#বিবশ_রজনী
#অন্তিম_পর্ব
…..
সকাল আটটার দিকে মিসেস নাজিয়া ঈশানকে ডাকতে শুরু করলেন কিন্তু ঈশানের ঘুম ভাঙ্গার কোনো লক্ষণ নেই। তিনি গতকালের মতোই মগে করে পানি নিয়ে এসে ঈশানের চোখে-মুখে ছিটাতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ঈশানের ঘুম ভেঙে গেল। ঈশান ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল, “মা রোজ রোজ এইসব তুমি কি শুরু করলে? একটু ঘুমাতে দেবে না।”
মিসেস নাজিয়া বললেন, “বাবা রাগ কোরো না, এত বেলা করে ঘুমাতে হয় না, শরীর খারাপ করবে। মুখ-হাত ধুয়ে ডাইনিংয়ে এসো, আমি নাস্তা দিচ্ছি।”
–“আমি এখন খাবো না, আরেকটু ঘুমাবো।”
–“বাবা আর ঘুমানো যাবে না, চোখ-মুখ ধুয়ে ফেলো দেখবে আর ঘুম আসবে না। নাস্তা করে বাজারে গিয়ে মাছ আর মুরগি নিয়ে এসো।”
–“কি মাছ?”
–“তুমি যেটা খাবে, সেটাই নিয়ে এসো।”
ঈশান বিছানা ছেড়ে উঠে বিরক্তমুখে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করে ঈশান বাজারে গিয়ে বড় চিংড়ি আর মুরগি কিনে নিয়ে এসে রান্নাঘরে রেখে নিজের ঘরে ঢুকলো, শরীরটা তার দুর্বল লাগছে।
নিজাম সাহেব সকাল দশটার দিকে চায়ের কাপ হাতে হামিদুলকে দাবা নিয়ে ল্যাবে আসতে বলে ল্যাব ঘরে ঢুকলেন। তিনি তাঁর রিভলভিং চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হামিদুল দাবা নিয়ে ল্যাবে ঢুকলো। নিজাম সাহেব বললেন, “আয় তোর সাথে আজকে দাবা খেলবো।”
হামিদুল বলল, “না আমি তোমার সাথে খেলবো না।”
–“আরে বেটা আয়। তুই জিতলে তোকে আমি একটা গিফট দেবো।”
হামিদুল অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজাম সাহেবের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো। নিজাম সাহেব গুটি সাজাতে সাজাতে বললেন, “রফিকের কি অবস্থারে? ওর পায়ের ব্যাথা সেড়েছে?”
–“মনে হয় সেড়ে গেছে, হাঁটাহাঁটি করতে দেখি তো।”
–“হু, নে চাল দে।”
হামিদুল গুটি চালল।
নিজাম সাহেব ইচ্ছাকৃত ভাবে পর পর দুইবার হামিদুলের কাছে হেরে গেলেন। হামিদুল খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। নিজাম সাহেব বললেন, “তুই তো দাবা অনেক ভালো খেলিসরে। আগামী বছর তোকে চ্যাম্পিয়ন লীগ খেলতে পাঠাবো।”
হামিদুল হাসতে হাসতে বলল, “আমার গিফট?”
–“হ্যাঁ দেবো তো, বিকেলবেলা দেবো।”
হামিদুলকে কি দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে নিজাম সাহেব ঠিক করলেন হামিদুলকে তিনি একটা ড্রোন কিনে দেবেন। ল্যাব থেকে বের হয়ে তিনি গাড়ি নিয়ে বাসা থেকে বের হলেন।
দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে রাফাত ঈশানকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলো, সে বাসা থেকে বের হয়েছে কি না।
ঈশানের যদিও বাসা থেকে বের হতে একদমই ইচ্ছা করছে না তবুও সে বলল, “আমি বের হচ্ছি, রাস্তায় জ্যাম না থাকলে আসতে বেশি সময় লাগবে না।”
ফোন রেখে ঈশান মিসেস নাজিয়াকে গিয়ে বলল, “মা ড্রাইভার কি বাসায় আছে?”
মিসেস নাজিয়া বললেন, “কেন বাবা কোথাও যাবে?”
–“হ্যাঁ, রাফাতরা ধরেছে ব্যাচেলর পয়েন্টে যাওয়ার জন্যে।”
–“সে তো ভালো কথা, যাও গিয়ে ঘুরে এসো।”
–“ঠিক আছে, আমি তাহলে ড্রাইভারকে নিয়ে গেলাম।”
ঈশান ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির নিচে চলে গেল। ঈশান বের হয়ে যেতেই মিসেস নাজিয়া আফরোজের চোখ দুটো ভিজে গেল। গত একটা বছর থেকে ঈশান বাসার বাইরে যায় না, সারাদিন ঘরে বসে থাকে। মিসেস নাজিয়ার মনে হচ্ছে ঈশান বোধহয় আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠেছে। আব্দুল মালেক সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে মিসেস নাজিয়ার চোখে জল দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার এই ভর দুপুরে তোমার চোখে জল কেন?”
মিসেস নাজিয়া চোখের জল না মুছেই বললেন, “জানো ঈশান ওর বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেল।”
–“কি, সত্যি?”
