বর্ষার এক রাতে,পর্ব : ১০,১১

বর্ষার এক রাতে,পর্ব : ১০,১১
সাদিয়া
পর্ব : ১০

তূবা বের হয়েছে নিজের গন্তব্যে। আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হয়েছে। কারণ তুসির ঔষধ কিনে নিতে হবে। সকালের ঔষধ শেষ। তাই তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়ল সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রনি কে খুঁজে চলছে। যদি পেয়ে যায়। হাটতে হাটতে খলির মুখের চার দোকানে রনি কে পেয়েই গেল। গলায় রুমাল ঝুলছে, প্যান্ট হাটু পর্যন্ত, শার্টের তিনটা বোতাম খোলা। ক্যারাম খেলছিল বন্ধুদের সাথে। তূবা দৌড়ে গেল। রনির কলার টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঠাস করে একটা চর মেরে দিল। হঠাৎ এমন ঘটনায় রনি সামলাতে পারল না। রাগে তূবার দিকে তাকায়। তূবার চোখ দিয়েও আগুন জ্বলছে। বড় বড় করে শ্বাস টানছে হাপিয়ে।

রনি সবাই কে চলে যেতে বলল।
“তুই থাপ্পড় কেরে মারছোস তূবা?”
“সত্যি করে বলতো রনি সেদিন ঠিক কি করেছিলি আমার সাথে।”
“সবাই জানে তোর সাথে কি হইছে আর তুই জানোস না?”
রনি কে হাসতে দেখে তূবা তার কলার চেঁপে ধরল।
“তোর সাথে আমি মজা করতে না সত্যিটা জানতে এসেছি। এখন বল সবটা বলবি।”
“ছাড় মানুষ দেখলে তোরই অসুবিধা হইব। আর তুই জানোস না আমি তোরে করছি কি?”
“রনি আল্লাহর দোহাই লাগে বল আমায়।”

রনি একটু চুপ থেকে বলল
“আমি তোরে রেপ করছিলাম এইডাই।”
তূবা আরেকটা চর বসিয়ে দিল রনির গালে। এবার রনি রেগে যায়। গরগর করে বলে,
“আমি হেইদিন তোর নামে দুর্নাম ছড়াইছি। তোর বিয়া করনের শখ হইছে আমারে কইতি। আমি তোরে বিয়া করতাম। কিন্তু তুই তো আরেক বেডার লগে বিয়া করতে চাইছোস তাই একেবারে তোর বিয়া বন্ধ কইরা দিলাম। আর কোনো বেডা তোরে বিয়া করতে আইতো না।”
“….
“তোর এই শইলের (শরীর) দিকে আমার নজর না রে তূবা। আমি তোরে পছন্দ করি। চাইলে হেইদিন হাচাহাচি আমি তোরে ধর্ষণ করতে পারতাম কিন্তু করছি না। কারণ তোরে আমি বিয়া করতে চাই।”

তূবা কি বলবে কি করবে তা জানে না সে। পাথরের মতো তাকিয়ে আছে রনির দিকে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে।

“তোর মনে নাই তোরে অজ্ঞান কইরা আমি তুইলা নিছিলাম। পরে উইঠা কি দেখছোস? তোর জামা কাপড় ছিঁড়া, শইলে রক্ত, হাতে রক্ত। আমি চাইতাম তুই শুধু আমার হইবি। তোরে সারা দুনিয়াতে খারাপ বানাইয়া আমি আমার কাছে লইয়া আইয়াম। দেখ এহন তুই অসহায়। ওহন বিয়া করবি আমারে?”

