মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই,০৬,০৭

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই,০৬,০৭
#মম_সাহা

পর্বঃ ছয়

সেই বিকেল হতে নিশ্চুপ তিস্তাকে খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা পেরিয়েছে। মাস্টারমশাই’র বাড়িতে গিয়ে যখন খোঁজ করলো তিস্তা এসেছে কিনা তখন হতেই সবার ভিতর ভয় জেগে উঠলো। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আসে নি মেয়েটা গেলো কোথায়? এ পাড়া ওপাড়া খোঁজ চললো সারা বিকেল। মাস্টারমশাই ও খোঁজ শুরু করলো।

অবশেষে হঠাৎ বর্ষণে সিক্ত হওয়ার পর মাস্টারমশাই এর মনে পড়লো তিস্তার প্রিয় জায়গা খানার কথা। ছুটে গেলো মধুসখী’র পাড়ে। কতক্ষণ ঝোপঝাড় খুঁজে নিরাশ হলো সে। অতঃপর ঘাটের শেষ প্রান্তে চোখ গেলো তার। ঘাড় অব্দি চুল গুলো ভিজে লেপ্টে থাকা এক সিক্ত নারীর দিকে নজর গেলো প্লাবনের। এইতো, তার হারিয়ে যাওয়া শ্বাসের নতুন আশ্রয়। তার ভীত মনের আপনজন।

তিস্তা তখনও ঠাঁই ঘাটে বসে ছিলো। বৃষ্টিতে তার ভিজে নাজেহাল অবস্থা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছায় নি। তার মস্তিষ্কের সচল নিউরন গুলো বারবার এটাই জানান দিচ্ছে মধুসখী’র সজীবতা।

মাস্টারমশাই তিস্তাকে পেছন থেকে বার কয়েক ডাক দিলো। ঝড়ের দাপটে হয়তো ডাক গুলো তিস্তার কান অব্দি আসে নি। হঠাৎ নিজের হাতে টান পড়ায় ধ্যান ভাঙলো তার। কিছুটা বোধগম্য হওয়ার আগেই চড় পড়লো গালে। ছিটকে গেলো সে কিছুটা। বিষ্মিত দৃষ্টিকে সামনে তাকাতেই দেখে মাস্টারমশাই এর বিক্ষিপ্ত মুখখানা। চোখ জোড়া ভীষণ ক্ষুব্ধ। শরীরের সাথে মাস্টারমশাই এর পাঞ্জাবিটা এঁটে সেঁটে আছে। কয়েক সেকেন্ডে মাস্টারমশাই’কে বেশ পর্যবেক্ষণ করা হয়ে গেলো তার।

হঠাৎ কানে ভেসে এলো অগ্নিবর্ষণ করার মতন কথা। মাস্টারমশাই চেঁচিয়ে বলছেন,
-‘এত রাতে এখানে বসে আছিস, ভয় ডর আছে তোর? কাল এত বড় একটা ঘটনায় যেখানে পুরো গ্রাম ভীত সেখানে তুই এত রাতে এই নদীর পাড়ে বসে আছিস! মাথা কী কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তোর? মানলাম ভ্রমরীকে তুই ভালোবাসতিস, তাই বলে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভুলে যাবি?’

তিস্তার ততক্ষণে ধ্যান ফিরলো। চারপাশে তাকালো। আসলেই তো, এত রাত হয়ে গেছে! সে অবাক হয়। এত রাত অব্দি সে এখানে বসে ছিলো?

তিস্তার জবাব না পেয়ে মাস্টারমশাই আরেকটু রেগে যায়। হাত ধরে টান দেয় উপরে যাওয়ার জন্য। কিন্ত তিস্তা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে,
-‘মাস্টারমশাই, আমাদের সাথে খুব বড় কিছু হবে বোধহয়।’

মাস্টারমশাই এতক্ষণ পরে তিস্তার এমন রহস্যমাখা বাক্য শুনে হতভম্ব হয়। কী বললো তিস্তা! অনেক বড় কিছু হবে মানে? তিস্তা কী নিজের মাঝে নেই?