–“হ্যাঁ।”
–“বলো কী?”
–“তোমাকে তো বলা হয়নি, গতকাল সকালে আমি ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে বাজার করতে পাঠিয়েছিলাম, আমার ছেলেটা বাজার করে এনেছে। আজও সকালবেলা বাজারে পাঠিয়েছি। আজ কি এনেছে জানো?”
মালেক সাহেব অবাক বিস্ময়ে বললেন, “কি এনেছে?”
–“চিংড়ি মাছ এনেছে, মুরগি এনেছে।”
–“নাজিয়া দেখো ও আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে।”
ঈশান কতদিন পর বাসা থেকে বের হয়েছে! কতদিন থেকে সে ধানমণ্ডি যায় না! শহরের পথ-ঘাট থেকে শুরু করে দোকানপাট সবকিছু যেন বদলে গেছে। ঈশানকে অন্যমনস্ক দেখে গাড়ির ড্রাইভার রুবেল বলল, “ভাইয়া কতদিন পরে আপনাকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছি! আগে আপনি আমাকে নিয়ে কত জায়গায় যেতেন! হঠাৎ কি হলো আপনার? বাসা থেকে বের হওয়া একদম বন্ধ করে দিলেন কেন?”
ঈশান বলল, “এমনিতেই, বের হতে ভাল লাগে না।”
–“মাঝেমধ্যে বের হবেন ভাইয়া মন ভাল থাকবে।”
ঈশান কিছু বলল না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে শুরু করলো, এই গোটা শহর জুড়ে অংশীর সাথে কত কত স্মৃতি তার রয়েছে! সেসব স্মৃতি সে কি করে ভুলে যাবে? বাসা থেকে বের হলেই যে অংশী এসে তার সামনে দাঁড়ায়, তার চোখে কোনো ভালোবাসা থাকে না, থাকে না কোনো মায়া, থাকে কেবল উপেক্ষা। অংশীর সাথে বন্ধুত্ব হবার পর কত কত সুন্দর মুহুর্ত তার কেটেছে, অথচ ফাইনাল ইয়ারের শেষের দিকে কি উপেক্ষাই না অংশী তাকে করতে শুরু করেছিল! অংশীর উপেক্ষা গুলোই আজ সব স্মৃতির সুখ কেঁড়ে নিয়ে কেবল কষ্ট দেয়। অংশী বেঁচে থাকলে নাহয় সে তার উপেক্ষা গুলোকেই আপন করে নিতো, আজ আর সেই সুযোগ কই?
ব্যাচেলর পয়েন্টে এসে গাড়ি থেকে নেমে ঈশান দেখলো সৌমিত্র বসে আছে। ঈশান গিয়ে সৌমিত্রর পাশে বসে বলল, “কিরে কি অবস্থা?”
সৌমিত্র বলল, “চলে এসেছিস, মনে হচ্ছিলো আসবি না।”
–“রাফাত কোথায়?”
–“এই তো জিগাতলা চলে এসেছে।”
হঠাৎ ঈশানের ফোন বেজে উঠলো, ঈশান ফোন বের করে অপরিচিত নম্বর দেখে কেটে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আবারও ফোন বেজে উঠলো। ঈশান বিরক্ত হয়ে ফোন ধরে জিজ্ঞাসা করলো, “হ্যালো, কে বলছেন?”
অপর পাশ থেকে জেরিন বলল, “আমি জেরিন বলছিলাম, অর্থনীতি বিভাগের। আমাকে মনে আছে?”
–“জেরিন! কেমন আছো তুমি?”
–“ভালো, আপনি কেমন আছেন?”
–“আমিও ভালো আছি, তো জেরিন হঠাৎ কি মনে করে?”
জেরিন ঈশানকে বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না। ঈশানের সাথে তার সৌজন্যমূলক কথা-বার্তা ব্যতীত বেশি কথা কখনোই হয়নি। অংশী বেঁচে থাকতে জেরিন তাকে মাঝে-মধ্যে ফোন করতো, তাদের কথাবার্তা একমিনিটও দীর্ঘ হতো না। অংশীর মৃত্যুর পর জেরিন ঈশানকে নিয়মিত কয়েকদিন ফোন করেছে, ঈশান তাকে আচ্ছামতন বকে দিয়েছে, এরপরও মাঝে মাঝে সে চেষ্টা করেছে ঈশানের সাথে কথা বলার, তবে ঈশান তাকে কখনোই ভাল-মন্দ বলার সুযোগটুকু দেয়নি। জেরিন ধরে নিয়েছিল তাকে তার মোটেও পছন্দ না, কিন্তু মনকে তো এত সহজে মানানো যায় না, জেরিন ফোন করেছে। ঈশানের কয়েক সেকেণ্ডের কণ্ঠস্বর সে রেকর্ড করে বার বার করে শুনেছে। মেয়েটা পাগলের মতো ঈশানকে ভালোবাসে অথচ ঈশানকে সে কথা বলার সাহস মেয়েটার কখনোই হয় না।
ঈশান পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো, “জেরিন কিছু বলবে?”
জেরিন বলল, “ভাইয়া আপনার শরীর কেমন?”
–“হ্যাঁ বেশ ভালো।”
–“ভাইয়া একটা কথা বলি যদি কিছু মনে না করেন?”
