মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই,০৪,০৫

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই,০৪,০৫
#মম_সাহা
পর্বঃ চার

“আপা কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলো কেনো,আম্মা?”

নিজের ছোট মেয়ের কথায় তনয়া বেগম ফিরে তাকালেন। তার হাতে ছাই লেগে আছে। গতকাল রাতের এঁটো থালাবাসন গুলো ধুচ্ছিলো সে। হাতের পাতিলটা নিচে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
-‘ভালো হয়েছে তুমি এসেছো এখানে। তা কাক ডাকা ভোরে উঠার মেয়ে তো তুমি না! কেনো উঠেছো!

-‘ঘুম ভেঙে গেলো আম্মা। বললা না তো, আপা চলে গেলো কেন?’

তনয়া বেগম বিরক্তিতে ক্ষাণিকটা ভ্রু কুঁচকে অধৈর্য মাখানো কণ্ঠে বললো,
-‘এখানে এসে একটু পানি তুলে দিয়ে যাও তো। হাঁড়িপাতিল গুলো ধুঁয়ে ফেলি। বাসি কাজ গুলো আগে শেষ করে নেই। আসো, আসো।’

মায়ের তাড়াহুড়ো মাখানো কণ্ঠে বুঝাই যাচ্ছে মায়ের প্রতিটা সেকেন্ডের মূল্য কতটা৷ আর তাছাড়া মা কিছু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তিস্তা আর কিছু না বলে মায়ের হাতে হাতে একটু সাহায্য করে দিলো। তনয়া হাঁড়ি পাতিলে পরিষ্কার পানি ঢেলে পরিষ্কার করতে করতে সেদিকে মনযোগ স্থাপন করে বললো,
-‘মেয়ে হয়েছো তুমি, সবার আগে নিজের নিরাপত্তার কথা তোমাকে ভাবতে হবে। আর তা তুমি ভেবেছো,কিন্তু যখন দেখবে তোমার একার পক্ষে নিজেকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হচ্ছে না তখন কাউকে জানাতে হবে। নিজের নিরাপদের জন্য মাঝে মাঝে অন্যের কথা ভুলতে হবে। যাই হোক, কাল মোতালেবের হাতে গরম তেল তুমি মেরেছিলে তাই না?’

মায়ের সবটা কথা এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিলো তিস্তা, কিন্তু শেষের প্রশ্নে তার হাতে থাকা থালের পাঁজা টা পরে গেলো ঝনঝন শব্দে। শরীরের মাঝে অস্থিরতা কাজ করলো। কাল রাতে আধাঁরিয়া প্রতিবাদের কথা তার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। যখন দুলাভাই তার বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছিলো সে তখন কড়াই থেকে অনেক খানি গরম তেল গোল চামচের মাধ্যমে নিয়ে দুলাভাই এর হাতে ছুঁড়ে ফেলে। দুলাভাই আৎকে উঠে। সামন্য চেঁচিয়েও উঠে। ততক্ষণে মা আর আপা বাড়িতে এসে পড়েছিলো। দুলাভাই এর অস্থিরতম চিৎকারে তারা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এসে দেখে দুলাভাই এর হাতের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। যখন সবাই জিজ্ঞেস করলো কীভাবে এমন হয়েছে তখন তিস্তা খুব চালাকি’র সাথে বলে ছিলো দুলাভাই মাছ ভাজতে এসেছিলো আর গরম কড়াইয়ের অনেকখানি তেল উল্টে পড়ে যায় তার উপর।

তিস্তা ভেবেছিলো,সে ঘটনা হয়তো আর কেউ জানবে না কিন্তু আম্মা কীভাবে জানলো?

