বিবশ_রজনী #পর্ব_তিন

#বিবশ_রজনী
#পর্ব_তিন
…..
নিজাম সাহেব রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঈশানকে নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করলেন। ঈশান ঘুমের মধ্যে এত নিখুঁত ভাবে হাঁটে কি করে? কেউ কি আড়াল থেকে তাকে দিয়ে এরকমটা করাতে পারে? কেউ যদি ঈশানকে দিয়ে এইসব করিয়ে থাকে তবে তাকে সম্মোহন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, যা বেশ জটিল একটা ব্যাপার। সম্মোহন পদ্ধতি অবলম্বন করে হয়তো কিছুদিন পর্যন্ত একজন মানুষকে প্রভাবিত করা সম্ভব কিন্তু এক বছরের অধিক সময় ধরে প্রভাবিত করা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া কাউকে সম্মোহিত করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির আশে-পাশে থাকবার আবশ্যকতা রয়েছে। সুতরাং ঈশান সম্মোহিত হয়ে এসব করছে এরকমটা ভিত্তিহীন। তাহলে ঈশান রাত দুইটা বাজতেই ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে গিয়ে রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটছে কেন? এত সরু একটা রেলিংয়ের উপর দিয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় এত নিখুঁতভাবে হাঁটাহাঁটি করা একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব না। দুই একবার হলে ভিন্ন ব্যাপার, ঈশান প্রতি রাতে অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সাথে রেলিংয়ের উপর দিয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় হাঁটে। ঈশানের সাথে সার্কাসের লোকেদের কিছুটা মিল রয়েছে। সার্কাসে কিছু কিছু খেলা রয়েছে যা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সার্কাসকর্মীরা দেখিয়ে থাকে। যেমন রশির উপরে হাঁটা। তবে তারা শুরুতেই রশির উপর দিয়ে হাঁটতে সক্ষম হয় না, দীর্ঘদিন এর উপর তাদেরকে দীক্ষা হয়। ঈশানকি ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটার চর্চা করতো? কিন্তু এরকম উদ্ভট একটা চেষ্টা সে কেন করবে?

নিজাম সাহেব চা শেষ করে ভিডিও ক্যামেরা, মাইক্রোফোন নিয়ে ল্যাবে গিয়ে ঢুকলেন। ভিডিও ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোনের মেমরিকার্ড খুলে তিনি ল্যাপটপে লাগিয়ে ল্যাপটপের মনিটরে চোখ রাখলেন। ল্যাপটপের মনিটরে ভেসে উঠলো ঘরের দরজা খুলে ঈশানের বের হয়ে আসার দৃশ্য। নিজাম সাহেব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন ঈশানের চোখের দিকে। ঈশান যদি চোখের পাতা মেলে তাকায় তবে একটা বিষয় পরিস্কার হওয়া যাবে, সে কি ঘুমের মধ্যেই আছে নাকি জেগে আছে। ঘুমন্ত মানুষের চোখের মনি ডান থেকে বামে এবং বাম থেকে ডান দিকে ঘুরতে থাকে।

ঈশান সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে গেল, একবারের জন্যেও চোখের পাতা মেলে তাকালো না, সোজা গিয়ে রেলিংয়ের উপরে উঠে একমুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো। রাত তিনটা পর্যন্ত ঈশান রেলিংয়ের উপরে হাঁটাহাঁটি করে ঘরে চলে গেল। একবারের জন্যেও তাকালো না। নিজাম সাহেব পরপর দুইবার ভিডিও দেখে চোখ বন্ধ করলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলেন।

