ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,০৭,০৮

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,০৭,০৮
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৭)

রিপ্তি বেশ জোর প্রয়োগে দরজা খুলে ফেললো। বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে লাল চাদরে মোড়ানো,আধশোয়া অনুভবের দিকে!

গভীর মনোযোগে ফোনে চোখ বুলোচ্ছে অনুভব। চোখের পাতা পড়ছেনা। কপালে ভাজ পড়ে আছে। পাতলা লাল চাদরটা দিয়ে বুক অব্দী ঢাকা। কিন্তু পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটের গুনগুনের সাথে দুপায়ের বৃদ্ধাআঙুলে চলছে নাচুনি নৃত্য!

রিপ্তি চড়া মেজাজ নিয়ে অনুভবের সামনে দাড়ালো,গলা উচিয়ে বললো,,,

“” সমস্যা কি আপনার? আপনি এখানে কি করে এলেন? আমি যেখানে যাবো আপনাকে সেখানেই যেতে হবে?? কেন এসেছেন এখানে?? আমাকে জ্বালাতে না পেরে পেট খারাপ হয়েছে?? আমাদের বাড়ীতে টয়লেট নেই?? এক বাড়ীর পেট খারাপ আরেকবাড়ীতে সারতে চলে এসেছেন?? আল্লাহ কি আপনার চোখে লজ্জার পাতা দেয়নি?? আপনার মধ্যে লজ্জানামক সামান্য অনুভূতির খোলসটুকু নেই?””

রিপ্তির চড়াগলার প্রশ্নসুঁচ বাকা হয়ে ফেরত আসছে। অনুভবের দিকে স্বল্প জাগরণের ক্ষতটুকুও সৃষ্টি করতে পারেনি। তার পাশে যে কেউ আছে,কেউ কিছু বলছে সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে তার মতো আপনমনে ফোন টিপছে। গানের সুরের টান বজায় রাখতে গলা কাঁপিয়ে টান দিলো,,,

“” কাল তো ছিলাম ভালো,,
আজ আমার কি হলো??

অনুভবের গানের মাঝেই রিপ্তি ওর ফোন কেড়ে নিলো। মেঝেতে আছাড় মেরে বললো,,

“” এতোদিন তো বোবা ছিলেন,এখন কি কালাও হয়ে গেলেন?? আমার কথা আপনার কানে ঢুকছেনা? ঢুকিয়ে দিবো??””

রিপ্তির গরম চাহনিতে খুব একটা প্রভাব পড়ছেনা অনুভবের। সবার মায়া চোখে চোখ আটকালেও অনুভবের এই গরম চোখে আটকাতেই ভালো লাগে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো রিপ্তির চোখের কোটরে ভাসছে। নাকের ডগার লালরাগটুকু ভ্রুযুগলের মাঝে রাখতে ইচ্ছে করে! যার নাম দিবে রাগটিপ!!

রিপ্তি আরেকটু কাছে এসে দাড়ালো। অনুভবের দিকে ঝুকে এসে বললো,,

“” এগুলো গান? গানকে অপমান করছেন?? আপনার কি মনে হয় ভুলভাল গান বললেই সবাই আপনার পা ধুয়ে পানি খাবে?? আপনার পা বাতাসা?? কোন দুনিয়াই হারিয়ে এসব গান খুজে আনেন? আনেন তো আনেন আবার মেয়েলি গান। বুকের আঁচলের জায়গায় বলছেন শাড়ীর আঁচল! শাড়ী পড়তে শখ হয়েছে নাকি যে গান গাইতে গাইতে শাড়ী পড়ে ফেলেছেন?””

অনুভব মিস্টি হাসলো। বেডের দেয়াল ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। রিপ্তির সাথে সন্ধি রেখে সেও ওরদিকে একটু ঝুকে এসেছে। ডান হাতের বৃদ্ধা আর শাহাদাৎ আঙুলসহিত রিপ্তির থুতনি চেপে ধরে বললো,,,

“” ক্রোধান্বিতা!””

রিপ্তির গরম চোখ নরম হয়ে এসেছে। গভীর আগ্রহ আর উৎসুক নয়ন। চেয়ে আছে অনুভবের অধরে। আবার কি নড়বে? বলবে কিছুবাক্য?? এই মানুষটা কেন বুঝেনা তার সামনে এলেই আমার বুকটা পিপাসায় মরিয়া হয়ে উঠে। সস্থিরচিত্ত অস্থিরচিত্ত হয়ে উঠে তার মুখের বুলি শোনার জন্য। কিন্তু কেন? কেন এতো মরিয়া? কেন এতো শুকনো তৃষ্ণা? কেন এতো উৎসুক? কিই বা শুনে মন প্রলয়ে উড়তে চায়??

রিপ্তির চোখ নরম পানিতে ছেয়ে যাচ্ছে। ছুটতে চাইছে অবাধে। কিন্তু রিপ্তি দিবেনা ছুটতে। এই মানুষটার সামনে তো নাইই। নরম পানি গরমের মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে চোখের চারপাশেই বন্দী হয়ে রইলো। অনুভবের দিকে ছলছল নয়নে কোমলসুরে বললো,,

“” চলে যাননা প্লিজ!””

রিপ্তির অনুরোধের সুরটা শান্ত হলেও বড্ড বেশি জোর। অনুভবের ইচ্ছে হলো এই জোরটা ধরে রাখতে কিন্তু চাইলেই কি সব করা যায়?? তার মতিভ্রম যে এখন তার হাতে নেই। হারিয়ে গিয়েছে সে কারো মাঝে,কারো মায়ার অন্তরালে আপনমনে জায়গা করে নিচ্ছে নিজের বিস্তৃতের!