তিস্তা’কে চুপ থাকতে দেখে তনয়া উঠে দাঁড়ালো, মেয়ের গালে শক্ত এক চড় বসালো। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
-‘তুমি কতটা বড় হয়েছো যে তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা আমাদের জানাতে পারো না? তোমার সাথে মোতালেব খারাপ আচরণ করে সেটা আগে বললে এত দূর ব্যাপার টা যেতো না। নোংরা আচরণ করার সাহস ওর হতো না। তোমারই বা কী দোষ! যেখানে তোমার বড় বোনই সংসার টিকিয়ে রাখার আশায় নিজের ছোট বোনের সাথে হওয়া অন্যায়’কে পশ্রয় দিয়েছে। এমন মেয়েও আমি পেটে ধরেছিলাম! ছিহ্।’

তিস্তার চড়ের ব্যাথায় চোখ টলমল করে উঠে। গালটা যেনো জ্বলে যায়। কিন্তু তার চেয়ে বেশি জ্বলে যায় হৃদয়টা। আম্মা তাকে ভুল বুঝে নি তাহলে!

তনয়া থালাবাসন গুলো একটা একটা করে মাটি থেকে তুলতে তুলতে বলে,
-‘আজ থেকে ফ্রক পড়া বন্ধ। আমি তো ভুলেই গেছিলাম, সব মানুষ এক হয় না৷ তোমার দৌড়ঝাঁপ কমাবে। মোতালেব কেবল একটা তো আর না, এ সমাজে অনেক গুলো আছে। যাও ঘরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে স্কুলের জন্য তৈরী হও। বড় হচ্ছো,শরীর বাড়ছে, বুদ্ধিটাও বাড়াও।’

তিস্তা মায়ের উপর অভিমান করে। ছুটে চলে যায় ঘরে। তনয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলে। বড় মেয়েটা এত স্বার্থপর ভাবতেই তার গা শিরশির করে উঠে। ভাগ্যিস গতকাল তার শাশুড়ি লতিকা বেগম রান্নাঘরের দৃশ্যটি দেখেছিলো। নাহয় তো এই মোতালেব আরও নোংরামি করতো তার ছোট মেয়েটার সাথে আর তারা জানতেও পারতো না। বড় মেয়েকে সে আড়ালে নিয়ে গিয়ে সব বলার পরে বড় মেয়ে নিজের বোনকে খারাপ বলে। তার বোন নাকি ফ্রক পড়ে ছেলেদের আকর্ষণ করছে। কতটা নিচু মনের হলে এসব বলেছে! তাই তো ঠাটিয়ে দু’খানা চড় দিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছে। সংসার যেহেতু তার এত প্রিয়, চরিত্রহীন সঙী নিয়েই যদি সংসার করার এত শখ তবে এ বাড়ির মুখো দর্শনও যেনো না করে।

______

তীর্যক রোদ খাড়াখাড়ি আকারে শরীরে পড়ছে। গরমে যেনো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। স্কুলে বড় মাঠ টার মাঝখানে তিস্তা তার বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করছে। শরীরটা তার আজ ভীষণ খারাপ লাগছে। ভেবেছে না খেয়ে আসার জন্য হয়তো এমন হচ্ছে।

গোল্লাছুট খেলায় মত্ত তিস্তা’কে ভরাট কণ্ঠে মাস্টারমশাই ডাক দিলো,
-‘তিস্তা, এখানে আয়।’

খেলায় মত্ত তিস্তা খেলাতে বিঘ্ন ঘটায় একটু বিরক্ত হলো। তবুও মাস্টারমশাই ডেকেছে বলে কথা। খেলা রেখে সে ছুটে আসলো। ঘর্মাক্ত লাল বর্ণা মুখ খানায় লেপ্টে থাকা ছোট্ট চুল গুলো কপাল থেকে সড়িয়ে হাঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠে বলে,
-‘কী মাস্টারমশাই?’

মাস্টারমশাই উত্তর দিলো না। বরং, তিস্তার বই বহন করা থলেটা তিস্তার দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,
-‘বাড়ি যা তাড়াতাড়ি। আর স্কুলে থাকার দরকার নেই, যা। পারলে স্কুলের পিছনের রাস্তা দিয়ে বাড়ি যাবি। বড় রাস্তায় উঠবি না কেমন?’

