ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৪১ #হুমাইরা_হাসান

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪১
#হুমাইরা_হাসান

– হ্যালো! আপনি কে হ্যাঁ? আমাকে ফ্লাওয়ার বুকে আর ফোনে টেক্সট পাঠানোর সাহস কি করে হলো আপনার?

হাতের মুঠোয় আগলে রাখা ফোনটা ফসকে পড়তে গিয়েও যেনো তড়িঘড়ি করে ধরে ফেললো অভিমন্যু। বিস্ফোরিত চোখে একবার তাকালো ফোনের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করা এগারো ডিজিটের নাম্বারের দিকে, ততক্ষণে ওদিক থেকে আবারও বাজখাঁই প্রশ্নটা ফোন কাঁপিয়ে ভেসে আসলো

– কি হলো শুনতে পাচ্ছেন না? সামনে পেলে গু’লি করে কানের ফুঁটো মেরামত করে দেবো হনুমান মুখো

– হোয়াট! হোয়াট ইজ হনুমান মুখো!

অভি’র প্রচন্ড বিব্রতকর অভিব্যক্তিতে এক লহমা মনোযোগ না দিয়ে শ্রীতমা কণ্ঠের খাদ সুউচ্চ করেই বলল

– হনুমান মুখো কি সেটা আয়নার সামনে দাঁড়ালেই টের পাবেন, এক তো আমাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে মা’রতে চেয়েছেন এখন আবার চিরকুট পাঠিয়ে জ্ঞ্যান দিচ্ছেন? তাও আবার সাথে কয়েকটা বাসি ফুল দিয়ে

– দেখুন ফুলগুলো একেবারেই বাসি ছিলো না, আমি ফ্রেশ ফুল নিয়েই গেছিলাম কিন্তু তখন দিতে পারিনি বলে ওটা বাসি হয়ে গেছিলো

– দেখুন আপনার সাথে ফালতু কথা বা ঝগড়া করার সময় আমার নেই আপ..

– আপনি নিজেই ফোন নিয়ে চ্যাঁচামেচি করছেন আবার নিজের বলছেন ঝগড়া করতে চান না, আজব মহিলা তো আপনি

এক তো শ্রীতমাকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই অভিমন্যু মুখের কথা ছিনিয়ে নিলো, তার উপর ওর উপরেই কি না চ্যাঁচামেচির অপবাদ দিচ্ছে, আর মহিলা! কে মহিলা?

– এই আপনি কিন্তু সীমা..

– আপনাকে মি.আব্রাহাম ডেকেছেন

এবারও শ্রীতমার কথার মাঝখানে দাড়ি বসিয়ে দেওয়া হলো, তবে এবার সেই কাজটার দায়ভার পড়লো কোনো এক অপরিচিত কণ্ঠে। ফ্যাসফ্যাসে একটা পুরুষ গলায় অভিমন্যুকে কথাটি বলতেই ও ধপ করে ফোনের স্ক্রীনের লাল অপশনটিতে আঙুল চেপে লাইনচ্যুত করেই আগন্তুকের সাথে হাঁটা ধরলো। শ্রীতমা হাত থেকে ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিলো বিছানাতে। অহেতুক রাগ হচ্ছে তার, ব্যাপারটাতে ও নিজেই নিজের উপর বিরক্ত। খুব ইচ্ছে করছিলো ফোনের অপরপাশের ছেলেটিকে আচ্ছা করে যা নয় তা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু সেটাও তো পারলো নাহ। মিজের নিয়ন্ত্রণহীন মেজাজে নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠে দাঁড়ালো, বাইরে একটু হাঁটাহাঁটি করা দরকার। সতেজ হাওয়া বুক ভরে নেওয়া দরকার, একটু শান্তি মিলবে হয়তো তাতে।

