ফানাহ্ 🖤 #লেখিকা_হুমাইরা_হাসান #পর্বসংখ্যা_০৭

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_০৭

বিছানার হাটু মুড়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মোহর,সারা চেহারায় আতংকের ছাপ, এসির হীম শৈথিল্যের দাপটেও কপাল টপকে এক ফোঁটা দু’ফোঁটা ঘাম ঝরছে। কিছুতেই সে জ’ঘন্য স্পর্শের কথা ভুলতে পারছে নাহ। সারা শরীরে তীব্র জ্বলন অনুভূত হচ্ছে, নিজেকে নিজেরই শেষ করে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছের মতো বিকৃত মস্তিষ্কের অস্থিত রোপ ছড়াচ্ছে।

শেষ রাতে শরীরে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেছিলো মোহরের। কোমড়ের আশেপাশে ক্লেদপূর্ণ অপ্র’কিতস্থ স্পর্শ পেয়ে ঘুম ছুটে যায় এক লহমায়, অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে। মোহর ভয়ে চিৎকার করতে গেলেই একটা হাত মুখ চে’পে ধরে, প্রাণপণে ছটফট করতে থাকে মোহর। কিন্তু দানবের ন্যায় অত্যুগ্র শরীর টার সাথে পেরে ওঠে না। নিদারুণ জীতি-তে মোহরের চোখ ছেপে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আজ হয়তো তার একমাত্র সম্বল সম্মান, ব্যক্তিত্ব টাও ধ্বংস হবে। অন্ধকারের ভয়ংকর নিকৃ’ষ্টতর হাতছানিতে হয়তো আজ তার সম্ভ্রম টাও হারাবে।
কোমরে থাকা হাতটার বিচরণ বাড়তে থাকলো, ধীরে ধীরে স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। মোহর দুইপা নাড়াতে গিয়েও পারলো না শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে খামচে ধরলো আগন্তুকের হাতে। গা গুলিয়ে আসছে ওর। তন্মধ্যে হুট করেই বাইরে বেশ জোরে কিছু পড়ার শব্দ হলো, মনে হলো এক জোড়া পা এদিকেই আসছে। তৎক্ষনাৎ সেই জঘন্য স্পর্শ টা সরে গেল।
মোহর হাত পা আছড়ানো থামিয়ে নির্জীবের ন্যায় দমে গেল, এতক্ষণ আছড়া-পাছড়ি করে শরীরের সমস্ত শক্তি টুকুও যেন ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু তবুও কাঁপা কাঁপা শরীরে উঠে গিয়ে ঘরের লাইট জ্বেলে দিল।আশেপাশে কোনো মানুষের অস্তিত্ব টুকুও নেই। কিন্তু মোহরের শরীরে চেপে ধরা জায়গা গুলোতে এখনো দপদপ করছে, এটা স্বপ্ন হতেই পারে নাহ। গলা শুকিয়ে এলো মোহরের। এমন নি’কৃষ্ট স্পর্শের চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। চোখ দিয়ে যেন লোহূ ঝরছে অশ্রুবিন্দুর সহিত।

সেই থেকেই বিছানায় পা গুটিয়ে শুয়ে আছে মোহর। হাত পা থরথর করে কাঁপছে, চোখ মুখ ফুলে রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। সারা শরীর রি রি করছে, অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তহিম করা ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারছেনা সে। মনে হচ্ছে বি’ষাক্ত সাপের দংশ’নে শরীরে বি’ষক্রিয়া ধরেছে। এসব কেন হচ্ছে ওর সাথে? আর কত কিছু সইতে হবে ওকে, কি এমন পাপ করেছিল যে সৃষ্টিকর্তা এমন নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দিচ্ছে? কি ছিল তার অপরাধ? এখন কি করবে, কাকে বলবে? কেও কি আদও বিশ্বাস করবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদেরকেই পায়ের নিচে রাখা হয়। আর এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের চক্ষুশূল ও বিশ্বাস তো দূর বরং ওর ঘাড়েই চরি’ত্রহীনতার দোষ চাপিয়ে আঙ্গুল তুলবে। এমন জ’ঘন্য কথাটা বিশ্বাস করার কেও নেই, সা’পের ছুঁচো গেলার মতো শ্বাসরুদ্ধ করে গলাধঃকরণ করতে হবে!
আর কতদিন এই দম বন্ধ করা মর্মভেদী যন্ত্রণাদায়ক জীবন বয়ে বেড়াতে হবে! নিজেকেই এখন ঘৃ’ণা হচ্ছে মোহরের। এই ছিল তার নিয়তি! তবে এহেন জ’ঘন্য পরিণামের বদলে মা বাবার সাথে তাকেও কেন মাটি গ্রহণ করলো নাহ, বিধাতা তাকেই মৃত্যু দিত। তবুও এই অভিশপ্ত জীবনের দায়ভার সঁপে না দিত!