তিস্তা অবাক হয়। হতভম্ব কণ্ঠে বলে,
-‘মাত্র তো একটা বিষয় পড়াইলো মাস্টারমশাই। ছুটি হতে তো ম্যালা দেড়ি। এখন গেলে বড় মাস্টার বাবা’র কাছে বিচার পাঠাইবে।’

-‘তুই বড় হবি কবে? নিজের শরীরে প্রতি তো অন্তত একটু যত্নশীল হওয়া উচিত। যা বাড়ি যা।’

তিস্তা অবাক হলো। হঠাৎ তার মনে পড়লো তার শরীর অসুস্থ হওয়ার কারণটা। প্রতিমাসের রুটিনমাফিক অসুখটা আবার তাকে ধরেছে আর সে ভুলে গেলো? মাস্টারমশাই কীভাবে জানলো? তিস্তা ভীরু চোখে নিজের পড়নের কাপড় খানার দিকে তাকালো। লজ্জায় সে মিইয়ে গেলো। ব্যাগটা হাতে নিয়ে দৌড়ে ছুটে গেলো স্কুলের পিছন দিকটাতে। কোনো থামা থামি নেই। এ বিশ্রী লজ্জা ঢাকার জন্য প্রাণপনে তাকে ছুটতে হবে। যতদূর গেলে মাস্টারমশাইয়ের চোখে চোখ পড়বে না।

_____

দীর্ঘ দু’দিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে তিস্তা। দাদী তাকে এ দু’দিন বাড়ি থেতে বের হতে দেয় নি। বন বাদাড়ে ছুটে বেড়ালে নাকি ভূ*ত পে’ত্নী ধরবে সে ভয়ে। গ্রামের প্রচলিত কিছু যুক্তিহীন নিয়ম সবসময়ই প্রচলিত থাকে। আজ জোড় করে তিস্তা বের হয়েছে। স্কুলে নাকি পরীক্ষা শুরু হবে তাই মাস্টারমশাই এর কাছে পড়তে যেতে হবে। তাছাড়া বাকি সহপাঠীরা জানিয়েছে কঙ্কণা নাকি মাস্টারমশাই এর সাথে অনেক ভাব জমিয়েছে। সেই ভাবও তো দেখতে হবে।

পাঠশালায় বাকি সহপাঠীরা চলে এসেছে তিস্তার আগেই। পড়ানো প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছে,তন্মধ্যেই হাজির হয় তিস্তা। প্রতিদিন দেরি করে পড়তে আসাটা যেনো তার বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

প্লাবন তখন কালো বোর্ডটাতে গুটি গুটি অক্ষর লিখতে ব্যস্ত। দরজায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে দরজার পানে তাকাতেই দু’দিন পর কাঙ্খিত মুখখানা দেখতে পেলো। দু’দিন যাবত এ মুখখানা দেখার আশায় কতবার যে সে দরজার পানে তাকিয়েছিলো। আজ অবশেষে তার তাকানো টা বিফলে গেলো না।

তিস্তার আজ অন্যরকম রূপ। নীল রাঙা ঝলমলে থ্রি-পিস শরীরে জড়ানো। চুল গুলো ভিজে পিঠের সাথে লেপ্টানো। চোখের নিচে মোটা করে কাজল দেওয়া। গলায় কালো একটা তাবিজ বাধাঁ। ফ্রক পড়া ছোট্ট তিস্তা জেনো থ্রি-পিস পড়ে বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। নিজেকে সাজিয়েছেও ভীষণ সুন্দর করে। কে বলবে মেয়েটা ছোট!

তিস্তা প্লাবনের দিকে তাকিয়ে বিনীত কণ্ঠে বললো,
-‘আসবো মাস্টারমশাই?’

প্লাবন কিছু বলার আগেই কঙ্কণা খোঁচা মারা কণ্ঠে বললো,
-‘কিরে, তিস্তা? এত সাজুগুজু কেনো করেছিস? বিয়ে ঠিক হলো নাকি?’