___________________________

কফির কাপটাতে লম্বা চুমুক দিয়ে লাল রঙের ফাইলটা হাতে তুলে নিলো, ভীষণ মনোযোগী চেহায়ায় সফেদ পৃষ্ঠার এপাশ ওপাশ উলটে পালটে দেখতে থাকলো। মোহর এবার ও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, লোকটার চোখে মুখে কৌতূহল। এসে থেকে যতবারই এই মানুষটার সাথে দেখা হয়েছে ততবারই শান্ত,নিশ্চুপতা খেয়াল করেছে। তবে মানুষটাকে একেবারেই মেহরাজের মতো রাশভারি স্বভাবের মনে হয় নাহ। আরও একটা ব্যাপার খুব গভীর ভাবে খেয়াল করেছে মোহর যে মেহরাজ অন্য কোনো ছেলে মোহরের আশেপাশে ঘেঁষলে তো বেশ রেগে যায়,আর এখন নিজেই একটা ছেলেকে তার ঘরে পাঠয়েছে! এমনকি একটা পরপুরুষ যে মেহরাজের ঘরে এসে মোহরের সামনে বসে আছে, তৃতীয় ব্যক্তির ও তো উপস্থিতি নেই, তবুও বাড়ির লোক তো একবার ও আড়চোখে তাকালো না!

সাত পাঁচ ভাবনার মাঝে আরো একটা ভাবনা বেশ সূচালো ভাবেই মস্তিষ্কে গেঁথে রইলো, তা হলো সাঞ্জের ভাষ্যমতে ইনিই তাথইয়ের পুরোনো প্রেমিক বা প্রাক্তন। পৃথক, পৃথক ইয়াসির। তাথই তো এখনো এই মানুষটার জন্যেই কষ্ট পায়। আচ্ছা এদের দুজনকে কি এক করে দেওয়া যায়না? এই মানুষটার চোখেও তো স্পষ্ট মায়া,টান দেখতে পাওয়া যায়। ইনি কি আরেকবার চাইবেন না ভালোবাসার মানুষটাকে এবার নিজের করে নিতে? নাকি পুরোনো সম্পর্কেত সুতোয় আর টান দিতে চাইবেন নাহ!

– মোহর?

ভাবনা ভঙ্গুর হলো স্পষ্ট সুন্দর একটা কণ্ঠে। মোহর অপ্রস্তুত হয়ে বলল

– জ্বী?

পৃথক ফাইলটা বন্ধ করে মোহরের দিকেই তাকিয়ে, ললাটে কিঞ্চিৎ ভাঁজ লক্ষ্য করা গেলো, তা চিন্তা নাকি দুশ্চিন্তার তা মোহরের জানা নেই। মৃদু স্বরে পৃথক বলল

– তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও মোহর?

মোহর বিব্রত হলো, এই জন্য বলে ডাক্তার আর উকিলদের কাছে কিছু লুকানো যায়না। এরা মানুষের চোখ মুখের ভাষা পড়তে পারে। মোহর বিব্রত হয়েই আমতা-আমতা করে বলল

– না আসলে

– তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বোসো এখানে

মোহর মৃদুমন্দ পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে সামনাসামনি বসলো। শ্যামলা মুখে মিষ্টি হেসে পৃথক বলল

– তোমার আমাকে কিছু বলার থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো মোহর।

মোহর যেনো একটু ভরসা খুঁজে পেলো পৃথকের চেহারাতে। অমায়িক চাহনিতে চেয়ে যেনো আপনজনের ন্যায় স্নেহ দেখতে পেলো। তবুও জড়ত্ব কাটাতে পারলো নাহ। আসলে ব্যাপারটাই এমন যে কথা শুরু করার কোনো তালগোল খুঁজে পাচ্ছে না। তবুও ধাতস্থ ভাবে জড়তা নিয়েই বলল

– আপনি কিছু মনে না করলে আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই

– তাথই আর আমাকে নিয়ে তাইতো?

মোহর বিব্রত হলো। একটু না অনেক বেশিই বিস্মিত হলো। পৃথক কি করে বুঝলো ও এ কথাই জানতে চাইবে? ও তো এই ব্যাপারে কিছুই বলে নি! মোহরের বুকভর্তি একঝাঁক কৌতূহল আর জিজ্ঞাংসুকে আবারও স্মিত হেসে পৃথক সহজতর করে দিলো। সামান্য হেসে বলল

– আমি আর তাথই যখন নিচে কথা বলছিলাম তুমি উপর থেকে বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে ছিলে, ওখানের দৃশ্যটা দেখার পর যে কেও ই এই প্রশ্ন করতে চাইবে, তোমার কৌতুহলী হওয়া টাও স্বাভাবিক।