প্লাবনের উত্তপ্ত রাগ হঠাৎ ঝিমিয়ে আসে। নেতিয়ে যায় তার বিশাল তেজ। একটু কোমল হয়। নিজেদের মাঝে অধিক দূরত্বটা খানিক ঘুচান। একটু এগিয়ে এসে স্নেহভরা হাতটা তিস্তার মাথায় রেখে কোমল কণ্ঠে বললো,
-‘কী বলছিস তিস্তা? কী হবে? তোর কী ভ্রমরীর জন্য খারাপ লাগছে? তাই এমন করছিস? কী হয়েছে বল?’

তিস্তা এবার নিজের নিষ্প্রাণ দৃষ্টি জোড়া মাস্টারমশাইয়ের উপর নিবদ্ধ করে। বৃষ্টির মাঝেও তিস্তার চোখের কোণে থাকা অশ্রুর কণা গুলো বেশ বোঝা যাচ্ছে। প্লাবনের টর্চ লাইটের আলোয় তিস্তার চোখের কোণে অশ্রকণা গুলো চিকচিক করে উঠলো।

মানবী’র চোখের কোণে অপ্রত্যাশিত অশ্রু দেখে ভীত হলো প্রেমে লেপ্টে থাকা পুরুষ। আহ্লাদী স্বরে বললো,
-‘কাঁদছিস কেনো তিস্তা? কী হয়েছে? চড় দিয়েছি বলে কাঁদছিস? আচ্ছা আর মারবো না। তবুও কাঁদিস না।’

প্লাবনের কোমল কণ্ঠে আহ্লাদ পেয়ে যায় তিস্তার চোখের অশ্রুকণা গুলো। আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেগে তারা ঝরতে আরম্ভ করলো। তিস্তা ভীত হলো। তার হঠাৎ করে ভীষণ ভয় চেপে ধরলো। সে স্থান, কাল,পাত্র সব ভুলে গেলো এক নিমিষে। দ্রুত গিয়ে মাস্টারমশাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরলো। পৃথিবীর সব আকুতি ঢেলে দিলো তার কণ্ঠে। একটু আশার আলোর খোঁজে মাস্টারমশাইয়ের হাতখানা চেপে ধরে, আকুতি মাখানো কণ্ঠে বললো,
-‘আমাকে বাঁচান মাস্টারমশাই। আমি মরতে চাই না। আমাকে বাঁচান। মৃত্যু খুব কঠিন। আমি মরবো না।’

ভুল জায়গায় এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে একটু থমকে যায় প্লাবন। তিস্তা মৃত্যু’র কথা কেনো বলছে! মেয়েটা কী ধীর ধীরে উন্মাদ হচ্ছে? এহেন কথা কেনো বলছে মেয়েটা! অতিরিক্ত শোকে কী তার মস্তিষ্কের সচলতা হারিয়েছে?

প্লাবনকে চুপ থাকতে দেখে তিস্তার ভীত মনে আরও ভয় ঢুকে গেলো। তবে কী মাস্টারমশাই তাকে বাঁচাবে না? এই পৃথিবীতে হঠাৎ করেই বেঁচে থাকার ভীষণ ইচ্ছে জাগছে তিস্তার। ভ্রমরী’র করুণ মৃত্যু দেখেই হয়তো তার এমন মৃত্যুভীতির উদয়। সে ভীত কণ্ঠে আবার বললো,
-‘আমাকে বাঁচাবেন না মাস্টারমশাই? আমাকে বাঁচাতে পারবেন না আপনি? তবে কী আমিও মারা যাবো? জমিদারের বউ মধুসখী’র মতন অত ভালোবাসা না পেতেই আমি মারা যাবো?’

প্লাবন হতভম্ব। মেয়েটা কী বলছে আবোলতাবোল! সে তিস্তার বাহুতে ভরসার হাত রেখে বলে,
-‘তুই কেনো মরবি? মৃত্যু কী এত সোজা? এসব বলছিস কেনো!’
-‘কারণ মধুসখী জীবিত হওয়া শুরু করছে বোধহয়।’

বৃষ্টির দাপটে কথাটা ক্ষাণিক অস্পষ্ট হয়ে কানে যেতেই ভড়কে যায় প্লাবন। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
-‘কী!’