তিস্তার এতক্ষণে কঙ্কণার দিকে দৃষ্টি গেলো। মেয়েটা কালো রঙের মখমল কাপড়ের জামা পড়ে এসেছে। বেশ সুন্দর লাগছে। দশজনের মাঝে দাড়ালে বেশ নজর কাড়বে তার রূপ নির্দ্বিধায়।

পরক্ষণেই কঙ্কণার বলা কথাটা মাথায় খেলে যেতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে সে। তেড়ে গিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই প্লাবন আটকে দেয় তাকে। রামধমক দিয়ে বলে,
-‘দু’দিন পর কী করতে এসেছিস এখানে? এমন পড়াশোনা করার চেয়ে না করা’ই ভালো। আর, মুখে এমন রঙচঙ মেখেছিস কেনো? বিয়ের বাতাস শরীরে লেগেছে নাকি?’

প্লাবনের ধমকে সশব্দে হেসে দেয় কঙ্কণা। তিস্তা হা হয়ে যায়। হঠাৎ ই তো তার সাজতে মন চাইলো। তাই বলে মাস্টারমশাই এসব বলবে? তাও কঙ্কণার সামনে?

ভীষণ অভিমান জাগে তিস্তার। দ্রুত সে বের হয়ে যায়। প্লাবন দু একবার পিছে ডাকলেও সে শুনে না। মন খারাপ হয় প্লাবনের। এভাবে না বললেও হয়তো পারতো। মেয়েটাকে দু’দিন পর দেখলো অথচ ভালো করে দেখতেও পেলো না।

ছোট্ট একটা আফসোসের শ্বাস ফেলে আবার নিজের পড়ানো তে মনযোগী হবে প্লাবন, এমন সময় তিস্তা আবার দরজার সামনে দাঁড়ায়। লাল টকটকে ফুলো গাল আর নাক টা প্রমাণ করে দিয়েছে মেয়েটা ভীষণ কেঁদেছে।

প্লাবন এবার দারুণ ভাবে অবাক হয়ে যায়। চোখের নিচে গাঢ়ো কাজল টা ধুঁয়ে এসেছে তিস্তা। এর কালো রঙটা খুব এলোমেলো হয়ে গেছে তবুও এঁটে বসে আছে চোখের কোণে। জামার সামনের অংশ কিছুটা ভিজে গিয়েছে। মেয়েটা তবে মুখ ধুয়ে এলো? এত রাগ!

প্লাবন ঘরে ঢুকার অনুমতি দিতেই তিস্তা গটগট পায়ে রুমে ঢুকলো। কঙ্কণা খোঁচা মারা কণ্ঠে বললো,
-‘আচ্ছা তিস্তা,পৃথিবীতে এত নাম থাকতেও তোর নাম তিস্তা কেনো রাখলো? তাও আবার আমাদের গ্রামের পাশের তিস্তা নদী থাকতেও তোকে আবার সেই নাম দেওয়ার কোনো দরকার ছিলো?’

প্লাবণ তিস্তার দিকে এক মুহূর্ত তাকালো, তিস্তার মুখ খোলার আগে সে’ই ধমকের স্বরে বললো,
-‘কঙ্কণা, উল্টোপাল্টা কথা বললে এখানে পড়তে আসার দরকার নাই। এটা তোমার এসব কথা বলার জায়গা না।’

কঙ্কণা চুপ হয়ে গেলো। তিস্তা নিজের জায়গায় বসতে যাবে এমন সময় বাহির থেকে হৈচৈ ভেসে এলো। প্লাবন ছুটে বের হয়ে আসলো। তার পিছে পিছে সব শিক্ষার্থী ছুটে আসলো। প্লাবন সদর দরজার কাছে দাঁড়াতেই দেখলো গ্রামের অনেক লোক বড় রাস্তার দিকে ছুটে যাচ্ছে। প্লাবণ গ্রামের এক মুরুব্বি’কে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘চাচা,কী হয়েছে?’

মুরব্বি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললো,
-‘তিস্তা নদীতে একটা মাইয়ার লাশ ভাইসা উঠছে। কী সুন্দর মাইয়া নাকি। সবাই তো তা-ই দেখতে যাইতাছে।’

প্লাবণ বিষ্মিত কণ্ঠে বলে ,
-‘মেয়ের লাশ!’