–“হ্যাঁ বলো।”
–“ভাইয়া আপনার সাথে আমি একদিন দেখা করতে চাই, আপনি কি আমাকে সময় দিতে পারবেন?”
ঈশানের মনে পড়ে গেল অংশীর কথা। একই ডিপার্টমেন্টে পড়া সত্যেও প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অংশীর সাথে একটা কথাও তার হয়নি, হঠাৎ একদিন অংশী তার নম্বরে ফোন করেছিল। ঈশান ফোন ধরার পরে প্রথমেই বলেছিল, “ঈশান তোমার সাথে আমি মিশতে চাই, তুমি কি আমাকে সময় দিতে পারবে?”
ঈশান জেরিনকে জিজ্ঞাসা করলো, “কেন বলো তো?”
জেরিন বলল, “কোনো কারণ নেই, পারবেন?”
–“কোথায়, কবে?”
–“আপনি যখন ফ্রি থাকবেন।”
–“ঠিক আছে, আমি তোমাকে জানাবো।”
জেরিনের সাথে কথা শেষ হতেই রাফাত এসে ঈশানদের পাশে বসলো। সৌমিত্র ঈশানকে জিজ্ঞাসা করলো, “জেরিন ফোন করেছিল নাকি?”
ঈশান ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বলল, “হ্যাঁ।”
রাফাত বলল, “কোন জেরিনরে? ঐ যে ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টের সুন্দরী মেয়েটা?”
ঈশান বলল, “হ্যাঁ, কেন তুই কি আরও কোনো জেরিনকে চিনিস?”
–“চিনি না, তারপরও শিওর হলাম, ঐ ই কি না।”
–“আচ্ছা বলতো তুই ওর নামের সাথে সুন্দরী যোগ করলি কেন?”
রাফাত বলে উঠলো, “তো বলবো না? জেরিনের পেছন পেছন কত ছেলেরা ঘুর ঘুর করতো দেখতি না?”
–“তুই এমন ভাবে বলছিস মনে হচ্ছে সে বিশ্ব সুন্দরী।”
–“হতে পারে না, কিন্তু সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ তো করতে হবে, অংশগ্রহণ করার আগ পর্যন্ত তাকে বিশ্ব সুন্দরীর খেতাব দেওয়া যেতেই পারে।”
–“হয়েছে, এখানেই বসে থাকবি নাকি অন্যকোথাও যাবি?”
–“সৌমিত্র আজ খাওয়াবে, সেজন্যেই তো আসতে বলেছে।”
–“সৌমিত্র কোনো উপলক্ষ আছে নাকি?”
সৌমিত্র হেসে বলল, “না রে, এমনিতেই। চল কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।”
বিকেলবেলা নিজাম সাহেব ড্রোন কিনে বাসায় ফিরে আসলেন। হামিদুলকে ড্রোন দেবার পর নিজাম সাহেবকে হামিদুল জিজ্ঞাসা করলো, “এইটা কী?”
নিজাম সাহেব বললেন, “তোর গিফট।”
–“কিন্তু জিনিসটা কী?”
–“এটা একটা ড্রোন।”
–“এইটা দিয়ে কি করে?”
–“এটা দিয়ে তুই অনেক উঁচু থেকে ভিডিও করতে পারবি।”
হামিদুলের কাছে বিষয়টা ইন্টারেস্টিং বলে মনে হলো না। নিজাম সাহেব হামিদুলের মুখ দেখে মনে মনে বললেন, পয়ষট্টি হাজার টাকার জিনিসের চেয়ে পাঁচশো টাকা দিয়ে একটা লাল শার্ট কিনে এনে দিলে বুঝি হামিদুল বেশি খুশি হতো। তবে তিনি জানেন ড্রোনের কার্যকারিতা বুঝবার পর হামিদুল সারাদিন ড্রোন নিয়েই পরে থাকবে।
সন্ধ্যাবেলা ঈশান বাসায় ফিরে এলো। শরীরটা তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে৷ সে বুঝতে পারছে দীর্ঘদিন পর বাসা থেকে বের হবার কারণে শরীর মানিয়ে নিতে সময় নিচ্ছে। ঈশান বিছানায় শুয়ে পড়লো কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়েও গেল।
রাত দশটার দিকে মিসেস নাজিয়া ঈশানের ঘরে এসে ঈশানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন, “বাবা টেবিলে খাবার দিয়েছি, খেয়ে এসে ঘুমাও।”
ঈশান ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “মা বাইরে সৌমিত্রদের সাথে খেয়ে এসেছি, ক্ষুধা নাই।”
–“অল্প করে খাও, আজ তুমি মাছ-মাংস নিয়ে এসেছো না? আমি তো তোমার জন্যেই ওসব রান্না করেছি।”
ঈশান বিছানা থেকে উঠে মিসেস নাজিয়া আফরোজের সাথে ডাইনিংয়ে চলে গেল।
রাত দুইটা বেজে দশমিনিট, নিজাম সাহেব জেরিনকে নিয়ে ঈশানের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু ঈশান ঘর থেকে বের হচ্ছে না।
রাত আড়াইটা বেজে গেল ঈশান ঘর থেকে হলো না। নিজাম সাহেবের মনে হলো ঈশান আজ আর বের হবে না, তিনি ঈশানদের ঘরের দরজা নক করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আব্দুল মালেক সাহেব দরজা খুলে দিলেন। নিজাম সাহেব বললেন, “আজ তো ঈশান বের হচ্ছে না।”
আব্দুল মালেক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “তাই নাকি? আমি তো খেয়ালই করিনি। আসুন ঘরে আসুন।”
নিজাম সাহেব জেরিনকে নিয়ে ঈশানদের বসার ঘরে গিয়ে বসে আব্দুল মালেক সাহেবকে বললেন, “আজ ঈশান ঘর থেকে বের না হবার কারন কী হতে পারে? এমন কিছু কি ঘটেছে যা আমি জানি না?”
