ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৩১ #হুমাইরা_হাসান

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩১
#হুমাইরা_হাসান

ব্যস্ত পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো মোহর। আজকে ফিরতে বেশ দেরীই হয়ে গেল, মেডিক্যালের শেষের দিকেটাতে এসে বেশ চাপ পোহাতে হচ্ছে। এই যেমন আজ ফিরতে এতটা দেরী হয়ে গেলো।
ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো ঘরটার সামনে, দরজার নব মুচড়ে এক পা ফেললেও পরক্ষণেই সামনের দৃশ্য দেখে থমকে গেলো।
সদ্য গোসল করে বেরিয়েছে হয়তোবা, পরনে শুধু কালো রঙের একটা ট্রাউজার। দেহের উপরাংশ পুরোপুরিই অনাবৃত, যাতে করে ফর্সা বুক টা চোখ ধাধানোর মতো উঁকি দিচ্ছে একদম স্পষ্টভাবে।
মোহর নবে হাত রেখেই থমকে রইলো, মেহরাজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে। দর্পনের প্রতিবিম্বে ঘর্মাক্ত রূপসীর চেহারাটুকু চোখে বিঁধতেই ঘুরে দাঁড়ালো। চোখাচোখি হতেই মোহরের অপ্রস্তুত চেহারাটা অবলোকন করে খাট থেকে ডিপ ব্লু রঙের টি-শার্ট টা তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলো।
মোহর ধাতস্থরূপে ভেতরে এসে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখলো, ঘামে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতেও অস্বস্তি লাগছে তাই ক্যাল ব্যয় না করে আলমারির দ্বার খুলে নিজের তোয়ালে আর জামাটা হাতের মুঠোয় ধরে পেছন ফিরলে মেহরাজকে সেই আগের অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে পেলো। বরং এবার দু’হাত পকেটে গুঁজেছে।
মোহর আড়ষ্টভাব নিয়েই এগোতে নিলেও থমকে গেলো মেহরাজের প্রশ্নে

– দেরী করলেন যে?

– আজ ক্লাসটাইমের ডিউরেশন বেশি ছিল

মাথা ঝুকিয়ে রেখেই জবাব দিলো। অদ্ভুত ভাবেই মেহরাজের দিকে তাকাতেও জড়তা, শঙ্কোচবোধ আঁকড়ে ধরছে। সেই রাত, সেই স্পর্শের কথাটা একটু বেশিই গাঢ় ভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে মেহরাজের চাহনি। মোহরের তটস্থ অবস্থাকে বাড়িয়ে দিয়ে মেহরাজ এগিয়ে এলো, ধীরে পায়ে এগিয়ে একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো।
মোহর পিছিয়ে নিতে গিয়েও পারলো না, পা দুটো যেন আঁটকে আছে ফ্লোরে, মেহরাজ সুস্থির তাকিয়ে মোহরের চেহারায়। ছোপ ছোপ ঘামে ভেজা নাক, কপাল, ওষ্ঠের নিচের অংশ। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, অনুজ্জ্বল চেহারা পানে অনিমেষ চেয়ে থেকেই মেহরাজ ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে বলল

– আপনি এতো সুন্দর কেনো মোহ? এতটা সুন্দর কেনো হয়েছিলেন আপনি? একটু কম সুন্দর হলেও তো পারতেন

মোহর ভাবক্রীয়াহীন অচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেহরাজের দিকে। মেহরাজ ওর নির্বোধ, অবুঝ মুখটাতে চক্ষু স্থির রেখে আবারও বলল

– এই যে আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে সারাদিন নিজের সামনে বসিয়ে রাখতে, শুধু হা করে তাকিয়ে থাকতে। আপনাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা যে খুব পীড়া দিচ্ছে মোহ, এতো সুন্দর হতে কে বলেছিল আপনাকে!