তিস্তা তার ডান হাতের তর্জনী আঙুল টা সামনের দিকে তাক করলো। অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
-‘মধুসখী আজ বৃষ্টির জল শুষে নিচ্ছে না। তার মানে সে জীবিত হতে চাচ্ছে। তার মানে আমাকে মরতে হবে মাস্টারমশাই! আমি জন্ম নিয়েছি আর মধুসখী মৃত ঘোষিত হয়। এখন মধুসখী জীবিত হচ্ছে, তবে কী আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এলো?’

প্লাবন তিস্তার কথার ভিত্তিতে সামনে তাকায়। টর্চের আলো মধুসখী’র উদ্দেশ্যে মারতেই পিলে চমকে উঠে তার। না চাইতেও দু পা পিছিয়ে যায়। মনে ভেসে উঠে কিছু যুক্তিহীন বিশ্বাস। মধুসখী’তে আজ খড়খড়ে মাটি নেই। ভিজে উঠেছে সে। এত বছর পর তার এহেন পরিবর্তন কেনো? তবে কী,,,

নাহ্, আর ভাবতে পারে না প্লাবন। নিজের অবস্থান ভুলে যায় সে। জড়িয়ে ধরে তিস্তাকে। ভীত কণ্ঠে বলে,
-‘এসব কী বলছিস তুই? কিছু হবে না তোর। কিসের সাথে কী মিলাচ্ছিস! দেখবি কাল রোদের আলো পড়তেই মধুসখী আবার খড়খড়ে হয়ে গিয়েছে। তুই চিন্তা করিস না।’

তিস্তা কী ভেবে যেনো ক্ষানিক হাসে। নিভু নিভু কণ্ঠে বলে,
-‘আমায় বাঁচাবেন তো মাস্টারমশাই? নাকি মধুসখী বেঁচে যাবে! গ্রামের জেলেদের ঘর কী তবে রমরমা হবে আবারও?’

প্লাবন আর কিছু বলার আগেই অনুভব করলো তিস্তার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। অনেক সময় একটানা বৃষ্টিতে ভিজার ফলে হয়তো এ দশা। প্লাবন আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে তিস্তাকে কোলে তুলে নিলো। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। তার মনে হচ্ছে মধুসখী পিছন থেকে তার পা টেনে ধরছে। সুন্দর মধুসখী হয়তো রাক্ষসী রূপ ধরে বলছে তিস্তাকে তার কাছে দিয়ে যেতে।

মাস্টারমশাইয়ের ভীত মন আরও ভীত হলো। সে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে পাড়ে উঠে গেলো। মধুসখী কেনো, কাউকেই সে দিবে না তিস্তাকে। তিস্তা কেবল তার।

____

তিস্তার নিস্তেজ শরীরটার দিকে তাকিয়ে বার বার ডুকরে কেঁদে উঠছে লতিকা বেগম। তিস্তার বাবাও মন খারাপ করে বসে আছে চারপায়া টাই। তিস্তার মা কেবল মেয়ের মাথার কিনারায় বসে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। প্লাবন দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।

এত রাতে গ্রামে ডাক্তার পাওয়া টা অসম্ভব হলেও এত রাতেও তিস্তা ডাক্তারের চিকিৎসা পাচ্ছে। তাও গ্রামের ডাক্তার না। শহুরে ডাক্তার। মোড়ল সাহেবের বড় ছেলে মাহিন। গত সপ্তাহে সে শহর থেকে এসেছে। শহরে সে ডাক্তারি পড়াশোনা করে। গ্রামের লোকে বলে, মোড়লের পুরো উল্টো তার ছেলে। যেমন ভদ্র, তেমন নম্র। অনেক মিশুকও। সে ডাক্তারি পড়াশোনা করছে বর্তমানে।

তিস্তার এমন অবস্থা দেখে দিক বেদিক ভুলে তিস্তার বাবা শেষমেশ মাহিনের কাছে যায়। এত ঝড়বৃষ্টিতে মোড়ল ছেলেকে আসতে দিতে না চাইলেও মাহিন বাবার কথা অমান্য করে ছুটে আসে।

নিজের কাছ থেকে কিছু ওষুধপত্র তনয়ার দিকে এগিয়ে দিলো মাহিন। বেশ নম্র কণ্ঠে বললো,
-‘চাচী,এই ওষুধ গুলো ওরে খাইয়ে দিবেন। রাতের মাঝে জ্বর নেমে যাবে আশারাখি।’