হামিদুল ঘুম থেকে উঠে দরজার নিচে একটা খাম পেয়েছে। ঘুম থেকে উঠার পর কয়েকবার সে খাম হাতে ল্যাবে গিয়ে দেখে এসেছে নিজাম সাহেবের ঘুম ভেঙেছে কি না। খাম নিয়ে সে ভীষণই চিন্তিত। এরকম এর আগে কখনো আসেনি, সে কি খাম খুলে দেখবে ভেতরে কি আছে, নাকি রেখে দিবে মনস্থির করতে পারছে না। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো, হামিদুল গিয়ে দরজা খুলে দেখলো বিউটি এসেছে। বিউটি ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলো, “আজকে কি রান্না করবো? ভাইজান কি বাজার করেছে?”
হামিদুল বলল, “বাবা এখনো ঘুমায়, তুমি মুরগি রান্না করো।”
বিউটি বলল, “ভাইজান কয়দিন থেকে এই অবেলায় ঘুমায় থাকে কেন?”
এমন সময় নিজাম সাহেব ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “ভাইজান এখন ঘুমায় সকালে উঠে দুপুরে, পাঁচ-ছয় ঘন্টা না ঘুমালে কি মানুষ সুস্থ থাকে?”
বিউটি লজ্জা পেয়ে বলল, “ভাইজান আপনি উঠলেন কখন?”
–“এই তো মাত্রই, তুমি আছো কেমন?”
–“ভাইজান আল্লাহ রাখছে ভালো, তবে জামাইটা খুব ঝামেলা করে।”
–“কি ঝামেলা করে?”
–“ভাইজান আপনাকে তো আগেই বলছিলাম ও নেশা করে, একদিন বলল, ও ভালো হয়ে গেছে, আর নেশা করবে না, ওরে একটা রিকশা কিনে দিতে। আমি রিকশা কিনে দিলাম, কয়দিন ভালো ছিল মাসখানেক আগে সে রিকশা বেচে দিয়ে আবারও নেশা শুরু করেছে। রিকশা বেচে যা টাকা পেয়েছিল সব শেষ, এখন টাকার জন্যে আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে।”
–“তুমি ওকে টাকা-পয়সা দিয়ো না।”
–“ভাইজান, টাকা না দিলে জোর করে নিয়ে যায়। রাত-বিরাতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়, কোনোদিন ফেরে কোনোদিন ফেরে না।”
–“কিন্তু বিউটি তুমি তো ওকে টাকা-পয়সা দিয়ে কুলাতে পারবে না, নেশাগ্রস্থদের অঢেল টাকা-পয়সা লাগে।”
–“জ্বী ভাইজান, আমার মনে হয় সে এখন চুরিও করে।”
–“নেশার টাকা যোগাড় না হলে চুরি করবে এমনটাই তো স্বাভাবিক। তুমি ওকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে দিয়ে দাও।”
–“আমিও সেইটা ভাবছি ভাইজান, কিন্তু আমি একলা মানুষ, ওরে ওখানে দিয়ে দিলে আমি বাসায় একা একা থাকবো কিভাবে?”
–“তুমি আমাদের এখানেই থাকতে পারো, কোন ভাড়া দেওয়া লাগবে না।”
–“ভাইজান আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি আমার অনেক উপকার করেন। রফিককে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির ব্যাপারে আমাকে যদি একটু সাহায্য করতেন তাহলে খুব উপকার হতো।”
–“অবশ্যই করবো বিউটি।”
–“ভাইজান, ছোটসাব বলল, মুরগি রান্না করতে। মুরগিই রাঁধবো নাকি অন্যকিছু।”
নিজাম সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, “ছোটসাহেবের জয় হোক, আজকে মুরগিই রাঁধো।”

বিউটি রান্নাঘরে চলে গেল। হামিদুল টেবিলের উপর থেকে খাম নিয়ে এসে নিজাম সাহেবকে দিয়ে বলল, “ঘুম থেকে উঠে দেখি দরজার নিচে এইটা পড়ে আছে।”

নিজাম সাহেব বেশ অবাক হলেন, খামের উপরে নিচে কিছুই লেখা নেই। খামের ভেতরে একটা কাগজের উপস্থিতি তিনি বুঝতে পারছেন, মনে হচ্ছে ভেতরে একটা চিঠি আছে। সচরাচর কেউ তাকে চিঠি জাতীয় কিছু লেখে না। তিনি খাম খুলে কাগজ বের করে পুনরায় অবাক হলেন, কাগজে কিছুই লেখা নেই।

মুখ-হাত ধুয়ে নিজাম সাহেব কাগজের ঘ্রাণ শুকে হামিদুলকে বললেন এক কাপ চা ল্যাবে নিয়ে আসতে। হামিদুল চিন্তিতমুখে নিজাম সাহেবের হাতে থাকা সাদা কাগজ ইঙ্গিত করে বলল, “ওইটা কী?”
নিজাম সাহেব হামিদুলকে সাদা কাগজ দেখিয়ে বললেন, “সাদা কাগজ।”
হামিদুল বিরক্ত হয়ে বলল, “কিছুই তো লেখা নাই।”
নিজাম সাহেব হেসে বললেন, “মনে হচ্ছে গোপন কিছু লেখা আছে। তুই আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যা।”
হামিদুল চিন্তিত মুখে রান্নাঘরে চলে গেল। তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না সাদা কাগজে গোপন কি লেখা থাকতে পারে।

নিজাম সাহেব ল্যাব ঘরে গিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে লাইটার দিয়ে কাগজে হালকা করে তাপ দিতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ তাপ দেবার পর বাদামী রঙের একটা লাইন ভেসে উঠলো, তাতে লেখা,
“আপনার কি কখনো নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয় না?”

