#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,পর্ব (৬)
#রোকসানা_রাহমান
রিপ্তির সামনেই কালো রঙে আবৃত থাকা শরীরটাকে অনাবৃত করে ফেললো অনুভব। নিজের কর্মঠ হাতদুটোর সাহায্যে একটানে খুলে ফেললো পান্জাবী! রিপ্তি হতবাক,নির্বোধ,কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কাঠ হয়ে রইলো। সামনের মানুষটি কি করতে চাচ্ছে তার মানে খুজছে। মানে খুজার সময়টুকুও যেন নিজের আয়ত্ব নেই। তার চোখদুটো অনুভবের দিকেই আটকে আছে। তার চালচলনের সাথে চোখের পাতারা খেলা করতে পারছেনা। তারা আজ খেলবেনা। দেখবে,নিরব হয়ে!
অনুভব পান্জাবীটা খুলে রিপ্তির শক্ত হয়ে থাকা শরীরের নরম কাধে রাখলো। তার চোখের দৃষ্টি কোনোদিকেই স্থির নেই। এদিক-ওদিক-সেদিক কোন দিকে আছে? কোন পথে কোন ইচ্ছেতে কোনদিকে ঘুরতে চাচ্ছে?? অনুভবের ঘামে ভেজা শরীরের দীপ্ত, রিপ্তির চোখে সইলোনা। সে অন্যদিকে তাকানোর চেষ্টায় আছে। কিন্তু মনোযোগ বারংবার ক্ষুন্ন হচ্ছে,নিজের কাধে পড়ে থাকা পান্জাবীর জন্য৷ মানুষটা তার থেকে দুকদম দুরে কিন্তু মনে হচ্ছে দুকদম তো দুর! দু আঙুলেরও দুরে নেই। ল্যাপ্টে আছে তারই দেহের মাঝে,শরীর সাজের সুতোর কোনায় কোনায়! এ কেমন টান? এ কেমন উত্তেজনা? এ কেমন আহ্বানে মরছে মন? পুড়ছে পুরো দেহনামক দুনিয়া???
অনুভব জামা ছেড়ে আধখোলা শরীর নিয়ে রিপ্তির দিকে তাকালো। তার সামনেই সে দাড়ানো। মুখোমুখি। শুধু চোখের দৃষ্টি অন্যপাতে। লাজুক মুখের বাকাদৃষ্টি অনুভবের ভালো লাগছে। বেশ ভালো! অনুভব ছোট্ট অনুভূতির ছোট্ট শিহরণ ছেড়ে, পড়নের লুঙ্গিটার চারপাশে তল্লাসী চাল্লাচ্ছে। কোমড়ের চারধারে কিছু না পেয়ে রিপ্তির কাধে পড়ে থাকা নিজের পান্জাবীটা হাতে নিলো। গভীর মনোঃসংযোগ আঁকছে কোনায় কোনায়। অনুভবের খোঁজখোঁজ খেলায় রিপ্তির বাকাদৃষ্টি সরলে রুপান্তরিত হলো। চোখে ফুটছে অবোধতা। মনে চলছে মনগড়া নানা প্রশ্ন। ছেলেটা এমন মরিয়া হয়ে কি খুজছে?? রিপ্তির প্রশ্ন উদয় হওয়ার সাথে সাথে অনুভবের ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি যোগ হলো। রিপ্তির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের রেখা দীর্ঘ করে, ওর হাত চেপে ধরেছে। দু-কদমের দুরত্ব এককদমে কমিয়ে এনে পেছন মুড়লো অনুভব। রিপ্তি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকিত। অনিচ্ছাতেই আশ্চর্যের ধ্বনি বেজে উঠলো,,
“” ব্লেড!””