তনয়া বেগম দ্রত ওষুধ গুলো নিয়ে মাথা নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতার স্বরে বললেন,
-‘আপনি বড় উপকার করলেন।’

মাহিন ছোট্ট হাসি দিয়ে বললো,
-‘আমি আপনার ছোট। আপনি অন্তত আমাকে আপনি বলে লজ্জা দিবেন না। আপনার ছেলের মতনই আমি। আজ তাহলে আসি।’

তিস্তার বাবা আমান শেখ উঠে দাঁড়ালো। ইতস্ততা ভরা কণ্ঠে বললো,
-‘আপনার পারিশ্রমিক টা কত যদি বলতেন,

মাহিন উঠে দাঁড়ালো। বিনয়ী কণ্ঠে বললো,
-‘লজ্জা দিবেন না এসব বলে। আপনারা আমরা একই গ্রামের। আমাদের আবার কিসের পারিশ্রমিক? আপনাদের জন্যই ডাক্তারী পড়ছি। আপনাদের কাজে আসার জন্য ই তো এতসব। রাতে কোনো সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবেন। আজ আসি তাহলে।’

অতঃপর মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘আপনি তো গ্রামের সবার পছন্দের মাস্টারমশাই প্লাবন তাই না? আপনার অনেক প্রশংসা শুনি। আজ দেখেও নিলাম। একদিন দেখা করবো আপনার সাথে। ভালো থাকবেন।’

মাস্টারমশাই ও বিনয়ের সাথে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ আচ্ছা।

মাহিন নিজের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে গেলো। তার পিছে পিছে এগিয়ে দেওয়ার জন্য আমান শেখও গেলো। মাহিন বের হতেই লতিকা বেগম মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন,
-‘এতদিন শুইন্যা আইছি এ পোলা নাকি অনেক ভালা। আজ দেখলামও। মোড়লের মতন চা’মাড় বেডার এত ভালা পোলা! তারে উপরওয়ালা বাঁচায় রাখুক।’

তিস্তার মা তনয়া বেগমও তিস্তার মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কৃতজ্ঞতার হাসি দিলেন।

কিন্তু মাস্টারমশাই এর মনে চলছে ভিন্ন দ্বন্দ্ব। সে মাহিনের চোখে অন্য কিছু দেখেছে তিস্তার জন্য । মুগ্ধতা বলা যায় সেটাকে।

#চলবে

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা

পর্বঃ সাত

গ্রামে ভ্রমরী’র মৃত্যুর খবরের সাথে আলোড়ন জাগিয়েছে আরেকটা খবর, মৃত মধুসখীর খড়খড়ে ভাব উধাও হওয়ার খবর। এখনো পানি আসে নি তবে মৃত ভাবটা এখন নেই। আগের মতন অত খড়া নেই। নদীর বুক এখন কোমল হয়েছে। মাটি নরম।

জেলেদের মুখে অসাধারণ হাসি। নতুন সুখের দেখা মিলবে বলে। মধুসখী নদীটা বেশ লক্ষী নদী। এ বেঁচে উঠলে জেলেদের ঘরে পরিপূর্ণতা দিবে দু-হাত ভরে।

দীর্ঘ দু’দিনের অসুস্থতায় মিইয়ে গিয়েছে তিস্তা। আজ সকাল হতে হতেই স্নান করে রোদে এসে দাঁড়ালো তিস্তা। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। মুখে দু এক খানা কালো দাগের উপস্থিতি। শরীরটাও সামান্য শুকিয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ বাহিরের দূরের পথ থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে এলো। গ্রামে অত গাড়ি তো আসে না। কেবল পুলিশের গাড়ি আসে। তবে কী বড় অফিসাররা গ্রামে এলো? ভ্রমরীর সাথে হওয়া অন্যায় এর কোনো খোঁজ মিললো?