মেহরাজের কণ্ঠস্বর টা কেমন অধৈর্য, হতাশ শোনালো। মানুষটার তীক্ষ্ণ, দৃঢ়, অনড়তায় ভরপুর দৃষ্টিতে মোহরের গাল লজ্জায় ভারী হয়ে আসছে। এসব কি বলছে লোকটা! লজ্জা অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে আসছে মোহর, এভাবে তাকিয়ে কেন আছে মেহরাজ ? সে কি বুঝছে না মোহর শরমে মিইয়ে যাচ্ছে! মেহরাজের এমন নীরব প্রখর দৃষ্টির পৃষ্ঠে সিক্ত মোহর আড়ষ্ঠ হচ্ছে ব্যকুলভাবে।
অধর জোড়া জড়ত্ব নিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে কিছু বলার জন্যে মুখ তুললেও কিছু বলার পূর্বেই মেহরাজ অধৈর্য গলায় বলে উঠলো

– আপনি আর তিন সেকেন্ড ও এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি হয়তো নিজের উপরেই নিয়ন্ত্রণ হারাবো মোহ..

মেহরাজের এরূপ বেলাজ কথাবার্তায় মোহর প্রচন্ডভাবে ভড়কে গেলো। মেহরাজকে বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই এক ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল। দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিরতিহীন ভারী ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করলো। এই লোকটা এতো বেহায়া হয়ে যাচ্ছে কেনো দিনদিন! মোহর কথার বানে মে’রেই না ফেলে কোনদিন।

.

ওয়াশরুম থেকে ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে ঘরজুড়ে কৌতুহলী দৃষ্টি মেললো মোহর। মেহরাজের এবারের অনুপস্থিত টা ওকে ভীষণ স্বস্তি দিলো। মানুষটার আশেপাশে ভীড়তেও এখন কেমন লজ্জা করে মোহরের।

ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো মোহর। সেই সকালে নাস্তা করে বেরিয়েছিল এখন প্রায় দুপুর। খিদেয় পেটে চোঁ-চোঁ করছে। ড্রয়িং রুমের পরিবেশ টা শান্ত, থমথমে। মোহর এগিয়ে গিয়ে খাবার বেরে বসতেই কোত্থেকে এসে হুট করেই পাশে বসে পড়লো মেহরাজ। মোহর ভূত দেখার মতো চমকে গেলেও থ মেরে তাকিয়ে রইলো খানিক। মেহরাজ সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে প্লেট টেনে নিতে নিতে বলল

– আপনি এতটা নিষ্ঠুর কি করে মোহ, আপনার স্বামীটা যে না খেয়ে বসে আছে সেটা একটা বার ও ভাবলেন না। পাষাণের মতো একাই খেতে বসে পড়ছেন।

মোহরের ভ্রু কুচকে এলো এবার, ভালো সে কি করে জানবে লোকটা না খেয়ে বসে আছে? অন্যদিন তো এতো আগেও আসেনা। কিন্তু মুখে কোনো প্রত্যুত্তর না করে মেহরাজের থালে ভাত তুলে দিতে লাগলো। নিজে পাশের চেয়ারটাতে বসে খাওয়া শুরু করলে কিছুক্ষণ পর ওমনিই মেহরাজের কান্ডে খাওয়া থামিয়ে চোখ প্রসারিত করে তাকিয়ে রইলো মেহরাজের দিকে, মেহরাজ মাছের টুকরো গুলো মোহরের প্লেটে তুলে দিতে দিতে বলল