নিজাম সাহেব ভেবে পেলেন না এরকম চিঠি কে লিখলো। চিঠিটা যে লিখেছে সে নিশ্চয়ই তাঁর পরিচিত কিন্তু এরকম নাম-ঠিকানা গোপন করে চিঠি পাঠানোর কি কারণ? নিজাম সাহেবের মনে হলো এরকম চিঠি সে আরও পেতে যাচ্ছে।

হামিদুল চা নিয়ে ল্যাবে ঢুকলো। নিজাম সাহেব চিঠিটা হামিদুলকে দিয়ে বললেন, “তোকে বলেছিলাম না গোপন কিছু লেখা আছে?”
হামিদুল কাগজের দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা কি তুমি লিখলে?”
–“ধুর গাধা আমি লিখবো কেন? যে চিঠিটা পাঠিয়েছে সে লিখেছে।”
–“একটু আগে না দেখলাম সাদা কাগজ, সেটাতে লেখা আসলো কোথা থেকে?”
–“এই লাইনটা লেখার জন্যে সে একটা গোপন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। তুই শিখবি?”
হামিদুল উৎসুকমুখে নিজাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সত্যি শেখাবে?”
–“হ্যাঁ, এখনই শেখাবো, তুই ঘরে গিয়ে একটা পাকা লেবু আর বাটিতে একটু পানি নিয়ে আয়।”

হামিদুল দ্রুত ল্যাব থেকে বের হয়ে ঘরে চলে গেল। নিজাম সাহেব চিঠির কথা বাদ দিয়ে ঈশানের কথা ভাবতে শুরু করলেন। ঈশান হাঁটার সময় বিড়বিড় করে কি বলে শোনার জন্যে তিনি বেশকিছু উন্নত প্রক্সুক্তির মাইক্রোফোন ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু মাইক্রোনে ঈশানের কোন কথাই ধরা পড়েনি। হাঁটার সময় ঈশানের পায়ের শব্দ মাইক্রোফোন নিখুঁতভাবে ধরতে পারলেও কন্ঠস্বর ধরতে পারেনি অর্থ্যাৎ ঈশান বিড়বিড় করে যা বলে তাতে কোন শব্দ নেই। নিজাম সাহেবকে ঈশানের ঠোঁটের ভাষা পড়তে হবে যা বেশ সময় সাপেক্ষ এবং ধৈর্যের ব্যাপার। একই ভিডিও তাকে বার বার দেখতে হবে।

হামিদুল পাকা লেবু এবং বাটি ভর্তি পানি নিয়ে ল্যাবে ঢুকে নিজাম সাহেবের পাশে বসলো। নিজাম সাহেব বললেন, “এত পানি এনেছিস কেন? অর্ধেকটা পানি ফেলে দিয়ে আয়।”
হামিদুল দ্রুত পানি কমিয়ে নিয়ে আসলো। নিজাম সাহেব বললেন, “এবার বাটিতে লেবুর রস চেপে দে।”
হামিদুল বেশ বিরক্ত হলো, সে আস্তো একটা লেবু নিয়ে এসেছে, সাথে কোন ছুরি আনেনি, এখন তাকে আবারও ঘরে গিয়ে লেবু কেটে আনতে হবে। বিরক্ত গলায় হামিদুল বলল, “আমি তো লেবু কেটে আনিনি, কেটে নিয়ে আসি।”
নিজাম সাহেব ডেস্ক থেকে একটা ছুরি বের করে হামিদুলকে দিয়ে বললেন, “এটা দিয়ে কাট।”
হামিদুল লেবু কেটে বাটিতে রস চেপে দিল। নিজাম সাহেব একটা কাগজ, একটা সরু তুলি হামিদুলকে দিয়ে বললেন, “এইবার তুলি বাটিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে কাগজে যা ইচ্ছা লেখ।”

হামিদুল নিজাম সাহেবের কথা মতো তুলি ডুবিয়ে ডুবিয়ে কাগজে লিখতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ লেখার পর নিজাম সাহেবের দিকে এগিয়ে কাগজ দিয়ে বলল, “লেখা শেষ।”
নিজাম সাহেব কাগজের লেখা শুকিয়ে যাবার পর হামিদুলকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই কাগজে যা লিখেছিস তা কি দেখা যাচ্ছে?”
হামিদুল কাগজ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “না।”
নিজাম সাহেব কাগজ হাতে নিয়ে লাইটার জ্বেলে কাগজে তাপ দিতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে কাগজে ভেসে উঠলো নিজাম সাহেবের কুকুরের নাম, “এ্যালাস্কান মালামিউট।”
হামিদুল আনন্দে আত্মহারা হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “এইটা কিভাবে হলো?”
নিজাম সাহেব হামিদুলকে বললেন, “কিভাবে কি হলো এটা আমি তোকে বলবো না। তোকে আমি একটা বই দেবো সেটা পড়ে পড়ে খুঁজে বের করবি কি কারণে লেবুর রস দিয়ে কাগজে লিখলে লেখা অদৃশ্য হয়ে যায় আবার কেন কাগজে তাপ দিলে লেখা দৃশ্যমান হয়ে যায়, ওকে?”

হামিদুল বেশ বিরক্ত হলো, তিনি যা জানেন তা তাকে বলে দিলে কি হয়? এখন তাকে পুরো একটা বই পড়তে হবে।
…..
#চলবে

লেখা,
নাহিদ হাসান নিবিড়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here