মালেক সাহেব বললেন, “আজ তো ও বাসার বাইরে ওর বন্ধুদের সাথে দেখা করে এসেছে।”
–“তাই নাকি?”
–“হ্যাঁ, গতকালও বের হয়েছিল, তবে বেশিক্ষণ বাইরে থাকেনি। আজ বেশ লম্বা সময় সে বাইরে ছিল। আরেকটা ব্যাপার তো আপনাকে বলাই হয়নি দুদিন থেকে সকাল আটটায় নাজিয়া ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলছে, বাজারে পাঠাচ্ছে।”
–“খুব ভাল ব্যাপার, আমার মনে হচ্ছে আমরা ঠিক দিকেই এগুচ্ছি।”
রাত তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে নিজাম সাহেব জেরিনকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে, “দুদিন থেকে বাইরে যাবার কারণে ঈশানের মস্তিষ্কের নিয়মিত রুটিনে গণ্ডগোল হয়ে গেছে, অর্থাৎ ঈশানকে নিয়মিত বাসা থেকে বাইরে বের করতে হবে।”
সকালবেলা নিজাম সাহেব আব্দুল মালেক সাহেবকে ফোন করে বললেন, “ঈশানকে নিয়মিত বাসার বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করতে হবে। আপনারা চেষ্টা করুন, আমিও করছি।”
মালেক সাহেবের সাথে কথা বলে নিজাম সাহেব ফোন করলেন সৌমিত্রকে। সৌমিত্র ফোন ধরার পর তিনি বললেন, “সৌমিত্র ঈশান গতকাল আপনাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল, তাইনা?”
–“হ্যাঁ।”
–“সৌমিত্র, গত একবছরে এমন একটা রাত যায়নি যেই রাতে ঈশান বাড়ির ছাদের রেলিংয়ে হাঁটেনি, কিন্তু আজ রাতে ও ঘর থেকে বের হয়নি। আমার বিশ্বাস, হঠাৎ বাড়ির বাইরে যাবার কারণে ওর মস্তিষ্কের নিয়মিত কার্যকলাপে গণ্ডগোল হতে শুরু করেছে। আপনারা বন্ধুরা চেষ্টা করুন, ঈশানকে নিয়মিত বাসার বাইরে বের করার।”
–“শুনে খুব ভালো লাগলো কিন্তু আমরা প্রতিদিন বললে তো ও আসবে বলে মনে হয় না।”
–“দুই-তিনদিন পর পর করুন।”
–“চেষ্টা করবো।”
নিজাম সাহেব দুপুরবেলা গোসল করতে ঢুকে দেখলেন কলে পানি নেই। তিনি বাথরুম থেকে বের হয়ে নিচতলায় গিয়ে রফিককে বললেন, “রফিক টাংকিতে যে পানি নেই তোমার কি সেই খবর আছে?”
রফিক বলল, “আমি তো খেয়াল করি নাই।”
নিজাম সাহেব বললেন, “খেয়াল রাখতে হবে। বাসার সবকিছু দেখে-শুনে রাখতে হবে। এখন থেকে মোটর ছেড়ে পানি তোলার কাজ তোমার।”
–“জ্বী আচ্ছা।”
আজ ঈশান বাসা থেকে বের হয়নি। নিজাম সাহেব জেরিনকে নিয়ে গত কয়েকদিনের মতোই ঈশানের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘড়ির কাটা রাত দুটো অতিক্রম করতেই ঈশান ঘর থেকে বের হয়ে আসলো, ঘরের সামনে একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল, “ঘর থেকে বের হলাম, যাচ্ছি ছাদে।”
জেরিন বলে উঠলো, “ছাদে যাচ্ছো কেন?”
ঈশান কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো। ঈশানের পেছন পেছন নিজাম সাহেব জেরিনকে নিয়ে ছাদে গেলেন। ছাদে উঠে ঈশান বলল, “কষ্ট হয় বুঝলে, খুব কষ্ট হয়।”
জেরিন সাথে সাথে বলল, “এত কিসের কষ্ট তোমার? আমি আছি তো, তাকিয়ে দেখো আমি আছি।”
নিজাম সাহেবের মনে হলো জেরিনের সামনে তাঁর থাকাটা উচিৎ হচ্ছে না। জেরিন তাঁর কারণে সবকিছু নিজের মতো করে প্রকাশ করতে পারছে না। নিজাম সাহেব জেরিনকে ফিসফিস করে বললেন, “আমি বাড়ির নিচে আছি, আপনি নিজের ইচ্ছা মতো ঈশানের সাথে কথা বলুন।”
নিজাম সাহেব ছাদ থেকে বাড়ির নিচে চলে গেলেন। ঈশান ছাদের রেলিংয়ের উপর উঠে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমি এখন কি করছি জানো?”