অনুভব রিপ্তির ছোয়া থেকে হাতটা দুরে সরিয়ে নিয়েছে,চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক। হালকা নড়ে বসলো। কিছু বলার ভঙ্গিমায় হাতটা নাড়িয়ে আবার মাঝপথেই থমকে রইলো। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে মেঝের দিকে চোখ। ভাঙা মোবাইলের ব্যাটারী আলগা হয়ে দুরে ছিটকে আছে।

মুহুর্তেই অনুভবের সহজমুখটাতে পরিবর্তনে চলে এসেছে। রিপ্তির পুরোমুখে একবার চোখ বুলিয়ে মুচকি হাসলো। অনুভবের হাসির মানে খুজায় ব্যস্ত রিপ্তি। তারমাঝেই লাল চাদরটা টেনে অনুভব বিছানায় শুয়ে পড়লো। উল্টোঘুরে আপাদমস্তক ঢেকে গুনগুনের অস্পষ্ট সুর।

অনুভবের অকস্মাৎ কান্ডে রিপ্তি হতবাক। যদিও তার দ্বারা এমন আচরণ নতুন নয়,তবুও! মনের খুব গভীরে ছোট্ট আশা ছিলো হয়তো এবার অন্য কিছু হবে। রিপ্তি বিছানা ছেড়ে নেমে দাড়ালো,কোমড়ে দুহাতের শক্ত চাপ,তীব্র তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো ঘনঘন। নাক ফুলিয়ে চিৎকার করে উঠলো,,

“” গায়ের জোর দেখাচ্ছেন? আপনার কি মনে হয় গায়ের জোরে সব করতে পারবেন?? দিবোনা করতে! আপনাকে ঘায়েল করতে আমি অন্যজোর দেখাবো। ভুলে যাবেননা মেয়েদের গায়ের জোর না থাকলেও অন্য জোর আছে! আর আমি সেগুলোই আপনার উপর চালান করবো,ধারালো অস্ত্রের মতো আপনার সব ক্ষত করে দিবো। হুহ!””

রিপ্তির উচুগলার কথাগুলো যেন হাওয়ায় ভাসছে। অনুভব তারমতো ভারী নিশ্বাস ফেলে ঘুমাচ্ছে। রিপ্তির দিকে তার বিচলিতভঙ্গি!

রিপ্তি আর সহ্য করতে পারছেনা। রাগের শেষপর্বের শেষ সীমানায় সে বিচরন করছে। অনুভবকে যে কি করতে ইচ্ছে করছে সেটাও বুঝে আনতে পারছেনা। ছোটবেলা সাদাকালো টিভিতে বাবার সাথে শক্তিমান দেখতো। তার অনেক শক্তি,আকাশে উড়তে পারে,যাকে তাকে নিয়ে উড়তে পারে। রিপ্তিরও ইচ্ছে হলো শক্তিমান হতে,অন্তত এই লাল ব্যাঙটাকে নিয়ে উড়ে গিয়ে কোনো নর্দমায় ফেলে দেওয়ার জন্য হলেও তার শক্তিমান হওয়ার ইচ্ছে!

রিপ্তি আর সময় ব্যয়ের অপেক্ষা না করে খাটের কর্ণারের টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো। পানিভর্তি জগটা নিয়ে উল্টো করে অনুভবের গায়ে ঢেলে দিয়ে বললো,,,

“” আজ থেকে তোর নাওয়া,খাওয়া,শোয়া সব বন্ধ। আমাকে জ্বালানো? আমাকে রাগানো?? আমার সামনে নাটক করা? মঞ্চ সাজানো?? এর শেষ দেখবো আমি,হাতে ট্রফি নিয়ে। এই খেলার হার জিতে রিপ্তি জয়ী হবে! হবে! হবে!! হতেই হবে!!!””

সারারাতের পড়ে থাকা হিমবাসী পানির গোসল সেরে উঠতে বাধ্য অনুভব। চোখ তার গোল রসগোল্লা,মুখে বিশালআকারের গুহা,শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গে ফুটে উঠছে অবিশ্বাস্যতা। রিপ্তির করে ফেলা কান্ডে নয়,বলে ফেলা কথার ধরনে।

অনুভবের রুম ছেড়ে চটপট পা চালাচ্ছে রিপ্তি। তার মাঝেই ভাবীর গলা পেলো,,,

“” তোমাকে দিয়ে একটা কাজও হয়না,রাসেল। এতো ভোরে শখ করে বাজারে পাঠালাম। আর তুমি? বাজার ছেড়ে আরেক গ্রামে গিয়ে হারিয়ে বসে আছো। এই তোমার পড়াশুনার গতি?? এই ব্রেন নিয়ে জাবিতে কি পড়াশোনা হচ্ছে তোমার?? চিনোনা বললেই পারতে,আমি বাবাকেও তোমার সাথে দিয়ে দিতাম। আসলে ভুল তোমার না আমারি! আমার ভুলের জন্য আমার মেয়েটাকে তার পছন্দের মাছের ঝোল খাওয়াতে পারলাম না।””
“” এতো রেগে যাচ্ছো কেন? আমিতো..””
“” চুপ আর একটা কথাও বলবেনা৷ আমার সারাবেলাটা চলে গিয়েছে। মেয়েটাকে নাস্তা খাওয়ানো হলোনা৷ তারমধ্যে বাসায় আমিও নেই। নিশ্চয় কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে ফেলেছে!””
“” এখানে কান্নার কি আছে?? রিপ্তি কি বাচ্চা? আর এমনিতেও ও বাসাতে বেলা করেই উঠে।””
“” তোমাকে বলেছিনা কথা বলবে না তাও কেন বলছো?? আমাদের দুজনের মাঝখানে তুমি কেন আসছো?? ভুল করেছো তা তো স্বীকার করছোইনা তার উপর আমাকে বিরক্ত করছো। এজন্যই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি। আমিতো জানতাম তুমি কেমন ছেলে,শুধু তোমার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে মনে বাধা লাগছিলো তাই।””
“” মিনি,শোনো তো..””
“” চুও আর একটা কথাও বলবেনা৷ আজ থেকে তোমার নাওয়া,খাওয়া,শোয়া বন্ধ! দেখি আমার আড়ালে তোমাকে কে খেতে দেয়।””

ভাবীর কন্ঠের ধার ধরেই এগিয়ে যাচ্ছিলো রিপ্তি। কিন্তু পৌছোনোর আগেই পা আটকে গেলো। তার নিজেরই বলে আসা কথা তার কানে পুনরায় বাজবে এটা তার অভাবনীয় ছিলো। ভাবী ভাইয়াকে বলেছে,দুজনের মধ্যে ভালোবাসা আছে,একটা শক্ত বন্ধন আছে তারা বলতেই পারে। যার সাথে ভাব,তার সাথেই তো রাগ হবে। কিন্তু আমার কেন হয়? কেন হলো? উনার সাথে তো আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তেমনভাবে আলাপও হয়নি। যা হয়েছে তা তো এক পক্ষের,শুধু আমারি। তাহলে?? আসলেই কি এক পক্ষের?? সবটাই কি অনিচ্ছাতে হয়েছে??

