ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্ব ১

#ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্ব ১
লেখা : মান্নাত মিম

দূর থেকে ট্রাক আসতে দেখে সে বাইকটা নিজের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু হায় বিধিবাম! ‘কপালের লিখন না যায় খণ্ডন।’ বাইকটা উলটে কয়েক দফা পল্টি খেয়ে ব্রিজের সাথে ধাক্কা লেগে পানিতে পড়ে যেতে লাগল। আর সে ডুবন্ত অবস্থায় কল্পনায় প্রিয়তমা ভালোবাসার স্ত্রী’র সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো চোখের সামনে দেখতে লাগল।
________

কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে একে-অপরকে ধরার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে। মেয়েটার পিছুপিছু ছেলেটা ছুটছে। নাহ, মেয়েটা বিচ্ছু অনেক তার আয়ত্তে আসতেই চাচ্ছে না। ছেলেটা হঠাৎ ধপ করে উপুড় হয়ে বালুতে পড়ে গেল। মেয়েটা পিছনে কারো ছুটে আসার আভাস না পেয়ে ঘুরে তাকালে তার প্রাণপ্রিয় স্বামী শাহেদকে দেখতে পায় গরম বালিতে শায়িত অবস্থায়। তাড়াতাড়ি আবার দৌড়ে শাহেদের কাছে যায় সে। শাহেদকে উপুড় অবস্থা থেকে সোজা করে নিজের কোলে তার মাথা রাখে। তার গালে আস্তে করে চাপড়ে ডাকতে লাগে। কিন্তু নাহ, কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না। একসময় চিৎকার করে কেঁদে সাহায্যের জন্য ডাকতে লাগলে হঠাৎই শাহেদ তার মুখ চেপে ধরে।

‘আরে কান্না করছ কেন? বেঁচে আছি মরে যাইনি তো, আজব! চিৎকার করে আরো মারতে চাও না-কি?’ –

শাহেদ তাকে ফিসফিস করে বলল কথাটা সাথে আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে একবার তাকিয়েও নিলো কেউ চিৎকারটা শোনে এসে পড়ল নাকি। কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকায় তখন চিৎকারের কারণে মানুষজন এগিয়ে তাদের সামনে আসতে দেখে শাহেদ তার প্রিয়তমা স্ত্রী’কে কোলে করে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে অদূরের এক বড়ো পাথরে বসায়।

‘লিলি কান্না থামাও বলছি।’

লিলি একবার শাহেদের দিকে তাকিয়ে দু’হাত দিয়ে তার বুকে কিল-ঘুষি দিতে লাগল। আর শাহেদ দু’হাতে লিলিকে আঁকড়ে ধরে তার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।

‘তুমি কীভাবে পারলে আমাকে এমন ভয় দেখাতে? তুমি আমার কথাটা একবারও ভাবলে না। জানো আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তখন?’

কান্না করতে করতে ভাঙা স্বরে বলে লিলি। আসলেই তখন তাকে একটু বেশিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল শাহেদ। মেয়েটা-ও সত্যি সত্যি ভীত হয়ে গেছে। উচিত ছিল তাড়াতাড়ি সাড়া দেওয়া। কিন্তু তাকে আরেকটু জ্বালাতে এমনটা হয়ে গেল। লিলির এমন বেশি ভালোবাসার জন্য তার বড্ড আফসোস হয়। মেয়েটা তাকে এতোই ভালোবাসে যে, তার সামান্য হাত কেটে যাওয়াতেও অস্থির হয়ে পড়ে। এ-ভালোবাসাই যেন না কোনদিন তাকে ডুবে মারে।

‘আচ্ছা স্যরি। কী করব বলো তো? তুমি নিজেকে আমার কাছে ধরা’ই দিচ্ছিলে না। তাই তো একটু ভয় দেখানোর অভিনয় করলাম।’

‘তাই বলে এভাবে। মনে হয়েছিল কেউ যেন আমার দম আঁটকে রেখেছে। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু যেন শত্রুরও না হয়।’