মোহর লজ্জিত হলো। সে কি না এখন আদব কায়দাহীনদের মতো অন্যের কথায় কান পেতে ধরা পড়লো! অপরাধীর মতো করে বলল

– আমি আসলে বারান্দার গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছিলাম। তখন দেখে ফেলেছি। ইচ্ছে করে আমি কারো কথায় কান পাতিনি

মোহরের নতজানু মুখটা ছোট্ট হয়ে গেছে। পৃথক এবার বেশ উচ্চরবেই হেসে উঠলো। মোহরের দিকে তাকিয়ে বলল

– তুমি আসলেই বেশ মজার মোহর। এইটুকুতেই এতটা ভাববার কিচ্ছু নেই। দেখতেই পারো, আফটার অল বাড়ি,ননদ দুটোই তোমার

মোহর প্রত্যুত্তরে খানিক চুপ রইলো। পৃথকের অতি সাবলীল আচরণে বেশ সহজতর বোধ করলো। তাই আর আগপাছ না ভেবেই ফক করে বলে ফেললো

– তাথই আপার আপনার উপর এতো রাগ কেনো ভাইয়া?

ফাইলের কাগজের ভাঁজেই স্থির হয়ে গেলো আঙুলের চালনা,পৃথকের হাসি হাসি মুখটা নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। তীব্র বিষাদের ঢাকা মুখটাতে কিঞ্চিৎ স্বাভাবিকত্ব আনার প্রচেষ্টা করলো , মৃদু স্বরে বলল

– কাওকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেটা রাখতে না পারলে তো ঘৃণা করা উচিত। তোমার তাথই আপার মন টা অনেক বড়ো তাই শুধু রাগ-ই করেছে।

মোহর যেনো উৎসাহ পেলো। বলার আগ্রহ আরো বেড়ে উঠলো। তবুও সেটা দমিয়ে কিঞ্চিৎ জিজ্ঞাংসুক গলায় বলল

– আপনাকে যদি আমি ব্যক্তিগত কিছু জিজ্ঞেস করি তাহলে কি রেগে যাবেন ভাইয়া?

– ভাইয়া বলছো, বোনের উপর কি রাগ করা যায় বলো!

মোহর আলতো হাসলো, আবারও গুরুতর ভাব নিয়ে বলল

– আপনি কি এখনো তাথই আপাকে ভালোবাসেন ভাইয়া?

নিস্তব্ধ ঘরে বাজ পড়ার ন্যায় কথাটা নিঃসৃত হলো মোহরের মুখ থেকে। পৃথক কয়েক মুহূর্ত ঠিক কোনো অভিব্যক্তি দিতে পারেনি, কয়েক লহমা পাথরের মতোই স্থির রইলো। নিস্তব্ধতা ভাংলো মোহরের গলায়

– আমি জানি হয়তো একটু অদ্ভুত প্রশ্ন করে ফেলেছি আমি। কিন্তু আমি জানতে চাই ভাইয়া! আপার জন্য এখনো এতটা অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, উনাকে একটু কষ্ট পেতে দেখে ঝাপিয়ে পড়লেন। ভালো বাসেন না তাহলে? আমিতো গল্প শুনেছি যেদিন আপনি চলে গেলেন সেদিনই আপনাদের দুজনের সম্পর্কের উপসংহার হয়েছে, তাহলে আজও কেনো তার জীবনে ভূমিকা রাখতে চাইছেন?

পৃথক প্রত্যুত্তরের ভাষা খুঁজে পেলো নাহ। মোহরের করা প্রশ্নটা ওর নিজেই নিজেকে করেছে বারংবার। তবুও কোনো উত্তর আসেনি। এই উত্তর তো ওর জান নেই! নিশ্চল চোখ দু’টো ফ্লোরে ফেলে পৃথক বলল

– কিছু জিনিসের কোনো উত্তর হয়না মোহ..

– উত্তর খুঁজে না পেলে সাজিয়ে নিতে হয়। নিজেই উত্তর তৈরি করে নিতে হয় ভাইয়া। আপনি আপার রাগ টা দেখছেন অথচ সেই রাগের আড়ালে এতগুলো বছরের তীব্র যন্ত্রণা, অপেক্ষাটা দেখতে পাননি?