রিপ্তি, ভাই আর ভাবীকে দেখছে গভীর নয়নে। দুজনেই মেতে আছে ভালোবাসার খুনসুটিতে। বেশ লাগছে দুজনকে! একদম চমৎকার সই!! আচ্ছা আমি যখন লাল ব্যাঙের সাথে ঝগড়া করি তখন আমায় কেমন দেখায়?? বাজে দেখায়,খুব বাজে। আমাকে নয়,লাল ব্যাঙকে! বদমাশ একটা,জীবনটা আমার ত্যানা ত্যানা। কোথায় ভাইয়া আর কোথায় সে। আরে,আমি বারবার কেন ভাইয়া আর ভাবীর জায়গায় আমাদের কল্পনা করছি? তাহলে কি আমি মনে মনে উনাকে স্বামী!! ছি! ছি!! ছি!!! এই লাল ব্যাঙটা আমার স্বামী হতে যাবে কেন? দুনিয়াই কি ব্যাঙের থুক্কু ছেলের অভাব পড়েছে?? যদি কিছুর অভাব পড়ে থাকে তা পড়বে ছেড়াভবের! ছেড়াভবের বউয়ের অভাব হবে।

রিপ্তি দু’হাতে মোনাজাত তুলে উপরে তাকিয়ে দোয়া করলো,,আল্লাহ! এই দুনিয়ার শুধু মেয়ে কেন,যত ব্যাঙানি আছে সবাইকে জলদি জলদি বিয়ের আসরে বসিয়ে দাও। এই ছেলের কপালে যেন বউ না জোটে! আর ভুলেভালে যদি প্রেম হয়ে যায় তাহলে যেন ছ্যাকা খায়। আমিন!

~~~

রিপ্তি বাসি নাস্তায় মুখ ডুবিয়েছে। টিভির সামনে বসে পায়ে পা তুলে গরুর ঝোলে রুটি ভিজাতেই অনুভবের রুমে হাউকাউ।

রিপ্তি কানখাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে ঠোঁটে ঝুলছে ছেলেমানুষি হাঁসি! মুখে হাফ রুটি ঢুকিয়ে মাংসে কাপড় পড়েছে তারমাঝেই ভাবী ছুটে এলেন। ওর পাশেই ধপ করে বসে পড়েছে। শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলো। রিপ্তির জন্য রেখে যাওয়া পানির গ্লাসটা নিজের দখলে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। রিপ্তি তৃপ্তির হাসি ছেড়ে এক টুকরো রুটি শেষ হয়ে যাওয়া ঝোল মুছে ভাবীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,,

“” ক্ষিদে পেয়েছে ভাবী? হা করো আমি খায়িয়ে দেই।””

মিন্মি কোনোরকম বাধা না দিয়ে টুপ করে রুটিটা মুখে পুড়ে বললো,,,

“” আমাদের গায়েও চোর এসেছে? তাও কাপড় চোর? ভয়ানক ব্যাপার রিপু।””
“” তোমাদের গায়ে চোর আসা নিষেধ?””
“” তা নয়,কিন্তু আমার ২৩ বছর জীবনে চুরি হওয়ার তো দুর কিছু হারিয়ে গিয়েছে তাও শুনিনি।””

রিপ্তি রুটির শেষাংশটাতে এক টুকরো মাংস লুকিয়ে ভাবীর মুখের দিকে ধরে বললো,,

“” চব্বিশ বছর জীবনেতো শোনছো! তুমি এককাজ করতে পারো,কাঁচের ফ্রেমে এই ডেটটা বন্দী করতে পারো। তারপর দেয়ালে সাজিয়ে রাখবে।””

মিন্মি,এক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,,

“” বুদ্ধীটা মন্দ না।””

এর মধ্যেই মিন্মির মা হন্তদন্তে দৌড়ে এলেন,,,

“” কী ভয়ানক কান্ড রে মিন্মি,শুধু অনুভব নয়,তোর জামাই আর তোর বাবার সব কাপড়ও হাওয়া! আমার মনে হয় চোর না চুন্নি এসব করেছে..””

রিপ্তির কানে চুন্নি শব্দটা আসতেই ও ভিষম খেলো। গলায় রুটি আটকে গিয়েছে। মিন্মি চটজলদি ওর মুখে পানি ধরতেই পাশ থেকে অনুভব বললো,,,

“” ঠিক বলেছেন আন্টি,চুন্নিটা মনে হয় গরুর মাংস খুব পছন্দ করে। রুমের মধ্যে কেমন মাংসের গন্ধে ভরে আছে!””

রিপ্তির গলায় এবার পানিও আটকে গেলো। নিজের মাথায় নিজেই হাতের তালু ঠেকাতে ঠেকাতে সরু চোখে অনুভবের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাল টাওয়াল জড়িয়ে ভেজা শরীরে দাড়িয়ে সে। চোখে সন্দেহদৃষ্টি!

মিন্মি অনুভবের দিকে তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে হতাশ গলায় বললো,,

“”মা,কিছু তো করো,অনুভব ভাইয়া আর কতক্ষণ এভাবে টাওয়াল পড়ে থাকবে?””

ভাবীর কথা টেনে নিয়ে রিপ্তি উত্তর দিলো,,

“” ভাবী,উনার শাড়ী খুব পছন্দ। আর লাল রঙ হলে তো কথাই নেই। তুমি বরঙ উনাকে তোমার বেনারশিটা এনে দাও! দেখবে আহ্লাদে বারোখানা হয়ে যাবে!””

রিপ্তির কথাতে রাসেল হো হো হো করে হেঁসে উঠলেও বাকি সবাই তাজ্জব বনে রইলো। রিপ্তি ধীরপায়ে অনুভবের পাশ কেটে যেতে যেতে বললো,,,

“” নাওয়া আর শোয়ার পালা শেষ,এবার খাওয়ার পালা!””