‘ইশ কতোটা ভালোবাসলে এমনটা বলা যায়! তোমার ভালোবাসা পেয়েই তো আমার জীবন ধন্য। বাবা-মা’হীন জীবনে তোমাকে পেয়ে ষোলোকলায় পরিপূর্ণ আমি।’

লিলির কান্না থেমে গেল শাহেদের কষ্টমাখা কথা আর মেদুর ছায়া মুখের দিকে তাকিয়ে। সে নিজের কান্না ভুলে শাহেদের অদৃষ্টে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়।

‘আরে আমি ঠিক আছি। কান্না করছি না। একটু শুধু মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তা তোমার কি আমাকে এখন ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে নাকি? বলো তাহলে, আমি কিন্তু সর্বদা রেডি এমন ভালোবাসায় ডুব দিতে।’

শাহেদের ভ্রু নাচিয়ে নির্লজ্জ কথায় লিলি লজ্জাবনত হয়ে গেল। ফোলা ফোলা গোল গাল লাল হয়ে গেছে লজ্জাতে। এমন সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে লিলির কটিদেশে থাকা শাহেদের হাত আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে লাগল। আর লিলির মুখের উপরে নিজের মুখ ঝুঁকাতে লাগল। সেটা দেখে লিলি তাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে থাকা সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর ফেলে দিলো।

‘আমার সাথে কোনো দুষ্টুমি চলবে না জনাব।’

অতঃপর বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আবার সেই দৌড়ে পগারপার।
_______

‘ভালোবাসার মধ্যসাগর-
ডুবে যাওয়া,
অতল গহীনে।
তুমি-আমি সন্দীপনে!’

লিলির কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে থাকা সামনের হাত দু’টো ঢিলে হয়ে গেল।

‘কতো সুন্দর কবিতাবৃত্তি করছিলাম। তোমার সেটা ভালো লাগল না। দিলে তো পেটটা ফুটো করে। এজন্যই বলে মানুষের ভালো করতে নেই।’

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কথাটা বলল শাহেদ। কক্সবাজারের সামনেরই এক হোটেলে উঠেছে তারা। সেখানের বুকিং করা রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’জনে।

‘তাই বুঝি তা কি সওয়াবের কাজ করলে শুনি তো ?’

দু’হাত ভাঁজ করে লিলি এক ভ্রু উঁচু করে বলল। শাহেদ এগিয়ে লিলির কটিদেশ চেপে নিজের অবস্থানে তাকে রেখে নিজের দু’হাত দেয়ালের উপর রাখল, লিলিকে বন্দিনী করে নিজের বাহুর মাঝে।

‘রোমান্টিক ওয়েদারের সৃষ্টি করলাম মাই লেডি।’

ফিসফিসিয়ে শাহেদের বলা কথায় শিহরণ বয়ে গেল তার। আবেশে চোখগুলোও যেন নিজ দায়ে বন্ধ হয়ে গেল। সেই সুযোগটা শাহেদ খুব ভালোভাবেই কাজে লাগাল। পাঁজাকোলে তাকে তুলে নিয়ে গেল রুমের ভিতরে।
_____

স্নিগ্ধ-সকালের মিষ্টতা বেশ তিক্ততার সাথে নির্দয়তা নিয়ে এলো। চোখের পাতা খোলায় নিজের সাথে হওয়া অশুভ অতীতের স্মৃতি রোমন্থন শেষ হলো।

‘আন্টি চলো না কেন?’