-‘হ মাস্টার, মাইয়ার লাশ। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখনও এমন লাশ ভাইসা উঠতো। আমরা সবাই ছড়া বাইন্ধা বলতাম,
”নদীর নাম তিস্তা,লাশ আসে ভাইস্যা।”

অনেক বছর পর সেই দিন দেখি আবার আইতাছে। তাইলে আর মাইয়ারা, ছোট বাচ্চা’রা নিরাপদ না।’

#চলবে

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা

পর্বঃ পাঁচ

চাপা উত্তেজনায় পুরো গ্রাম স্তব্ধ। উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে মাস্টারমশাই’র সকল শিক্ষার্থীর মাঝেও। সবচেয়ে উত্তেজিত হয়েছে তিস্তা। কার লাশ ভেসে এসেছে নদীতে, তা না দেখলে জেনো তার শান্তি হবে না। মাস্টারমশাই সবাই’কে ছুটি দিয়ে দেয়। কারণ, এত উৎকণ্ঠা নিয়ে ছেলেমেয়ের আর পড়াতে মন বসবে না। সবাই যখন বের হয়ে গেলো, মাস্টারমশাই তিস্তাকে ভরাট কণ্ঠে বললো,
-‘তুই কিন্তু ভুলেও নদীর পাড় যাবি না। তুই এখানেই থাকবি এখন। গত দু’দিন যাবত অনেক পড়া পড়িস নি, এখন সব পড়ে শেষ করবি।’

তিস্তার চকচকে উত্তেজনা আকাশ সমান হতাশায় রূপান্তরিত হলো। এক রাশ নতুন কিছু দেখার উদ্দীপনা মিইয়ে গেলো ভরাট কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়া শব্দ গুলোর কাছে। তার ভয়ঙ্কর রকমের রাগ হলো। পড়াশোনাটা সৃষ্টি কেনো হয়েছে? এমন ছোট্ট মনের ছোট্ট আশা গুলো খান খান করে দেওয়ার জন্য’ই বুঝি পড়াশোনার সৃষ্টি? পড়াশোনা ম’রে যেতে পারে না? ওর বাঁচার কোনো অধিকার নেই। এমন ডজন খানেক অভিশাপ দিয়ে তিস্তা পড়ার বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে গেলো।

তিস্তার উচ্ছ্বসিত মুখ ভঙ্গির সেকেন্ডের মাঝে বিরাট পরিবর্তে পেট ফেটে হাসি এলো প্লাবনের। এ মেয়ে’র যা আগ্রহ সব ব্যাপারে, এত সহজে লাশ না দেখে মিটবে না। একাই চলে যাবে সুযোগ পেলে। দীর্ঘক্ষণ নিজের মনের মাঝে আকাশ পাতাল ভেবে প্লাবন ঠিক করলো তিস্তার আগ্রহ শেষ করার উপায়।

তিস্তা ব্যাগ থেকে বই বের করতে যাবে তার আগেই প্লাবন এক রাশ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
-‘তুই সত্যিই নদীর পাড়ে যাবি না!’

-‘কীভাবে যাবো? আপনি ছুটি দিয়েছেন?’

-‘চল,আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনো কথা বলতে পারবি না। রাজি?’

তিস্তা’র মিইয়ে যাওয়া উৎসাহ দ্বিগুণ আকারে ধারণ করলো। উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে বললো,
-‘সত্যি!’
-‘হ্যাঁ সত্যি। এবার চল।’

তিস্তা দিক বেদিক ভুলে ছুটে এলো। বেশ মজা’র কিছু দেখবে ভেবে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
-‘চলেন, চলেন। ধন্যবাদ মাস্টারমশাই।’

প্লাবন কিছু না বলে ধীর গতিতে বের হয়ে আসলো। সে জানে, তিস্তা তার মনের উত্তেজনা না মিটিয়ে থাকতো না। এর চেয়ে সে সাথে থেকে মনের উৎকণ্ঠা নিভিয়ে দিবে।

______

ভিজে বালুর মাঝে সাদা রাঙা ঝলমলে জামা পড়া একটি মেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। হ্যাঁ, এ মেয়েটিই এখন লাশ বলে চারদিকে গন্য হচ্ছে।