পৃথক বসে থেকেই অস্থির করে উঠলো। ফাইলটা ধপ করে ফেললো সেন্টার টেবিলে যেটাকে মেহরাজ ওকে নিতে পাঠিয়েছে আজ। তৎপর হয়ে বলল

– মোহর তুমি যেমনটা ভাবছো আদও তেমন নয়। সময়, স্থান, পরিস্থিতি সব পালটেছে। যার চোখে এক সময় আমি নিজেকে দেখেছি তার মুখের দিকে তাকালেও এখন আমার বুকটা কেঁপে ওঠে, অপরাধী মনে হয় নিজেকে। কিন্তু আমি অপারগ ছিলাম, সত্যিই অপারগ। ওর হয়তো আমার উপর অনেক রাগ অনেক,কিন্তু আমারতো কিছু করার ছিলো নাহ।

এতটুকু বলেই থেমে গেলো, মোহর নিখুঁত ভাবে পরখ করলো প্রচন্ড অস্থির, বেদনামিশ্রিত চেহারা টা। কে বলেছে পুরুষের কষ্ট হয়না! পুরুষ যদি পাথরমনাই হয় তাহলে এই যে চোখে মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ, অপরাধ বোধ, গ্লাণি এটা কি? একটা মানুষকে কেন্দ্র করে যে পৃথকের হৃদবক্ষে র’ক্তক্ষরণ চলছে তা ওর মুখটাই স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। মোহরের কেনো যে মায়া হলো, ভীষণ রকম মায়া হলো পৃথকের চেহারায় তাকিয়ে। যেনো মনে হচ্ছে নিজের খুব আপন কাওকে কষ্ট পেতে দেখছে। সহানুভূতির গলায় বলল

– আমি জানি ভাইয়া,আপাতদৃষ্টির বাইরে অনেক কিছুই থাকে যা আমরা অনেকেই জানতে পারিনা। অথচ না জেনেই আমরা একটা মানুষকে ভুল বুঝে বসি। আমি জানিনা আপনার বাধ্যবাধকতা কি ছিলো বা কি হয়েছিলো, আপনি আর আপার সম্পর্ক টাও আমি সাঞ্জের মুখে যতটুকু শুনেছি ততটুকুই। কিন্তু একটা কথা আমি খুব করে জানি তা হলো, তাথই আপা আজও আপনাকে আগের মতোই ভালোবাসে, আজও আপনার অপেক্ষা করে। নারীর রাগ আর জেদের আড়ালে তীব্র অধিকার বোধ আর অভিমান লুকিয়ে থাকে। সেটাকেই রাগ বা ঘৃণা মনে হচ্ছে আপনার। কিন্তু আদতেও কি তাই?

পৃথক উত্তর করলো নাহ। খাপছাড়া লাগছে নিজেকে খুব, যতটা কঠোরত্ব নিয়ে ফিরেছিলো তা কিছুতেই ধরে রাখতে পারছেনা। কোনো ভাবেই পারছে না। বারংবার বেহায়া মনটা বছর কয়েক আগের ভুলটাকে সংশোধনের দাবি রাখছে সেই মায়াবী মুখখানায় নিজের জন্য ব্যাকুলতা দেখবার ইচ্ছে টা তীব্র থেকে তীব্রতর-ই হচ্ছে।

.

– তোর ভাবসাব কি বলতো? তোর মতিগতি কিন্তু একবারেই সুবিধার ঠেকছে না আমার,কি চাচ্ছিস টা কি তুই?

– কিসব বলছো তুমি? কি চাইবো আমি!

কাকলি বেগম চটে উঠলো মেয়ের কথায়। বেশ কিছুদিন ধরেই এই হেয়ালিপনা লক্ষ্য করছেন উনি, কিছু জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যায় মেয়েটা।

– আমি কি বলছি বুঝছিস না? বাড়িতে এসেছিলে ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষার পরের ছুটিতে, এখন মাস পেরিয়ে গেলো অথচ তোর যাওয়ার নাম নেই। পড়াশোনা কি করতে চাস না তুই?

সাঞ্জর ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো। অপ্রস্তুত গলায় বলল

– চাইবো না কেনো

– মনে তো হচ্ছে না, তোর জাওয়ার কোনো ইচ্ছেই দেখছি না। পড়াশোনা এভাবে কে করে?