~~~

বাসী নাস্তায় পেট ভরে, রিপ্তি আলসেভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে ছিলো। অনুভবকে এমন জব্দ করতে পেরেছে সেই খুশিতে তার চোখ লেগে এসেছিলো। ক্লান্তঘুম ছেড়ে উঠতে উঠতে বেলা তিনটে। এতো ভালো ঘুম হয়েছে যে,মন তার ফুরফুরা। এবার শরীরটাকে ফুরফুরা করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন ঠান্ডা পানির লম্বা গোসল। রিপ্তি কাপড় গুছিয়ে গোসলখানায় ঢুকে দেখলো সাবান নেই। কাপড় গোসলখানায় রেখেই ভাবীকে ডাক পারতে পারতে রুম ছেড়ে বেরিয়েছে।

সাবান নিয়ে গোসলখানায় ঢুকেই রিপ্তি চিৎকার করে উঠলো,,,

“” ভাবী!””

মিন্মি ননদের কন্ঠে পেয়ে দৌড়ে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,,

“” কিরে কি হয়েছে?””
“” আমার কাপড় কোথায় গেলো?””
“” কাপড় কোথায় গেলো মানে?””

রিপ্তি গোসলখানার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,,

“” আমিতো এখানে কাপড় রেখেই তোমার কাছে সাবান আনতে গিয়েছিলাম!””
“” কি বলিস? তাহলে কি এবার বাড়ীতে চুন্নির সাথে চোরেরও আগমন ঘটলো?””

রিপ্তির চিৎকারে বাড়ীর সকলেই উপস্থিত ছিলেন। মিন্মির মা আৎকে উঠে বললেন,,

“” কী সর্বনাশের কান্ড রে মিন্মি। এবার কি বাড়ীর মেয়ে, বউদের কাপড় ও চুরি হয়ে গেলো? এ কেমন কাপড় চোর এসেছে রে আমাদের গায়ে? এরা নির্ঘাত স্বামী স্ত্রী হবে বুঝলি?””

মিন্মির মা আন্দাজীর ঢিল ছুড়ে মারতেই পেছন থেকে অনুভবের কন্ঠ,,,

“” চোরটা ইয়াং বয়সের আন্টি। তাই ইয়াং গার্লদের কাপড় চুরি করেছে। বেশ ভদ্রও তাই আপনার কোনো কাপড়ে হাত দেয়নি।””

সকলের চোখ অনুভবের দিকে। দরজার কাছে দাড়িয়ে,হাতে ভাতের প্লেট,ভাত মাখাচ্ছে। আঙুলের আবদ্ধে দলা পাকিয়ে মুখে নিতেই রিপ্তি দৌড়ে এলো। অনুভবের ভাতের হাত টেনে নিয়ে নিজের মুখে পুড়েছে। সাথে ভাতের প্লেটটাও কেড়ে নিয়ে বললো,,,

“” আপনি যে একটা খাটি নির্লজ্জ,বেহায়া,বেশরম,কুটিল বাজ তা আজ প্রমাণ করে ছাড়লেন!””

অনুভব রিপ্তির কথা গায়ে মাখলোনা। মিন্মির মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,,

“”আন্টি আপনি চাইলে আপনার শাড়ী দিয়ে উনাকে সাহায্য করতে পারেন। বেচারী কতদিন গোসল না করে থাকবে বলুন!””

অনুভব ঠোঁটে বাকা হাঁসি নিয়ে রুম ত্যাগ করবে তার আগে রিপ্তির দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে আবার বললো,,

“” শাড়ীর সাথে সুই সুতোও গিফট দিয়েন। ফিট করতে কাজে লাগবে!””

চলবে

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৮)

অনুভব ঠোঁটে বাকা হাঁসি নিয়ে রুম ত্যাগ করবে তার আগে রিপ্তির দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে আবার বললো,,

“” শাড়ীর সাথে সুই সুতোও গিফট দিয়েন। ফিট করতে কাজে লাগবে!””

অনুভব শব্দ করে হেঁটে যাচ্ছে। রিপ্তির ধৈর্যভার চোখ তার উপর। এমন কথাগুলো সে চুপচাপ কি করে সহ্য করলো?? চোর সবার সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে অথচ সকলে চুপ। মানছি ওরা জানেনা,কিন্তু আমি তো জানি,তবুও কেন চুপ করে আছি? কেন চিৎকার করে বলতে পারছিনা,আপনি কোন অধিকারে আমার জামাকাপড়ে হাত দিয়েছেন?? একজন পুরুষ হয়ে একজন মেয়ের জামাতে হাত দেওয়া মানে তার শরীরে হাত দেওয়া! এতদুর এগুতে আপনার বিবেক বাধা দেয়নি??

রিপ্তির গাম্ভীর্যভাব হঠাৎই মিলে গেলো শূন্যতায়। এই লোকটা তো মানুষের কাতারেই পড়েনা তাহলে তার বিবেক আসবে কিভাবে??

রিপ্তি একআকাশ সমান বিরক্ত নিয়ে গোসলখানার দিকে তাকিয়ে রইলো!

~~~

“” নে,এগুলো ধর। মায়ের শাড়ী এটা। তোকে খুব ভালো লাগবে। গোসল করে এগুলো পড়ে নিস। বেলা তো গড়িয়ে যাচ্ছে। বেশি দেরি করে গোসল করলে ঠান্ডা লেগে যাবে!””

রিপ্তি ভাবীর হাত থেকে অফহোয়াইট রঙের সুতির শাড়ীটা হাতে নিলো। শাড়ীর ভাজে থাকা ব্লাউজ মুখের সামনে ধরে বললো,,

“”আন্টি আসলেই এতো মোটা,ভাবী? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা।””

মিন্মি মুচকি হেঁসে রিপ্তির হাতে সুই আর সুতো দিয়ে বললো,,,

“” বয়সের দিক থেকে দেখতে গেলে আম্মুও মোটেও মোটা না,রিপিসোনা। তুমি খাওয়াদাওয়াই আরেকটু খেয়াল রাখো,যাতে দ্বিতীয়বার যখন আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে আসবে,চোরকে নিয়ে কোনো চিন্তায় থাকতে নাহয়।””
“” খাওয়ার সাথে চোরের কি সম্পর্ক?””

রিপ্তির প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই মিন্মি বেরিয়ে এলো।

রিপ্তি দরজা আটকে নিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়েছে। পড়নের জামার উপরেই ব্লাউজটা পড়ে বোতাম আটকালো। আয়নায় তাকিয়ে রিপ্তির আহতমন বলে উঠলো,এর মধ্যেতো আরেকটা রিপ্তি অনায়াসে ঢুকতে পারবে।

রিপ্তি চটপট ব্লাউজটা খুলে অনিচ্ছাতে সুই হাতে নিলো। সুইয়ে সুতা ঢুকাতে গিয়েনঅনুভবের কথা মনে পড়ে গিয়েছে,,লাল ব্যাঙ কি করে জানলো? আমার সুই সুতো কাজে লাগবে? তারমানে?? ছি! ছি!! ছি!!! ইচ্ছে তো করছে ব্লাউজে না আপনার চোখে সুই ঢুকিয়ে দেই!
~~~