পাশে থাকা বোনের মেয়ে রিম্পি কথাটা বলল। লিলি যেন এক অন্য দুনিয়ার মধ্যে ছিল। সেখানে কেবল সুখেরই আনাগোনা বহমান ছিল। তা শুধু ছিল’তেই বিদ্যমান। বর্তমানে লাশ হয়ে জীবন-যাপন করা হচ্ছে। এখন আর চোখে জল আসে না, আবেগরা সব হৃদয় গভীরে রক্ত ঝরায়। কেউ-ই তা দেখার জন্য নেই। শুধু একা নিঃসঙ্গ রাত্রিহীনা।

টেম্পোর জন্য অপেক্ষাকৃত দু’জন মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মেজবাহ। সে-ও গিয়ে দাঁড়াল তাদের সাথে। সোনা ঝরা রোদের আলো থেকে বাঁচতে মেয়েটি নিজের চোখের ওপর হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে। সাদা সালোয়ার-কামিজ পরিধান মেয়েটির মুখ দেখার জন্য তার মনটা কেমন বিচলিত হচ্ছে! এমন সময় টেম্পো চলে আসায় তিনজনই সেটাতে উঠল। একে-অপরের মুখোমুখি হয়ে বসায় এবার মেয়েটির রূপের অপার সৌন্দর্য দেখার ভাগ্য হলো মেজবাহর। ফর্সা মুখের আদলে গড়া তীক্ষ্ণ নাক, হরিণী চোখ, ফোলা ফোলা গাল, কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট। আল্লাহ সৌন্দর্য দানে কোনো খামতি রাখেননি।

‘আন্টি দেখ আমাদের দিকে কেমন করে লোকটা তাকিয়ে আছে!’

রিম্পির কথায় অবনত চোখ তুলে তাকাল লিলি। আর সাথে সাথেই চোখাচোখি হল মেজবাহর সাথে। তাতেই তীব্র ব্যথা অনুভব করল মেজবাহ নিজ বক্ষস্থলে। মেয়েটির চোখে যেন সমুদ্রের আছড়ে পড়ার ঢেউ। ভাসিয়ে নেওয়ার আকুলতা সেখানে। কথাগুলো যেন মেজবাহর মনকুঠিরে জমা ছিল। মেয়েটিকে দেখে তারা সংগোপিত, লুকায়িত জমা অনুভূতিরা আজ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

‘না মামনি, এভাবে বলতে নেই। চোখ আছে তাকানোর জন্যই।’

রিম্পিকে বুঝিয়ে বলে আবার মেজবাহর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘কিছু মনে করবেন না। আসলে বাচ্চা মানুষ তো তাই এভাবে বলে ফেলেছে।’

লিলির কথা বলায় ঠোঁটের কম্পমান যেন মেজবাহর হৃদয়ে কম্পিত আলোড়নের সৃষ্টি করছে। সে কী না কী বলল কিছুই তার শ্রবণেদ্রিয় হয়নি। শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই মুখপানে তাকিয়ে রইল মেজবাহ। মেজবাহর কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পেয়ে লিলি একবার পাশ ফিরে রিম্পির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘মনে হয় লোকটা কানে শুনতে পায় না। বেঁচে গেলে তুমি, ভাগ্য ভালো তোমার পঁচা কথা শুনতে পায়নি। নাহলে কী যে হত আল্লাহ মালুম!’

লিলির এবারের বলা কথাগুলো শুনতে পায় মেজবাহ। সে শুনতে পায় না মনে করে লিলি স্পষ্টতই জোরে বলে কথাগুলো। যা তার কর্ণকুহরে যাওয়া মাত্র সম্মোহনের ধ্যান ভাঙে।

‘ও হ্যালো! কী বললেন আমাকে? আমি বয়রা, কানে শুনতে পাই না। সাহস তো কম নয় আমাকে নিয়ে মজা করছেন।’

বিস্ফোরিত দৃষ্টি নিয়ে চক্ষু যুগল যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। লোকটা সব শুনে ফেলল। এখন না জানি তাদের কি মনে করবে? ভেতরে ভেতরে ভয় পাওয়াটাকে মেজবাহর সামনে প্রকাশ করল না লিলি। বেশ দম নিয়ে বলল,

‘আপনার সত্যিই মনে হয় সমস্যা আছে। তখন তো বললাম সাড়া দিলেন না। পরের কথাটার জন্য অযথা ধমকাচ্ছেন। তবুও দুঃখিত কিছু মনে করবেন না দয়া করে।’

ঝাল-মিষ্টি মিশ্রিত মনে হলো মেজবাহর কাছে লিলির বলা প্রতিটি বাক্য। তার মন চাচ্ছে শুধু কান পেতে শুনতে সেই সুমধুর কণ্ঠস্বর বাণী। কিন্তু মেয়ে দেখি একটা বাড়তি কথা তো বলেই না ; পারলে কথা যেন আরো কম বলে বাক্যের শেষে দাঁড়ি লাগিয়ে সমাপ্তি টানে।

‘বাবু তোমার নাম কী?’