রিপ্তির মনে আতঙ্ক বাসা বাধছে। জোরালো হলো অনুভবের দিকে তাকানোর পর। তার দিকে পিঠ রেখে মুখ ঘুরে আছে। সন্দিগ্বের পুরো চাহনিটাই পড়ছে অনুভবের পিঠে। শক্তপেশিতে সাজানো গৌরবর্ণের পিঠের কারুকায চাঁদের জোসনায় অপরিস্ফুট। মায়ারাতের মৃদু বাতাস চারিদিকে বিদ্যমান,তবুও ঘামের ঝরণা বয়ছে অনুভবের পিঠে। এঁকে-বেঁকে গড়িয়ে পড়া ঘামরাশির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারছেনা রিপ্তি। হাতের ব্লেডের দিকে দৃষ্টি ফেলছে অবিশ্বাসতায়।
“” আপনি কি মুদির কারবারী? জামাকাপড়ের মধ্যে দোকান খুলে বসে আছেন? নাকি নাপিত? লাফাতে লাফাতে সবার দাড়িগোঁফ কামাচ্ছেন!””
কিছুক্ষণ আগেও যে গলাটায় সেকেন্ডে সেকেন্ডে বর্জ্যপাত পড়ছিলো তা এখন শান্ত। কিন্তু অশান্ত হতে কতক্ষণ?? রিপ্তির সহজগলার প্রশ্নের অপরপাশ থেকে কোনো উত্তর আসেনি। অনুভব চুপ,নিরব,নিশ্চুপ। এ কেমন নিরবতা?? এই মানুষটার নিরবতা রিপ্তি সয়তে পারেনা৷ একদমই না। কিন্তু কেন?? কেন মন বারবার নির্লজ্জের মতো উনার উচ্ছাসে গলিয়ে পড়া কন্ঠবাক্য শুনতে চায়? এতো ব্যাকুলতা কেন কর্ণদ্বয়ের??
অনুভবের স্তব্ধতা রিপ্তির মনের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পুড়ে দিতে চায় হৃদপিন্ড! কিন্তু এমন ভয়াবহ কান্ড সে কিছুতেই হতে দিবেনা৷ রিপ্তির শরীর রি রি করে উঠলো। চোখের চারধার লাল আভার শিরারা জেগে উঠছে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে অনুভবের পেতে দেওয়া পিঠে ধারালো দৃষ্টি ছুড়লো।
“” ইচ্ছেতো করছে আপনার গৌরবর্ণটাকে টকটকে লাল বানিয়ে দিতে, যাতে জামানামক খোলস পড়া লাল ব্যাঙ নয়,ভেতর থেকে রক্তে রাঙানো লাল ব্যাঙে রুপান্তর হয়!””
নোনাপানির জলে রিপ্তির চোখ ছলছল। চোখের কোল টয়টুম্বর হয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই উল্টোপথে হাঁটা ধরলো।
~~~
মিন্মি শ্বশুড়মশাইকে কদমবুসি করে ভেজাচোখে বিদায় নিচ্ছিলো তার মাঝেই পরিবানু চেচিয়ে উঠলেন,,,
“” আল্লাহই কি সব আল্লাদ তোর শরীরে ঢাইললা দিছে?? যেমন ঢং শুরু করছস মনে অইতাছে হওউর বাড়ি যাইতাছস। ঐ ছ্যামড়ি আর কত ঢং করবি? রাইত শেষ কইরা দিবি? পরে মাইনশের কানাকানি হুনতাম?””
পরিবানুর ঝাঝ কন্ঠে মিন্মির উপর কোনো রকম প্রকট পড়ছেনা৷ সে ধীর পায়ে এসে নানিশ্বাশুড়িকে ঝাপটে ধরে কানে কানে বললো,,,
“” একদিনেই আমার সব ঢং বুঝে নিলে কিভাবে হবে? দুইদিন পর তো আবার আসবো,নানি। আমার ঢংয়ের রঙে তোমাকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিবে।””
পরিবানু মহাতাংকে চিৎকার করে উঠলো,,,
“” ছাড়,ছাড় কইতাছি। গোসল-আসল নাই,পাকপবিতরের বালাই নাই,আমারে ছুবিনা। আমি তাহাজ্জুত পরুম!””