জেরিন বলল, “জানতে চাই না, ঘরে ফিরে যাও।”
–“ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটছি, পড়ে গেলে মরে যাব। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
–“কিছুই সমাধান হবে না বরং আরেকজন ঠিক তোমারই মতন পাগল হয়ে যাবে…”
রাত তিনটা বাজতেই ঈশান ছাদের রেলিং থেকে থেকে নেমে ঘরে চলে গেল, জেরিন নেমে আসলো বাড়ির নিচে।
পরের এক সপ্তাহ ঈশানকে বাসা থেকে বের করা গেল না এবং প্রতিরাতেই সে ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটা অব্যাহত রাখলো। নিজাম সাহেব জেরিনকে গত সাতটা রাতই স্বাধীনভাবে ঈশানের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন।
আজ শনিবার, জেরিন সকাল এগারোটার দিকে ঈশানকে ফোন করে বলল, “ভাইয়া আপনি তো আর কিছু জানালেন না?”
ঈশান জিজ্ঞাসা করলো, “কি ব্যাপারে বলো তো?”
–“আপনার সাথে দেখা করার ব্যাপারে।”
–“ওহহো, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ তুমি ফ্রি আছো?”
–“আমি সবসময় ফ্রি থাকি ভাইয়া।”
–“ঠিক আছে, কোথায় আসলে দেখা করতে তোমার সুবিধা হবে?”
–“টি.এস.সিতে আসতে পারবেন?”
–“হ্যাঁ আসতে পারবো। কয়টার দিকে আসবো বলো?”
–“বিকেল পাঁচটায় আসতে পারবেন?”
–“হ্যাঁ পারবো।”
–“আচ্ছা, আমি পাঁচটার দিকে টি.এস.সিতে আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো।”
ঈশান বিকেল পাঁচটার দিকে টি.এস.সিতে এসে দেখলো জেরিন রাজু ভাস্কর্যের সামনে বসে আছে। ঈশান গিয়ে জেরিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কি ব্যাপার বলো তো?”
জেরিন মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বলল, “তেমন কিছুই না, আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল।”
–“সত্যি কি তাই নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে?”
জেরিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলুন আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।”
–“কোথায়?”
–“চলুন তারপর দেখবেন।”
জেরিন একটা রিকশা ঠিক করে রিকশায় উঠে বসে ঈশানকে রিকশায় উঠতে বলল। ঈশান গিয়ে রিকশায় উঠে বসলো, পুরো রাস্তায় তারা কেউ কোনো বলল না।
রিকশা এসে থামলো আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে। ঈশান রিকশা থেকে নেমে জেরিনকে জিজ্ঞাসা করলো, “এইখানে কেন?”
জেরিন বলল, “এমনিতেই, চলুন ভেতরে যাই।”
ঈশান জেরিনকে অনুসরণ করতে শুরু করলো।
জেরিন দোকানে দোকানে ঢুকে পাঞ্জাবী দেখতে শুরু করলো। বেশ কয়েকটা দোকানে পাঞ্জাবী দেখে একটা দোকানে এসে জেরিনের কালো রঙের একটা পাঞ্জাবী খুব পছন্দ হলো। সে পাঞ্জাবীটা ঈশানের হাতে দিয়ে বলল, “এইটা ট্রায়াল দিন তো।”
ঈশান অবাক হয়ে বলল, “তুমি কি আমার জন্যে পাঞ্জাবী পছন্দ করছো?”
জেরিন অভিমান গলায় বলল, “তো কি অন্যকারও জন্যে? ট্রায়াল দিন বলছি।”
ঈশান ট্রায়াল ঘরে গিয়ে টিশার্ট বদলে পাঞ্জাবী পরে বের হয়ে আসলো। ঈশানকে দেখে জেরিন বলল, “পারফেক্ট, খুব সুন্দর লাগছে।”
জেরিন দোকানীকে জিজ্ঞাসা করলো, “দেখুন তো সুন্দর লাগছে না?”