ভোর থেকে এই যন্ত্রণায় পার করলো। সকালের আলো ফোঁটা পর্যন্ত ওমন গুটিয়েই রইলো বিছানার এক কোণায়। সময়ের পাল্লার সক্রিয়তার সঙ্গে মোহরের সারা শরীর নির্জীব হয়ে আসতে থাকলো। ঝিম দিয়ে উঠলো সমস্ত দেহ। হুট করেই গা গুলিয়ে আসতেই কালক্ষেপণ না করে বিছানাতেই গড়গড় করে বমি করে ফেলল মোহর। কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর শক্তি টুকুও পেল নাহ। অকস্মাৎ সারা হাত পায়ে অসম্ভব কাঁপুনি শুরু হলো, চোখের মণি উলটে সাদা অংশ বেড়িয়ে এলো। বিছানায় চিত হয়ে পরে বিকৃত ভাবে বেঁকে গেল মোহরের শরীর। প্রবলভাবে হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে এক সময় থেমে গেল সবকিছু, নিষ্ক্রিয় হয়ে এলো পুরো দুনিয়াটা।

…………………..

-তোমাকে কি এই জন্যে রাখা হয়েছিল? কোথায় ছিলে তুমি?

ভয়ং’করভাবে গর্জে উঠলো মেহরাজ। নাজমা থরথর করে কেঁপে উঠলো এহেন হুংকারে। শাহারা উঠে এলো বিছানার শিথান থেকে, মেহরাজের কাঁধে হাত রেখে বলল

-শান্ত হও মেহরাজ। ওর এই অবস্থা হবে এটা কেও আঁচ করতে পারেনি, কে জানতো এক রাতের মধ্যে এই অবস্থা হবে, আমি ওকে রাতেও সুস্থ স্বাভাবিক দেখে গেলাম

-এই জন্যেই বলেছিলাম ওকে চোখে চোখে রাখতে। ওর যদি কিছু হয়ে যায় আই স্যুয়ার এর শোধ কড়ায় গন্ডায় উসুল করবো আমি।

বলেই অপেক্ষা না করে আবারও ছুটে গেল মোহরের পাশে। ডান হাতের কবজিটা হাতে তুলে ক্ষানিক চুপ করে রইলো। পালসরেট এখনো খুব ক্ষীনভাবে দৌড়াচ্ছে। সারা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে পাংসুটে বর্ণ ধারণ করেছে। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে নীল হয়ে গেছে। হুট করে দেখতে যে কেও মৃ’ত বলে দিতে পারে।
উপস্থিত সকলে খুব বেশি চিন্তিত না হলেও চেহারায় বেশ কৌতূহল আর আতঙ্কের ছাপ। কাকলি কৌতূহল দমাতে না পেরে ফিচেল স্বরে বলেই উঠলো

-এই মেয়ে আবার বি’ষ টিষ খেয়েছে নাকি। বলা তো যায়না। সারাদিন ঘরের মধ্যে ভূতের মতো বসে থাকে।

-যে বাড়িতে তোমাদের মতো সর্পতুল্য মানুষ থাকে সেখানে ওর মতো মেয়ের ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কিই বা করার আছে, সামনে গেলেই তো ফোস করে ওঠো

বৃদ্ধা গলার ঝাঝালো স্বরে বলল শাহারা। তাৎক্ষণিক কাকলির মুখে আধার নামলো। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বেশ আওয়াজ করেই বলে উঠলো

-আপনি এই দুদিনের মেয়ের জন্য আমাকে সাপ বলছেন মা। আমি এ বাড়ির বউ কোনো রাস্তায় মেয়ে নই যে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি

কথাটা তুলনামূলক উচ্চস্বরে হওয়ায় মেহরাজের কানে বিঁধে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে রক্তচক্ষুতে তাকালো কাকলির মুখের দিকে। নিমিষেই চুপসে গেল সে, চোখা মুখটা মুহুর্তের মাঝেই ভোতা স্বরূপ হলো।
পাশেই দাঁড়িয়ে মেহরাজের মা মিসেস আম্বি। কিছু একটা বলার জন্য উসখুস করছে বেশ অনেকক্ষণ ধরে। মুখ খুলবে তার আগেই ঘরে প্রবেশ করলো মোটাসোটা খাটো শরীরের মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক।
মেহরাজ কাকলিকে কিছু বলবে তার আগেই ভদ্রলোকের আগমনে উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গিয়ে কালো রঙের আয়তাকার বক্সটা হাতে এগিয়ে আনলো।
ভদ্রলোক এসেই মোহরের পাশে বসে চোখের নিচে হাত রেখে ফ্যাকাসে চোখ দু’টো পর্যবেক্ষণ করলো। পালসে হাত রেখে দাঁড়ি গোফে আবৃত মুখ খানা আরও গম্ভীর করে তুললো।

দীর্ঘ মুহুর্ত পার করে, মোহরের হাতে স্যালাইনের নল ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কতগুলো ওষুধের নাম প্রেসক্রাইব করে মেহরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল

-মি.আব্রাহাম আপনি একটু আমার সাথে বাইরে আসুন

মেহরাজ উঠে দাঁড়ালো, ডাক্তারের সাথে বাইরে এসেই বলল

-ডক্টর কেমন বুঝলেন। হাউ ইজ সি? ইস এভরিথিং অলরাইট?

-কিপ পেসেন্ট মি.আব্রাহাম। বি থ্যাংকফুল যে উনি এখনো ঠিক আছেন। নাহ তো যে অবস্থা দেখলাম আর কিছুক্ষণ দেরি হলে অনেক খারাপ কিছু হওয়ার আশংকা ছিল, এ্যানিওয়েস এরকমটা কি এর আগেও হয়েছিল? আর কি কারণে হয়েছিল সেটা আমাকে বললে ভালো হয়!

মেহরাজের প্রশস্তত কপালে সরু ভাজ পড়লো। আঁখিদ্বর নিমিত্তে ছোট করে জিজ্ঞাসা করলো

-ওর এক্সাক্টলি কি হয়েছিল ডক্টর?

-উনার খিঁচুনি হয়েছিল, মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্সের স্নায়ুকোষসমূহের অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক ক্রিয়ার ফলে খিঁচুনি হয়। বার বার স্নায়বিক কারণে অর্থাৎ হঠাৎ খিচুনি বা অজ্ঞান হয়ে যাবার রোগ। এটি একপ্রকার মস্তিষ্কের রোগ; চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় “নিউরোলোজিক্যাল ডিজিজ”

খানিক থেমে ডক্টর আবারও বললো

-রক্তে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হলে, শর্করা কমে গেলে, মাথায় কোনো আঘাত পেলে বা টিউমার হলে, মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা স্ট্রোক হলে খিঁচুনি হতে পারে। মৃগীরোগীদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত ওষুধ সেবনেও খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। আসলে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো কারণই জানা যায় না। তবে উনার ক্ষেত্রে যেটা বুঝলাম উনি মেইবি মানসিকভাবে ভীষণ আঘাতপ্রাপ্ত। প্রেসার এখনো আপ-ডাউন করছে। উনি হয়তো কোনো কিছুতে ভীষণ ভয় পেয়েছে বা আতংকিত হয়েছে যার ফলে এইরকম সিচুয়েশন ক্রিয়েট হয়েছে। আশাকরি আপনি ব্যাপার টা বুঝতে পারছেন মি.আব্রাহাম?