সাঞ্জে মাথা ঝুকিয়ে নিলো। চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু ভর করেছে, কিন্তু মায়ের সামনে একেবারেই প্রকাশ করতে চাইনা ও। মা নিশ্চয় বকবে, কিন্তু চোখ কি আর সেসব বোঝে,ঠিকই বেহায়ার মতো গড়িয়ে পড়লো গাল বয়ে।

-এসব কি করছিস বল তো? মেয়েটাকে বকছিস কেনো এভাবে

আম্বি কাললির উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে এসে বসলো সাঞ্জের পাশে। ওকে ধরে চোখের পানি গুলো মুছিয়ে দিলো, ব্যস্ত হয়ে বলল

– এভাবে কেও বকে, কাঁদিয়ে ফেলেছিস মেয়েটাকে। না যেতে চাইলে না যাক না

– না যাক বললেই তো হবে না ভাবী, ওর পড়াশোনা টা তো দিন দিন চাঙ্গে উঠছে। এভাবে করলে রেজাল্ট কেমন আসবে?

আম্বি বেগম সাঞ্জের মুখের দিকে তাকালো। ভীষণ মায়া লাগলো মেয়েটার মুখে চেয়ে, মমতা ভরা গলায় বলল

– বাচ্চা মেয়ে, একা হোস্টেলে কেই বা থাকতে চাইবে। ও না হয় এখানে থেকেই পড়াশোনা করুক, এক্সাম টা শুধু কলেজে গিয়ে দিয়ে আসলেই হবে

– তাই যখন করার ছিলো তাহলে এতো তোড়জোড় করে ওতো দূরে ভর্তি হলোই বা কেনো। আমি আর কি বলবো এ বাড়িতে একটা মানুষ আছে যে আমার কথার দাম দেবে!

বলে গজগজ করতে করতে উঠে গেলেন। সাঞ্জে মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আবার আম্বির দিকে তাকালো। তাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– আমি আর হোস্টেলে যেতে চাইনা বড়মা।আমার ওখানে একা ভাল্লাগে না,তুমি একটু মা কে বোঝাও না। বাবাকে বললে আমাকে বকবে খুব

আম্বি খাতুন সাঞ্জের কপালে চুমু দিয়ে বলল

– এইটুকুর জন্য কেও কাঁদে? পাগলী মেয়ে। আমি তোর বড় আব্বুর সাথে কথা বলবো, সে বলে দিলে আর কেও কিচ্ছুটি বলবে না।

…………

– শ্রী?

কণ্ঠস্বরটা অতি পরিচিত ঠেকলেও পেছনে ঘোরার সাহস হলো না। হাঁটুতে মৃদু কম্পন ধরেছে। বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে, এ যেনো মনে ভুল হয়!

– শ্রীতমা?

শ্রী’য়ের প্রার্থনাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে আবারও ডেকে উঠলো সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর। প্রবল অস্থিরতা নিয়ে আস্তেধীরে ঘুরে তাকালো শ্রীতমা। পুরোপুরি ঘুরে তাকাতেই চোখের সামনে স্পষ্ট হলো চেহারাটা। বুকের মাঝে প্রাণপণে যে ঘাঁ লোকানোর চেষ্টা এখনও করে যাচ্ছে সেটা যেনো মুহুর্তেই দগদগে হয়ে উঠলো, চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসলো

– শ্রীতমা, তোমাকে আমি..

– খবরদার, খবরদার যদি আর এক পা এগিয়েছেন তো! আর আমার নামটা নিজের মুখে আনার সাহস কি করে হলো আপনার

– শ্রী তুমি আমার কথাটা একবার শোনো

– কক্ষনো না, আপনার কথা শোনা তো দূর, আমি আপনার মুখটাও দেখতে চাইনা।

অরুণের চেহারাটা আরও পাংসুটে হয়ে গেলো। মেয়েটাকে বোঝাবে কি, একটা কথা অব্দি বলতে দিচ্ছে নাহ। ও ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরও দু’কদম এগিয়ে এসে বলল

– শ্রী আমাকে একটু বলতে দাও আমি তোমাকে..

