ভালোবাসার_বর্ষণ #পর্ব_৪ #নীহারিকা_নুর

#ভালোবাসার_বর্ষণ
#পর্ব_৪
#নীহারিকা_নুর

সকাল থেকে মন খারাপ করে বসে আছে তরু। ওর মা এসে যখন বলল নিজের কাপড় গুছিয়ে নাও। নিজের প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে নিও। তোমার বাবা তোমাকে তোমার ফুপির সাথে তার বাসায় যেতে বলেছে। আপাতত তার কাছে থেকেই ভার্সিটিতে এডমিট হবে। এরপর৷ তোমার বাবা ঢাকায় চলে আসলে তখন নাহয় আমিও সেখানে যাব। তারপর নাহয় তুমি আমাদের কাছে চলে এসো। আর এখন আমি যেতে পারব না। তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ তোমার দাদির বয়স হয়েছে। এখন তার সব দেখা শোনার দায়িত্ব তো আমার ই। আমি তো তাকে ফেলে এখন যেতে পারব না। আর সেটা ভালোও দেখায় না। তহমিনা বেগম বলে চলে যাওয়ার পর থেকেই মন খারাপ হয়ে আছে তরুর। এই গতকালই এমন একটা সিচুয়েশন গেল। আজকেই আবার মাকে ছেড়ে দূরে যেতে হবে। তরুর ফুপি তরুকে ভালোবাসে না এমনটা নয়। বরং তরুর ফুপি, ফুপা উভয়ই তরুকে খুব ভালোবাসে। তবে ওই যে মাকে ছেড়ে কখনো দূরে থাকা হয় নি এজন্যই মূলত মনটা খারাপ। প্রথমে একটু আমতা আমতা করছিল তরু। যে সে তার মাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তবে জোড় গলায় সে কথাটা বলার সাহস হয় নি তরুর। শুধু তহমিনা হলে নাহয় তার সাথে জোড় দিয়ে কথাটা বলতে পারত তরু। তবে এটা যেহেতু নুরুল ইসলাম এর আদেশ তাই আর কথা বাড়ানোর সাহস হয় নি তরুর। বাবাকে সে যথেষ্ট ভয় পায়। নুরুল ইসলাম মেয়েকে তেমন কখনোই বকেন নি তবুও কেমন যেন ভয় লাগে তাকে। তার এই রগচটা স্বভাবের জন্যই মূলত তাকে ভয় পান। তার উপর তরু ছোট বেলা থেকেই বাবাকে কাছে পায় নি। চাকরির সুবাদে তিনি এক এক সময় এক এক জায়গায় রয়েছেন। মেয়েকে তার যথেষ্ট সময় দেয়া হয় নি৷ আর এ কারণেই মূলত বাবা মেয়ের মধ্যে কিছুটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বাবা মেয়ের মধ্যে ভালোবাসার কমতি নেই তবুও কেমন একটা অদৃশ্য দেয়াল রয়েই গেছে। তরু কখনো কিছু আবদার করলেও নুরুল এর কাছে নয় বরং তহমিনাকেই জানায়। বাবার কাছে তেমন একটা আবদারও করে না।

ছোট থেকে যেসব বাচ্চারা বাবাকে কাছে পায়, বাবার আঙুলে আঙুল রেখে হাটতে শেখে, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে বাবাকে পাশে পায়, প্রতিদিনকার ঘটে যাওয়া ঘটনার ঝুড়ি নিয়ে বাবার সাথে বসতে পারে সেসব বাবা মেয়েদের মধ্যে যেমন বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্কটা গড়ে ওঠে সেরকম টা মূলত দূরে থেকে বড় হওয়া বাচ্চাদের মধ্যে একটু কম দেখা যায়৷ যদিও প্রযুক্তির সুবাধে এখন প্রতিনিয়ত কথা বলা সম্ভব। তবুও প্রত্যাক্ষ দেখা আর শুধু কথা বলা এর মাঝে তফাৎ বহু।

একজন সন্তানের সাথে শাসন এর থেকে বেশি বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তবেই সে তার ভালো মন্দ সব কিছু বাবা মায়ের সাথে শেয়ার করবে। আর এই সম্পর্ক গড়ে তুলতে সন্তানকে দিতে হবে প্রচুর সময়।



তহমিনা বেগম কিচেনে কাজ করছেন অনেকক্ষণ যাবত। তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে তরুর রুম থেকে কোন সারা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে যে একজন মানুষ আছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। তহমিনা নুরনাহারকে এদিকটা দেখতে বলে তিনি গেলেন তার মেয়ে কি করছে সেটা দেখতে।