দোকানী বলল, “আসলেই খুব মানিয়েছে।”
ঈশান বোকার মতো একবার জেরিনের দিকে একবার দোকানীর দিকে তাকিয়ে ট্রায়াল ঘরে গিয়ে আবারও পাঞ্জাবী বদলে টিশার্ট পরে নিল।
জেরিন পাঞ্জাবীর টাকা পরিশোধ করে ফ্রেশ একটা পাঞ্জাবী প্যাক করে দিতে বলল। দোকানী কিছুক্ষণের মধ্যে পাঞ্জাবী প্যাক করে দিল। জেরিন পাঞ্জাবীর ব্যাগ ঈশানকে হাতে ধরিয়ে বলল, “চলুন এইবার বাড়ি ফেরা যাক।”
রাত আটটা, নিজাম সাহেব ল্যাব ঘরে বসে আছেন। তাঁর মাথায় ১৩.১০.২০ তারিখটা সকাল থেকে ঘুরঘুর করছে। তিনি কাগজে আলাদা আলাদা ভাবে ১৩, ১০, এবং ২০ লিখে সংখ্যাগুলোর রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছেন। ১৩ নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি তেরোর পাশে লিখলেন, তেরো তম জন্মদিন? ৩১শে জানুয়ারী? কিন্তু কোনোটাই তাঁর মনে ধরছে না তিনি ভাবছেন ১৩ সংখ্যাটা বিশেষ ঠিক কি কারণে হতে পারে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তাঁর মাথায় এলো, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তেরো তম ব্যাচ ছিলেন। এরপর তিনি ভাবতে শুরু করলেন, ১০ নিয়ে। দশ নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাঁর মনে পড়লো, তৃনার কথা। তৃনা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সর্বমোট সাতটা চিঠি লিখেছে, নাম-ঠিকানাবিহীন চিঠি এসেছে তিনটা, তাহলে সর্বমোট চিঠির সংখ্যা দাঁড়ায় দশটা। তৃনার হাতের লেখা তিনি চেনেন, নাম ঠিকানা বিহীন যেসব চিঠি এসেছে সেসব তৃনার হাতে লেখা নয়। নিজাম সাহেবের মনে প্রশ্ন জাগলো, তৃনা কি তবে অন্যকাউকে দিয়ে চিঠিগুলো লিখিয়েছে? যদি তৃনা তা করেই থাকে তাহলে বিশের অর্থ দাঁড়ায় ইংরেজি অক্ষরে তৃনার পূর্ণ নাম অর্থাৎ, (Kasfia Chowdhury Trina)। নিজাম সাহেব বেশ অবাক হয়ে ভাবলেন, তৃনা কি এখনো বিয়ে করেনি? সর্বশেষ চিঠিতে সে ঈঙ্গিত প্রদান করে লিখেছে নিজাম সাহেব যদি তাকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে তাহলে তিনি যেন তাকে খুঁজে বের করেন। নিজাম সাহেব সঙ্গী হীনতায় খুব বেশি ভোগেন ব্যাপারটা তেমন নয় তবে মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা হয়, কেউ একজন পাশে তাঁর পাশে থাকুক। নিজাম সাহেব ভাবতে শুরু করলেন, তৃনাকে সঙ্গী করা কি তাঁর উচিৎ হবে? নিজাম সাহেবের মনে হলো আগে তাকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন কিন্তু সে তো চিঠিতে কোনো ঠিকানা লিখেনি। নিজাম সাহেবের মনে পড়লো বাংলা বাজারের দি বুক সেন্টারের কথা তবে তারা যে তাকে তৃনার ঠিকানা দিতে পারবে এমনটা তাঁর মনে হয় না। হঠাৎ নিজাম সাহেবের মনে পড়লো, প্রথম চিঠিটার কথা। প্রথম চিঠি লেখা হয়েছিল লেবুর কালি দিয়ে পরের চিঠিগুলো কলমের কালি দিয়ে লেখা, কলমের কালির নিচেই কি লেবুর কালি দিয়ে ঠিকানা লেখা আছে? নিজাম সাহেব দ্বিতীয় এবং তৃতীয় চিঠি বের করে লাইটার দিয়ে তাপ দিতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি দেখলেন, দ্বিতীয় চিঠির নিচের অংশে লেখা, “বাড়ি নং ২০৫৩, ফ্ল্যাট নং ১৭ কদমতলা, বাসাবো।”
রাত একটা, নিজাম সাহেব ঈশানদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করলেন।
ঈশানদের বাড়ি পৌঁছে তিনি দেখলেন জেরিন তাঁর আগেই চলে এসেছে। রাত পৌনে দুইটায় তিনি জেরিনকে বললেন, “আপনার উপরে যাবার সময় হয়েছে। আমি এখানে আছি।”
জেরিন ঈশানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঈশান রাত দুটো বাজতেই ঘর থেকে বের হলো। ঈশান বিড়বিড় করে ঘর থেকে বের হবার কথা বলতেই জেরিন বলে উঠলো, “এক পাও সামনে বাড়াবে না। ঘরে ফিরে যাও বলছি।”
ঈশান সিঁড়ির দিকে পা বাঁড়ালো। জেরিন জোর গলায় বলল, “আবার? ঘরে যেতে বলেছি না?”