তিস্তা মাস্টারমশাই এর আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ চাপা উত্তেজনা কাজ করলেও এখন ভয় করছে। কেমন বিধ্বস্ত দেহখানা। প্লাবন তিস্তার গুটিয়ে যাওয়া দেখে ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
-‘কিরে, ভয় পাচ্ছিস? এ জন্যই বলেছি আসার দরকার নেই। শুনলি না তখন আমার কথা।’

তিস্তা ভীত চোখে মাস্টারমশাই এর দিকে তাকায়। সত্যিই মাস্টারমশাই’র কথা শোনা উচিৎ ছিলো তার। এই যে, এখন কেমন পস্তাতে হচ্ছে কথা না শুনে। অনাকাঙ্খিত উত্তেজনা, ভয় তাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। নদীর বাতাসে আজ জেনো কেমন ধূসর গন্ধ। এটা কী লাশের গন্ধ? নাকি কোনো পঁচে যাওয়া মস্তিষ্কের নোংরামির গন্ধ?

মেলার মতন হৈ হৈ করে লোক এলো লাশ দেখতে। এ যেনো কারো মৃত দেহ না, অসাধারণ এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। নিজের চোখে দর্শন না করলে যেনো দুনিয়া টা মিথ্যে হয়ে যাবে, জন্ম বিফলে যাবে। ধাক্কাধাক্কি করে সবাই দাঁড়িয়েছে লাশ দেখার জন্য।

সদর থেকে পুলিশ আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো। ততক্ষণে ভীড় কমার বদলে দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। বাড়ি গিয়ে জমিয়ে নতুন গল্প করার লোভ ছাড়তে পারে নি পথিকরা, তাই তো আগ্রহ আর টানটান উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটাকে দেখার জন্য। কোন গ্রামের মেয়ে, কার মেয়ে এসব চেহারা না দেখলে কীভাবে বলবে!

তিস্তার ছোট্ট মনও সেই পথিকদের বাহিরে না। সেও অনেক ভয় পাওয়া সত্বেও দাঁড়িয়ে আছে। শেষমেশ কী হয় দেখার জন্য।

পুলিশ আসতেই সবাই সড়ে দাঁড়ায়। চাপা উত্তেজনায় থম মেরে আছে সবাই। পুলিশদের মাঝেই একজন কনস্টেবল এগিয়ে গেলো বড় অফিসারের আদেশে। সবার অপেক্ষা’র পালা শেষ করে থুবড়ে পড়ে থাকা লাশটা’কে সোজা করলো। চুলে ঢেকে যাওয়া চেহারাটা’কে সড়াতেই আৎকে উঠে সবাই। ভীড়ের মাঝে এক গগণ বিদারক চিৎকার ভেসে আসে। সাথে ঝমঝম করে স্রোত বয় বিষন্নতার আফসোসের। হাজারো চিৎকারের মাঝে একটা কথাই সবাই বলছে,
-‘আরে এটা তো গ্রামের পুরোহিতের মাইয়া ভ্রমরী।’

ততক্ষণে তিস্তা লাশটা’র পাশে এসে ধপ করে বসে পড়ে। হৃদয়বিদারক আর্তনাদ করে বলে,
-‘আমার ভ্রমর,ও ভ্রমরী তুই এখানে শুয়ে আসিস কেন? ভ্রমর, উঠনা সই। উঠ। তুই ঘুমিয়ে আছিস কেনো? উঠ তাড়াতাড়ি।’

প্লাবন যেনো নিজের বাক্ শক্তি হারিয়ে ফেললো। ভ্রমরীর লাশ দেখার জন্য চারপাশে এত রমরমা? এত উচ্ছ্বাস? তার পাঠশালার আরেকটা দুরন্ত ছাত্রী, এভাবে এখানে শুয়ে আছে!

