লগে অভদ্রতা করবি না।’

মোড়লের ধমকে চাকরটা মাথা নত করে ফেললো। মোড়ল সাহেব নিজের বিদঘুটে আকৃতির হাসি দিয়ে সাধারণ কণ্ঠে বললো,
-‘আচ্ছা মাস্টার। তুমি যা কও তা’ই হইবো। তাহলে কঙ্কণা কাইল থেইকা তোমার এইখানে আইসাই পড়বো। ভালো থাইকো।’

প্লাবন ঘাঁড় নাড়িয়ে বললো,
-‘বসলেন না?’

-‘না মাস্টার। ম্যালা কাজ আছে। আজ তাহলে আসি?’

প্লাবন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। মোড়ল বের হতে নিয়েও একটু দাঁড়ালো। পড়ার ঘরটার দিকে তাকালো। ঘরের দরজা ঘেষে তখন তিস্তা দাড়ানো। মোড়ল তিস্তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে প্লাবনের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘এ তিস্তা নদী যে এখানে? কঙ্কণা এলে আবার দেখো নদীর জল বহুদূর না গড়ায়। একটা সাপ হলে আরেকটা নেউল।’

মোড়লের কথায় প্লাবন কিছুটা হেসে দেয়। হেসে চোখে ইশারা করে তেমন কিছু হবে না।

মোড়ল প্লাবনদের সদর দরজা পার হতেই তিস্তা দু’লাফে উঠোনে নেমে এলো। বিরক্ত মেশানো কণ্ঠে বললো,
-‘ঐ কঙ্কণা’রে পড়ানোর কী দরকার আপনার মাস্টারমশাই? ও খালি ঝগড়া করে। আমার একদম ভাল্লাগে না ওরে। টাকার গরমে যেনো ও শান্তি পায় না এমন ভাবখানা।’

প্লাবন তিস্তার কথায় কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্লাবনের মা মুখঝামটা দিয়ে বললো,
-‘হ্যাঁ, আমার ছেলের সুখ তো কারো সহ্য হয় না। স্বয়ং ওরই নিজের সুখ সহ্য হয় না। মোড়লের বাড়িতে গিয়া পড়াইলে কত টাকা পাইতো। নাহ্, হেয় তো আবার দরদী। এখন আবার এই উড়নচণ্ডী মেয়ে ঢং করতে আসছে। যা, বাড়িতে যা।’

প্লাবন অসহায় কণ্ঠে বললো,
-‘আহ্! মা! ওর সাথে কীভাবে কথা বলছো? যা তিস্তা পড়ার ঘরে যা।’

তিস্তা আর এক মুহূর্ত ব্যায় না করে ঘরে চলে গেলো। মাস্টারমশাই এর মা’টা কেমন যেনো। মহিলা বেশ পড়াশোনা জানলেও কেমন জেনো আচার আচরণ।

প্লাবন ছোট্ট শ্বাস ফেলে মা’কে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তার বাকি শিক্ষার্থী চলে আসলো। ব্যস্ত হয়ে গেলো সে দৈনন্দিন কাজে।

_______

বাড়ির উঠোনে হারিকেনের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। তিস্তা রান্নাঘরে মাঝ গুলো ভাজছে। মা পাশের বাড়িতে গিয়েছে, সে বাড়িতে ঝামেলা হচ্ছে বলে। যাওয়ার আগে তিস্তার ঘাঁড়ে মাছ ভাজার বিরাট দায়িত্ব দিয়ে গেছে।

বাড়িতে এখন সে, তার দাদী আর দুলাভাই আছে। আপাও মায়ের সাথে গিয়েছে।

তিস্তা গভীর মনযোগ তেলের ভিতর থাকা ফুটন্ত মাছ গুলো দেখছে। এটার মাঝেও ভীষণ আকর্ষণীয় কিছু খুঁজে পাচ্ছে বোধহয় সে। আসলে বয়ঃসন্ধির সময়টাই এমন। অসাধারণও বিরক্ত আসে আবার অতি সাধারণও আনন্দিত করে।

কিশোরী তিস্তা হঠাৎ অনুভব করলো তার পিঠে নোংরা হাতের ছোঁয়া। সে হাতটা জামার ভিতরে থাকা অতি গোপনীয় পিঠটা বাজে ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে।

তিস্তা চমকে পিছে তাকায়৷ বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
-‘দুলাভাই!’

পেটমোটা ভারী শরীর যুক্ত মোতালেব হালকা হাসে। হাতের ছোঁয়া আরও গভীর করে। যতটা গভীর করলে পিঠের অন্তর্বাসের কাপড়টা অব্দি ছোঁয়া যায়। বিশ্রী হেসে বলে,
-‘বেশ বড় হয়েছিস। এবার দুলাভাই এর খাতির যত্ন কর। চুড়ি,আলতা,আয়না কিনে দিবো।’

তিস্তা উঠতে নিলেও শক্ত হাতের চাপে উঠতে পারে না। দুলাভাই তবে মনুষ্যত্ব একবারে হারিয়ে ফেলেছে! তার দাম কী তিস্তাকে দিতে হবে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here