“” রিপ্তি আপু,তুমি এখনো গোসল করোনি? আপু যে বললো,তোমাকে নিয়ে মার্কেটে যাবে!””

মিশির কথাতে রিপ্তির মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। এভাবে সেলাই করে কি ব্লাউজ ফিট করা যায়?? করা গেলেও সে করবেনা৷ যে সমস্যা তৈরী করেছে তার সমাধান ও কিছুতেই নিবেনা। দরকার হলে একদিন কেন সাতদিন গোসল করবেনা। এটা কি এমন কঠিন কাজ? গোসল না করলে কি এমন ক্ষতি হবে? গন্ধ বের হবে তো হলে হবে! তবুও গোসল করবে না! করবে না,করবেইনা!!!

“” অনুভব ভাইয়া!””

অনুভব নামটা কানে যেতে রিপ্তির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চেতনা থেকে ফিরে এলো। একবার মিশির দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই দরজায় চোখ পড়লো। অনুভব বাকা হয়ে দাড়িয়ে আছে,কোথাও যাচ্ছিলো,মিশির ডাকে দাড়িয়েছে। এখনো এদিকটা ঘুরেনি,পড়নে এখনো লাল টাওয়াল। তবে শুকনো। বিকেলে যখন দেখেছিলো তখন খেয়াল না করলেও মনে হচ্ছে ভিজে ছিলো। রিপ্তি নাক সিটকে মনে মনে আউরালো,লজ্জা শরম কিছু নাই। সামান্য টাওয়াল পড়ে পুরো বাড়ি চষে বেড়াচ্ছে। সবাইকে শরীর দেখিয়ে বেড়াচ্ছে।

আহা! কি আমার শরীর রে
ধুলোর কণার জমাট মশারী!!!

এতোই যখন শরীর দেখানোর শখ,তো যা না পতিতালয়ে। ও থুক্কু,ব্যাঙালয়ে!

“” অনুভব ভাইয়া এদিকে একটু আসোনা। শো-কেসের উপর আমার জরির ব্যাগটা। নাগাল পাচ্ছিনা।””

মিশির অনুরোধে অনুভব ভেতরে ঢুকছে। মিশির কাছে এগুতেই রিপ্তি দুজনের মাঝে দেওয়াল হয়ে দাড়ালো। অনুভবের দিকে ভারী দৃষ্টি। পা ছেড়ে পেটের দিকে উঠেই রিপ্তি চোখ সরিয়ে নিলো। এমন নগ্ন শরীরে মিশিকে কোলে নিবে নাকি?? নিবে নাই কেন? শুধু তো চোখে না,শরীরের শিরা উপশিরাতেই নোংরামী। সুযোগ পেয়েই দৌড়ে এসেছে বাচ্চা মেয়েটাকে কোলে নিতে। নোংরালোক কোথাকার। রিপ্তি ঠান্ডা কন্ঠে বললো,,

“” মিশি আমাকে বললেই পারতে। আমি নামিয়ে দিতাম।””

মিশির পরিষ্কার উত্তর,,

“” তুমি পারবেনা,আপু!””

রিপ্তি কন্ঠে জোর এনে বললো,,

“” পারবো।””
“” কি করে? উচ্চতায় তুমি আর আমিতো প্রায় সমান। অনুভব ভাইয়া লম্বা আছে উনি পারবেন।””

মিশির কথায় রিপ্তি আড়চোখে শো-কেসের উচ্চতা মেপে নিলো। তারমানে অনুভব কোলে নিতে আসেনি,নিজে নামিয়ে দেওয়ার জন্য এসেছিলো?? ধ্যাত,আমিও আছি,পুকুরের গভীরত্ব না বুঝেই ঝাপ দিয়েছি। এখন তো লজ্জায় নিজেই ডুববো। কি করি?? রিপ্তি অনুভবের শোচালোদৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারছেনা। এবার তার আফসোসের ভান্ডারে আরেকফোটা আফসোস জমলো। সে কেন ছেলেদের মতো লম্বা হলোনা?? আল্লাহ কেন,ছেলেদেরকে লম্বার দিকেেও এগিয়ে রাখলো,উফ! জীবনটা আমার লজ্জায় আর আফসোসেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

রিপ্তি অনুভবের দিকে তাকিয়ে একটু ভাব ধরলো,গলা পরিষ্কার করে,জামার হাতা গুটিয়ে নিয়ে বললো,,

“” তো কি হয়েছে মিশি?? আমি তোমাকে লম্বা বানিয়ে দিবো।””
“” মানে?””

রিপ্তি চোখে ভাবময়ী হাঁসি এনে বললো,,

“” তোমাকে উচু করে!””

মিশিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর কোমড় চেপে ধরেছে রিপ্তি। নিজের সর্বস্বশক্তি পেশিতে এনে দুর্বল গলায় বললো,,,

“” ব্যাগটা পেয়েছো মিশি?””
“” কি করে পাবো? আগে তো উচু করো!””

রিপ্তি মাথা তুলে উপরে তাকিয়ে নিরাশ হলো। মিশি যেমনটি মাটিতে দাড়িয়েছিলো এখনো তাই আছে। তাহলে তার শরীর কাঁপুনি জোরটা কোথায় পড়লো???