মিন্মি নানিকে ছাড়ার বদলে আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরলো। চোখে,মুখে দুষ্টুমী ফুটছে। কন্ঠে আহ্লাদ এনে বললো,,
“” নানি গো,আমিতো তোমাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি তাই ঠিক করেছি,রাতে তোমার নাতি আমাকে জড়িয়ে ধরার পর দৌড়ে এসে তোমাকে জড়িয়ে দুটো চুমু খাব। তারপর সকালের গোসলটা….””
মিন্মি,নিজের দুরন্তপনার কথাগুলো শেষ করতে পারলোনা। তারআগেই রিপ্তি নানির পেছন এসে দাড়িয়েছে। চোখ শুকনো,কিন্তু পাতা ভেজা। চোখ ছেড়ে রিপ্তির হাতের দিকে চোখ পড়তেই মিন্মি ভীতকন্ঠে চিৎকার করে উঠলো,,
“” রিপ্তি!””
মিন্মির অকস্মাৎ চিৎকারে সকলের চোখ ওর দিকে। মিন্মি নানিকে ছেড়ে দ্রুতগতিতে রিপ্তির দিকে ছুটলো। ওর ডান হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে দ্রুততার সাথে বললো,,,
“” তোর হাতে কি হয়েছে?””
ভাবীর কথাতে যেন রিপ্তির ভ্রম কাটলো। নিজের হাতের দিকে নিজে তাকিয়ে ক্ষিণস্বরে বললো,,
“” রক্ত!””
~~~
“” মিন্মি এ সিটে তিনজন অনায়াসে বসা যায়,তবুও কেন এমন রূঢ় ব্যবহার করছো? বিয়ের পর প্রথম বউকে নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছি,আলাদা গেলে মানুষ কি বলবে? একটু তো বুঝ!””
“” যা খুশি বলুক তাতে আমার কি? আমার গায়ের মানুষের কথা আমি সহ্য করতে পারলে, তুমি পারবেনা? আর যেতে যেতেও প্রায় মাঝরাত হয়ে যাবে। ঐবেলা কে আসবে তোমাকে দেখতে? তোমার যদি এতো লজ্জা লাগে,ঘোমটা পড়ে থেকো। তবুও তুমি এ গাড়ীতে বসবে না। নাহলে কিন্তু আমি নেমে পড়বো!””
নতুন বউয়ের তেজ আর জিদের কাছে পরাস্ত হতেই হলো রাসেলকে। গাড়ীর দরজা লাগিয়ে শ্বশুড়ের সাথে বসতে পা বাড়িয়েছে।
ভাবী আর ভাইয়ার কথা কাটাকাটি সবটুকু রিপ্তির কানে না পৌছুলেও তার নিথর হয়ে থাকা শরীরটা জেগে উঠছে। চোখের পাতা মেলে ঝাপসা আলোকে পরিষ্কার করতে বার কয়েক দ্রুত পাতায় পাতায় বারি মেলে নিলো। মাথা তুলে সোজা হয়ে বুঝতে পারলো সে এতক্ষণ ভাবীর কাধে মাথা রেখে শুয়েছিলো। পাশফিরে তাকাতেই ইন্জীনের তীব্র শব্দ!
“” ভাবী,আমরা কোথায় যাচ্ছি?””
“” আমার বাপেরবাড়ী।””
রিপ্তির সন্দেহজনক গলা,,,
“” তোমার বাপেরবাড়ীতে আমি কেন যাচ্ছি? আর আমি গাড়ীতে কি করে এলাম? আমি তোমার কাধে কেন ঘুমাচ্ছিলাম??””
