ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,০৪,০৫

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,০৪,০৫
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪)

রিপ্তি আর তৃণা এদিকওদিক ঘুরেফিরে কোথাও জুতো পেলোনা। দুজনেই হতাশভঙ্গিকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখনি অনুভব পাশ থেকে গান ধরলো,,

বিয়েবাড়ীর ভীরে,,
সুন্দরীর জুতো গেল হারিয়ে
সই দেখনা খুজে দেখনা
জুতোর গজালো কি পাখনা

অনুভবের গানের সুরের সাথে নিজের বা’চোখটা টিপে দিলো। চোখে,ঠোঁটে দুষ্টুর ছায়া নিয়ে রিপ্তির দিকে এগিয়ে আসছে। রিপ্তি এককদম পিছিয়ে যেতেই মাটিতে কিছু পড়ার শব্দ। রিপ্তি আর তৃণা অনুভবের জুতো পড়ার দিকে চেয়ে আছে। তারমাঝেই তৃণার মিহির চিৎকার,,

“” এগুলো তো রাসেল ভাইয়ার জুতো!””

অনুভব গান থামিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো। দুজনের মুখের অবস্থা দেখার মতো হয়ে আছে। তাই অনুভবও হাসির ফাঁকে ফাঁকে ওদের দেখছে।

~~~

“” বেশ হয়েছে,ছোটবেলা পড়িসনি? অন্যের জন্য গর্ত খুড়লে নিজেরই পড়তে হয়??””

তৃণার কথায় রিপ্তি তেলে-বেগুনে জ্বলসে যাচ্ছে। কড়া চোখে তৃণার দিকে তাকালো। তৃণা রিপ্তির চাহনিকে অগ্রাহ্য করেই বললো,,

“” কি প্রয়োজন ছিলো অমন সুন্দরমতন মানুষতার জুতো চুরি করার? এখন হলো তো? নে,এবার খালি পায়ে হাঁট!””

রিপ্তি বসা থেকে উঠে দাড়ালো,মুখে কাঠিন্যভাব এনে বললো,,

“” ঐ লাল ব্যাঙটাকে তোর সুন্দর লাগলো?””
“” ব্যাঙ? কোথায় ব্যাঙ?””
“” যার প্রশংসায় তুই পঞ্চমুখী সেই ব্যাঙ! শুধু ব্যাঙ নয়,লাল ব্যাঙ,ভাঙা গলার লাল ব্যাঙ!!””
“” ভাঙা গলা? কোথায় ভাঙা গলা? ইশ! কি সুন্দর করে গান গাইলো।””

তৃণার মুখের অভিব্যক্তিভাবে রিপ্তির শরীর পুড়ছে। ইচ্ছে করছে ওর লজ্জিত গালদুটোতে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে বসতে। অমন বান্দরমুখো ছেলে নাকি সুন্দর,আহা চেহারার কি ছিরি,ছেড়া কন্ঠ,ছেড়া রুচি,ছেড়া ভাব। এই ছেলের নাম অনুভব নয়,ছেড়াভব হওয়া উচিত ছিলো। এতো অনুভূতিপ্রবণ নামটা যে কে রাখলো তার মুখদর্শন করা দরকার। রিপ্তি তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বললো,,

“” তোর মতো রুচিহীন মেয়ে আমার বেস্টফ্রেন্ড কি করে হলো? সর আমার সামনে থেকে! তোর গা থেকে ব্যাঙ ব্যাঙ গন্ধ আসছে!””

রিপ্তি নাক চেপে ধরে গালদুটোতে বাতাস ভরে নিলো। মুখের ভাব এমন যেন এই বুঝি বমি করে দিবে!

~~~

খাওয়ার টেবিলে বসে রিপ্তির খাওয়া হলোনা। তার মুখোমুখি বসেছিলো অনুভব। সামনে এমন ব্যাঙমুখো ছেলে বসে থাকলে কি খাওয়া যায়?? যদিও অনুভব তাকে একটুও বিরক্ত করেনি। সে তার আপনমনে আয়েশীভাবে খাচ্ছিলো। কিন্তু এটা রিপ্তির একদম সহ্য হলোনা৷ অনুভবের খাবারের প্রত্যেকটা দানাতেই রিপ্তি বিরক্ত খুজে নিয়েছে। হঠাৎ করেই তার সব অসহ্য লাগতে শুরু করে দিয়েছিলো। তাই সকলকে এড়িয়ে খাবার ছেড়ে উঠে এলো। কিছু ভালো লাগছেনা তার। হৈ হট্টগোল,নানা রকম শোরগোলে তার ভেতরটাতে একঘেয়েমীর আকাশ নেমে এলো।

রিপ্তি বিয়েবাড়ী ছেড়ে কিছুটা দুরে চলে এসেছে। খালি পায়ে হাঁটছে। নির্জন পরিবেশের খোলা হাওয়া বেশ লাগছে। খালি পায়ে মাটির ছোয়া,ভেতরের একঘেয়েমিটা দুর করে দিয়েছে। ভালো লাগছে তার! সবকিছু ভালো লাগছে। বিকেলের ক্লান্ত হাওয়া,ক্লান্ত আকাশ,গায়ের মেঠো পথ,ধুলো মাখা দূর্বাঘাস! উফ পৃথিবী অনেক সুন্দর! রিপ্তি এক ঝলক ভালো লাগায় ডুব দিতে চোখের পাতা বন্ধ করলো। পেট টেনে,শব্দ করে নিশ্বাস নিতেই অনুভবের মুখটা ভেসে উঠেছে। চট করে চোখ মেলে ফেললো রিপ্তি। এই লোকটার মুখ সে কিছুতেই দেখতে চায়না। কিছুতেই না!