– শুনতে চাইনা আমি। আপনার মুখ থেকে একটা শব্দ আমি শুনতে চাইনা।আপনার চেহারা দেখলেও ঘেন্না লাগছে আমার

– আমাকে একবার অন্তত বলতে দাও, প্লিজ! আমি জানি আমি অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি কিন্তু

– কিন্তু কি হ্যাঁ? আপনার কোনো সাফাই আমি শুনতে চাচ্ছি নাহ। আপনার চেহারাটা দেখলে বরং নিজের প্রতি ঘেন্না হচ্ছে যে এই রকম একটা জানো’য়ারকে আমি ভালোবেসেছিলাম

অরুণ এগিয়ে এসে শ্রীতমার হাত চেপে ধরলো। অস্থিরস্বরে বলল

– শ্রীতমা আমাকে একটু বোঝো। আমি জানি আমি ভুল করেছি অন্যায় করেছি কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসার নাম করে ঠকাইনি! বিশ্বাস করো আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি, তাথইয়ের সাথে বিয়ে হলেও মনের মিল আমাদের কখনোই হয়নি, মন থেকে আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি

শ্রীতমা ঝামটা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলো। মনটা একটু হালকা করতে বেরিয়েছিলো বাইরব হাঁটতে। কিন্তু বাইরে এসে এই মানুষটার মুখ দর্শন করতে হবে জানতে পারলে কখনোই বের হতো না, ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে গেলেও বেরোতো নাহ। ঘৃণাত্মক চাহনিতে একবার তাকালো অরুণের দিক্ব। বড়ো বড়ো পা ফেলে পাশ কাটিয়ে আসতে নিলেই অরুণ দুহাতে ওর বাহু চেপে ধরলো। শ্রীতমার জীর্ণ শরীর টা দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল

– তোমাকে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি তো? কেনো শুনছো না আমার কথা

কথাটি বলে আর কিছু বলে ওঠার আগেই সজোরে একটা তামাশা পড়লো অরুণের গালের ওপর। ফর্সা গালে পাঁচটা আঙুলের ছাপ তৎক্ষণাৎ স্পষ্টভাবে বসে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো অরুণ, তাথই আঙুল উঁচিয়ে বলল

– শেষ বারের মতো বলছি, নেহাৎ আমি ঝামেলা চাইনা বলে এতোদিন কিছু বলিনি। এরপর থেকে আমার আশেপাশে ভেরার চেষ্টা করলেও আমি আপনার এগেইনস্টে স্টেপ নেবো বলে রাখলাম।

এক মুহূর্ত আর দাঁড়ালো না। অরুণের বিস্ফোরিত চাহনিকে অগ্রাহ্য করে এক ছুটে ঢুকে গেলো হোস্টেলের ভেতরে। এক দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে। ঘৃণা, অসহ্যকর বিশ্রিরকম একটা অনুভূতি ওকে গলা টি’পে মার’ছে। নিজের উপরেই বারংবার ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। কি করে এতো বড়ো বোকামি টা করেছিলো ও! কি করে!

___________________________

ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ। আশেপাশের পরিবেশটার একবার পর্যবেক্ষণ করলে যে কেও মুগ্ধ হতে বাধ্য। বহুতল ভবন বিশিষ্ট পাঁচতারা হোটেল। উঁচু উঁচু ঘর, বিশাল জায়গা। জমিনের টাইলস আয়নার মতো ঝকঝকে। বহির্বিশ্বে তিন তারকা নামে খ্যাত হলেও বাংলাদেশে এই পাঁচ তারকার রূপ ভীষণ আভিযাত্য প্রকাশ করে।
এই হোটেলেরই একটা বিশাকার রুম বুকড নামীদামী একটা ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্টদের নামে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আজ মেহরাজের। বেশ দীর্ঘক্ষণ ধরে মিটিং চলমান থেকে এখন প্রায় শেষের দিকে, ল্যাপটপে টাচ করে প্রজেক্টেরের জ্বলজ্বল করা স্ক্রিনটা নিভিয়ে দিয়ে মেহরাজ বলল

– অভি, শো দ্যা নিউ প্রজেক্ট ফাইল টু মি.গসলি

বলে মুহুর্ত কয়েক অপেক্ষা করলেও কোনো প্রত্যুত্তর আসলো না অপরপক্ষ হতে, মেহরাজ ভ্রু কুচকে তাকালেও অভিমন্যুর কোনো সাড়া পেলো না, ও বেখেয়ালি হয়েই তাকিয়ে আছে ডান পাশের বিশালাকার গ্লাসওয়ালটার দিকে, এদিকে একজোড়া উৎসুক চোখের চাহনি যে ওর দিকে একধীমে তাকিয়ে তা হয়তো ওর ধারণাতেও নেই।

– মি. অভিমন্যু মুখার্জি, মেই আই হ্যাভ ইউর অ্যাটেনশন প্লিজ?