রিপ্তির পরপর প্রশ্নে মিন্মি চুপ। মমতাময়ী দৃষ্টি ননদের উপর। নতুন বিয়ে,নতুন পরিচয়,নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। তবে নতুনকে পুরাতন করার সময়টাকে বিলম্বে ফেলতে চায়না। স্বামীকে ইচ্ছে করেই অন্য গাড়ীতে পাঠিয়েছে। বিয়েরদিন থেকেই রিপ্তির উপর পুরোনজর তার। ওর ভেতরে কিছু তো একটা চলছে। হাতের মুষ্ঠিতে ব্লেড নিয়ে ঘুরছে,হাত কেটে রক্ত ঝরছে অথচ সে টেরই পেলোনা। যে মেয়ে রক্ত দেখলে জ্ঞান হারায় সে ইচ্ছে করে হাত কাটার সাহস কুড়োতে পারেনা। আর যদিও কুড়িয়ে নেয়,তাহলে সে ভয়ানক কিছুর সাথে লড়ছে। কিন্তু সেটা কি? তা জানতে হলে রিপ্তির সাথে আলাদা কথা বলা প্রয়োজন!
মায়ের কোলের ওমটুকু পাওয়ার সৌভাগ্যটাও হয়নি মেয়েটার। এ বাড়ীতে বউ হয়ে আসার প্রধান কারণই ছিলো রিপ্তি। মেয়ে দেখতে আসলে সাধারণত,পাত্র আর পাত্রী আলাদা করে কথা বলে। কিন্তু মিন্মির বেলা উল্টো হয়েছিলো। পাত্রের জায়গায় পাত্রের বাবা তার সাথে আলাদা হয়ে কথা বলতে চেয়েছিলো। রাসেল তার পরিচিত। কলেজের সহপাঠী ছিলো। তার সূত্রধরে এ পরিবারের অনেককিছুই তার জানা। তবে যা অজানা ছিলো তা সেদিন রাসেলের বাবার কাছ থেকেই জেনেছে। সেদিন উনার সাথে অনেক কথা হয়েছিলো,দীর্ঘসময় নিয়ে। সবগুলোই হৃদয়বিদারক! সব শেষে একটা কথাই উনি বলেছিলেন,,,
“” সম্পর্কে হয়তো তুমি ঐ বাড়িতে আমার ছেলের বউ হয়ে ঢুকবে,কিন্তু আমার মেয়েটা যেন ভাবী নয়,একজন মা পায়!””
রিপ্তি ভাবীর হাতধরে ঝাকি দিয়ে বললো,,,
“” ও ভাবী কোথায় হারিয়ে গেলে? কিছু বলছোনা কেন?””
মিন্মি ঠোঁটে এক চিলতে হাসি এনে বললো,,
“” আমার একদিনের মেয়েটাকে এক জায়গায় রেখে আমি অন্য জায়গায় কি করে যায় বল তো রিপু? এতোটা নির্দয় আমি নই।””
“” একদিনের মেয়ে মানে?””
“” কিছুনা। আমার বাড়ীতে যেতে তোমার কোনো সমস্যা?””
“” তা না,কিন্তু বাবা তো বাসায় একা!””
“” সেটা তো আমিও জানি,রিপু। এখন তো উনার এক মেয়ে নন। দু-দুটো মেয়ে।””
“” তাই বলে তুমি আমাকে ঘুম থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসবে?””
রিপ্তির ভুল ভাঙিয়ে দিতে গিয়েও মিন্মি থেমে গেলো। তাহলে কি ও সব ভুলে গিয়েছে? যা ভুলে গিয়েছে তা কি আবার স্বরণে নিয়ে আসবে নাকি বুঝে উঠতে পারছেনা মিন্মি। এ দিকে চিন্তার জালে সে খারাপভাবে জড়িয়ে পড়ছে। একদিনের মা হয়েই টেনশনে আমার প্রেসার লো থেকে হাই,হাই থেকে লোতে উঠানামা করছে! আজ বুঝতে পারছি,মায়েরা কেন রোগ ছাড়া রোগী হয়ে যায়। পৃথিবীতে সকল রোগের প্রধান উৎসই হয়তো প্রিয়মানুষের প্রতি ভালোবাসা!!