তূবা রনি কে এলোপাথাড়ি চর দিতে দিতে বলল
“কুত্তার বাচ্চা আমার জীবনটারে একদম শেষ করে দিছোস তুই। তোর জন্যে আমার জীবন আজ এত অন্ধকারে। আমার জীবন টা নষ্ট করে দিয়েছিস রনি।”
রনি কিছু বলল না। তূবা কে থামালও না। হেসে হেসে জবাব দিল।
“ওহন আমারে বিয়া কর দেখবি সব ঠিক হয়ে যাইব।”
“তোর জন্যে আমি পবিত্র থেকেও পবিত্র না। আমার শরীরে একটা মানুষের ছুঁয়া ধেয়ে গেছে। রনি আমার জীবন টা নষ্ট করে দিলি তুই।”

রনির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল
“তূবা এই তূবা কি কছ এইগুলা?”
“….
“তূবা। কথা কো।”
“….
“তূবা তুই মাত্র কি কইলি।”
“…
তূবা আর কিছু না বলে দৌড়ে চলে যায়। রনি তূবা কে অনেক ডাকে কিন্তু সে চলে গেছে। ধপ করে সে মাটিতে বসে পড়ল। বিড়বিড় করল
“তূবা কি কইয়া গেলি তুই?”

আহফিন আজ অফিস থেকে ফিরে এসেছে তাড়াতাড়ি। মাথার ভেতরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। এত চিন্তা ভাবনা মস্তিষ্ক নিতে চাইছে না। আসার পর থেকেই রুমে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। কলিংবেলের আওয়াজে আহফিন ঘড়ি দেখল। এটা তূবার আসার সময় নয়। আর ও তো রাতে আসবে। আহফিন নেমে নিচে গেল। দরজা খুলে বিধ্বস্ত অবস্থায় তূবা কে দেখে চমকে উঠল সে। বুকটা মুচড় দিয়ে উঠেছে তার। তূবার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, অদ্ভুত চাউনি, এলোমেলো চুল, নিস্তেজ দেহ আহফিন কে হতবাক করে দিল। সে দ্রুত তূবার বাহুতে ধরল। জিজ্ঞেস করল “কি হয়েছে?”
তূবা নীরব। আহফিন আবার আস্তে করে বলল
“কি হয়েছে তূবা?”
এবার তূবা বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আহফিন টেনে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

তূবা শূন্য শরীর ছেড়ে দিয়ে আহফিনের টিশার্ট খামছে হুহু করে কাঁদছে। আহফিন তূবা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেও তূবা নিচে বসে হাটু গুটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। আহফিন কিছুই বুঝতে পারছিল তূবা হঠাৎ এত করে কাঁদছে কেন। সে তূবা কে পাজোকোলে তুলে নিয়ে উপরে গেল। বিছানায় বসিয়ে তূবার সামনে এক গ্লাস পানি দিল। তূবা আপন মনে কাঁদতেই থাকে। আহফিন তূবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মুখের সামনে পানি ধরল। তূবা অল্প পানি খেয়ে চুপ হলো। শুধু শব্দটা বন্ধ হয়েছে চোখের পানি নয়।

আহফিন তূবার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল
“কি হয়েছে তূবা? তোমার প্রতিটা চোখের পানি আমাকে অধৈর্য করে তুলছে। প্লিজ আর কান্না না করে বলো আমায় কি হয়ছে।”
“র.রনি..”
“রনি? কি করেছে সে?”
“…
“তূবা বলো।”
“রনির সাথে আজ দেখা হয়েছে।”
“কি বলো?”
“…
“তারপর কি হয়েছে তূবা?”

সে আহফিনের চোখের দিকে তাকিয়ে পানি ছেড়ে দিল। ঠোঁট উল্টে করুণ মুখে বলল “সে স্বীকার করেছে সেদিন রাতে আমার সাথে বাজে কিছু করনি। শুধু দুর্নাম ছড়িয়ে আমার জীবন টা শেষ করে দিল।” চোখে পানি নিয়েই পাগলের মতো হেসে উঠল তূবা। তার এই কথাতে আহফিন তেমন অবাক হয় নি। কারণ সে এ ব্যাপারে জানে।