এতক্ষণ ভীষণ মনোযোগ সহকারে ডাক্তারের কথা গুলো শুনছিল মেহরাজ। প্রত্যুত্তরে ঘাড় নাড়ালো কিঞ্চিৎ। ডক্টর জিজ্ঞাসা করলো

-মৃগীর কথা যে বললাম, এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, সেখানে জিহ্বা কেটে যাওয়া, ঠোঁট কেটে যাওয়া, মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে যাওয়া, কাপড়ে প্রস্রাব-পায়খানা করে যাওয়া, যখন তখন অজ্ঞান হয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া, সেগুলো সাধারণত মৃগী রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। হিস্টিরিয়া রোগটা মেয়েদের বেশি হয়, অল্প বয়সে বেশি হয়। উনার ক্ষেত্রে যা বুঝলাম তা হলো উনি কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে এতো বেশি প্যানিকড হয়ে গেছিলেন যে তৎক্ষনাৎ প্রচণ্ড জ্বর আর মিনি অ্যা’টাকে খিঁচুনি উঠে গেছে। আর ভয় পাওয়ার কারনটাও হয়তো সংযত, উনার গলায় এবং মুখে আঙুলের ছাপ রয়েছে, আই ক্যান্ট বিলিভ আপনার বাড়িতে কেও ফিসিক্যালি এ্যাবি’উসড হচ্ছে মি.আব্রাহাম!

শেষের কথাটায় প্রচন্ড হতবিহ্বলতা আর কৌতূহল প্রকাশ পেল। মেহরাজ বিচলিত হলো নাহ। বরং শান্ত স্বরেই বলল

-এক্সাক্টলি ইটস নট দ্যাট হোয়াট ইউ থট। রিসেন্টলি মোহরের মা পাসড হয়েছেন। যার কারণে ও অনেক বেশি প্যানিকড। অ্যা লিটিল বিট মেন্টালি সিক। বাট আ’ম সিউর সি উইল রিকোভার সুন। আপাতত এই ওষুধ গুলোতে কি ও সুস্থ হবে ডক্টর?

-আশা করছি। তবে মেডিসিনের চেয়েও উনার এখন সাপোর্ট দরকার। ইফ ইউ ডন্ট মাইন্ড মে আই নো মিস.মোহর আপনার কি হয়?

ডক্টরের গলায় একরাশ কৌতূহল। মেহরাজ খানিক নির্লিপ্ত তাকিয়ে রইলো।এই লোকটা দীর্ঘদিন ধরে তার পরিবারের সকলের চিকিৎসা করে আসছে। বেশ সম্মান করে মানুষ টাকে।
খানিক মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে স্ট্রেইট কাট স্টাইলে বলল

-সি ইজ মাই ওয়াইফ। মিসেস.মেহরাজ আব্রাহাম

ডক্টর খানিক হা করে চেয়ে রইলো। যেন বড়সড় তব্দা খেয়েছে। মেহরাজ উনাকে দমিয়ে কোনো রকম সংযোজন বিয়োজন করে বুঝিয়ে বলল আনএক্সপেক্টেডলি বিয়ে হওয়ার কথা। ডক্টর ঘনঘন মাথা ঝাকালো, যাওয়ার সময় মেহরাজের কাঁধে হাত রেখে বলল

-আই নো ইউ আর ভেরি রেসপনসেবল এ্যন্ড সিনসিয়ার ম্যান। তবুও বলছি ওয়াইফকে টাইম দাও, খেয়াল রাখো,। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে ওর লাইফ রিস্ক আছে।

মেহরাজ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। ডক্টর যেতেই শান্ত চেহারার ফাঁকের ক্রুদ্ধ চেহারা টা উপচে এলো, ঘরে ঢুকতেই শাহারা বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে বলল

-ডাক্তার কি বলল মেহরাজ ওর কি হয়েছিল

সব প্রশ্ন আর অনুসন্ধিৎসা ভরা চাহনিকে অগ্রাহ্য করে ওর ভীষণ শানিত গলার তীক্ষ্ণভেদি স্বরে আরাব করে বলল

-ওর এই অবস্থার জন্য যে দায়ী তাকে আমি কিছুতেই ছাড়বো নাহ। আর লাস্ট বারের মতো বলে দিচ্ছি এরপর থেকে মোহরের প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার আমি সহ্য করবো না, ওকে যদি কারো সহ্য না হয়, তবে বাড়ির ফটক হার হামেশা উন্মুক্ত। আই ওন্ট টলারেট এ্যানিমোর!

বলেই ঘরের কোণার দিকের বিশাল আলমারির সামনে গিয়ে কাবার্ড খুলে একটা বক্স বের করলো। সকলে তখনও নিশ্চুপ

-নাজমা, মোহরের সব প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো আমার ঘরে এনে দাও।

-ও কি এখন তোর ঘরেই থাকবে বাবু?