রিপ্তি লুকায়িত দৃষ্টিতে অনুভবের দিকে তাকাতে চাইলেও ওর দৃষ্টিকটু নজরে ধরা পড়েছে। অনুভবের পেশিবহুল হাতদুটো বুকে বাধা,কটুদৃষ্টি,এক ভ্রূ খানিকটা বাকা,চোয়াল শক্ত। এমনভাবে দাড়িয়ে আছে যেন রিপ্তির কান্ডে সে ভুল করে বিরক্তের রাজ্যে ঢুকে পড়েছে। রিপ্তির কষ্ট হলো,এমন আশাভঙ্গ হবে বুঝতেও পারেনি। এভাবে যেচে এসে হেরে বসবে তা কি ও ভেবেছিলো? রিপ্তির কান্না পাচ্ছে। এই লোকটার সামনে হেরে যেতে ওর একটুও ভালো লাগেনা। কেমন জানি কান্না কান্না হার মনে হয়।

“” বলেছিলাম না পারবে না? শুধু শুধু আমাকে দেরি করালে আপু!””

রিপ্তি মনে মনে সাহস জুগিয়ে বললো,,

“” একবার না পারিলে,দেখ শতবার!””

রিপ্তি মনে মনে আল্লাহর উপর গভীর বিশ্বাস নিয়ে বিসমিল্লাহ্ উচ্চারণ করছে। দ্বিতীয়বারের মতো মিশিকে উচু করতে গিয়ে নিজেও উচু হয়ে যাচ্ছে। আরে আমার বিসমিল্লাহর এতো জোর?? রিপ্তি মনে মনে শতশত বিসমিল্লাহ পড়তে পড়তে ঠোঁটে হাসি ফুটাচ্ছে। ঠিক তখনি কানের কাছে নিভু ধ্বনি,,

তোমার কোমড়ে আমার হাত,
কাটাবো আরেকটি গুমোট রাত!!!(রোকসানা)

অনুভবের গানের সুরে রিপ্তির দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। সে নয়,বরংচ অনুভবই তাদের দুজনকে হাওয়াই উচিয়ে ধরেছে। রিপ্তির মুখ লালচে ভাব আসতেই অনুভব মিশির উদ্দেশ্যে বললো,,

“” মিশি,তোমার শরীরের চিকন গড়নে তো বুঝাই যায়না,তুমি….””

অনুভবের কথার মাঝেই রিপ্তি মিশিকে ছেড়ে দিয়ে এক হাতে অনুভবের মুখতো অন্য হাতে চোখ চেপে ধরে বললো,,

“”খবরদার,আর একবার যদি মিশির দিকে তাকিয়েছেন তো আপনার চোখ আমি গেলে দিবো। আপনার এই নোংরা চোখ থেকে এই বাচ্চাটাকে তো রেহাই দিন।””
“” আপু!””