রিপ্তি এলোমেলো পা ফেলে পেছনপথ ধরলো। আকাশের লালআভায় ক্লান্ত সূর্যের রশ্মি পড়ছে রিপ্তির মুখে। বিকেলের তেজহীন তাপটাও রিপ্তির সহ্য করতে ইচ্ছে হলোনা। তাই দ্রুত পা ফেলেছে। কিছুদুর এগুতেই তার পা থমকে গেলো। অদুরে একটি ছেলে আর মেয়ে পাশাপাশি দাড়িয়ে। না,পাশাপাশি নয়,মেয়েটিকে ছেলেটি আড়াল করে দাড়িয়ে আছে। কারো মুখই রিপ্তি দেখতে পাচ্ছে না। অস্পষ্ট চওড়াপিঠে ঝাপসা দৃষ্টি ফেলেই রিপ্তি কন্ঠ ছাড়লো,,

“” ওটা অনুভব না? এই অজ পাড়াগায়ে মেয়েসঙ্গি কোথা থেকে পেলো?””

রিপ্তি দ্রুত কদম ফেলে মানুষদুটোর দিকে এগুতে গিয়েও থমকে গেলো। আমি ওখানে গিয়ে কি করবো? ছেড়াভব যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে কথা বলুক আমার কি? যার কন্ঠ ফুটলেই নোংরা গান বের হয় তার চরিত্রে দোষ তো থাকবেই! এমন দোষওয়ালা চরিত্রের থেকে দুরে থাকায় শ্রেয়! রিপ্তি আরেকবার তীক্ষ্ণদৃষ্টি ছুড়লো,দুরের মানব-মানবীর দিকে। অনুভব একাধারে কথা বলে যাচ্ছে। অস্পষ্ট কথাগুলো রিপ্তির কানে দুর্বল হয়ে বাজছে। দু-হাত খুব ঘনঘন নাড়ছে। রিপ্তি আর একদন্ডও ওখানে দাড়ালোনা। ঘন পা ফেলে বিয়েবাড়ীর দিকে এগুলো। গোটা কয়েক কদম ফেলতেই তৃণা দৌড়ে এলো,,,

“” কোথায় ছিলি তুই? পুরোবাড়ী হালচষেছি,কিন্তু তোর তো কোনো দেখা নেই!””

তৃণার কথায় রিপ্তি ক্লান্ত চাহনি আঁকলো। ঠোঁটে শুকনো হাসি এনে ভেতরে ঢুকবে তখনি তৃণা ওর হাত চেপে ধরলো।

“” খালি পায়ে আর কতক্ষণ ঘুরবি? নে,জুতো পড়ে নে।””

তৃণা রিপ্তির সামনে জুতো রাখতেই রিপ্তির দ্রুত প্রশ্ন,,,

“” কোথায় পেলি? কোথায় লুকিয়েছিলো?””
“” আমি কিভাবে বলবো? অনুভব ভাইয়া জানেন!””
“” তাহলে তুই পেলি কি করে?””
“” অনুভব ভাইয়া আমাকে ডেকে নিয়ে দিলো। উনার তোকে দেখে অনেক মায়া লাগছে তাই..””
“”এই কথা তোকে,উনি নিজে বলেছেন?””
“” হুম!””

রিপ্তি জুতো জোড়ার দিকে তাকালো। পায়ে পড়তে গিয়েও থমকে গেলো। উবু হয়ে হাতে নিচ্ছে।

“” তুই জুতো পায়ে না পড়ে হাতে পড়ছিস কেন?””

রিপ্তি তৃণার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো। ওর চোখ পড়েছে বা’পাশে। কিছুটা দুরেই অনুভব দাড়িয়ে। এক মাঝবয়সী লোকের সাথে আলাপে মশগুল। রিপ্তি কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিশ্চুপী। সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিটে পৌছুতেই ধপধপ পা ফেলে অনুভবের কাছে এগিয়ে এসেছে। অনুভব নিজের গল্পসঙ্গীকে কিছু একটা বুঝানোর জন্য হাত নাড়াতেই রিপ্তি ওর হাত চেপে ধরলো। চোখে আগুনের ফুলকি নিয়ে জুতো জোড়া ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,,

“”আপনার মায়া আপনার কাছেই রাখুন। আমি খালি পায়েই হাঁটবো। শুধু আজকে কেন দরকার পড়লে সারাজীবন খালি পায়ে হাঁটবো। তবুও আপনার মায়া আমি নেবোনা।””