– আমাকে দেখার জন্য সারাজীবন আছে মোহ, আপাতত খেয়ে নিন

মোহর আরও কিছুক্ষণ ওমন অনড় দৃষ্টি কায়েম রেখে অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। নিজের অজান্তেই চোখের কোণায় পানির মুক্তোদানা জমাট বাঁধলো। নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ে গেলো মোহরের। ইলিশ মাছ খুব পছন্দ হলেও কাঁটা ছাড়াতে পারেনা বলে খেতে চাইতো না মোহর, তখন আব্বা ওকে নিজের পাশে বসিয়ে একটা মাঝের পেটি নিজের প্লেটে তুলে কাটা ছাড়িয়ে একটু একটু করে মোহরের পাতে তুলে দিতো, ঠিক যেমনটা মেহরাজ এখন দিচ্ছে। নিজের মনের অজান্তেই মোহরের ভীষণ ইচ্ছে হলো হাউমাউ করে কেঁদে উঠতে, পাশে বসে থাকা নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়ার মানুষটিকে ঝাপটে ধরে পরনের পোশাক টা নিজের অশ্রুতে ভিজিয়ে দিতে। না তো খুব কড়া গলায় ধমকে দিতে, শাসানির ন্যায় আঙুল তুলে বলতে

– কে আপনি হ্যাঁ? কোত্থেকে এসেছেন? আপনি কি আমাকে মানুষ মনে করেন নাকি বই? এভাবে আমার আপাদমস্তকটা পড়ে ফেলেন কি করে? কি করে না বলতেই সবটা বুঝে যান বলুন তোহ? এভাবে বুঝতে নেই যে কাওকে, এমন যত্ন করতে নেই তো..পাথর মনের মানুষ গুলোও যে প্রেমে পড়ে যায়,ভালোবেসে ফেলে।

কিন্তু বলা হলো নাহ। স্বামীর মাঝে যেনো প্রাণের বাবার প্রতিচ্ছবি টুকু আজ দেখতে পেলো মোহর। ও না বলা সত্ত্বেও কি করে মেহরাজ বুঝে গেলো তা যানে নাহ, কি করে বুঝলো কাঁটা ছাড়াতে পারে না বলেই ভাজি তুলে নিয়েছিল নিজের পাতে।
নিঃশব্দে খেয়ে নিলো গ্রাস গুলো। একটা টু শব্দ অব্দি করলো না, আর নাইবা মেহরাজ করলো।

খাওয়া শেষে সবটা গুছিয়ে উপরের ঘরের দিকে যেতে নিলে মেহরাজ পেছন থেকে ডেকে বলল

– মোহ

ঘুরে দাঁড়ালে অবিলম্বেই আবারও বলল

– সময় পেলে একটু আসবেন ঘরে

মোহর কিঞ্চিৎ ঘাড় নাড়ালো শুধু। তবে সেটা দেখার আগেই মেহরাজ পা বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। মোহর ও দাঁড়ালো নাহ, এগোলো সামনের ঘরটার দিকে। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বার দুয়েক টোকা দিলো দরজায়, জবাব এলো নাহ। মোহর আলতো ভাবে দরজা ঠেলে ফাঁক করলো

বিপরীত দিকে মুখ করে থাকায় চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাওয়া গেলো না, কিন্তু তার পেছন টুকু দেখেই মোহর আঁচ করে নিলো,,নিস্তেজ, নিঃসাড় দৃষ্টি হয়তো দূর প্রান্তুরে। অবিন্যস্তত, চাকচিক্যহীন মুখটাও হয়তো ফ্যাকাসে হয়ে আছে।
আস্তেধীরে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো মোহর।
কাঁধের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে হুট করেই ধ্যান ভেঙে যাওয়া স্বরূপ চমকিত হয়ে তাকালো তাথই, মোহরকে দেখে অপ্রস্তুতত হলেও তৎক্ষনাৎ তা সামলে নিয়ে ভীষণ সহবত সুলভ হাসি হেসে বলল

– তুমি কখন এলে, বসো

মোহর বসলো পাশটাতে। সামনেই ছোট্ট কাঠের দোলনা, তাতে ঘুমিয়ে ছোট্ট একটা নিষ্পাপ প্রাণ। মোহর সেদিকেই তাকিয়ে বলল

– অনেক দিন ই তো হলো, বাবুকে ওর বাবা দেখতে আসেনা যে?

এতক্ষণ মুখে টেনে রাখা কৃত্রিম হাসিটা ঝাড়বাতির মতো ধপ করে নিভে গেলো তাথইয়ের। তবুও সুপ্রসন্ন গলায় বলার চেষ্টা করলো

– ব্যস্ত থাকে।

– সত্যিই কি?