মিশির কাঁদো কাঁদো কন্ঠে রিপ্তি আৎকে উঠলো। কি করতে গিয়ে কি করেছে? নোংরা দৃষ্টি থেকে বাঁচাতে গিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়েছে? আল্লাহ! কোমড় ভেঙে যায়নি তো?

~~~

খাবার টেবিলে মনমরা হয়ে বসে আছে রিপ্তি। বাসায় মোট সাতজন সদস্য থাকা সত্ত্বেও ডাইনিংয়ের বেশিরভাগ চেয়ারগুলোই ফাঁকা। ভাবী,ভাবীর মা আর সে বাদে সকলেই অনুপস্থিত।

“” কিরে,খাচ্ছিস না কেন?””

ভাবীর কন্ঠে রিপ্তি নড়ে বসলো,,

“” ভাইয়া কোথায়?””
“” আমি কি জানি?””
“” তোমার বর,তুমি জানো না?””

মিন্মি গ্লাসে পানিভর্তি করতে করতে বললো,,

“” বর হলে কি আমায় সব জানতে হবে?””

ভাবীর এমন বেরসিক উত্তরে রিপ্তির সকালের ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ভালোবাসার খুনসুটি কি এখনো চলছে? খুনসুটি হওয়া ভালো তবে দীর্ঘ হলে মুশকিল! এতে দুজনের মনেই আঘাত আনে। রিপ্তি চেয়ার ছেড়ে উঠলে মিন্মি বললো,,

“” কোথায় যাচ্ছিস?””
“” ভাইয়াকে ডাকতে।””

রিপ্তি ভেবেছিলো ভাবী ধমক দিয়ে তাকে আবার বসিয়ে দিবে। কিন্তু না তেমনটি ঘটনি। মিন্মি চুপ। খালি প্লেটে ভাত বারায় মনোযোগ দিয়েছে। যার মানে এই,আচ্ছা যা!

রিপ্তি খুশিমনে দুকদম এগুতে পেছন থেকে মিন্মি বলে উঠলো,,

“” অনুভব ভাইয়াকেও ডেকে দিস তো।””
“” পারবো না।””

রিপ্তির এমন পরিষ্কার গলার না তে বেশ অবাক হয়েছে মিন্মি। ভাতের চামচ নিয়েই এগিয়ে এসে বললো,,

“” এটা কেমন আচরন রিপি? এভাবে কেউ না করে? তুই কি বাচ্চা?””

ভাবীর শাসনিতে রিপ্তির মুখে আধার নেমেছে। ধরা গলায় বললো,,,

“” তুমি যদি বলো,আমি পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারবো,সমুদ্রে আগুন জ্বালিয়ে দিবো,মাটিতে জলোচ্ছ্বাস তুলে দিবো। তুৃমি চাইলে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজটাও আমি করে দিবো। তবুও তোমার অনুভব ভাইয়াকে ডাকতে বলোনা।””
“” সমুদ্রে আগুন জ্বালিয়ে দিবি?””
“” হুম,আমার ভাবীর জন্য আমি এই সামান্য কাজ করতে পারবোনা?””
“”মাটিতে জলোচ্ছ্বাস তুলার থেকেও অনুভব ভাইয়াকে ডেকে দেওয়া কঠিন?””
“” হুম!””

মিন্মি বিস্ময় নিয়ে বললো,,

“” তাহলে তো আমি না বুঝে আমার ননদকে অনেক কঠিন কাজের অর্ডার দিয়ে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস তুমি না করেছিলে রিপি! তুমি খেতে বসো। কঠিন কাজটা আমিই করে আসি।””

মিন্মি অনুভবের রুমের দিকে এগুলেই পেছন থেকে ডেকে উঠলো রিপ্তি,,

“” এবার কি হলো?””
“” তুমি বসো। আমার কঠিন কাজ আমিই করে আসি।””

রিপ্তির দিকে এগিয়ে এলো মিন্মি। নিখুতভাবে খুটিয়ে দেখছে। এই মেয়ের মনে চলছেটা কি??

“” এই যে বললি,পৃথিবী ধ্বংস করে দিবি তাও অনুভব ভাইকে ডাকতে পারবি না!””

রিপ্তি ততক্ষণে হাঁটা ধরেছিলো। থেমে বললো,,

“” উনাকে না লাল ব্যাঙকে ডাকতে যাচ্ছি।””
“” লাল ব্যাঙ?””

মিন্মি জায়গা বদল করে দাড়িয়ে জমিনে তাকিয়েই আবার বললো,,

“” কোথায় পেলি লাল ব্যাঙ?””

ভাবীর ভয়ার্তমুখটা রিপ্তির বেশ পছন্দ হলো। তার চটজলদি উত্তর,,

“” কেন,তুমি দেখোনি? তোমাদের পুরোবাড়ীতেই তো লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।””

মিন্মি রুমের কোনায় কোনায় চোখ খুচিয়ে বললো,,

“” কোথায়? আমি তো দেখতে পাচ্ছিনা।””
“” এ ব্যাঙ সবাই দেখতে পায়না,ভাবী।””
“” তুই বলতে চাচ্ছিস,শুধু তোকেই এই ব্যাঙ দেখা দেয়,আর কাউকে দেয়না?””
“” অনেকটাই এমন,তবে কথাটা হবে,সবাইকে দেখা দেয়,কিন্তু সবাই দেখতে পায়না।””
“” কেন?””

রিপ্তি ভাবীর প্রশ্ন এড়িয়ে বললো,,

“” এতো চিন্তার কিছু নেই ভাবী। আমি তোমার জন্য L.B. চক্ষু আবিষ্কার করবো। তখন তুমিও দেখতে পারবে।””
“” সেটা আবার কি?””

ভাবীর প্রশ্নে রিপ্তি ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর জ্ঞানীভাব নিয়ে বললো,,,

“” L= লাল আর B= ব্যাঙ। অর্থাৎ লাল ব্যাঙ চক্ষু। এটি এক ধরনের কৃত্রিম চক্ষু। যেটা চোখে পড়লেই লাল ব্যাঙকে দেখা যাবে। তবে এটা এখনো বানানো হয়নি। আমি তোমার জন্য স্পেশালিভাবে বানাবো।””

মিন্মি কিছুটা খোচা মেরে বললো,,

“” পড়ছিস ব্যবসা নিয়ে,আর হচ্ছিস বিজ্ঞানী? আমাকে তোর বোকা মনে হয়? আকার ওকার ছাড়া বলদ? যা বুঝাবি আমি তাই বুঝে নিবো?””

ভাবী চটে যাচ্ছে বুঝতে পেরে রিপ্তি দ্রুত ভাবনার চাল চেলে বললো,,,

“” আরে ভাবী,এটাও তো ব্যবসায়!””
“” এটা কি করে ব্যবসা হলো?””

এবার রিপ্তি বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,,

“” এই ধরো,আমি মোটা অংকের টাকা ইনভেস্ট করে দেশ-বিদেশ থেকে বিজ্ঞানী ভাড়া করে আনলাম। তারপর তাদেরকে দিয়ে এলবি চক্ষু বানিয়ে এটার উপর নানারকম শো শুরু করে দিবো। আমাদের দেশে যেহেতু লাল ব্যাঙ নেই সেহেতু সকলেই উৎসাহসহিত দেখতে আসবে। আমি তো আর এমনি এমনি দেখতে দিবো না। চড়া দামের টিকিট কেটে তারপর দেখতে হবে। লাল ব্যাঙ দেখার জন্য তারা টিকেটও ক্রয় করবে। তারপর সবাইকে একটা একটা করে এলবি চক্ষু দিয়ে বসিয়ে দেবো স্টেজের সামনে। ব্যস! জমে যাবে শো। আমার তো মনে হচ্ছে যদি সাতদিনও এই শোটা করতে পারি তাহলে আমরা কোটিপতি হয়ে যাবো। ধনিদের টপ লিস্টে আমাদের নাম থাকবে!””

রিপ্তির ধনী হওয়ার মনগড়া গল্প মিন্মি হা’করে গিলছে। চোখের পাতা এমনভাবেই আটকে আছে যেন,সে সত্যি সত্যি এলবি চক্ষু লাগিয়ে লাল ব্যাঙের শো দেখছে। রিপ্তির হাসি পাচ্ছে। দুনিয়া কাঁপানো হাঁসি। তবে সে দুনিয়া কাঁপালোনা,ঠোঁট কাঁপিয়ে হালকা হেঁসে অনুভবের রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে।

রিপ্তি চলে যেতেই মিন্মির মুখগহ্বর বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চেতনায় ফিরে এসেছে। তার মুখও ভর্তি হয়ে আসলো মিস্টি হাঁসিতে। হাঁসি নিয়ে ভাত বারাতে মনোযোগ দিলেও আবার মনোযোগ ক্ষুন্ন হয়েছে। মাথার ভেতর ঘুরছে আজকে সারাদিনের ঘটে যাওয়া অদ্ভুত কান্ডগুলো। মুহুর্তেই ভেসে উঠলো অনুভবের মুখটা। এ বাসায় তার আসার কথা ছিলোনা। তবুও এসেছে। কিন্তু কেন?? হতে পারে সে রাসেলে বন্ধু,একসময় মিন্মিরও পরিচিত। একি কলেজে পড়াশোনা ছিলো। তাই বলে কোনো কারণ ছাড়া এ বাড়িতে চলে আসবে?? ভোরবেলায় এসেছিলো অনুভব। রাসেলের ফোন পেয়ে তাড়াহুড়োতে মিন্মি বেরিয়ে যাচ্ছিলো,দরজা খুলতেই অনুভবের ক্লান্ত দুচোখে আটকে যায় মিন্মির পলক। চোখের দুপাশ ফুলে ফেপে ছিলো,এলোমেলো চুলের অগোছালো অনুভবকে দেখে অনেকটায় ভড়কে যায় মিন্মি। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রাসেলের ফোন চলে আসে। ব্যস্ততায় অনুভবকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে তার চোখদুটো বলছিলো সে ঘুমাতে চায়,সারারাত যে তার দুপাতা এক হয়নি! এতো সকালে বাবা উঠেনা,রিপ্তিও ঘুমাচ্ছিলো,তাদের বাসায় আর কোনো রুম ফাঁকা না থাকায় নিজের রুমেই অনুভবকে বিছানা করে দিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলো। তারপর? তারপর এক এক ঘটনা এমনভাবে ঘটে যাচ্ছিলো যে অনুভবের সাথে আলাদা করে কথাটুকুও হয়নি। তবে মনের কোনে কিছুটা সন্দেহের বাসা বাধছে। শুধু অনুভবকে নিয়ে নয়,রিপ্তিও আছে। ওর আচরনগুলোও স্বাভাবিক নয়। দুজনের মনেই কিছু চলছে। কিন্তু কি?

সে রাতে রিপ্তির হাতের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে অনুভব নিজেই ব্যান্ডেজ করেছিলো। ব্যান্ডেজ করার সময় ওর চোখের ব্যাথারপানিটা মিন্মির চোখে পড়েছে। অস্ষ্টতায়ও না খুব বেশি স্পষ্ট ছিলো। রিপ্তিকে সঙ্গে নিয়ে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই যে অনুভবের চোখের দৃষ্টি তুখোড় হয়ে এসেছিলো তাও মিন্মি বুঝতে পেরেছিলো। এমন কি রিপ্তিকে অজ্ঞান অবস্থায় রাসেল যখন কোলে তুলতে যাচ্ছিলো তার পথ আটকে দাড়িয়েছিলো অনুভব। সকলের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে অনুভব নিজে রিপ্তিকে গাড়ীতে দিয়ে এসেছিলো। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিলো রাসেল এবং বাবা সবটায় খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু আসলেই কি এগুলো স্বাভাবিক ছিলো??

অনুভবকে পুরো একটা বছর কাছ থেকে দেখেছিলো মিন্মি। শুধু মেধাতে নয়,ভদ্র,নম্র,বিনয়ী এবং যথেষ্ট তীক্ষ্ণবুদ্ধীসত্তার অধিকারী ছিলো। ওর পছন্দসই এতোটাই উপর লেভেলে ছিলো যে কলেজের যে কোনো ফাংশনের পুরো দাযিত্বটা পড়তো অনুভবের উপর। টিচাররা সবাই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতো ওকে। তখনকার অনুভবের সাথে এখনকার অনুভবের কোনো মিল খুজে পাচ্ছেনা মিন্মি। মনে হচ্ছে সে দুটো অনুভবকে দেখছে। যারা দুটো ভিন দেশে বাস করছে। কিন্তু এসবের কারণ কি?? মাত্র পাঁচ বছরে এতোটা পরিবর্তন কি করে আসতে পারে? এই পরিবর্তনের সাথে রিপ্তির কোনো সম্পর্ক আছে কি?? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? যেখানে আমরা নিজেরাই এতোবছর পর ওর মুখদর্শন করার সুযোগ পেলাম সেখানে রিপ্তির সাথে দেখা হওয়াটা অসম্ভব! তাহলে কোন যোগসূত্রে দুজনে গাথা পড়েছে???