রিপ্তি চলে আসার জন্য ঘুরে দাড়াতেই অনুভবের অস্পষ্ট কন্ঠবুলি,,

“” অগ্নিহংসী!””

~~~

মাথায় স্নেহের স্পর্শ পেতেই রিপ্তির গভীরঘুম আলসেমীতে পরিণত হলো। পিটপিট করে চোখের পাতা মেলছে। ইচ্ছে করছেনা মেলতে তবুও তাকে মেলতে হলো। চোখের সামনে এমন নীলচে মায়াময়ীকে দেখে তার চোখ জুরিয়ে যাচ্ছে। হালকা নীল রঙের সুতি শাড়ী পরিহিতা তার মাথার কাছে বসে আছে। আদরী চোখ,মিস্টি হাসি,মায়ার বাধনে রিপ্তি আটকে আছে। মিন্মি,রিপ্তির ভাবী। বয়সে তার থেকে খুব একটা বড় নয়। তবে অপরিচিত। কাল বিয়ের আসরেই কয়েক পলক দেখেছিলো। তেমন কথা হয়নি,আলাপটা জমেওনি। তারপর?

“” তুই কি চোখ মেলেও ঘুমাস রিপু?””

ভাবীর শীতল কন্ঠে রিপ্তির চোখ বন্ধ হতে বাধ্য। ভালো লাগার ঝড় বয়ছে তার বুকে। নাক টেনে গভীর নিশ্বাস নিতেই কেমন মা মা গন্ধ পাচ্ছে। এতো ভালো লাগা সে অন্ধকারে নয় আলোতে নিতে চায়। রিপ্তি কিছু সময় পেরিয়েই চোখ মেললো। মিন্মি মিস্টি হাসিটাকে নিমিষেই মিশিয়ে নিলো। মুখভার করে বললো,,

“” তোর কি আমাকে পছন্দ হয়নি,রিপু? যদি পছন্দ নাহয় তাহলে বল। আমি এখনি ফেরত যাবো। তোর ইচ্ছেতেই আমি থাকবো অনিচ্ছাতে চলে যাবো।””

মিন্মির কথার কোনো আদি-অন্ত কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা রিপ্তি। মেয়েটি তার অপরিচিত। আর একজন অপরিচিতের মুখে তুই ডাকটা রাগের কারণ হতে পারে,কিন্তু তার রাগ হচ্ছেনা। ভালো লাগছে,বড্ড বেশি ভালো লাগছে। তবে অবাকও হচ্ছে। এতো অল্পতে এতো আপন??

রিপ্তি নিরব। মিন্মি ওর মাথা থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিলো। মুখ বাকিয়ে অভিমানিসুর,,,

“” কাল এক ঝলক তোকে দেখেছিলাম। তারপর আর কোনো দেখা নেই। তোদের বাড়ীতে আসার পরও তোর খোঁজ নেই। ননদ হোস তুই আমার। কোথায় মজা-আহ্লাদে ভরিয়ে রাখবি আমায় তা না চোখের দেখাটাও দেখতে এলিনা? এটা কিন্তু ভারী অন্যায় হয়েছে রিপু!””

রিপ্তি আর শুয়ে থাকতে পারলোনা। শোয়া থেকে উঠে সোজা নতুনভাবীকে জরিয়ে ধরে বললো,,

“” সরি,ভাবী। অতিরিক্ত আমেজে মাথা ধরেছিলো তাই!””

মিন্মি ননদের বাধন ছাড়িয়ে মুখোমুখি হলো। রিপ্তির মুখে সচেতন দৃষ্টি ছুড়ে বললো,,

“” এইটুকুই তো নাকি অন্যকিছু?””

রিপ্তি মাথা নিচু করে বললো,,

“” হুম!””
“” কোনটাতে হুম?””

রিপ্তি ভাবীর প্রশ্ন এড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,,

“” বাবা,কোথায়?””
“” রান্নার ওখানে গেছে।””
“” রান্না! কিসের রান্না?””
“” বৌ-ভাতের।””
“” বৌ-ভাত? ওখানে বাবার কি কাজ? বাবুর্চি আসেনি? বাবার গরমে এলার্জি আছে,ভাবী। আগুনের তাপ কি করে সহ্য করবে?””

মিন্মি বিছানার চাদর গুছাচ্ছিলো। রিপ্তির প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলোনা৷ তার আগেই রিপ্তি বেরিয়ে পড়েছে।

~~~
লাল লুঙ্গির সাথে সাদা পাতলা গেঞ্জি পড়েছে অনুভব। গলায় লাল গামছা, হাতে নাড়ুনী। সে রান্না করছে নাকি গামছা ভিজিয়ে ঘাম জমাচ্ছে তাই বুঝতে পারছেনা রিপ্তি। প্রায় দশ মিনিটের মতো হবে সে এখানে দাড়িয়ে আছে। স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তব এই দোটানায় সে স্থির। চোখের সামনে মানুষটাকে তার পুরুষ নয়,মহাপুরুষ মনে হচ্ছে। ফটোগ্রাফার থেকে সোজা বাবুর্চিতে কি করে নামলো?? দুনিয়ার সকল কাজই কি তার আয়ত্বে চলে গিয়েছে? রিপ্তির স্থিরদৃষ্টি অনুভবের উপর। চাইলেও পারছেনা নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আনতে। এ কেমন মোহনীয় উন্মত্ততায় ভুগছে সে?

রিপ্তি নিজের বিহ্বলতাকে সঙ্গে নিয়ে সামনে এগুলো। তার চক্ষুদ্বয় অতৃপ্তে ভুগছে। আজ সচেতন নয়,বিরক্ত নয়,অসহ্য নয়,উদাসীনতাকে প্রশ্রয় দিয়ে সামনে এগুলো। অন্যমনস্কতায় পা ফেলতেই রিপ্তির পা ভারী কিছুর সাথে আটকে গিয়েছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনুভবের উপর গিয়ে পড়লো। অনুভবের কর্মঠ হাতের চাপ রিপ্তির উত্তেলিত বাহে পড়েছে।

“” আপনি আমাকে ছুলেন কেন? আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে ছোয়ার? ছাড়ুন বলছি,নাহলে কিন্তু আমি…””

রিপ্তির কথার মাঝপথে অনুভব হাতের চাপ সহজ করে দিলো। রিপ্তির মাথাটা, অনুভবের বুক ছোয়া থেকে পেট অব্দি চলে আসতেই ও ভয়ে অস্পষ্ট শব্দ করলো। বা’হাত দিয়ে অনুভবের গামছা সহিত গেন্জি খামচে ধরে আছে। চোখের পাতা এতো কঠিনভাবেই বন্ধ করেছে যে,চারপাশে শীর্ণ কুচকানোর ভাজ! অনুভব রিপ্তিকে সম্পুর্নভাবে ছেড়ে দিয়ে নিচুসুর টানলো,,,

বুক চিনচিন করছে হায়,,
মন তোমায় কাছে চায়,,
আমরা দুজন,দুজন আজ
প্রেমের দুনিয়ায়,,,
তুমি ছুয়ে দিলে তাই
আমার কি যে হয়ে যায়…(গান)