ঈশান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলো। বারো তলায় উঠে জেরিন পুনরায় বলল, “তোমাকে ঘরে যেতে বলেছি, নাহলে ভালো হবে না কিন্তু।”
ঈশান জেরিনের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল, “কষ্ট হয়, বুঝলে খুব কষ্ট হয়।”
জেরিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “কোনো কষ্ট নেই তোমার। যে তোমাকে দিনের পর দিন উপেক্ষা করেছে তার জন্যে কষ্ট? কখনো না ঈশান, যে উপেক্ষা করে তার জন্যে কখনো কষ্ট পেতে হয় না, তাকে ভুলে যেতে হয়।”
জেরিন কথা শেষ করে ঈশানের সামনে গিয়ে ঈশানকে জড়িয়ে ধরল সাথে সাথেই ঈশান ছাদের মেঝেতে পড়ে গেল। জেরিন ঈশানের পাশে বসে নিজাম সাহেবকে ফোন করে বলল, “ঈশান ছাদের মেঝেতে পড়ে গেছে।”
নিজাম সাহেব মালেক সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত ছাদে চলে আসলেন। ছাদে এসে নিজাম সাহেব মালেক সাহেবকে বললেন, “ঈশানকে ঘরে নিয়ে যেতে হবে।”
মালেক সাহেব নিচে গিয়ে রুবেলকে ডেকে ছাদে নিয়ে আসলেন। ঈশানকে সবাই মিলে ছাদ থেকে ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল।
নিজাম সাহেব মালেক সাহেবকে বাড়ি ফেরার আগে বললেন, “ঈশান ছাদে পড়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা ঈশানকে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। সবকিছু আমি তাকে খুলে বলবো।”
রবিবার দুপুর একটা, নিজাম সাহেব ঈশানদের বাসায় গিয়ে ঈশানের ঘরে ঢুকে ঈশানকে বলল, “আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?”
ঈশান ভুরু কুঁচকে বলল, “না তো, কে আপনি?”
–“আমি বেশকিছুদিন থেকে আপনার চিকিৎসা করছি। আপনি আমাকে দেখেননি সেজন্যেই চিনতে পারছেন না। আমরা কি বাড়ির ছাদে গিয়ে কথা বলতে পারি।”
–“জ্বী চলুন।”
নিজাম সাহেব ছাদে গিয়ে ঈশানকে বললেন, “ঈশান আমি আপনাকে কিছু কথা বলছি, মন দিয়ে শুনবেন। আপনাকে নিশ্চয়ই আগে আপনার মা দু’একবার বলেছেন আপনি রাতে ঘুমিয়ে যাবার পর হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে চোখ বন্ধ অবস্থায় ছাদে এসে ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন। বলেছে না?”
–“জ্বী বলেছে।”
–“আপনি গত এক বছর থেকে এমনটা করে আসছেন, কিন্তু এসবের কিছুই ঘুম থেকে উঠবার পর আপনার মনে থাকে না। মনে থাকবার কথা নয়, কারণ ব্যাপারটা ঘটে আপনি ঘুমন্ত অবস্থায়, এটাকে ইংরেজিতে বলা হয় স্লিপ ওয়াকিং। ঈশান আমার ধারণা আপনি একটা সময় দেয়ালের উপর চোখ বন্ধ করে হাঁটবার চেষ্টা করতেন। আমার ধারণা কি ঠিক?”
–“জ্বী, আমি স্কুল থেকেই দেয়ালের উপর চোখ বন্ধ করে হাঁটতাম, ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগতো। বেশ কয়েকবার দেয়াল থেকে পড়ে ব্যাথাও পেয়েছি।”
–“কিন্তু চেষ্টা তো ছাড়েননি তাই না? একটা সময় নিশ্চয়ই আপনি যে কোনো দেয়ালের উপর দিয়েই না পড়ে চোখ বন্ধ করে হাঁটতে পারতেন, তাই না?”
–“হু।”
–“ঈশান, অংশীকে আপনি খুব ভালোবাসতেন, আপনি জানতেন অংশীর সাথে কখনো আপনার মিল হবে না কারণ আপনাদের মধ্যে ধর্মের ব্যবধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অংশীও আপনাকে হয়তো খুব ভালোবাসতো, একটা সময় সে বদলে গিয়েছে। মানুষ কখন বদলে যায় তা তো বলা যায় না। অংশীর পরিবর্তন আপনাকে মানসিকভাবে খুব কষ্ট দিত। যখনই সে আপনাকে বেশি উপেক্ষা করতো, এড়িয়ে চলতো তখনই আপনি গভীর রাতে গিয়ে ছাদের রেলিংয়ের উপর হাঁটতে শুরু করতেন। অংশীর মৃত্যুর পর আপনি প্রচণ্ডভাবে আঘাত পেয়েছেন। আমার ধারণা প্রথম প্রথম আপনি স্বপ্নে রেলিংয়ের উপর নিজেকে হাঁটতে দেখতেন। পরবর্তীতে এটাই বাস্তব হয়ে গিয়েছে। এর বেশকিছু কারণ রয়েছে, প্রথমত অংশীর মৃত্যুর পর আপনি খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, আপনার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ না রাখতে না রাখতে একটা দূরত্ব হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়ত, আপনি একাকীত্বতায় ভুগতে ভুগতে একটা সময় নিজের সাথে নিজেই কথা বলতে শুরু করলেন। এখানে আপনি অংশীকে যা যা বলছেন তার উত্তর অংশী রূপে আপনারই অবচেতন মন আপনাকে দিচ্ছে। দেখুন ঈশান, যা হয়ে গেছে তা তো হয়েই গেছে, আপনি অংশীকে খুব ভালোবাসতেন কিন্তু সে আর বেঁচে নেই। তার জন্যে হৃদয়ে কষ্ট পুষে না রেখে আপনাকে যে উপেক্ষা করে না, খুব খুব ভালোবাসে তাকে ভালোবাসবার চেষ্টা করুন, আমার বিশ্বাস সে আপনাকে কখনো ছেড়ে যাবে না। জেরিন মেয়েটা আপনাকে খুব ভালোবাসে।”