~~~
রিপ্তির সাথে ঘুমাবে বলে কঠিন প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলো মিন্মি। ভাইয়ের অসহায় মুখটাকে এড়াতে পারলোনা রিপ্তি। মিন্মি যদি রিপ্তির মায়ের রুপে স্নেহের আদর ঢালতে পারে, রিপ্তিও ভাইয়ের পাশে মারূপে দাড়াতে পারে। আর মা হয়ে ছেলের উপর বউয়ের এমন অবিচার মানতে সে নারাজ। তাই একপ্রকার জোরজবরদস্তিতেই ভাবীকে নিজের রুম থেকে বের করে দিলো। ভেতর দিক থেকে সিটকিনি লাগাতেই মিন্মি নরমসুরে বললো,,
“” আমি পাশের রুমেই আছি,রিপু। দরকারে ডাকিস!””
“” হুম! তুমি এখন যাওতো ভাবী আমার ঘুম পাচ্ছে!””
রিপ্তি রুমের লাইটটা নেভাতে গিয়েও নেভালো না। অন্ধকারকে যে, সে খুব একটা ভয় পায় তা নয়। কিন্তু অতো সাহসীও নয় যে নতুন জায়গায়, নতুন রুমে,নতুন অন্ধকারে,নতুন বিছানায় ঘুমাবে। যদিও সে একা নয়,মিন্মির ছোটবোন মিশি তার সাথেই শুয়েছে। বয়স কত আর হবে,এই বারো কি চৌদ্ধ!
রিপ্তি বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। মিশির উপর পাতলা চাদরটা মেলে দিয়ে নিজেও গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ করতেই অনুভবের সেই জোসনামাখায় ঘামরাশি ভেসে উঠলো। মুহুর্তেই রিপ্তির সবকিছু কেমন অগোছালো লাগতে শুরু করেছে। কেমন অনুভূতে ভুগছে বুঝতে পারছেনা। তবে খারাপ লাগছে প্রচন্ড খারাপ!
ভালোই হয়েছে ভাবীর সাথে এসেছি। ঐ লাল ব্যাঙের মুখ না দেখাটাই শ্রেয়। এমন শব্দহীন মুখোর মুখ এই রিপ্তি আর কখনো দেখবেনা। বাবাতো বলেছিলো বিয়ের কয়েকদিন থাকবে। বিয়ের ঝামেলা তো শেষ! এখন নিশ্চয় চলে যাবে। যাক,বাড়ী থেকে আপদ বিদেয় হলেই ভালো। এই আপদটা আসার পর থেকে আমার সব খারাপ হচ্ছে,আমার সব গোছানো জিনিস অগোছালো হয়ে যাচ্ছে,ভাবছি এক করছি আরেক। এই ভালো,এই খারাপ,এই শান্ত,এই রাগ,এই সুস্থ,এই অসুস্থ! উফ! এমন আধমরা হয়ে বাঁচার কোনো মানেই হয়না। অসভ্য একটা,ইতর,বদমাশ,বজ্জাত,পৃথিবীর যত খারাপ প্রাণী,কীটপতঙ্গ আছে সব উনি,বিরক্তকর মানুষ একটা!
রিপ্তি রাগ,অনুরাগ,ক্ষোভ,বিদ্বেষ,মান,অভিমান সবকিছু একসাথে মিশিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো। ঘুমডানা ঘুমরাজ্যের আকাশে মেলা শুরু করতেই রিপ্তির কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলো। বুকের উপর ভারী কিছুর ভার অনুভব করছে,শাপের মতো কিছু একটা তাকে পেচিয়ে ধরে আছে,কারো ভারীনিশ্বাসের শব্দে রিপ্তির বুকে হাসফাস শুরু হয়ে গিয়েছে। রিপ্তি চোখবন্ধ অবস্থায় চিৎকার করে উঠলো,,
“” লাল ব্যাঙ!””