আম্বির প্রশ্নের উত্তর তৎক্ষনাৎ করলো না মেহরাজ। বক্স থেকে একটা প্যাকেট বের করতে করতে বলল

-বউ যখন আমার তখন থাকবেও আমার ঘরে, এটা কি স্বাভাবিক নয়?

আম্বি বেগমের এই মুহূর্তে প্রচন্ড রাগ উঠলো। বিছানায় শয্যাশায়ী রুগ্ন মেয়েটার উপরেও মেজাজ ক্ষুব্ধ হলো যেন, তিরতিরে গলায় বলল

-আমি তোদের ডিভোর্সের জন্যে এ্যাপইন্ট করেছি, এখন তোরা যদি সেপারেশনে না থাকিস তাইলে ওটা গ্রান্টেড হবে কি করে

শাহারা বেগমের মেজাজ জ্বলে উঠলো পুত্রবধূর এহেন কথা শুনে। ধমক দিয়ে বলল

-ছি ছি আম্বি, তোমার কান্ডজ্ঞানের সাথে কি মনুষ্যত্বও লোপ পেয়েছে? এই মেয়েটার এই অবস্থাতেও তুমি সেপারেশনের কথা বলছো।

তবে আম্বির থেকে উত্তর আর এলো না। তার আগেই মেহরাজ হুকুমের স্বরে বলল

-আর কোনো কথা নাহ। আসতে পারো তোমরা

আম্বি অপমান আর ক্রোধে ক্ষুব্ধ হয়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে, সাথে সাথে কাকলিও পিছু ধরলো। শাহারা বেগম গেলে সব শেষে বেরোলো নাজমা,
মোহর যখন ভোররাতের দিকে বিছানাতে পরে কাতরাচ্ছিল তখন ওই দেখেছে প্রথমে। কোনো কিছুর পরোয়া না করে আগেই মেহরাজ কে ও তারপরে শাহারাকে খবর দিয়েছে। বমি করে ভাসিয়ে সেই বিছানাতেই পরে ছিল মোহর। মেহরাজ কোলে তুলে এনেছে নিজের ঘরে, নাজমার এ বাড়িতে থাকার এত বছর মেয়াদে এই প্রথম মেহরাজের বিছানায় হয়তো কাওকে দেখলো।
মাঝে মধ্যে মেহরাজ কেও কেমন সন্দেহ হয় নাজমার। আদও মোহরের সাথে ওর পরিচয় দুদিনের? অকস্মাৎ জোর করে হওয়া বিয়েতে রাজি হয়ে গেল সে? কিন্তু মেহরাজ তো চাইলেই..

-কিছু বলবে?

পুরোটা ভাবতেও পারলো নাহ। তার আগেই মেহরাজের নিরুত্তাপ কন্ঠস্বরে সম্ভিৎ ফিরলো। ঘনঘন মাথা ঝাকিয়ে না বলে বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে।