তহমিনা বেগম এসে দেখলেন তিনি তখন যেখানে বসা দেখে গিয়েছিলেন এখনো সেখানেই বসা। এক চুলও নড়ে নি তার মেয়ে। তহমিনা বেগম এর মেজাজ চটে যায়৷ মনে মনে ঠিক করেন মেয়েকে দু চার কথা শোনাবেন এখন। এক পা ভেতরে নিয়েও আবার পিছিয়ে আনেন। তার মন যেন তাকে বাধা দিচ্ছে বকা দেয়ার জন্য। তরু চলে যাওয়ায় ঢ়ে তরুর একার খারাপ লাগছে এমনটা নয় তহমিনা বেগম এর ও বেশ খারাপ লাগছে। তবে তা তিনি তার মেয়ের সামনে প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না। এক পা সামনে নিয়েও আবার পিছিয়ে এনেছেন। মেয়েকে বকা দেওয়ার জন্য যেসব কথা মনে মনে সাজিয়েছেন তা গলা অবধি এনে আবার গিলে নিলেন। তরুর সামনে না গিয়ে আবার কিচেনে ফিরে আসলেন। নুরনাহার তখন সবজি বসানোর জন্য কড়াইতে মসলা নাড়ছিলেন। তহমিনা বেগম এসে বললেন

– আপা আপনার ভাতিজি কতদূর গোছালো একটু দেখেন তো গিয়ে। গোছানো না হলে আপনি একটু ওর ব্যাগ প্যাক করতে সাহায্য করে দেন।

– আরে তহমিনা তুমি না মাত্র গেলে তরুর কাছে। আবার এলে কেন। কিচেন আমি সামলাচ্ছি। তুমি দেখ তরুর কি লাগবে না লাগবে। আমি কি এখানে থাকি বলো। তুমিই ভালো জানো ওর কোথায় কি আছে।

তবুও তহমিনা ইনিয়ে বিনিয়ে নুরনাহারকেই যেতে বলছেন। তহমিনা বেগম মূলত এই মুহুর্তে তরুর সামনে যেতে চাচ্ছেন না। নুরনাহার আবার যেতে বললে তহমিনা মাথা নিচু করে ওখানে দাড়িয়েই পায়ের নখ দ্বারা মেঝে খোটাচ্ছিলেন। তার চোখের কোটর অবশ্য ইতোমধ্যেই জলে টইটুম্বুর অবস্থা। যেন একটু নাড়া লাগলেই এখন গড়িয়ে পড়বে। এর কোনটাই নুরনাহার এর দৃষ্টি এড়াল না। নুর নাহার বুজতে পারছেন তহমিনার এই মুহুর্তে কেমন অনুভুতি হচ্ছে। কারণ তার মেয়েটা যখন ঢাকায় চান্স পেল না পেল চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে তখন খবরটা শোনার পর থেকেই তার বুকের মধ্যে কেমন শুন্যতা অনুভব করছিলেন। এই যে এক মাত্র মামাতো বোনের বিয়েতে এটেন্ড করতেও আসতে পারে নি তার এক্সাম শুরু হওয়ায়। নুর নাহার অবশ্য এখন এতে অভ্যাস্ত। তবে তহমিনা তো ছোট থেকে তরুকে হাতের তারায় মানুষ করেছেন। একটা রাতও দূরে গিয়ে থাকতে দেন নি৷ মায়ের আচলের তলায়ই বড় হয়েছে তরু। একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুবাধে ভালোবাসা সব ওর একার জন্যই বরাদ্দ। ওকে না দেখে এক মুহুর্ত ও কা’টত না তহমিনার। তরু অবশ্য বড্ড আদুরে তার মায়ের কাছে। গ্রামের মেয়েদের যেমন উড়নচণ্ডী ভাব থাকে তরুর মধ্যে সেগুলো নেই৷ তহমিনা কখনো বাহিরের মানুষদের সাথেও তেমন মিশতে দেয় নি। মেয়েকে গ্রামে রেখে বড় করলেও তরুর মধ্যে সেরকম অবুজপনা মোটেই দেখা যায় না। এতটুকু বয়সেই যথেষ্ট ম্যাচিউর মনে হয় তরুকে। একটা পুতুলকে যেমন যেভাবে ইচ্ছে নাচানো যায় তরু ছিল তহমিনার কাছে তেমনই। তহমিনা নিজের মতো করেই গড়ে তুলেছেন। এত আদরের মেয়ে তাকে ছেড়ে যাবে এটা মানতে তহমিনার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। এখন তরুর সামনে গেলে হয়ত তহমিনা নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না সেখানেই কান্না করে দিবে। তাই এখন ইনিয়ে বিনিয়ে নুরনাহার কে পাঠাচ্ছে।