পাশ থেকে মিশি লাফ দিয়ে উঠে রিপ্তিকে ঝাপটে ধরে ভীতস্বরে বললো,,
“” আপু,কোথায় ব্যাঙ? ও মা গো! আমাকে কামড়ে দিবে নাতো?””
রিপ্তি মিশিকে জড়িয়ে ধরেই শোয়া থেকে উঠে বসলো। চারপাশ চোখ বুলিয়ে নিজেই নিজের বোকামীতে হাসলো। ঘুমের ঘোরেও কিসব আজেবাজে চিন্তা আসছে। অনুভব নয়,মিশি তাকে জড়িয়ে ধরেছিলো।
রিপ্তি মিশিকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে আশ্বাসের সুরে বললো,,,
“” আমি স্বপ্নে ব্যাঙ দেখছিলাম। এখানে কিছু নেই। তুমি ঘুমাও। আমি আছি তো। কিছু হবেনা।””
রিপ্তির কথায় খুব একটা ভরসা পেলো না মিশি। নিজের আগে-পিছে সব জায়গায় চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো। রিপ্তিকে ছেড়ে নিজের বালিশে মাথা রাখলো। চাদর দিয়ে নিজের শরীরের আগাগোড়া মুড়িয়ে নিয়েছে।
“” পানি খাবো,তুমি কি আমাকে একটু বলবে রান্নাঘরটা কোনদিকে?””
মিশি সর্বাঙ্গ ঢাকা অবস্থায় বললো,,
“” রুম থেকে বেরিয়ে ডানদিকে যাবে। কিছুদুর গেলেই বসার ঘর। তার বা-পাশে!””
~~~
রিপ্তি,মিশির বলে দেওয়া নির্দেশের পথে চলছে। বসার রুম ছেড়ে রান্নাঘরে এগুচ্ছে। পুরোবাড়ী অন্ধকার! এতোরাতে লাইট জ্বালাতে মন বাধা দিচ্ছে। তাই অন্ধকারের মাঝেও আলোর দিশা খুজে নিয়ে হাঁটছে। কিচেনের দরজার সাথে ফ্রিজ। রিপ্তি আর ভেতরে না ঢুকে ফ্রিজে হাত দিলো। তেষ্টা তার গলা ছেড়ে বুকের দিকে বয়ছে। তাড়াহুড়োয় বোতল থেকে গলায় পানি ঢালছে। পানি পেটে পৌছুতে না পৌছুতেই কর্ণবিবরে ক্ষীণ সুর বাজছে,,,
দো দিল মিল রেহে হ্যা
মাগার চুপকে চুপকে!!
সাবকো হো রেহি হ্যা,
হা সাবকো হো রেহি হ্যা
খাবার চুপকে চুপকে!!
দো দিল মিল রেহে হ্যা
মাগার চুপকে চুপকে!!!
রিপ্তির হাত থেকে পানির বোতল পড়ে গিয়েছে। মনোঃকন্ঠে অস্পষ্টভাবে অনুভব নাম ভাসছে। এতোরাতে অনুভব এখানে কি করে আসবে? পাশের বাড়ী হলেও মানা যেতো। তা তো নয়। তাহলে? কিন্তু তার মস্তিষ্কও জোরালোভাবেই জানান দিচ্ছে এটা অনুভবের কন্ঠ! এমন ভাঙা গলায় লাল ব্যাঙ ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারেনা। মনের দোটানা,দ্বিধাবোধ পরিষ্কার করতে রিপ্তি গানের সুর অনুসরণ করে হাঁটা ধরেছে। এক অজানা ঘোরের মধ্যেই সে ছুটছে। ধীর কদম ধীর হতে ঘন হয়ে আসছে। একটা দরজার সামনে গিয়ে দাড়াতেই কাধে নরম হাতের ছোয়া! রিপ্তির উৎকন্ঠে কন্ঠ কেঁপে উঠছে। কাঁপা কন্ঠে অনুভব নামটা উচ্চারণ করার পূর্বেই,,
“” রিপ্তি আপু,তুমি আপু আর দুলাভাইয়ার রুমের সামনে কি করছো? আড়ি পাতছো? বিনা জিজ্ঞাসায় অন্যের রুমে আড়ি পাততে হয়না,তুমি জানোনা?””