অনুভবের গানের শব্দে রিপ্তির ভয় কুপোকাত। বন্ধ চোখের দরজা হা’তে রুপান্তর। মনের ঘরে অন্তর অন্তর ছোট্ট শব্দ বাজনা তুলছে, ছি!ছি!!ছি!!!

~~~

গোসল সেরে রিপ্তি আয়নার সামনে দাড়িয়েছে। মেহমান আসতে চলেছে অথচ এখনো সে রেডি হতে পারলোনা। নিজের বাড়ীর আনুষ্ঠানিকের কাজ তো নিজেদেরই সামলাতে হয়,সেখানে সাজগোজের সময় কই?? এদিকে ভাবী নাছোড়বান্দা! তার বিছানায় সবুজ রঙের হালকা কাজের লেহেঙ্গা রেখে গিয়েছে। সাথে গরম আর আদেশীসুর তো বটেই। আধাঘন্টার মধ্যে রেডি হতে হবে। নাহলে কি করবে সেটা বলেনি! না বললে কি তার এতো ব্যস্ততার মধ্যেও ভাবীর কথা শুনতে ভালো লাগছে।

আধাঘন্টার মধ্যে ২০ মিনিট লাগিয়ে দিলো লেহেঙ্গা পড়তে। তাও সম্পুর্ণ হয়নি। উপরের পার্টের হুক সে কিছুতেই লাগাতে পারছেনা। শরীরের সাথে এডজাস্ট হয়নি নাকি হাত লম্বা হয়নি তাও বুঝতে পারছেনা। তবে এতোগুলো মিনিট পার করে এটা বুঝে গিয়েছে তার দ্বারা এটা আর সম্ভব হবেনা।

রিপ্তি দরজা মেলে বাইরে উকি দিলো। আশেপাশে তেমন কেউ নেই। দৌড়ে কি ভাবীর রুমে যাবে নাকি পরিচিত কারো আসার অপেক্ষায় থাকবে?? মনের প্রশ্নের সাথে পরিস্থিতি সামলিয়ে উঠার আগেই তৃণার কন্ঠ পেলো। তার খোঁজই করছে সে। তৃণার কন্ঠ মিলে গেলো। তবে এইদিকের পথ ধরেই এগুচ্ছে। পায়ের শব্দে রিপ্তি সেটা আন্দাজ করতে পেরেছে। সচেতন মনোযোগী পায়ের শব্দে। শব্দটা নিজের দরজার সামনে আসতেই রিপ্তি আর অপেক্ষা করতে পারলোনা। দরজার সরু ফাঁকা দিয়ে বাইরের মানুষটিকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসলো। নিজের খোলা পিঠ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চটপটে বললো,,

“” জলদি হুকগুলো লাগিয়ে দে। ভাবী আমার অপেক্ষায় আছে।””

রিপ্তির তাড়া পেছনের মানুষটিকে ছুতে পারলোনা। শান্তকন্ঠে মিহিসুর,,,

শান্ত বুকে অশান্তের ঢেউ
ভাঙলো দু-কূল,সামলা কেউ!!(রোকসানা)

চলবে

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৫)

রিপ্তি,নিজের খোলা পিঠ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চটপটে বললো,,

“” জলদি হুকগুলো লাগিয়ে দে। ভাবী আমার অপেক্ষায় আছে।””

রিপ্তির তাড়া পেছনের মানুষটিকে ছুতে পারলোনা। শান্তকন্ঠে মিহিসুর,,,

শান্ত বুকে অশান্তের ঢেউ
ভাঙলো দু-কূল,সামলা কেউ!!(রোকসানা)

গানকন্ঠির কন্ঠে রিপ্তি স্তম্ভিত। অন্তর আকন্ঠে অস্ফুটসুরে ভেসে এলো,অনুভব!
রিপ্তির মুখ ভয়ার্ত। পা কাঁপছে অনরবত। কাঁপুনির কম্পন তীব্র হয়ে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফেলবে ভাবতেও পারেনি। নিজের শোয়াঘরে এক ছেলে ঢুকেছে,তাও অন্যকেউ নয়,অনুভব! লাল ব্যাঙ। যাকে সে দেখতে পারেনা। দুচোখের বিষ। আর সেই বিষভর্তি মানুষটার বিষাক্ত চাহনি আঁকছে নিজের খোলা পিঠে। সুযোগটা তো সেই দিয়েছে! রিপ্তির পুরো শরীর অসার হয়ে আসছে। মাথার চুলগুলো ডান কাধের সামনের দিকে, ডানহাতের মুষ্ঠিতে আবদ্ধ ছিলো। হাতের বল ধীরগতিতে কমে এসে চুলগুলো আলগা হয়ে গেলো। ছড়িয়ে পড়ছে বুকের কাছাকাছি। এমন লজ্জাদায়ক কান্ড,তাও নিজের তৈরী করা,নিজের বোকামীতে রিপ্তির শরীর নিশ্চল হয়ে রয়েছে। না পারছে পেছনে ঘুরে মানুষটার দিকে কড়া দৃষ্টি ছুড়তে। না পারছে নিজেকে ঢেকে নিতে,না পারছে নিজেকে আড়াল করতে। এমন স্থিরধী অবস্থাকেও রিপ্তি মেনে নিতে পারছেনা। সরলাকৃতিতে নিচের দিকে টানটান হয়ে থাকা দু-হাতের মুষ্ঠিতে জোর আনলো। দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে পেছন ঘুরলো। চোখে জ্বলন্তআগুন এনে কিছু বলবে তার আগেই তৃণার কন্ঠ ভেসে এসেছে। রিপ্তির চোখের জলন্তআগুন নিভে গেলো। চোখের কোটরজুরে ভয় জায়গা করে নিচ্ছে। রিপ্তি একবার দরজার দিকে চেয়ে থেকে অনুভবের দিকে তাকালো। অনুভবের দৃষ্টি তার দিকে নেই। অন্যদিকে। বাপাশে লম্বালম্বিভাবে দাড়িয়ে থাকা ড্রেসিংটেবিলের আয়নায়। ঠোঁটে হাসির রেখা স্পষ্ট! রিপ্তি অনুভবের দৃষ্টি অনুসরণ করে বাদিকে ঘুরতেই চোখ তার ছানাবড়! মুহুর্তেই রিপ্তির চোখ লালরঙে ছেয়ে গেলো। সামনের জীবন্ত মানুষটির দিকে না চেয়ে আয়নায় অনুভবের প্রতিচ্ছবিটির দিকে কঠিন চাহনি ছুড়ে দিয়েছে। এমনভাব,যেন আয়নাসহ সেই মানুষটিকে পুড়িয়ে দিবে!

“” আপনি যে এমন নির্লজ্জ,বেহায়া,নোংরা মনের মানুষ তা আমি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলাম। মানছি আমি ভুল করে আপনার হাত ধরেছিলাম তাই বলে আপনি কোনো বাধা দিবেননা? ধেই ধেই করে একটা মেয়ের রুমে ঢুকে যাবেন? শুধু ঢুকেও শান্তি হয়নি? সুযোগ পেয়ে অনাবৃতের দিকে চেয়ে আছেন? আবার হাঁসছেন? আপনার কি মিনিমাম সম্মানবোধ নেই? আপনার এসব কান্ডের জন্য যে একটা মেয়ের চোখে ছোট হয়ে যাচ্ছেন সেটাও বুঝছেননা?””

রিপ্তির গর্জে উঠা কন্ঠে অনুভবের কোনো হেলদোল নেই। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে ওর মুখের দিকে ফেলেছে,এতুটুকুই! রিপ্তি অনুভবের চোখে চোখ রেখে আরো কয়েকটা কটু কথা শুনাতে প্রস্তুত হলো। কিন্তু তার আর ঠোঁটখোলা হয়ে উঠলো না। এই চোখদুটোতে কোনো লালসার বিন্দু খুজে পাচ্ছেনা। যা পাচ্ছে তা মুগ্ধতা! কিন্তু এটা কি করে সম্ভব?? রিপ্তির এমন নিরবতা দেখে অনুভবের হাসির রেখা দ্বিগুন হারে বেড়ে গেলো। রিপ্তিকে চমকে দিয়ে ওর বিছানায় শুয়ে পড়লো। অনুভবের এমন আশ্চর্যজনক কান্ডে রিপ্তি বাকরুদ্ধ সাথে শ্বাসরুদ্ধ। তারমাঝেই তৃণার হাঁকডাক কানে এসে বাজছে। কন্ঠটা ধীরে ধীরে ঘন হয়ে আসছে। রুমের দিকেই আসছে নাকি?? রিপ্তি বড়বড় কদম পেলে অনুভবের দিকে তেড়ে এলো,,,