আহফিন শুধু তূবার গালে হাত রাখল।
“তূবা আমার দিকে তাকাও।”
“রনি আমার জীবন টা শেষ করে দিলো।”
“তূবা শান্ত হোও তুমি। আমার দিকে তাকাও।”
সে নিজের মতোই বিলাপ পারছিল। আহফিন যখন ধমক দিলো তখন সে তার চোখের দিকে তাকায়। আহফিন শান্ত স্বরে বলল
“তূবা প্রতিটা শেষ থেকে আবার নতুন কিছু শুরু হয়। কেন এতো ভেঙ্গে পড়ছো? হতে পারে এটাতে তোমার জীবন নতুন এক আলো পেল।”
“জীবন আলো নয় অন্ধকার পেয়েছে আহফিন। আমার জীবন টা রনির দুর্নাম আর আপনার ছুঁয়ায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
আহফিন কি বলবে তা জানে না। তূবা কে একলা একটু সময় দিয়ে সে চলে গেল। তার ভেতরেও দহন চলে।

রনি পাগলের মতো গেল তূবার বাসায়। গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল তূবা কে। শিরিন বেগম বের হয়ে বললেন
“তুই এই নে আইছোস কে?”
“খালা তূবা কই? আমার তূবা কই?”
“তোর তূবা? কাওলা কইরা রাখছিলি নাকি?”
“খালা আমি তোমার সাথে লাগতে আইছি না। আমারে কোও তূবা কই।”
“তুই কইলেই আমার কওন লাগব হেই কই গেছে?”
“খালা আমার মাথা গরম হইয়া যাইতাছে কিন্তু।”
“তাইলে রাখা আমি ঘর থেইকা বডি(দা) ডা লইয়া আই। এক কুপে তোর ঘাড় থেইকা কল্লা(মাথা) ডা আলোগ কইরা দেই।”

সাপের মতো রেগে উঠল রনি। চোখ লাল হয়ে উঠেছে তার। বৃষ্টির দিনেও ঘামছে। পারলে শিরিন বেগম কে এখানেই ধরে ফেলে সে। দুজনের খুব তর্কা তর্কি হয়। একসময় তিনি বললেন,
“তূবা চাকরিতে গেছে। রাইতের চাকরিতে গেছে।”
“রাইতের চাকরি মানে? কি কইতাছো তুমি?”
“বুঝোস না? তুই যেইটা জোর কইরা করছোস হে হেইডা টাকার বদলে করতে গেছে। এহন বুঝছোস তুই? জীবনডা একবারে নষ্ট কইরা দিলি তুই। আমারে তূবা পাইছোস না যে তোরে কিছু করতাম না। যা এইত থে নাইলে হাচাহাচি তোর মাথা আলোগ কইরা ফালবাম। যা কইতাছি।”
রনি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। শিরিনের কথা গুলি বারবার কানে লাগছে। “হাছাই কি বড় ভুল কইরা ফাললাম?”

ঘন্টা দুই এক পর যখন আহফিন ফিরে এলো তখন পরিবেশ ঠান্ডা। একটু আগেই বর্ষণ হয়ে গিয়েছে। আহফিন গিয়ে দেখল তূবা বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। হাতের ট্রে টা টেবিলের উপর রেখে তূবার পাশে বসল সে। মাথায় আহফিনের স্পর্শ পেয়ে তূবা উঠে বসল।

“পরিবেশ তো দেখছি ভীষণ শীতল। একটু আগে শ্রাবণ ধারার পরের থমথমে অবস্থা। কি স্নিগ্ধ সতেজ।”
আহফিনের কথায় তূবা কিছু বলল না।

“এদিকে আসো ডিনার করবে।”
“খিদে নেই, খাবো না আমি।”
“আসো আমি খায়িয়ে দিচ্ছি।”
আহফিনের মুখ থেকে এমন একটা কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইল তূবা। এমন কথা কখনো আশা করে না সে। কিন্তু..!

“কি হলো আসো।”
“….
আহফিন আর ডাকল না তূবা কে। ভাতের প্লেট টা হাতে নিয়ে এক লোকমা খাবার তুলে দিল তূবার মুখে। তূবা তখনো বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছিল তাকে। ভেতরে কিছু একটা চলছে তার। এই অনুভূতি, এই ছুটে চলার নাম কি?