রিপ্তির উতলা মন হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলো।
“” তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে, মিশি!””
“” হুম,তোমার দেরি হচ্ছে দেখে উঠে এলাম।””
মিশি কথা শেষ করতেই দুজনের সন্নিকটে থাকা দরজার আড়াল থেকে গানের সুর ভেসে এলো। রিপ্তি কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করলো,বন্ধুর কন্ঠ তো বন্ধুর মতোই হবে!
~~~
রিপ্তির ঘুম ভেঙেছে দশটার দিকে। বিছানা ছেড়েছে এগারটার দিকে। ঘুমের জন্য নয়,আলসেতেও নয়। এ বাড়ীর সকলে আত্মীয় হলেও সবাইতো প্রায় তার অপরিচিতের মতোই। কার কাছে যাবে,কোথায় গিয়ে ফ্রেশ হবে,কে খাবার দিবে? কার সাথে কথা বলবে? যদি বুঝে উঠতে না পারে? কেমন অসস্থি ঠেকবে। তার থেকে ভালো এখানেই অপেক্ষা করা। কেউ না কেউ তো এসে তাকে ডাকবে। তখনি না হয় উঠা যাবে। কিন্তু রিপ্তির জল্পনা-কল্পনার পরিপুর্ণ হওয়ার বিন্দুমাত্র আলোও দেখলোনা। এই রুম মুখো কেউ হয়নি। এমন কি ভাবীও না। ব্যাপার কি ঘটছে তা রিপ্তির বোধশক্তির বাইরে। এভাবে শুয়ে থাকাটাও ভালো দেখাচ্ছেনা। সামনাসামনি না হোক,মনে মনে কটু কথা তো বলবেই। তাই রিপ্তি বিছানা গুছিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়েছে। দশ মিনিটের মতো এদিক-ওদিক-সেদিক ঘুরেও রিপ্তি কাউকে পেলোনা৷ মিশিটাই বা কোথায় গেলো? রিপ্তির মুখ বিরক্তে ছেয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত নিয়ে আবার নিজের রুমে ফিরে এলো। বসা-শোয়া,এপাশ-ওপাশ করে গোছানো বিছানা অগোছালো হয়ে গেলো। তাও কারো হদিস নেই। রিপ্তি ধৈর্যের সীমা লঙ্ঘন করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই থেমে গেলো। ভাবীর রুমের দরজার কাছে এগুলো। ভেতর থেকে আটকানো কি? তাহলে কি ভাবী ঘুমাচ্ছে? কিন্তু এতোবেলা ঘুমাচ্ছে কেন? এদিকে ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে। রিপ্তি ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবেনা ভাবনায় আটকে গেলো। পরিশেষে দরজায় কড়া নেড়ে ডাক দিলো,,,
“” ভাবী, ও ভাবী,তুমি কি এখনো ঘুমাচ্ছো? কয়টা বাজে জানো? একটু পর যোহরের আযান পড়বে!””
ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে রিপ্তি আরো কয়েক ঘা দরজায় ফেলতেই ভেতর থেকে ভারী কন্ঠ,,,
♪♪কে যেন ডাকে
আমারে ডাকে
লুকিয়ে আড়ালে
জড়াবো তাকে
সমুখে পেলে
শাড়ীরই আঁচলে
ঘরে তে মন টেকে না
একেলা রইতে পারিনা
না না না এ ব্যথা সইতে পারিনা!!(মুভিসং)
রিপ্তি বেশ জোর প্রয়োগে দরজা খুলে ফেললো। বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে লাল চাদরে মোড়ানো,আধশোয়া অনুভবের দিকে!
চলবে