তিস্তা ভেজা চুলে গামছা জড়ানো অবস্থায়ই ছুটে গেলো। তনয়া বেগম তখন রান্নাঘরে কেবল ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে ছিলো। গরম ভাত খেয়ে আমান শেখ দোকানে যান। বাজারে তার বড় মুদির দোকান আছে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় তার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। তিস্তাও আজ স্কুলে যাবে। গরম ভাত পেটে থাকলে মাথা ঠান্ডা থাকবে। পেট শান্তি মানেই দুনিয়া শান্তি।

মেয়েকে হঠাৎ ছুটে যেতে দেখে তনয়া ডাক দিলো চওড়া কণ্ঠে। কে শুনে কার ডাক! তনয়ার ডাকে ঘর থেকে আমান শেখ বেরিয়ে আসলেন। ছোট্ট কণ্ঠে খানিকটা বিরক্ত ভাব মিশিয়ে বললেন,
-‘কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতন চেঁচাচ্ছো কেনো? বাড়ির বউয়ের গলা গঞ্জের হাট অব্দি পৌঁছুচ্ছে বোধহয়।’

তনয়া বেগম ক্ষ্যাপে গেলেন। অসন্তোষ জনক কণ্ঠে বললেন,
-‘আমি কী করবো? মেয়ে একটা তো হয়েছে উড়নচণ্ডী। এই জ্বরে গোসল দিলো। এখন আবার কই জেনো ভেজা চুলে ছুটে গেলো। কী করবো আমি এ মেয়ে নিয়ে। আগুনে ভাত চড়িয়েছি। আপনি একটু গিয়ে দেখুন না কোথায় গেলো। মাথা আবার ঘুরিয়ে টুরিয়ে পড়ে গেলে হবে আরেক কেলেঙ্কারি।’

আমান শেখের কপালের ভাজ গুলো আরেকটু গাঢ়ো হলো। বিরক্তিটা সরে গিয়ে ভাঁজ পড়লো চিন্তার। মেয়েটা এত অসুস্থতার মাঝে ছুটোছুটি করছে? এ মেয়েটাকে নিয়ে সে যত চিন্তা করে বড় মেয়েটাকে নিয়ে তার এক ভাগ চিন্তাও করতে হতো না।
-‘চিৎকার চেঁচামেচি না করে আগে ওটা বললেই তো পারতে। মেয়েটা যে কার মতন হলো!’

কথা শেষ করে আমান শেখ হন্তদন্ত হয়ে হয়ে মেয়ের পিছে পিছে গেলেন। তনয়া বেগম একটু মুচকি হাসি দিলেন। মেয়েটা তার বাবার প্রাণ যেনো। এই যে, মেয়ের কথা শুনতেই বিরক্ত উবে গিয়ে চিন্তা হানা দিয়েছে মুখে। মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী।

শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

তিস্তা নিজের বাড়ি ছেড়ে বেশখানিকটা এগিয়ে গেলো। পথিমধ্যে ভীষণ ভীড়। সেখানটাই পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার আশেপাশে কত গুলো ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তিস্তা এগিয়ে গেলো, মোড়ল সাহেবও এখানে আছে। নেপাল জেঠুকেও দেখা যাচ্ছে। মানুষটার শরীরে সাদা ধুতি আর একটা বেশ পুরোনো ফতুয়া। ফতুয়াটা’র রঙও সাদা কিন্তু পুরোনো হওয়ায় হলদেটে রঙ ধারণ করেছে। সাদা রংও কেমন ঘেটে যায় পুরোনো হলে! পুরোনো হলে সব কিছুই রঙ বদলায়। হোক জেঠুর ঢিলে ফতুয়া কিংবা রক্তমাংসের মানুষ।

পুলিশ অফিসারদের কাছাকাছি যেতেই ভুড়িওয়ালা অফিসারের কথা ভেসে এলো,
-‘আমরা তো আমাদের মতন খুঁজছি, কিন্তু কোনো কিছুই পাচ্ছি না। কাউকে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না।’

অফিসারের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মোড়লের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এলো,
-‘কিছুই পাচ্ছি না মানে কী? গেরাম থেইকা একটা মাইয়া এমন ভাবে মই’রা যাইবো আর আপনি পাচ্ছি না বইলা খালাস হইবেন তা তো হইতে পারে না। যত তাড়াতাড়ি পারেন হেই বেজন্মারে খুইজা বাইর করেন।’

অফিসার যেনো একটু ভড়কে গেলেন। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললেন,
-‘আমরা সব দেখছি। সবাই তো অনুসন্ধান করা শুরু করে দিয়েছে এখন দেখি কী করা যায়।’