“” এটা কোন ধরনের অসভ্যতা? উঠুন বলছি। এখনি আমার রুম থেকে বের হবেন। নাহলে কিন্তু…””

রিপ্তি কিন্তুতে আটকে গেলেও অনুভব আটকে যায়নি। সে মাথার নিচের বালিশটা বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো,উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। অনুভবের কান্ডকারখানায় তার ঠিক কেমন রিয়েক্ট করা উচিত সেটাও ভুলে যাচ্ছে রিপ্তি। সবকিছু অগোছালো,জগা খিচুড়িতে পরিনত হলো। উদ্বিগ্নের কঠোর ছাপ,চোখে,মুখে। দরজায় সতর্কদৃষ্টি ফেলছে বারবার। এদিকে অনুভবকে দেখে মনে হচ্ছে,কত যুগ সে ঘুমায়নি। শত যুগের ঘুম সে রিপ্তির রুমে আয়েশীতে ঘুমাবে। কোনো নড়চড় নাই। দম আটকে ঘুমাচ্ছে নাকি?? রিপ্তি আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে অনুভবের হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিলো,,

“” এমন অদ্ভুত আচরন করছেন কেন? উঠুননা,প্লিজ! তৃণা এখনি চলে আসবে।””

রিপ্তির আকুতি কন্ঠে অনুভব নড়লো। উঠে বসলো। রিপ্তিকে মিস্টি হাসি উপহার দিলো। তারপর আবার আগের ন্যায় শুয়ে পড়লো।

অনুভবের এমন আশ্বাসজনকভঙ্গির নাটকে রিপ্তির শরীর কাঁপছে। ভয়ে নয়,রাগে। ইচ্ছে করছে এই অসভ্য লাল ব্যাঙটাকে তুলে একটা আছাড় মারতে,পচা ডোবায়। রিপ্তির আফসোস হচ্ছে,সে কেন মেয়ে হলো? আর অনুভব কেন ছেলে হলো? যদি উল্টোটা হতো,তাহলে অনায়াসেই সে অনুভবকে আছাড় মারতে পারতো। আফসোস আর হতাশা মিলেমিশে এক হতেই তৃণার গলা,,,

“” এই রিপি,মরে আছিস নাকি বেঁচে? সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি,কোনো উত্তর নেই। তুই কি চাচ্ছিস আমি গলা শুকিয়ে মরে যাই?””

তৃণা নিজের কথার মাঝপথেই রিপ্তির রুমের দুয়ারে হাত দিয়েছে। কিন্তু খুলার আগেই সিটকিনি লাগানোর শব্দ।

“” দরজা বন্ধ করলি কেন?””

রিপ্তি বন্ধ দরজা আগলে বললো,,

“” আমার দরজা আমি আটকেছি,তাতে তোর কি?””
“” সামান্য প্রশ্নে এতো রাগ দেখাচ্ছিস কেন?””
“” আমার রাগ আমি দেখাচ্ছি,তাতে তোর কি?””
“” আমার আবার কি হবে? ভাবী তোকে ডাকছে,বললো এখনি তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।””
“” নিয়ে যেতে হবে কেন? আমার পা নেই? আমি হাঁটতে পারিনা?””

তৃণা দরজায় ঘনঘন কড়া নেড়ে বললো,,

“” রিপি,এই রিপি তোর কি হয়েছে রে? মাথায় সমস্যা হয়েছে? নিশ্চয় সারাদিন কিছু খাসনি তাই এমন উল্টাপাল্টা উত্তর দিচ্ছিস। ভাবি তো সেজন্যই তোকে ডাকলো। চল,খেয়ে নিবি। দরজাটা খোল!””

রিপ্তি বিরক্ত নিয়ে বললো,,

“” তুই যাবি এখান থেকে?””
“” তুই আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস তো? যা আর আসবোনা। কোনো দিননা। তুই ডাকলেও না। ডেকে এনে এমন অপমান!””

তৃণার কন্ঠ ভারী হয়ে এলো। প্রায় কেঁদেই দিবে এমন ভাব ঠিক তখনি ভেতর থেকে গানের সুর,,,

♪♪বলছি তোমায় দিব্বি খেলে
আমি বড় শান্ত ছেলে
দেখছি তোমায় সুযোগ পেলে
শুনে বুঝি ভিষম খেলে,,(মুভিসং)

“” অনুভব ভাইয়া!””

রিপ্তি ঝড়েরগতিতে পেছন ঘুরলো। অনুভব খাটে নেই। তার সামনে দাড়িয়ে। গুছিয়ে আনা পরিবেশটাতে অনুভব এমন পানি ঢেলে দিবে তা ও আন্দাজও করতে পারেনি। সব শেষ!

তৃণা উৎকন্ঠা হয়ে বললো,,

“” অনুভব ভাইয়ার কন্ঠ পেলাম না? উনি তোর রুমে কি করছে?””

রিপ্তি কন্ঠ টেনে বললো,,

“” ককোথায়? আমার রুমে কেউ নেই। আমি তো গান শুনছিলাম।””
“” তাহলে আমার মনে খটকা লাগছে কেন? আর তুই দরজা আটকিয়ে আছিস কেন? দেখি দরজা খোল তো!””
“” তোর আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা? আমাকে মিথ্যেবাদি বানাচ্ছিস? তোর আমাকে…””

রিপ্তির কথার মাঝ খানেই অনুভব দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। তৃণার দিকে বাঁকা হাসি ছুড়ে গুনগুন করতে করতে হেঁটে চলে যাচ্ছে। তার চলে যাওয়ার পানে তৃণা নিষ্পলকে চেয়ে আছে। বেশ কিছু সময় শেষে রিপ্তির দিকে তাকালো। সেও মাথা বের করে অনুভবের চলে যাওয়ার পানেই তাকিয়ে ছিলো।

“” এই তোর সত্যবাদী?””

তৃণার হুংকারে রিপ্তি চুপ। অপরাধীর মতো মুখ করে রইলো।

“” দরজা আটকে অনুভব ভাইয়ার সাথে কি করছিলি?””

তৃণার এমন জেরা প্রশ্নে রিপ্তি হকচকিত।

“” কি করছিলাম মানে? উনার সাথে আমি কি করবো? উনিই করে কুল পাননা আমি কখন করবো।””
“” মানে?””

রিপ্তি দরজা ছেড়ে বাইরে এসে দাড়ালো। তৃণার দিকে এসে শান্তভাবেই বললো,,

“” তুই যা ভাবছিস তেমন কিছুনা। ভুল করে আমি উনাকে,না উনি আমার রুমে ঢুকেছিলেন। তারপর..””
“” তারপর দরজায় খিল দিয়ে জামা খুলে ফেললি?””

তৃণার এমন অকাট্য কথায় রিপ্তি চোখ গরম করলো। শক্ত উত্তর দিতে যাবে কিন্তু আর দেওয়া হলোনা। তৃণার চোখ রিপ্তির কাঁধে,জামার চেইন লাগানো না থাকায় কাধ থেকে সামান্য না,অনেকখানি সরে গিয়েছে!