“হা করো।”

দুই বার বলার পর তূবা মুখ খুলল। আহফিন হাসি দিয়ে তূবার মুখে ভাত তুলে দিল। তূবা লোকমা মুখে নিচ্ছে আর অবাক হয়ে তাকিয়ে আহফিন কে দেখছে। তূবার এমন তাকানো যে আহফিন বুঝতে পারছে না এমন নয়। সে মনে মনে হাসছে।
“আমাকে তোমার পছন্দ?”
“…
আহফিন তূবার উত্তরের আশা করল না।

“তূবা তুমি এখনো বাচ্চাটি আছো। তোমার মাঝে শিশুর মতো আরেকটা মানবী আছে। এমনিতেও মেয়েদের অনেক রূপ দেখা যায়। তবে এই তূবা কেও ভালো লাগে আমার।”
তূবা হা করে দেখছে তাকে। তূবা কে খায়িয়ে দিতে দিতে আহফিনের অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। অতীত মনে হতেই ভেতরটা কেমন জ্বলে উঠল তার। ভারি কিছু অনুভব করছে আহফিন।

একবার ভাবল উঠে যাবে তাকে না খায়িয়ে। কিন্তু কি ভেবে যেন তূবা কে সব গুলি ভাত খায়িয়ে হাত ধুয়ে নিল। তূবা কে আজ সে বিরক্ত করতে চায় না। তাই ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল সোফায়। তূবা আড়চোখে দেখল তাকে। বুঝতে পারল না লোকটার হয়েছে কি? লোকটার এমন অদ্ভুত আচারনের কারণে তাকে চিনতে অসুবিধা হয় তার। সেও আর কিছু না বলে শুয়ে পড়ল পাশ ফিরে। চোখ গুলিতে রাজ্যের ঘুম দেখা দিচ্ছে।

বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। রনি রাস্তায় বসে আছে। বৃষ্টির সাথে সাথে চোখের পানিও ঝরছে তার। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। হাতে থাকা মদের বোতলটায় আমার চুমুক লাগল। মাতাল কন্ঠে বলল
“তূবা রে আমি তোরে ভালোবাসি। তূবা কই তুই? আমার বুকটা জ্বইলা যাইতাছে রে। আমার কষ্টডা তুই দেখলি না। তূবা।”
জোরে চিৎকার করে রনি আবার মদের বোতল মুখে ধরল।
“আল্লাহ, আল্লাহ গো এত বড় ভুল আমারে দিয়া কি কইরা করাইলা? আল্লাহ আমারে আটকাইলা না কেরে? কেরে আমার রাগ ডা কমাইলা না? কেরে আল্লাহ কেরে?”

রাস্তায় হাত বারি দিতে দিতে কেঁদে উঠল রনি। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে তার। কাঁদতে কাঁদতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল
“তূবা… তূবা রে..!”

রাত ১২ টা বেজে ১৭ মিনিট। আহফিন অফিসের কাজ শেষ করে ল্যাপটপ রাখল। বিছানায় তাকিয়ে দেখল তূবা ঘুমিয়ে গেছে। আহফিন স্লান হেসে ল্যাপটপ রেখে এগিয়ে গেল বিছানায়। ঘুমন্ত তূবার মুখটা তার বুকে খিলখিল করা ঢেউ তুলে দিচ্ছে। আহফিন তূবার গায়ের চাদর টেনে দিয়ে কপালে চুমু দিল। তূবার পাশে এক হাত রেখে নিজেই বিড়বিড় করল।
“আমার প্রশান্তি হবে তূবা?”