রিম্পি ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। এতটুকু পিচ্চির কাছে পাত্তা না পাওয়া অসম্মানজনক লাগতে পারে মেজবাহর সেটা ভেবেই লিলি রিম্পি’কে করা প্রশ্নের উত্তরে বলল,

‘ও’র নাম রিম্পিমনি।’

কথা শেষ হতে যাওয়ার আগেই মেজবাহ আবার প্রশ্ন করল,

‘আপনার নামটা কী জানতে পারি?’

অযথা অতিরঞ্জিত কথা বলা লিলির ভালো লাগে না। আগে পছন্দ ছিল, তা কেবল একজনের সাথেই। এখন সেটা প্রায় বিলুপ্ত, তাও অপরিচিতের সাথে তো ভুলেও নয়।

‘বললেন না যে আপনার নামটা কী?’

এবার লিলি তার ক্রুদ্ধ, রুষ্ট আর রাগান্বিত হওয়া আঁখিযুগল নিয়ে মেজবাহকে শাসানো গলায় বলল,

‘আমার সাথে অতিরিক্ত কথা বলতে আসবেন না।’

‘এটা অতিরিক্তের কী হল? মানুষ নাম তো জিজ্ঞেস করতেই পারে। সাধারণ বিষয়টাকে আপনি’ই অতিরিক্ত বানাচ্ছেন।’

নাহ উত্তর যেন না দেওয়া পর্যন্ত লোকটার থামতি নেই। তারচেয়ে উত্তর দেওয়াই শ্রেয়। অন্তত কথা বলা তো থামবে। মন’ই মনে ভেবে, ভাবনার অন্তরাল থেকে বেড়িয়ে লিলি নিজের নাম বলল মেজবাহকে। এখানেই যেন আশার আলোর সপ্তপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিলো মেজবাহর মনে। মেজবাহ-ও নিজের নাম বলে সাথে বাড়ি-ঘর কর্ম স্থানের নামও বলে দিচ্ছে তাকে।

‘আমার নাম মেজবাহ। এই তো মুন্সিগঞ্জের মধ্যে। ইলেক্ট্রিসিটি বিল দেওয়ার কাজে বহাল আপাতত। এমনিতে নিজের বাবা-মা বলতে কেউ-ই নেই। মা ছোট বেলায় মারা গিয়েছেন, আর বাবা দু’বছর হলো গত হয়েছেন। অবশ্য নিজস্ব বাড়িটুকু অন্তত আছে। সেটা শুধু বিশ্রামের জন্য নামে মাত্র। একাকী জীবনে বাইরে বাইরে কাটিয়েই সারা। এখন দেখি আশার আলো পেলাম সেই জীবনে সজীবতা আনার।’

বিরক্তি ছেয়ে গেছে লিলির মুখ-মণ্ডলে। তাকে কেন জানতে হবে তার পরিচয়? সে কি জানতে চেয়েছে এসব? তবুও ভদ্রতার খাতিরে তার মুখের ওপর বলল না কথাগুলো। মনে মনে হজম করল কথাগুলো। মেজবাহ মনে হয় তার মুখের অভিব্যক্তি ধরতে পেরেছে তাই প্রসঙ্গে পালটাতেতে বলল,

‘তা আপনার বাড়ি কোথায়? দেখলাম আমার সাথেই তো ব্রিজ থেকে টেম্পোতে উঠলেন।’

মেজবাহর করা প্রশ্নে লিলির মুখে মেদুর ছায়া নেমে আসলো। যে অতীত তখন এই ব্রিজ দেখে মনে হলো, সেটাই আবার মনের মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here