~~~

মেহমানের আসা-যাওয়া পর্বটা শেষ। খুব নিকটীয় আত্মীয়রা এখনো রিপ্তিদের বাসা দখল করে আছে। রিপ্তির ভাবী,রিন্মির পরিবার থেকে বয়োজ্যেষ্ঠরা এসেছেন অনেক আগেই। বসার রুমে বড়দের আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আর কিছু সময়বাদেই রিন্মিকে উনারা নিয়ে নিজ গায়ে পাড়ি দিবেন। রিপ্তি মন খারাপ নিয়ে ভাবীর রুমে ঢুকলো। ভাবীর পাশে বসতেই এক এক করে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ঢুকে পড়েছে। ছোট,বড়,সমবয়সী সকলেই আছে। সবাই রিপ্তির পরিচিত। সকলেই ভাবীর সাথে নানা দুষ্টু খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। সবার সাথে তাল মিলিয়ে রিপ্তির ঠোঁটেও হাঁসি ঝিলিক দিচ্ছে। তবে খুব কম সময়ের জন্য। তারমাঝেই রিপ্তির মামাতো ভাই হৃদয় চিৎকার করে উঠলো,,,

“” অনুভব ভাইয়া! এদিকে এসো। আমার কাছে বসো।””

রিপ্তি ঘাড় বাকিয়ে দরজার দিকে তাকালো। সারাদিনের ঘেমে উঠা শরীরে এখনো লাল লুঙ্গিটাই আছে। তবে গায়ের জামাটা পাল্টিয়েছে। কালো রঙের পান্জাবী,না ফতুয়া না শার্ট! ঠিক কি পরেছে তা বুঝে উঠতে পারছেনা সে। তবে কিছু একটা পড়েছে,সাথে গলায় চিকন ওড়নার মতো কিছু জড়ানো। এমন অদ্ভুত আর ভিন্ন সাজে সকলের থেকে আলাদা দেখাচ্ছে। অনুভবের চোখে চোখ পড়তেই রিপ্তি চোখ সরিয়ে নিলো। নিজেকে ভাবীর আড়ালে লুকিয়ে ফেললো। মানুষটা ভেতরে ঢুকার পর থেকে রুমটা কেমন উষ্ণতায় ছেয়ে গিয়েছে। রিপ্তি ঘেমেও উঠেছে। পড়নে সুতির গাঢ় গোলাপী জামাটা পিঠের সাথে ল্যাপ্তে গেলো। রিপ্তির হাত জামাতে পড়তেই দুপুরে ঘটে যাওয়া কান্ডটা মনে পড়ছে। ভয়,অসস্থি লজ্জায় মিলেমিশে একাকার।