হকচকিয়ে তাকালো অভিমন্যু, বিব্রতের ন্যায় এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। বসের শান্ত চোখে চেয়ে নিঃশব্দে সরি জানালো বারংবার

.

– তোমার ভাবসাব আমি ঠিক বুঝছিনা অভি। প্রেমে পড়েছো?

হাঁটতে হাঁটতেও যেনো পা থমকে গেলো অভিমন্যুর, পুনরায় হাঁটার গতি বাড়িয়ে অস্বস্তি ভরা গলায় বলল

– না না স্যার, কি বলছেন!

– তোমার আয়না দেখার এতো আর্জ যে মিটিং রুমেও হা করে আয়না দেখছিলে। প্রেমে পড়লে তো প্রেমিকাকে দেখে তুমি নিজেকে কেনো দেখছিলে বলো তো!

সবেমাত্র মিটিং সেড়ে বেরিয়েছে সকলে। মেহরাজ নিজের রুমের দিকে এগোচ্ছে, আর পেছন পেছন অভিমন্যু। চলার পথে বসের এহেন প্রশ্নে একটু না পুরোটাই ভড়কে গেলো অভিমন্যু, আমতা-আমতা করে বলল

– না স্যার তেমন কিছু না

মেহরাজ আড়চোখে তাকালো অভিমন্যুর দিকে। মিথ্যে বলে ধরা পড়ে যাওয়ার ন্যায় চাহনি দিয়ে বলল

– স্যার আসলে আয়নাতে দেখছিলাম আমাকে দেখতে হনুমান মুখো লাগে কি না

– হোয়াট! হনুমান মুখো? প্রেমিকার কাছ থেকে এমন কমপ্লিমেন্ট খুব কম মানুষ ই পাই অভি, ক্যারি অন

বলেই পা থামিয়ে দাঁড়ালো। বর্গাকৃতির কালো রঙের কার্ডটা দরজার সামনে সোয়াইপ করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। অভিমন্যু তাকিয়ে রইল হ্যাবলার মতো

– এই মানুষটার প্রতিটি পদক্ষেপেই যেনো আস্তো আস্তো রহস্য। চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলা যায় না

মেহরাজ দরজা লাগিয়ে ভেতরে এসেই গায়ের ব্রুনেট রঙের ব্লেজার টা খুলে ফেললো। গলার কাছে বোতাম গুলো এক এক করে আলগা করতে করতে ধপ করে বসে পড়লো কাউচে, মাথা এলিয়ে দিতেই একটা চেহারা দর্পনের ন্যায় প্রতিফলিত হলো মস্তিষ্কে। পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই লক স্ক্রীনের নীল শাড়ি পরিহিতার চেহারা টা ভেসে উঠলো। যেনো অপরূপ কোনো অপরূপাকে দু চক্ষে অবলোকন করে মেহরাজ, ওর ধূসর বর্ণা চোখ দু’টিতে অগাধ তৃষ্ণা আর ব্যাকুলতা, হুট করেই রাতের দৃশ্যটা স্পষ্টভাবে মস্তিষ্ক টা যেনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাধ্যমে চোখের লেন্সের সামনে ভাসিয়ে তুললো______