মোহরের কণ্ঠটা কেমন অন্যরকম শোনালো। তাথই ভ্রু কুচকে তাকালে মোহরের মুখাবয়বের পরিবর্তন হলো। বেশ সহজতর ভাব এনে কিঞ্চিৎ হেসে বলল

– একা একাই ঘরে বসে থাকো কেন আপা বাইরে এসে মেশো না কেনো সবার সাথে?

– সবাই সবার মতো ব্যস্ত। আমার উগ্র মেজাজ দেখার সময় কার।

তাচ্ছিল্য হেসে বলল তাথই। মোহর অপলক চেয়ে রইলো সেই মুখটির দিকে। ওভাবেই চেয়ে বলল

– আমাকেই দেখো, হাতে গোনা দুই একজন বাদে সকলেরই চক্ষুশূল আমি। তবুও তো মিশি, সেদিক থেকে দেখলে এটা তো তোমারই পরিবার। সবাই তোমাকে ভালোবাসে।

তাথইয়ের মুখাবয়বের তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। চোয়াল শক্ত রেখেই বলল

– কিন্তু আমি বাসি না কাওকে।

– আসলেই কি বাসো না কাওকে?

ধপ করে বুজে গেলো রূঢ় স্বর, নরম হয়ে এলো শক্ত চোয়াল, নিগূঢ় ব্যক্তিত্বের ভীত টা যেন ক্রমেই নড়েচড়ে উঠলো। তাথইয়ের অপ্রসন্ন চেহারাটায় চোখ রেখে হাতটা সবিনয়ে ধরলো মোহর, তাথইয়ের ফিরে তাকানোটাকে ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে নরম গলায় বলল

– আর কতো চুপ থাকবে আপা? বদমেজাজি, রুক্ষ স্বভাবের আড়ালে আর কতো নিজের দুঃখটাকে আগলে রাখবে। একটা সময়ে কষ্টগুলোও আত্মচিৎকার দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাই, তুমি কতো চুপ থাকবে।

তাথইয়ের বিস্ফোরিত নয়নে যেন বিন্দু বিন্দু পানি জমতে দেখলো মোহর, কিন্তু থামলো না, হাতের করপুট আরও শক্ত করে বলল

– তোমার আশেপাশে এমন অনেক কিছুই ঘটে যাচ্ছে যাকে তুমি নীরবে সহ্য করে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছো, অথচ নিজের ঘাড়েই সব দোষ চাপিয়ে নিচ্ছো। কেন করছো এমন আপা? একটা বার কি তোমার মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করে না?

তাথই খপ করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। চোয়াল শক্ত করে কড়া গলায় বলল

– কি যা তা বলছো তুমি? কি বলবো, কাকে বলবো!

– আমি কি বলছি তা আমার চেয়ে ভালো তুমিই বোঝো আপা। চুপ করে থেকো না, আর কতো এভাবে থাকবে আর কতো নিজের জীবনটাকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে?

তেলের মাঝে ছিটকে ওঠা মাছের মতো তেঁতে উঠলো তাথই। ধপ করে উঠে দাঁড়ালো, খানিক চেঁচিয়ে বলল

– কি বলবো, কাকে বলবো? কেনো বলবো? কেও নাই আমার কেও নাই যে শুনবে। এভাবেই থাকবো আমি। তোমাকে এর আগেও নিষেধ করেছি, আমার কথা কাওকে ভাবতে হবে না, তোমাকেও নাহ। বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে আর কোনোদিন ও আসবে নাহ

আঙুল তুলে মোহরকে বেরিয়ে যেতে বললেও মোহর স্থির রইলো। তাথইয়ের আকস্মিক চিৎকারে তোয়ার ঘুম ভেঙে গেছে, ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছে বাচ্চাটা। ওকে ধরলো না তাথই আর নাইবা মোহর ধরলো। বরং উঠে তাথইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল

– আছে আপা। সবাই আছে, তুমি শুধু একটা বার মুখ ফুটে সব বলো। আমি জানি তুমি সব বোঝো সব জানো। কিন্তু কেন সব মেনে নিচ্ছো? একবার সব মেনে নিয়ছো বলেই আজ এখানে এসে দাঁড়াতে হয়েছে, আর নিও না।

– কি বলবো আমি? কোন উছিলায় বলবো? কার জন্য? বাড়ির লোক কি করবে? বড়োজোর এখান থেকে তুলে আরেক নর্দমায় ঢেলে দেবে ঠিক এখানে যেভাবে দিয়েছিলো

বলেই আঁৎকে উঠলো, চোখ ফুরে পানি বেরিয়ে এলো। এবার আর থামালো না, আঁটকালো না চোখের পানি। শক্ত মুখ দেখিয়ে লুকিয়ে নিলো না নিজেকে, মুখে হাত রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
মোহর এগিয়ে গিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরলো তাথইকে, টেনে এনে বিছানায় বসালো, দুহাতে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল

– আর কোত্থাও যেতে হবে না তোমাকে আপা। তুমি শুধু একবার মুখিয়ে দাঁড়াও, আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে। সবার মিথ্যে মুখোশ টেনে ছি’ড়ে ফেলবো। তুমি আর এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না।

তাথই কিছুই বলল নাহ। নির্জীব বস্তুর ন্যায় মোহরের কাঁধে মাথা ফেলে পড়ে রইলো। মোহরের কথা গুলো বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়ে বাজতে থাকলো, আর চোখের সামনে একটা চেহারাই বারবার ভেসে উঠতে লাগলো যাকে শতবার, হাজারবার ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও পারেনি। আজ অব্দি ভুলিয়ে দিতে পারেনি।

___________________________

একেবারে গোসল করেই বেরোলো মোহর। আজ কেমন বিদঘুটে গরম পড়েছে। শরতের শেষে এসেও এমন অসহ্য গরমের হেতু বোঝে না মোহর। একটু হাঁটাচলা করেই শরীর ঘেমে ভিজে উঠেছিল, ঘামে অসহ্য হয়ে এই মাঝ রাতেও গোসল করে এলো।
মেহরাজ বিছানাতে আধশোয়া হয়ে ফোন চাপছিলো। এক পায় আরেক পায়ের উপর তুলে বিরামহীন নাচাচ্ছে। মোহর চোখ সরিয়ে নিলো।লোকটার সমস্ত কিছুই যেনো খুব করে আকর্ষিত করতে চাই। বারান্দার পর্দাটা উড়ছে, সারাদিন গরমে দগ্ধ করে এখন হয়তো প্রকৃতি তার ধরণীকে ভেজানোর প্রয়াসে মত্ত। থেকে থেকে আকাশে চমকে ওঠা সরু আলোর বাঁক সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

– ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? এদিকে আসুন।

মোহর হাতের ভেজা বস্তু টা একপাশে রেখে বিছানাতে এক কোণায় গিয়ে বসলো। ফ্লোরে রাখা পায়ের এক পাতার উপরে আরেকটা পায়ের তলদেশ চেপে ধরলো। অস্বস্তি সামলাতে এই ব্যর্থ প্রয়াসটুকুও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো মেহরাজের জড়তাহীন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বেহায়া নজর

– এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? কি করেছি আমি

মেহরাজের বাঁকানো ভ্রুর ভাঁজ কিঞ্চিৎ প্রসারিত হলো, তীক্ষ্ণ চাহনি বহমাম রেখেই অকপটে বলল

– আপনি আর কি করবেন। আমি যে একটু শান্তিমতো তাকিয়ে দেখবো সেটুকুতেও তো হাজারো প্রশ্ন।