“”ভাইয়া,প্লিজ! প্লিজ!! প্লিজ!!! একটা গান গাওনা।””
“” এখন গান? এটা কি গান গাওয়ার সময় হৃদয়? আমি এখানে জরুরী কথা সারতে এসেছি।””

অনুভবের গুরুগম্ভীর কথাগুলো রিপ্তির হৃদয়ে গিয়ে ঠেকছে। তার মানা করাটাও কি দারুন। মনের কোনে দীপ্ত আলোয় আলোকিত হচ্ছে অন্ধকার কুঠির। কিন্তু কেন?? এই বিরক্ত আর নিচ মনের মানুষটার জন্য সে হৃদয়ে প্রদীপ জ্বালাতে চায়না। কিন্তু চাইলে কি বাধা দেওয়া যায়? এ যে ধরা ছোয়ার বাইরের প্রদীপ!

রিপ্তির ভাবনার ঘোর কাটলো অনুভবের কন্ঠে,,,

♪♪বাননো কি সাহেলি, রেশাম কি গড়ি
ছুপ ছুপকে শারমায়ে দেখে চরি চরি!!!
ইয়ে মানে ইয়া না মানে
ম্যাতো ইসপে মার গেয়া
ইয়ে লাডকি হায় আল্লাহ, হায় হায় রে আল্লাহ(মুভিসং)

অনুভবের গানের মাঝেই তৃণা দৌড়ে এলো। অসতর্কতায় রিপ্তির উপর ঢলে বসেছে। অনুভবের দিকে বিস্ময়দৃষ্টি রেখে বললো,,,

“” শাহ রুখ খান!””
“” তোর মাথা খান। এতো শাহ রুখ খানের ধারে কাছেও নেই। তুই বরং ব্যাঙ খান বলতে পারিস!””

রিপ্তির তাচ্ছিল্যমাখা কথাগুলো ঠিক হজম করতে পারেনি তৃণা। শক্ত চিমটি কাটলো রিপ্তির উরুতে। রিপ্তির দিকে ঝুকে এসে নিচুস্বরে বললো,,

“” তো এই ব্যাঙ খানের সাথে জামা খুলে কি করছিলি? ব্যাঙখানকে দেখেই যদি জামা সামলাতে না পারিস তাহলে শাহরুখখানকে দেখলে কি করবি?””

রিপ্তি চোখ পাকালে তৃণা থেমে গেলো। গভীর মনোযোগে অনুভবের গান শুনছে। রিপ্তি চুপ। শুনছে তো সেও। কিন্তু তারমতো কি অন্যদের বুকেও ঢেউ ভাঙছে??

সেই যে অনুভব ঢোকার সময় তাকে পরখ করছিলো রিপ্তি তারপর আর তাকাতে কারেনি। লজ্জায় তার সব শক্তিবল শূন্য। তবে অনুভবের আড়চোখে তাকানোটা এড়িয়ে যেতে পারলোনা। তার অবচেতন মন ঠিক বুঝে নিচ্ছে। যতবার অনুভব ওর দিকে তাকাচ্ছে ততবার ও একটু একটু করে ভাবীর আড়ালে লুকোচ্ছে। লুকোবেইনা কেন? মানুষটার চোখের দৃষ্টির উপস্থিতে বারবার মনে হচ্ছে তার পিঠ খোলা। আর অনুভব সেখানেই তাকিয়ে আছে। এমন অসস্থি,অস্থিরতার মাঝে রিপ্তির দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। তাই হঠাৎ করেই রিপ্তি ভাবীর আড়াল থেকে বেরোলো। ঠিক অনুভবের সামনে এসে দাড়িয়েছে। সকলেই অবাক। এমনটা কেউ আশা করেনি। গরম পরিবেশ হঠাৎই থমথমে হয়ে গেলো। সকলের দৃষ্টি রিপ্তির উপর স্থির! পিনপতন নিরবতা কাটিয়ে তৃণা শিস বাজিয়ে উঠলো,চিৎকার করে বললো,,

“” আমাদের কাজলরানীও হাজির। এইবার জমে যাবে। রিপ্তি শুরু কর। তোর কোকিলাসুরে অনুভব ভাইয়া কাত হতে বাধ্য!””