পুলিশ কর্মকর্তার কিছু লোক এগিয়ে এলো। ভুড়িওয়ালা বড় কর্তা নাক মুখ কুঁচকে ধমক দিয়ে বললো,
-‘এই মেয়ে, উঠ এখান থেকে। লাশ’কে ছুঁয়েছিস কেনো? পরে তো তোর উপর দোষ পরবে। যা উঠ।’

তিস্তা যেনো আরো এঁটে বসলো ভ্রমরীর নিস্তব্ধ দেহখানার সাথে। দু’দিন সে ঘর থেকে বের হয় নি বলে মেয়েটা নিজে গিয়ে দেখা করে এসেছে। কাল দুপুরেও তো দেখা করে এসেছিলো। হ্যাঁ, এ জামাটাই তো শরীরে ছিলো। তবে কী মেয়েটা আর বাড়ি ফিরে নি?

উৎকণ্ঠায়,উত্তেজনায় ঠান্ডা হয়ে আসে তিস্তার শরীর। জড়ানো কণ্ঠে বান্ধবীর লাশ খানায় হাত বুলিয়ে বলে,
-‘দেখেছিস সই, সবাই তোর নাম ভুলে গেছে! কেমন লাশ লাশ করছে! এই শোনো তোমরা, ওর নাম ভ্রমরী। কেউ লাশ বলবে না। আমার সই ঘুমিয়ে আছে। উঠ না সই। উঠবি না?’

আর কণ্ঠনালি থেকে শব্দ নিসৃত করতে সক্ষম হয় নি তিস্তা। বর্ণহীন পানিতে টইটম্বুর হওয়া তিস্তা নদীর পাড়ে লুটিয়ে পড়ে রক্তমাংসের গড়া তিস্তার দেহখানা। সইয়ের নিস্তব্ধতা অসার করে দেয় মেয়েটার শরীর।

গ্রামে যেকোনো খবর ছড়ায় বাতাসেরও আগে। অপরিচিত লাশ গ্রামের পরিচিত,ছুটন্ত, দূরন্ত মেয়ে ভ্রমরীর এ যেনো কেউ ভাবতেই পারে নি। মানুষজন এবার আরও দ্বিগুণ হলো। সাদা ধূতি পড়া, কপালে চন্দন লেপ্টানো মধ্যবয়স্ক বিপত্নীক পুরোহিত নেপাল ঠাকুর হন্তদন্ত হয়ে দিশেহারার মতন ছুটে আসে।

ততক্ষণে প্লাবন আর কয়েকজন এগিয়ে আসে তিস্তার জ্ঞান ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টায়।

মধ্যবয়স্ক নেপাল আহাজারি করে উঠে। নিজের কপাল চাপড়িয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে দিয়ে বলে,
-‘ও ঠাকুর গো, আমার কপাল ক্যান পুড়ো তুমি বারবার? আমার ফুলের মতন কন্যা কেন আজ ধূলোয় লুটালো? কোন পশুর ক্ষুধার নিবৃত্তি হলো আমার কন্যা? হে ঈশ্বর, তুমি বুঝি মরারে আবার মাইরা গেলা? আমার মাইয়া ছাড়া আমার যে কেউ নাই। আমি কি নিয়ে থাকবো।’

ভীড়ের মাঝে থেকে দু’একজন এগিয়ে এলো। নেপাল’কে স্বান্তনা দিচ্ছে তার মেয়ের খুবলে খাওয়া লাশটার সামনে। দূর দূরান্ত হতে মানুষ এসেছে লাশ দেখার তীব্র আকাঙ্খায়। এমন পৈচাশিক আকাঙ্খাও থাকতে পারে, এদের না দেখলে বুঝা যেতো না।

সবার মুখে মুখে আফসোসের স্বর। মেয়ে টা অনেক ভালা ছিলো, কারো মুখে মুখে তর্ক করতো না। একটু দুষ্টামি করতো তিস্তার সাথ দেওয়ার জন্য কিন্তু কোনো বেয়াদবি করতো না। এমন আরও গুনগান শুরু হলো গ্রামের পর গ্রাম। সাথে আফসোস ছিলো সবার মুখে। মা মরা মেয়েটা এমন অকালে মরলো!