– তহমিনা তোহা ছিল না কাল এখানে। ও কোথায়? ওকে বলো তরুকে সাহায্য করতে।

– সে কি আপা আপনি দেখেন নি৷ ও তো চলে গেছে। সকালের একটু পরেই বেড়িয়েছে। ওর বাবা ফোন করেছিল। বাসায় নাকি কি ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে তাই তখনই চলে গেল মেয়েটা।

– ওহ আচ্ছা। তাহলে তুমি দেখ এখানে। আমি তরুর কাছে যাচ্ছি।

নুরনাহার বেরিয়ে যেতে নিয়েও আবার ফিরে আসে। তহমিনা ততক্ষণে রান্নায় হাত লাগিয়েছে।

– তহমিনা তরু তোমার মেয়ে হলেও ওকে আমি মেয়ের মতোই ভালোবাসি৷ তোমার মেয়ে আমার কাছেই যাচ্ছে। খালে ভাসিয়ে দিচ্ছ না যে এত কাদতে হবে৷ তুমি চাইলে তুমিও আমার সাথে চলো। তাহলে মায়ের জন্য নাহয় একজন লোক রেখে দিব যে মায়ের দেখা শোনা করবে।

নুরনাহার এর কথায় মুচকি হাসি দিয়ে আবার রান্নায় মনযোগ দেয় তহমিনা। আর বলে না আপা আমি কাদছি না৷ আপনি দেখেন তরু কি করছে। নুরনাহার চলে গেলে মনে মনে হাসে তহমিনা। কথা যত সহজে বলা যায় বাস্তবে কি তত সহজেই সবটা সম্ভব হয়। এখন যদি তহমিনা সত্যি মেয়েকে নিয়ে দূরে থাকতে চায় তবে এরাই আবার বলবে যে শাশুড়ীকে পছন্দ করে না তাই শাশুড়ীকে একা রেখে চলে গেছে। সংসার ধর্ম যতটা সহজ মনে হয় এতটা সহজ ও নয়। এগুলো একজন নারীই বুঝতে পারে যে পদে পদে তাকে কত কিছু সামলাতে হয়।

নুরনাহার এসে দেখে তরু কিছুই গোছায় নি।

– আরে তরু এতক্ষণ কি করছিস রে মামনি। তিনটার বাস মিস হয়ে গেলে আজকে আর ঢাকায় ফেরা লাগবে না৷ তুই শাওয়ারে ঢোক আমি বাকিটা গোছাচ্ছি।

– কিরে আপা তরু কি যেতে চাচ্ছে না নাকি৷ এখনো রেডি হয় নি। ও চাইছে টা কি দেখি তো আমি৷।

তরু ঘাড়া ঘুরিয়ে দেখে ওর রুমের দরজার সামনে নুরুল ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে৷ নুরুল ইসলামকে দেখার সাথে সাথেই এক লাফে খাট থেকে নেমে দাড়ায় তরু। এতক্ষণ যে মা, ফুপি বলল তা গায়েই লাগল না। অথচ নুরুল ইসলাম কিছু বলার আগেই এক লাফে খাট থেকে নেমে নিচে দাড়িয়েছে।

নুরুল ইসলাম মেয়ের কাহিনি দেখে একটু হাসলেন। তবে তা নীরব হাসি৷ তার মুখ দেখেও বোঝা যাবে না তিনি হাসছেন। তিনি বললেন

– আরে শান্ত হও। তোমার সাথে আমার কথা আছে তাই এসেছি ।

তরু নুরুল ইসলাম এর দিকে তাকায়। কালকের পর একবারও বাবার মুখোমুখি হয় নি তরু। বাবা কি বলবে সেই ভয়ে এক প্রকার লুকিয়েই গিয়েছে বাবার সামনে থেকে। এখন বাবা ওর রুমে এসেছে কিছু বলতে। জ্বিভ দিয়ে ঠোট ভেজায় তরু। নুরুল ইসলাম কি বলবে সেটা শুনতে তার দিকে তাকিয়ে তরু।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here