তৃণার কন্ঠের সাথে বাকি সবার কন্ঠও জোড়া লেগেছে। এক উত্তেজিত উত্তজনার মধ্যে এক সাগর পানি ঢেলে দিয়ে রিপ্তি রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

~~~

সকলের সাথে এতো ভাব,এতো গল্প আমার সাথে কেন নাই? সবার সাথে এতো নম্র,এতো ভদ্র আচরন আমার সাথে কেন নয়? আমার সামনে এলে বোবা হয়ে যায়,অন্যদের সাথে গেলে কথার ফুল ঝরতেই থাকে। আমার সামনে ভাঙা গলায় গান আর সবার সামনে? গাইবোনা আমি গান,সাজব না আমি কাজল। কেন সাজবো? আপনার মতো লাল ব্যাঙের পাশে আমার মতো কাজল নয়,পচা ডোবার গন্ধওয়ালা ব্যাঙ দাড়াবে। না দাড়ালে আমি দাড় করাবো। সমুদ্রের তলদেশ থেকে ব্যাঙ ধরে আনবো হুহ!

বাড়ি ছাড়িয়ে পাঁচ-ছয় মিনিটের হাঁটার পথ পেরুলেই শান্তদিঘী। সেই দিঘীরপাড়ে বসেই রিপ্তি মনোঃকষ্টে ভুগছে। কষ্ট হচ্ছে তার কেন হচ্ছে জানেনা। তবে খুব বেশিই কষ্ট। যতটা কষ্ট পেলে আশেপাশের সককিছু অসহ্য হয়ে যায়।

একটা অচেনা মানুষ! হঠাৎ আগমনে এতো জলদি কি করে সবার ভালোবাসার পাত্র হয়ে গেলো? কি করে? এমন নোংরা মানুষটাকে সবাই কেন ভালোবাসবে? আমি বাসতে দিবোনা। কিছুতেইনা।

দিঘীর মতো রিপ্তির চোখটাও অনেকটা শুকনো। কিন্তু তলদেশে ঠিকই কিছুটা পানি চিকচিক করছে।

রিপ্তি দিঘী ছেড়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো। পাঁচ মিনিটের রাস্তা দুই মিনিটে পেরিয়ে বাসায় ঢুকেছে। অনুসন্ধানী চোখ চারপাশে ঘুরছে। কাউকে খুজছে। কিন্তু পাচ্ছে কই??

পুরোবাড়ি তন্নতন্ন করে খুজে কোথাও পেলোনা। সবশেষে সিড়ির ধার পেরিয়ে রুমে ঢুকবে তখনি অস্পষ্ট শব্দ পেলো। মনে হয় ছাদ থেকে আসছে। রিপ্তি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে থমকে গেলো। ছাদের পাঁচিলে বসে আছে অনুভব। সাথে রাসেল ভাইয়া। কিছু একটা শলাপরামর্শ হচ্ছে। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে অনুভব। রাসেল শুধু শুনে যাচ্ছে সাথে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি-অসম্মতি জানাচ্ছে। রিপ্তি কিছুসময় দাড়িয়ে থাকলো। বেশিক্ষণ দাড়ানোর মতো ধৈর্য্য অর্জন করতে পারলোনা। ঘন পা ফেলে দুজনের কথার মাঝখানে বলে উঠলো,,,

“” ভাইয়া,তুমি এখানে কি করছো? ভাবী ডাকছে। বাবারা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে! রওনা হবে কখন?

রাসেল সামান্য বিরক্ত নিয়ে বললো,,

“” আমি যে বলেছিলাম,সব গুছানো হয়ে এলে আমায় ডাকতে।””

রিপ্তির দ্রুত উত্তর,,

“” ডাকতেই তো এলাম।””

রাসেল অনুভবের দিকে তাকালো। ইশারায় কথা চালিয়ে সিড়ির দিকে পা চালাচ্ছে। রিপ্তি, অনুভবের দিকে কয়েক সেকেন্ডের দীর্ঘ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে, ভাইয়াকে অনুসরণ করে বের হতে গিয়েও থমকে গেলো। অনুভবের কন্ঠে থমকে যেতে বাধ্য হলো,,

জোসনাকন্যার
জোসনাস্নান
হৃদস্পন্দন করলো
আত্মদান…(রোকসানা)

“” আপনি নিজেকে কি মনে করেন? নাট্যকার? গীতিকার,সুরকার?? যখন তখন যাতা শব্দ মিশিয়ে সুর টানছেন? কি ভেবেছেন? সৃজনশীলের সব ‘কার’ আপনি একাই পুটলিতে ভরবেন? তাও আমাদের বাড়ীতে এসে? সবাইকে চমকে দিয়ে জয়জয়কার শুনবেন? সবকিছু এতোই সহজ? হাতের মোয়া?””

রিপ্তি কথার তেজের সাথে সাথে অনুভবের খুব নিকটে এসে দাড়িয়েছে। দুজনের মধ্যে দুরত্ব নামমাত্র!অনুভব, রিপ্তির লালআভার চোখ ছেড়ে কথার প্যাচে ভিজে উঠা ঠোঁটের দিকে গভীরদৃষ্টি ফেলে বললো,,,

“” ঢেউভাঙা ঠোঁট!””

অনুভবের কন্ঠে ছোট্ট বাক্যতে রিপ্তির রাগ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। চোখে,মুখে উগ্রভাব সস্পষ্ট। ঘনঘন নিশ্বাস ত্যাগ করে আচমকায় অনুভবের কলার চেপে ধরলো,,,

“”আপনি যখন হঠাৎ এমন ছোট্টবাক্য ঢেলে দিয়ে প্রমাণ করেন আপনি বোবা নন,আপনিও কথা বলতে জানেন। শুধু আমার সামনেই আপনার কথার গাছ শূন্য! তখন আমার কি করতে ইচ্ছে করে জানেন? ইচ্ছে হয় আপনার শরীরে জড়ানো জামাকাপড় খুলে পুরো শরীরে ব্লেডের আচড় বসিয়ে দিতে। প্রত্যেকটা আচড়ে টকটক লালরক্ত ঝর্ণার রুপে যখন বেয়ে আসবে তখন মনে হবে এগুলো রক্ত নয়,আপনার কথার গাছের শূন্যতা কাটিয়ে নতুন করে কথার কুড়ি ফুটছে!””

রিপ্তি মনের জ্বালা জবানবন্দীতে মিটিয়ে অনুভবের কলার ছেড়ে দিলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে চোখ বন্ধ করেছে। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে আর বন্ধ করতে পারছেনা। বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে চোখের পাতা। নিষ্পলকে চেয়ে আছে অনুভবের ব্যস্ত হাতে,যা অনুভবের শরীরে জড়ানো সেই কালো অদ্ভুত পান্জাবী খুলায় নিয়োজিত!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here