চলবে♥

#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া

পর্ব : ১১
দুঃখ কষ্টের মাঝে দিন গেলেও সময় থেমে থাকে না। দিন দিনের মতো যেতে থাকে। সময় কারো বন্ধু নয় যে থেমে থাকবে।

আহফিনের প্রতি তূবার পিনপিনে রাগ টার পাশাপাশি আলাদা এক অনুভূতি জন্মেছে। কেমন যেন একটা টান অনুভব করে লোকটার প্রতি। তার সামনে আসলে সে নাম না জানা অনুভূতি তে হারিয়ে যায়। ইদানীং এটা খুব খেয়াল করছে তূবা। এই তো সেদিনই গিয়ে দেখতে পেল আহফিন মদ খেতে খেতে একদম নাজেহাল অবস্থা। ফ্লোরে নিথর হয়ে পড়ে ছিল। এই দৃশ্য দেখে তূবার ভেতর সহ মুচড় দিয়ে উঠে ছিল। চোখের কোণায় এক দুই ফোঁটা পানিও জমেছিল কষ্টে। সেদিন থেকে আরো বেশি করে টান অনুভব করে আহফিনের প্রতি। এরপর মানুষটা তাকে কিছু বলতে চেয়েও বলেনি। তূবাও জোর দিলও না এতে। কারণ মানুষটা কে তার আলাদা রকম ভাবে ভালো লাগে। মানুষটার কাছাকাছি গেলে সেই অনুভূতি হয়, সেই উথালপাতাল ঢেউ, সহস্র সাগরের ঢেউ হতে থাকে।
এসব ভাবতে ভাবতে আয়নার সামনে বসে তূবা হেসে উঠল। আজ অনেক দিন পর সে চোখে কাজল দিয়েছে। নিজের মৃগনয়না চোখ গুলি কে কাজল কালোয় সাজিয়ে তুলেছে। কি ভেবে যেন তূবা আবার হেসে উঠল।

“আপা তুমি কাজল দিয়েছো?”
তূবা পিছন ফিরে তাকাল। তুসির কথায় সে মুচকি হাসল। এগিয়ে গিয়ে তুসি কে এনে হাটু পেতে নিচে বসতে বসতে বলল
“কেন তোর বোন কে ভালো লাগছে না?”
“আরে আমার বোন কে পরীর চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে বলেই বলছি। আমার তো এখন ভয় হচ্ছে পরী না তোমাকে তুলে নিয়ে যায়।”
তূবা হাসল। সাথে তুসিও হাসল।
বলল
“আপা তুমি কত গুলি মাস হাসো না বলো তো।”
তূবা হাসির মাত্রা কমিয়ে আনল।

“জানো তোমার হাসি দেখার জন্যে আমি কত অপেক্ষা করি। তুমি হাসলে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।”
তুসির মুখে এমন কথা শুনে তূবা তাকে জড়িয়ে ধরল। গালে কপালে চুমু দিল। সে জানে এই মেয়ে টা তাকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সেও চেষ্টা করে তুসি কে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসতে।

“তুসি আমার লক্ষ্মী বোন টা।”
“আপা একটু দাঁড়াও।”
“কেন?”
তুসি হুইল চেয়ার টেনে গোলাপি কালার লিপস্টিক টা আনল।
“এদিকে আসো।”
“কেন?”
“আরে আসো না।”
“দেখ তুসি পাগলামি করিস না। আমি কিন্তু এখন এসব দিবো না।”
“আরে তুমি আসোই না।”
“তুসি..”
“যাও তোমার সাথে রাগ করছি।”
“ওরে বাবা রে আমার বোন টা খুব রাগ করে ফেলেছে? আচ্ছা এই নে।”
তুসি দাঁত বের করে দিয়ে হেসে তূবার ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপস্টিক টা দিয়ে দিলো। তুসি নিজের বোন কে দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তূবা হেসে তুসির নাক টেনে ধরল। ওপাশ থেকে শিরিন বেগম দুই মেয়ের ভাব দেখে আনমনে হেসে উঠলেন। তূবার সুন্দর মায়াবী মুখটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন তিনি।

“আম্মা কিছু বলবে?”
তূবার প্রশ্নে শিরিন বেগম মুখের ভাব ভঙ্গি ঠিক আর কঠিন করে ভেতরে ঢুকলেন।
“হো কইতাছি ঘরে চাউল শেষ হইয়া গেছে। বাজারও তেমন নাই।”
“আচ্ছা আমি আসার সময় নিয়ে আসব।”