– কেনো দেখবেন

খানিক গাল ফুলিয়েই বলল মোহর। মেহরাজ উত্তর দিলো নাহ। কিছুক্ষণ অসন্তোষ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই চাহনির অগাধ পরিবর্তন হলো। দৃষ্টি অবিন্যস্ত অথচ গাঢ় হতে থাকলো অবিলম্বেই। সূক্ষ্ম নজরের ধারালো দৃষ্টিতেই পরখ করলো প্রিয়তমার আগাগোড়া।
বাঁকা চোখেই পা থেকে মাথা অব্দি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্থিরনেত্রে দেখলো মোহরের লজ্জা, অস্বস্তিতে সিটিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।
সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতে থাকা দৃষ্টি হুট আঁটকে গেলো চুলের পানিতে ভিজে থাকা কোমর, পিঠের ভাঁজে, স্থির চিত্তে হঠাৎই সূক্ষ্ম যন্ত্রণাভূত হলো মেহরাজের বক্ষে। সদ্যস্নানে স্নিগ্ধ মোহরকে দারুণ শুদ্ধ, বিমল মনে হলো মেহরাজের।
স্থির চাহনিতেই নির্বিকার সুরে বলল

– আপনার শুকরিয়া করা উচিত আপনার স্বামী শুধু তাকিয়েই দেখে। তা না হলে এই মাঝরাতে আপনার গোসলের কারণ গরম না হয়ে অন্যকিছু হতো

লাজলজ্জা হীন কথার পৃষ্ঠে প্রত্যুত্তর দূর ভয়ংকর লজ্জায় নেতিয়ে মোহর। লোকটা দিনদিন ভয়ংকর অসভ্য হয়ে উঠছে যে! মোহরকে অস্বস্তি আর লজ্জায় ফেলার বিরতিহীন প্রক্রিয়াতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যেনো।
চোখ মুখ খিঁচিয়েই উঠে যেতে নিলে মেহরাজ এক টান দিয়ে বসালো, পুরুষালী স্পর্শে তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পড়লো মেহরাজের বুকের উপরে। হয়তো এটাই মেহরাজের উদ্দেশ্য ছিলো। একটা হাতের থাবা কোমরে চেপে আরেকটা হাতের মোহরের ভেজা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল

– সবসময় পালাই পালাই করেন কেনো?

মোহর নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেও একচুল নড়তে পারলো না। ছাড়া পেলো না দানবীয় শক্তির ন্যায় স্পর্শ থেকে। হেরে যাওয়া হরিণীর ন্যায় চোখে ক্লান্ত স্বরে বলল

– আপনি এতো অসভ্য কেনো?

– আপনি অসভ্য বানিয়েছেন তাই

মোহরের ভ্রু কুচকে এলো রাগে। লোকটা দিনকে দিন নয় বরং ঘন্টায় ঘন্টায় অসভ্য হচ্ছে। নির্লজ্জ মুখে কিছুই আটকাচ্ছে না। বেশ কড়া গলায় তেজের সহিত বলল

– আপনি ভীষণ অসভ্য, নির্লজ্জ আর বেহায়া হয়ে যাচ্ছেন রুদ্ধ, ছাড়ুন আমায়

ঝড়ের বেগে বাতাস টেনে নিলো বুক ভরে, বেসামাল হৃদক্রিয়া টাকে সামলে ঠোঁট কামড়ে ধরলো মেহরাজ। অস্থির চিত্তটাকে গোগ্রাসে দমিয়ে অসহিষ্ণু গলায় বলল

– এই যে আপনি আমাকে পাগল করে ফেলছেন, অসভ্য বানাচ্ছেন এর শাস্তিরূপে আপনাকে কি করা উচিত? এই যে নিজের চোখ, ঠোঁট আর কণ্ঠস্বরে আমায় অধৈর্য করে দিচ্ছেন । বাঁধ ভেঙে গেলে কি সামলাতে পারবেন আমায়?

মোহরের অবুঝ নেত্রদ্বয়ের পরিবর্তন ঘটলো ব্যাপকভাবে। ভার হয়ে আসা চোখ তুলে তাকাতে পারলো নাহ। মেহরাজের এই লাগামহীন, বেপরোয়া কথায় মিইয়ে গিয়ে নিজে যেটা বলতে চেয়েছিলো সেটাই ভুলে বসলো।
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here