রাত তখন প্রায় তিনটা হয়তো। ঘন্টা দুয়েক আগে চোখ দুটি বুজলেও ঘুম এসে ধরা দেয়নি। বুকের মাঝে পিঠ ঠেকিয়ে দেদারসে ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করা মেয়েটি যে ওর প্রাণ, ওকে ছেড়ে একটা দিনও যে মুশকিল। মোহরকে বুঝিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেও মেহরাজ নিজের চোখে ঘুম নামাতে পারেনি বা চাইনি। মুখটা এগিয়ে নিলো আরও কাছে, রেশমি সুতার ন্যায় নরম চুলের গুচ্ছে নাক ডুবিয়ে দিলো, মুগ্ধকর সুবাসে মন চিত্ত ভরে এলো মেহরাজের৷ পেছন থেকে জড়িয়ে রাখা হাতের বন্ধনী আরও দৃঢ় করে চুলের ভেতরেই পরপর চারবার গাঢ় ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। ঘুমের মাঝেই নড়েচড়ে উঠলো মোহর, পাশ ফিরে একদম মেহরাজের থুতনির সোজাসুজি মুখটা ভিড়ালো। আধবোজা চোখে টিপটিপ করে বার দুয়েক তাকিয়ে রইলো। মোহরের জেগে যাওয়ার ভয়ে থমথমে মুখ করে তাকিয়ে রইলো মেহরাজ, আদও ঘুম ভেঙে গেছে নাকি ঘুমের ঘোরে আছে তা বোঝার আগেই চিকন চিকন আঙুলের চাপ পড়লো মেহরাজের কানের উপর। প্রচন্ড অবাক করে দিয়ে মোহর ওর বেহায়া মনটাকে অস্থির করে দিলো তিনগুণ আদর দিয়ে। আশ্চর্যে যতটা না চোখ টা প্রসারিত হলো মেহরাজের তার চেয়েও বেশি উন্মত্ততা ভর করলো, হতবিহবলতা সামলাতে ঠিক কতক্ষণ দম বন্ধ করে ছিলো মেহরাজ তা ওর হিসেবের বাইরে। হাত দুটো আর নরম শরীর টাতে রাখতে পারেনি মেহরাজ, কম্পন মাত্রার কাছে হার মেনে জড়িয়ে নিতে পারলো না মোহরকে_____

ধপ করে চোখ খুলে তাকালো মেহরাজ। এখনো বিশ্বাস করতে পারে না ওর লজ্জাবতী, লজ্জাবউ টা নিজের অজান্তেই কতটা ভয়াবহ কাজ করে ফেলেছে। আচ্ছা মোহর চিঠিটা পরে ভাবেনি যে ঘুমের ঘোরে কোন ভয়ংকর কাজটা করে ফেলেছে? নাকি সেই লাইনটাই ওর বোধগম্য হয়নি? আচ্ছা মোহরের কি এতটুকুও মনে নেই? ও কি এটা মনে করে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে না যে কিভাবে ওর নরম হাতের তালুটা দিয়ে চেপে ধরেছিলো মেহরাজের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িবৃত গাল, কান? কিচ্ছুটি মনে নেই ওর?
মেহরাজের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কটাও কেমন হতবুদ্ধির ন্যায় আচরণ করলো। সমস্ত কিছু ভুলিয়ে শুধু ঘুমু ঘুমু ঠোঁটের তন্দ্রামিশ্রিত ওই চুমুটার কথায় প্রাণভরে ভেবে যাচ্ছে যা মোহর নিজের অজান্তেই অতি আদরে মেখে দিয়েছে ওর ওষ্ঠভাঁজের গহীনে। মোহরের গায়ের গন্ধটা যেনো এখনো ওকে মাতাল করেই রেখেছে, ওর মনের রুদ্ধদ্বার টা চুরচুর করে দিচ্ছে ওর মোহমায়া, মেহরাজের প্রাণভোমরা,, স্থুল কণ্ঠে অস্থিরতম স্ফূর্তিতে ফিসফিসিয়ে মেহরাজ বলল

” শব্দে বাক্যে কোনো কিছুতেই আপনাকে ব্যাখ্যা করার সামর্থ্য আমার নেই মোহমায়া, হাজারো গ্রহ উপগ্রহে ভরা দুনিয়াটাতে একটামাত্র নক্ষত্রটা আপনিই…পুরো দুনিয়াটাও যদি সফর করে আসি আমি আর আমার ক্লান্ত চোখ জোড়া,থমকে যাবে এক আপনিতে এসে। ”
.
.
.
চলমান

#হীডিংঃ একদিনের ব্যবধানে কতটা অনুভব করেছেন মেহরাজ আর তার মোহ কে? করেছেন তো! তাই তো বহুত বড়ো পর্ব দিয়েছি। পড়ুন, পড়ুন আর মন্তব্য করুন। অপেক্ষারত ❤️

#Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here