নেপাল ঠাকুর এবার মুখ খুললেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন,
-‘আমার কন্যার আত্মার শান্তির জন্য হইলেও ঐ নরপশুরে ধইরেন সাহেব। আমার আর কোনো চাওয়া নেই। কন্যা আমার শান্তিতে পরলোকে থাকুক। এই পৃথিবী তো আর তাকে শান্তি দিলো না। মা’হারা অভাগিনী টা।’

কথা থামিয়ে’ই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো নেপাল ঠাকুর। তিস্তারও চোখে জলে টইটুম্বুর হলো। পুকুরে আর সাঁতার প্রতিযোগিতা দেওয়া হবে না, ইচ্ছে হলেই ডাই’নী বলা যাবে না। ইচ্ছে হলেও কাউকে জড়িয়ে বলা হবে না, তুই আমার প্রাণের সই। মাঝে মাঝে মানুষ এত অসহায় কেন হয়ে যায়?

মোড়লের স্বান্তনার কণ্ঠ ভেসে এলো,
-‘আর কাইন্দা কী হইবো নেপাল? একলা মাইয়াটারে বিয়া না দিয়া ঘরে রাইখা শকূণের খাবার বানাইছো। তবে ভ্রমরী আমাগো গ্রামের মাইয়া। ওর সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার হইবো। তুমি বাড়ি যাও।’

মোড়লের কথায় সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া নেপাল জেঠু ছোট্ট বাচ্চাদের মতন মাথা নাড়িয়ে দুর্বল পায়ে হাঁটা ধরে বা’দিকের মাটির সরু রাস্তাটায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় বাবা সে। সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখার মতন অসহায়ত্ব আর কিইবা হতে পারে?

তিস্তার ছোট্ট মনে আকাশ আধাঁর করা বিষন্নতা হানা দিলো। মৃত সইয়ের জন্য যতটা না কষ্ট হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে নেপাল জেঠুর জন্য। মানুষটার দিন দুনিয়ায় আপন বলতে আর যে কেউ রইল না।

তিস্তা মাটির পথটার দিকে ছুটে গেলো। নেপাল ঠাকুর একটু হকচকিয়ে গেলো বোধহয় তাকে দেখে। যখন ঠাওর করতে পারলো এটা তিস্তা তখন ছোট্ট শ্বাস ফেললো। বিষন্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘মা, তুই এইখানে যে?’

জেঠুর কথায় ঠেলে কান্না এলো তিস্তার। জেঠুর হাতটা আঁকড়ে ধরে কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘তোমার খুব কষ্ট লাগছে তাই না, জেঠু?

নেপাল ঠাকুর মৃত হৃদয়টা নিয়ে খানিকটা হাসে। তিস্তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
-‘কষ্ট হবে সেটাই তো স্বাভাবিক রে মা। আমার এত্ত ছোট মেয়েটা এমন অকালে চলে যাবে কে জানতো?’

তিস্তা জেঠুর চোখের কোণে অশ্রু টুকু মুছে দেয়। ছোট্ট তিস্তা বেশ ভরসাময় নারীর মতন বললো,
-‘কেঁদো না জেঠু। এই যে তোমার ভ্রমরী তিস্তার মাঝে আছে। যখন ইচ্ছে হবে ছুটে আসবে। দেখবে তিস্তার হাসিতে ভ্রমরীর খিলখিল হাসিখানা।’

মধ্যবয়স্ক নিঃস্ব মানুষটা কেঁদে দেয়। বাচ্চাদের মতন মাথা দুলাতে দুলাতে বলে,
-‘ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুক মা। ভ্রমরীর মতন আর কোনো ফুল জেনো ঝড়ে না যায়। আমি আসছি মা।’

তিস্তা আর কিছু বলার আগে পুরোহিত জেঠু ছুটে চলে গেলো। নিজের দুর্বলতা না দেখানোর অদম্য ইচ্ছেয় লোকচক্ষুর আড়াল হলো বোধহয়।

তিস্তা নিজের অশ্রু টুকু মুছে নিলো। ছোট্ট শ্বাস ফেললো। হঠাৎ পেছন থেকে ভরাট পুরুষালী কণ্ঠে চমকে উঠলো। পিছনে তাকিয়ে দেখে মোড়লের ডাক্তার ছেলে, মাহিন।

মাহিন হাসিমুখে এগিয়ে এলো। মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-‘তুমি তো তিস্তা তাই না? শরীর কেমন এখন?’