~~~

অনুভবের রুমের দরজা খোলা। রিপ্তি লুকিয়ে ভেতরে উকিঝুকি মারছে। নাহ,রুমের কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছেনা। রিপ্তি ভালো করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। কোথায় গেলো? পালিয়েছে নাকি?? রিপ্তির মুখে চিন্তার ছাপ পড়ার আগেই পাশ থেকে পানির শব্দ। তারমানে ওয়াশরুমে?? ওয়াশরুমের দরজার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে রিপ্তি। মনের ভাবনাকুটিরে টুপ করে ডুব দিলো। এখনি সুযোগ রিপ্তি,কিছুতো একটা উপায় ভাব। এই ছেড়াভবকে শায়েস্তা করতে হবে। কিন্তু কি উপায়ে?? রিপ্তির ভাবনারা তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। কিন্তু এতো কম সময়ে কি ভালো বুদ্ধীরা দেখা দেয়?? কোনো কিছুই মাথায় আসছেনা রিপ্তি নিরাশমনে ফিরে যাওয়ার জন্য পা ফেললো। তখনি চোখ পড়লো বিছানায়। অনুভবের লাল টাওয়ালটা বিছিয়ে পড়ে আছে। রিপ্তি সাথে সাথে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো,,,

“” এই ছেলে কি খাবারের সাথে লজ্জাও খেয়ে নেয়?? নিজের শেষ সম্বল বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে কি করছে?? ছি! ছি!! আমায় এগুলোও দেখতে হচ্ছে??””

রিপ্তি বেশ কিছুক্ষণ মুখ ঢেকে দাড়িয়ে রইলো। তারপর আচমকা হাত সরিয়ে একা একা বিড়বিড় করছে,,

“” আমি কেন লজ্জা পাচ্ছি? লজ্জা তো পাবে লাল ব্যাঙ!””

রিপ্তি টাওয়ালের কাছে এগিয়ে দাড়ালো,,

“” আমাকে হেনস্ত করা না? আমার উপর নিজের জোর প্রয়োগ করা? খোলা শরীরে আমাকে ছোয়া? আমার যে কোনো দাম নেই তাই বারবার আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন তো? এবার আমিও দেখাবো রিপ্তির দাম কতটা হুহ! আপনাকে তো এ বাড়ী ছাড়তেই হবে,শুধু বাড়ী কেন বাংলাদেশ ছাড়তে হবে। আর সেটার সফলকাম হতে আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করে যাবো। এখন বুঝবেন,দামহীন,বলহীন,হৃদয়হীন রিপ্তির খেল!””

রিপ্তি আরেকবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে চট করে লাল টাওয়ালটা তুলে নিলো। বেরিয়ে যেতে যেতে গান ধরলো,,,

আমি চলি আগে আগে
সবাই আমার পিছে রে
আমি চলি উড়ে উড়ে
আকাশ আমার নিচে রে
আমি যে নাম্বার ওয়ান
ও লাল ব্যাঙ
আমি যে নাম্বার ওয়ান

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here