তুসি বলল “আপা আসার সময় আচার এনো?”
“আচ্ছা আনব।” গালে আদর করে বলল তূবা।

তূবা ব্যাগ নিয়ে চলে যাওয়ার সময় শিরিন বেগম বললেন “সাবধানে যাইছ।” তূবা পিছন ঘুরে তাকাল শিরিনের দিকে। স্লান হেসে বের হয়ে পড়ল।
তিনি ভাবতে লাগলেন “কি ভাগ্য নিয়ে এসেছে। কতটা কপাল পুড়া হলে এমন কথা বলতে হয় তাকে এই কাজে যাওয়ার সময়।” শিরিন বেগমের বুক ভরে কান্না চলে আসল।

সেদিনের পর থেকে রনির আবার দেখা মিলে না। ছেলেটা অদ্ভুত রকমের পাগল। এভাবে আড়ালে থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন এসে আবার না জানি কোন দুর্ঘটনা ঘটায়। ভয় হয় তূবার। সে এত ভয়ের মাঝেও আহফিন কে মনে করে। হেসে উঠে সে। আজ দেখলে কি বলবে মানুষটা? অবাক হবে নাকি স্বাভাবিক ভাবেই নিবে? রিকশায় বসে বসে ভাবতে থাকল তূবা।

কলিংবেল বাজাতেই ফরিদা আন্টি খুলে দিল দরজা। তূবা কে দেখে তিনি মিষ্টি করে হাসলেন। “আজ কত দিন পর আপনাকে দেখলাম আন্টি।”
“হ্যাঁ মা তোমাকেও অনেকদিন পর দেখছি।”
“কেমন আছেন আন্টি?”
“ভালো। তুমি কেমন আছো মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“ভেতরে আসো। আহফিন বাবা একটু বাহিরে গেল কি যেন দরকারে।”
তূবা আর কিছু বলল না।

ঘড়ির কাটা ৭ টায়। আহফিনের গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। তূবা মুচকি হেসে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল রুমে।
তাড়াহুড়া করে আসছিল আহফিন। তূবা কে দেখে থমকে গেল সে। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছে নিশ্বাস থমকে গেছে তার। পা আর বাড়াতে পারল না আহফিন। সেখানেই আটকে রইল। হাতে থাকা গ্লাসটাও নিচে পড়ে শব্দ হলো। তার চোখ গুলির পাতা নড়ছেই না। সামনে থাকা মোহিনীর দিকে অদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তূবা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। কাজল কালো চোখ গুলি বুকের ভেতরে ছুরির মতো আঘাত করছে আহফিনের। গোলাপের পাপড়ির ন্যায় গোলাপি ঠোঁট গুলি তাকে বড্ড টানছে। আহফিনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। তার এমন হাল দেখে তূবা এবার না হেসে পারল না। তূবার হাসি দেখে আহফিনের মস্তিষ্ক যেন কাজ করা থামিয়ে দিয়েছে। সে মাথা ঝাকায় চোখ বন্ধ করে। আবার তাকায় তূবার পানে। নেশাতুর চোখ গুলি নিয়ে এগিয়ে গেল তূবার দিকে।

“কি দেখছেন?”
“তুমি তূবাই তো? নাকি তার যমজ বোন?”
তূবা এবার খিলখিল করে হেসে উঠল। আহফিন তখনো নিজের ঘোর থেকে ফিরতে পারেনি। সে আচমকা তূবার গালে হাত রাখল। বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে তূবার গালে হাত বুলিয়ে দিল। তূবার মাথা এগিয়ে এনে গভীর ভালোবাসা দিল কপালে। তারপর বুকের গহীনে শক্ত করে জাবড়ে ধরল। কেন যেন তার চোখ গুলি চিকচিক করে উঠছে।
আহফিনের এমন কান্ডে তূবা হতবাক। শান্ত হয়ে মাথা পেতে রেখেছে আহফিনের বুকে। কি শীতল বুক!