________

ভর সন্ধ্যা তখন। চারপাশ আধাঁর করা বিষন্ন সন্ধ্যা নেমেছে আজ। মধুসখী নদীর কিনারায় রাজকীয় ঘাটের নিচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে তিস্তা। চুল গুলো তার অদৃশ্য বাতাসে উড়ছে।

গতকাল সইয়ের লাশ দেখার পর যে জ্ঞান হারালো একবারে রাতে ফিরেছে। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে খাটে আবিষ্কার করলো সে। বাহির থেকে তখন ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। সাথে ভেসে আসছে আম্মা, বাবা আর দাদীর চাপা কথোপকথনের শব্দ।

তিস্তা কান খাড়া করলো। এত চাপা গলায় তো কথা বলার মানুষ তারা না। মা – বাবার কথা বাদ দিলেও দাদী! সে কথা বললে কম পক্ষে গঞ্জের দোকান অব্দি কথা যায় আর সে কিনা এত ধীরে কথা বলছে?

তিস্তা নিজের ঘরের টিনের দরজায় কান পাতলো। বাবা বলছেন,
-‘জানো,মেয়েটারে যখন দাহ করতে নিলো, শরীরের কী অবস্থা তার। কুকুরও বোধহয় এমন হিংস্র হয় না।’

বাবা’র কথার পরিপ্রেক্ষিতে মায়ের চাপা স্বর ভেসে এলো,
-‘আচ্ছা, কে করেছে এসব! মেয়েটা তো খারাপ ছিলো না। গতকাল দুপুরে আমাদের তিস্তার সাথে দেখা করতে এসেছিলো যে জামাটা পরে সেটাই তো শরীরে দেখলাম। তাহলে কী বাড়ি যায় নি মেয়েটা?’

-‘নাহ্। নেপাল ঠাকুরের কথায় যা বুঝলাম, সে গতকাল কুমতি গ্রামে গিয়েছিলো কী পূজার জন্য । বাড়িতে এসেছিল মধ্যরাতে। বাড়িতে মেয়েকে না দেখে ভেবেছিলো তার বড় ভাইয়ের বাড়িতে হয়তো মেয়েটা ঘুমাতে গেছে। প্রায় নাকি সে দেরিতে বাড়ি আসলে মেয়েটা নিজের জেঠুর বাড়ি ঘুমায়। কিন্তু কাল যে অদৃষ্ট নির্মম খেলা খেলবে কে জানতো। মেয়েটাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিলো। কী অ’মানুষ।’

-‘পুলিশ কী বললো গো?’
-‘ওসব পুলিশ টাকার নিচে থাকে। বলেছে তো অনুসন্ধান করবে উনারা কিন্তু হাবভাবে তা মনে হয় না।’

তারপর কিছুটা সময় চুপ রয় পাশের রুমের মানুষ গুলো। তিস্তার চোখ দিয়ে অঝরে বর্ষিত হয় অশ্রু। দাদী হুশিয়ারি কণ্ঠে বলে,
-‘দেখিস, তিস্তারেও এহন থেইকা সাবধানে রাখতে হইবো। ম্যালা বছর পর গ্রামে বোধহয় মানুষ খেকো রাক্ষস এসেছে। ওরে একলা ছাড়িস না।’

দাদী’র কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কথা আসে না। বাবা-মায়ের মনে ভয় হয়। রাক্ষসটা কে? সে কী মানুষ খেকো না মেয়ে খেকো? বাকি রাতটা পুরো গ্রামবাসীরই বোধহয় নির্ঘুম কাটে। নিষ্পাপের মৃত্যু কেইবা মানতে পারে!

ভাবনার মাঝে হঠাৎ তিস্তা অনুভব করলো সে ভিজে যাচ্ছে। শরীর বেয়ে পানি পড়ছে। চোখ মেলে দেখে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝপঝপ করে বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে চারপাশ। কিন্তু হঠাৎ তিস্তার চোখের সামনের দৃশ্যটি দেখে তিস্তার চোখ বড় হয়ে যায় বিষ্ময়ে।

এতদিন সব পানি শুষে নেওয়া মধুসখী পানি শুষছে না। বৃষ্টির পানি জমছে নদীখানায়। সাথে সজীব হয়ে উঠছে বোধহয় মধুসখী। এ কোন ভয়াবহ ইঙ্গিত!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here