নিজাম সাহেব একটা পেনড্রাইভ ঈশানকে দিয়ে বললেন, “এখানে আপনার ছাদে হাঁটার ভিডিও রয়েছে, দেখে নিবেন।”
ঈশানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজাম সাহেব ঈশানদের বাসা থেকে বের হয়ে আসলেন।
ঈশান ঘরে ফিরে নিজাম সাহেবের দিয়ে যাওয়া পেনড্রাইভ থেকে ভিডিও ছেড়ে নিজেকে, চোখ বন্ধ অবস্থায় ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে গিয়ে রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটতে দেখে অবাক হয়ে গেল।
নিজাম সাহেব বাসায় ফিরে এসে প্রথমে ঈশানের বাবা আব্দুল মালেক এবং পরবর্তীতে সোমিত্রকে ফোন করে বললেন, ঈশানকে কোনোকিছুতে সবসময় ব্যস্ত রাখার জন্যে।
ঈশান বিষন্ন মনে ঘরে বসে আছে, কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না। এমন সময় সৌমিত্র রাফাত সহ ঈশানদের বাসায় এসে ঈশানকে নিয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে লম্বা সময় চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিল।
প্রতি রাতের মতোই নিজাম সাহেব এবং জেরিন ঈশানদের বাসায় উপস্থিত হলো কিন্তু ঈশান ঘর থেকে বের হলো না।
একটা সপ্তাহ কেটে গেল, সৌমিত্র এবং রাফাত প্রতিদিন ঈশানকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজাম সাহেব ঈশানদের বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন কিন্তু জেরিন বন্ধ করেনি, প্রতিরাতে ঠিক দুইটা বাজতেই সে ঈশানের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
দুই সপ্তাহ কেটে গেল, জেরিন একদিন ঈশানকে ফোন করে বলল, “ভাইয়া আপনিকি আমাকে সময় দিতে পারবেন?”
ঈশান জিজ্ঞাসা করলো, “কখন?”
–“আজ বিকেল পাঁচটায়, টি.এস.সিতে।”
–“ঠিক আছে আমি পাঁচটার দিকে চলে আসবো।”
–“ভাইয়া শুনুন, আপনাকে আমি যেই পাঞ্জাবী দিয়েছি ওটা পরে আসবেন কিন্তু।”
–“ঠিক আছে।”
ঈশান জেরিনের দেওয়া পাঞ্জাবী, আরেকটা জিন্স পরে বিকেল পাঁচটায় টি.এস.সিতে গিয়ে আগের মতোই দেখলো জেরিন রাজু ভাস্কর্যের সামনে বসে আছে। ঈশান গিয়ে জেরিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কি ব্যাপার বলো তো?”
জেরিন মিষ্টি করে হেসে বলল, “ব্যাপার কিছু না, আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল।”
–“আজকে কি আমরা আবার আজিজে যাব।”
জেরিন হেসে বলল, “না।”
–“তাহলে?”
–“আজ আমরা হেঁটে বেড়াবো।”
–“ঠিক আছে।”
জেরিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলুন।”
ঈশানের সাথে শহীদ মিনারের রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জেরিন হঠাৎ বলল, “ভাইয়া, আপনার হাতটা আমাকে একটু দেবেন?”
ঈশান বলল, “দিতে পারি, তবে আমার একটা শর্ত আছে।”
–“কি শর্ত?”
–“এই মুহূর্ত থেকে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকা বন্ধ করতে হবে, রাজী?”
জেরিন উত্তর না দিয়ে ঈশানের একটা হাত শক্ত করে ধরে বলল, “আপনি এত চালাক কেন? প্রথম দিনই, ভাইয়া বাদ, দ্বিতীয় দিন বলবেন আপনি বাদ। তৃতীয় দিন… থাক লজ্জা লাগছে বলবো না।”
সন্ধ্যা সাতটা, নিজাম সাহেব বাসাবোর কদমতলায় গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি নং ২০৫৩ খুঁজে বের করলেন। নিজাম সাহেব বাড়িতে লিফট থাকা সত্ত্বেও সিঁড়ি বেয়ে ছয়তলায় গিয়ে উঠলেন। ফ্ল্যাট নম্বর সতেরোর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ঘামতে শুরু করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন তাঁর হৃদক্রিয়া বেড়ে গেছে। ফ্ল্যাট নম্বর সতেরোর দরজার পাশেই কলিংবেলের সুইচ দেওয়া আছে কিন্তু কলিংবেল বাজানোর সাহস তাঁর হল না, তিনি দরজায় নক করলেন। কেন যেন তাঁর হঠাৎই ভীষণ লজ্জা লাগছে, ইচ্ছা হচ্ছে দ্রুত পালিয়ে যেতে, কিন্তু তার আগেই তৃনা দরজা খুলে অবিশ্বাসের চোখে নিজাম সাহেবের দিকে তাকালো, মুহুর্তের মধ্যে নিজাম সাহেবকে জড়িয়ে ধরে তৃনা বলল,
“তুমি এসেছো। আমি জানতাম, তুমি ঠিক আসবে।”
…..
#সমাপ্ত
লেখা,
নাহিদ হাসান নিবিড