আহফিন তূবা কে তুলে আবারো চুমু দিতে লাগল কপালে। অন্য হাতে তূবার আরেক গাল স্পর্শ করল। আহফিনের দুই হাতের তালুতে তূবার মুখশ্রী আরো বেশি মায়াবী লাগছিল। ডাগরডাগর চোখ গুলি তাকিয়ে আছে আহফিনের চোখের দিকে। মুখ ফুসকে বলেই ফেলল
“কি দেখছেন আহফিন?”
“সুহহ। আমার চোখের তৃষ্ণা মিটাতে দাও তোমার ওই কাজল কালো চোখের গভীরতায় তাকিয়ে থেকে। যদি পারতাম এই চোখ বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখতাম। আমার সাধ্য নেই। তাই তোমাকেই চোখের সামনে রাখতে চাই আজীবন। লুকিয়ে রাখতে না পারি। সামনে রেখে দিব যত্ন করে।”
“আমি কি সারাজীবন আপনার কাছে থাকব আহফিন?”
“হ্যাঁ।”
“যদি না থাকি?”
“জোর করে রাখব।”
“জোর করে কি রাখা যায়?”
“হ্যাঁ চাইলেই পারা যায়। আমার চোখের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য হলেও তোমাকে আমি বেঁধে রাখতে রাজি আছি।”

তূবাতূবা হুট করে আহফিন কে জড়িয়ে ধরল। কেন ধরল তা জানে না। আজকাল অনুভূতি গুলি বড্ড অবাধ্য হয়েছে। তারা কিছুতেই তার লাগামে থাকতে চাইছে না। সেগুলি এখন বেহায়া বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা শুধু আহফিন কে চায়।
আহফিন তূবাকে শক্ত করে আগলে নিল। তার মাথায় ঠোঁট স্পর্শ করল। আহফিন বিড়বিড় করল
“তোমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে আমি শতশত বছর পাড়ি দিতে চাই। আমার বুক হীম করার জন্যে হলেও তূবার শীতল পরশ চাই।”
তূবা চোখ বন্ধ করে নিল। মনে মনে বলল
“আমিও আপনার এই শীতল বুকে মাথা রেখে নিজের দুঃখ ভুলতে চাই আহফিন। তবে সেটা কি আদৌও সম্ভব?”

—-
তূবা তাড়া দিচ্ছে তুসি কে তাড়াতাড়ি তৈরি করিয়ে দিতে। ডক্টর দেখানোর সময় হয়ে গিয়েছে। এক মিনিট দেরি করলেও সিরিয়াল সবার লাস্টে চলে যাবে। তূবা না খেয়েই তুসি কে নিয়ে বের হয়ে গেল। শিরিন বেগম যেতে চাইলেও তূবা বলল “আম্মা তোমার যেতে হবে না। আর ওখানে দেরিও হতে পারে। তুমি বাসায় থাকো।”

তুসি কে নিয়ে তূবা বের হয়েছে। আহফিন বলেছিল আসবে। তূবা না করলেও তাকে না আসার জন্যে রাজি করাতে পারে নি। পরে নিজেই ফোন করে বলল তার কাজ পড়ে গেছে। তূবা মনে মনে খুশিই হলো। তা নাহলে তুসি কে কি বলত সে?”

তুসিকে হুইল চেয়ারে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় গলি থেকে অনেক দূরে হঠাৎ রনির সাথে দেখা হয়ে গেল। ভয়ে তূবার কলিজা শুকিয়ে গেছে। আবার কোনো অঘটন ঘটতে চলছে নাকি? রনি কে দেখে তূবার স্বাভাবিক মনে হলো না।

তুসি ঘাড় কাত করে তূবা কে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না। তূবা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল
“তুই এখানে কি? পথ আটকে দাঁড়িয়েছিস কেন?”
“…

রনি কিছু বলল না। শুধু লাল ফোলা চোখ গুলি তূবার উপর নিক্ষেপ করল। দেখতে কেমন নেশাখোরের মতো লাগছে। গা থেকে বাজে গন্ধও বের হচ্ছে। তূবা কিছু বলতে যাবে তখনি..!

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here