……………………

গলা মুখ শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে আছে। কোন অবস্থায় কিভাবে আছে কিছুই ঠাওর করতে পারছে না মোহর। চোখের পাতার উপর যেন টন খানেক ভর ভার করে বসে আছে। খুলতে গেলে হাঁফিয়ে উঠছে। দীর্ঘ সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে টিপটিপ করে চোখের পাতা খুললো মোহর। আদও কি বেঁচে আছে সে? এমন নিস্তেজ অসাড় কেন লাগছে?
চোখের উপরে বিশাল ছাদ। কিন্তু কেমন যেন অন্যরকম। হীম শৈথিল্যে রুগ্ন শরীরে শৈতপ্রবাহ বয়ে গেল। কাঁপতে থাকা বা হাতটা নাড়াতে গেলে তীক্ষ্ণ সুচের মতো কিছু একটা বিঁধে গেল, মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো মোহর।
তবে তার শব্দ এতই নিম্ন ছিল যে খুব কাছে না থাকলে হয়তো এক ঘরে থেকেও কেও শুনতে পারবে নাহ।
ভারি চোখের পাতা সম্পূর্ণ খুলতে না পারলেও যথাসাধ্য প্রসারিত করার চেষ্টা করলো, ঘাড় কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে আশপাশ টা দেখার প্রচেষ্টা করলেও শুধু এক পাশের বিশালাকৃতির একটা কাঁচ ছাড়া কিছুই দেখতে পেল নাহ। কাঁচ নয় আয়না, কোনো ফ্রেমে বাঁধাই করা নয়,তবে চারপাশে বর্গাকৃতির নকশা করা, কেমন অদ্ভুত সুন্দর।
তবে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো নাহ। কণ্ঠনালী শুকিয়ে ক্ষরা ধরেছে, মুখের ভেতর কেম৷ তিতকুটে স্বাদ লেগে আছে। একটু পানি খাওয়া দরকার, মুহুর্তেই কাশি উঠে গেল মোহরের। কাশির দাপটে নিস্তেজ শরীর টা নড়েচড়ে উঠলে স্যালাইনের নলটা বেকে তড়তড় করে রক্ত উঠে গেলো সফেদ নলের বিপরিতগামী হয়ে।
এক মুহুর্তের মধ্যে পুরোটা উপলব্ধি করতে পারলো নাহ মোহর, ঘাড়ের পেছন দিক থেকে আলতো ভাবে কেও স্পর্শ করে সামান্য উঁচু করিয়ে মুখের সামনে পানির গ্লাস ধরলে চুকচুক শব্দ করে মোহর পুরো গ্লাসের পানি সাবাড় করে দিল। যেন জন্ম থেকে তৃষার্ত ছিল। ধরে প্রাণ ফিরলে মুখের ঠিক ছয়/সাত ইঞ্চি দূরে একটা পুরুষালী চেহারা ঝুঁকে থাকতে দেখে বায়োস্কোপেএ স্লাইডের মতো তড়াৎ স্বচ্ছভাবে মোহরের সেই বিকৃত ঘটনা টা মনে পরে গেল,
দূর্বল হাতের এক ধাক্কার মেহরাজকে সরিয়ে দিলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বিছানার এক কোণায় লেপ্টে গেল

-ইটস ওকে, আমি আমি। ভয় পেও না

মেহরাজ এগিয়ে আসতে গেলে মোহর আৎকে উঠলো। দূর্বল গলায় চিৎকার করে বলল

-সরে যান,দূরে সরে যান। আমার কাছে আসবেন নাহ। খবরদার, এবার আমায় ছুঁতে আসলে আমি নিজেকেই শেষ করে দেব বলে দিলাম সরে যান বলছি

স্যালাইনের নলে টান লেগে গলগল করে রক্ত ছুটে বেরোচ্ছে মোহরের হাত দিয়ে, সেই রক্তে বিছানার চাদর ভিজে ছোপছোপ দাগ বসে যাচ্ছে। সেদিকে একদমই ভ্রুক্ষেপ নেই মোহরের বিরতিহীনভাবে বলতেই থাকলো

-আমাকে ছোঁবেন না, একদম নাহ। জ’ঘন্য সবাই। সবাই খারাপ। আমি ম’রে যাব, চলে যাব আমি

মেহরাজ ব্যতিব্যস্ত হলো নাহ, নিজের সদাসর্বদা শান্ত ভাব টা ধরে রেখেই বলল

-তোমাকে কেও ছোঁবে না মোহর, এদিকে আসো দেখ তোমার হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে। আমাকে দেখতে দাও

-না না না, আপনি আমায় ধরবেন নাহ। আমার কষ্ট হয়, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আপনার পায়ে পরি আমায় ধরবেন নাহ

-তোমার হাত থেকে রক্ত বেরোচ্ছে মোহর, ক্ষতি হয়ে যাবে। কেও কিচ্ছু বলবে না। এদিকে আসো

বলে এক পা এক পা করে এগোতে লাগলো মেহরাজ। মোহর সরতে সরতে খাটের কোণায় এসে পড়েছে। আরেকটু হলেই পড়ে যাবে, মেহরাজ ছুটে এসে ওকে ধরতে গেলে মোহর ওকে বিস্মিত করে ছুটে ওর পায়ের কাছে বসে পরে, দু’হাতে মেহরাজের পা ধরে বলে,

-আমি আপনার পায়ে পরি, আমায় মুক্তি দিন। আমায় মে’রে ফেলুন। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। এত বড় শাস্তি আমি কেন পাচ্ছি আমিতো কারো ক্ষতি করিনি। আমি চলে যাব অনেক দূরে চলে যাব। সবার জীবন থেকে দূরে,আমায় মুক্তি দিয়ে দিন
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here