তিস্তা মুখ কুঁচকে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘ভালো।’
-‘শুধু ভালো? না, অনেক ভালো?’

মাহিনের এমন কথায় সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় তিস্তা। বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আমার জ্বর কমিয়েছেন বলে কী এত প্রশ্ন করা লাগবে? আমার উত্তর দিবো না। যান।’

মাহিন তিস্তার কথায় আরেকটু হেসে দেয়।হাসিমাখা কণ্ঠে বলে,
-‘না, আমি তো এমনেই জিজ্ঞেস করেছি। তা এখানে কেনো?’

-‘মন চেয়েছে তাই আসছি। আপনার সমস্যা?’

মাহিন তিস্তার উত্তর শুনে হা হয়ে গেলো। এত তেজ মেয়েটার!

তিস্তা বাড়ির পথে হাঁটা ধরে। পথের মাঝে তার বাবার সাথে দেখে হয়। আমান শেখ নিজের মেয়েকে দেখতেই এগিয়ে গেলেন। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
-‘কী রে মা, কোথায় গিয়েছিলি? তোর না শরীর অসুস্থ? চল বাড়ি চল।’

তিস্তা বাবার হাত ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাবা’রা বুঝি এত ভালো হয়? সব বাবাদের সন্তান যেনো বেঁচে থাকে। কারণ বাবাদের প্রাণ যে তাদের সন্তানের মাঝে।

____

ইচ্ছে না থাকা সত্বেও এক বান্ধবী’র বিয়েতে এসেছে তিস্তা। সব বন্ধু-বান্ধব তাকে জোর করে নিয়ে আসছে বললেই চলে। তিস্তার মন ভীষণ খারাপ। ভ্রমরীর চলে যাওয়ার পর আর কিছুতেই তার মন বসছে না। তার মাঝে গত দু’দিন যাবত মাস্টারমশাই গ্রামে নেই। স্কুলের কাজে সদরে গিয়েছে।

হঠাৎ তিস্তা অনুভব করলো তার পিছে কেউ দাঁড়িয়েছে। চমকে তাকাতে দেখলো মাস্টারমশাই এর হাসি হাসি মুখ। তিস্তাকে তাকাতে দেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,
-‘কিরে, তুই এসেছিস। ভালো হয়েছে ঘর থেকে বের হয়েছিস। সবার সাথে মিশলে ভালো লাগবে।’

কে শুনে কার কথা? দীর্ঘ দু’দিন মাস্টারমশাইকে না দেখার তৃষ্ণা মিটাতে ব্যস্ত তিস্তারানী। এই মানুষটাকে না দেখে মনের মাঝে মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে।

তিস্তাকে ড্যাবড্যাব তাকিয়ে থাকতে দেখে প্লাবন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-‘কিরে, জ্বর কমেছে?’

তিস্তার ধ্যান ভাঙলো। মাথা নিচু করে বললো,
-‘হ্যাঁ কমেছে। কখন এলেন?’
-‘এই তো একটু আগে। রিমুর বিয়েতে তো আগেই দাওয়াত দিয়েছিলো। তাই সোজা এখানে চলে আসলাম।’

তিস্তা আর কিছু বলে না। মনের মাঝে ভীষণ মন খারাপটা এখন আর নেই। কেনো!

তিস্তা আনমনেই রিমুর দিকে তাকায়। বধূ বেশে তার ছোট বান্ধবী কত বড় লাগছে। হঠাৎ একটা বিষয় নজর কাড়ে তিস্তার। রিমুর বর, রিমু ঘেমে গেছে বলে তার রুমালটা আড়ালে এগিয়ে দিলো। ভীষণ মিষ্টি একটা দৃশ্য।

হঠাৎ তিস্তা মাস্টারমশাই এর দিকে তাকিয়ে আনমনেই বললো,
-‘আমার না ভীষণ বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে মাস্টারমশাই।’

তিস্তার নিচু কণ্ঠের স্বচ্ছ কথায় হতভম্ব মাস্টারমশাই। এ মেয়ে কী বলছে। বিয়ে বিয়ে আবার পায় কীভাবে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here