ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_২৫ #লেখিকা_হুমাইরা_হাসান

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_২৫
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান

সূর্যের মনোরম নরম রোদ্দুর, বাবুই পাখির কলকলানি, বৃষ্টি ফোঁটার উপর উপচে পড়া রোশনাইয়ে মুক্তোর ন্যায় ঝিলিক। প্রাসাদতুল্য বাড়িটার থেকে মিটার খানের দূরত্বে হৃদের ঢেউগুলো বাতাসের ছলকানিতে ছোঁয়াছুঁয়ির অসম খেলায় মেতেছে।
সুবহে সাদিকের প্রহর পেরিয়ে বেলা হওয়ার সাথে সাথে চাঞ্চল্যে মেতে ওঠে আড়মোড়া ভাঙা পরিবেশ। খুব ভোরে ঝরে পড়া শিউলি গুলোতেও মরিচার ন্যায় রঙ ধরতে শুরু করেছে।

ঘরটার মাঝে এসির শৈথিল্যের স্পর্শ কাটা দিচ্ছে শরীরে, বারান্দার স্লাইডিং ডোর ভেদ করে এলোপাতাড়ি তীর্যক আলো গুলো উপরে পরছে ঝকঝকে ফকফকে টাইলসে। প্রকৃতির এরূপ উন্মত্ত সৌন্দর্য, নতুনত্বের অবগাহন, সুসজ্জিত তটস্থ রূপ সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে প্রেমিকের নির্জীব, নিস্তেজ দৃষ্টি বিমোহিত তার প্রিয়তমার চোখে, মুখে,ঠোঁটে, সব খানে।
পদ্মলোচন দুটি আঁখি, কিশলয়ের মতো কোমল দুটি অধর। দুধে আলতা গায়ের রঙ ছাড়াও যে কারো গড়ন এতোটা আকর্ষণীর হয় তা মেহরাজের জানা ছিল না। আসলেই কি এতটা দৃষ্টিনান্দনিক! নাকি ওর চক্ষের ভ্রম? কেন একই চেহারায় হৃদয় খানা বারবার আত্মভোলা হয়ে যায়। এই রূপ, এই চেহারাতে তাকিয়ে যেন জন্ম জন্মান্তর পার করে দেওয়া যায়! আখিপল্লবের পাতলা আবরণে অসংখ্য বার ওষ্ঠ ছুঁয়ে ভুলে যাওয়া যায় এক জীবনের দুঃশ্চিন্তা, পরাজয়, গ্লাণি।

এক হাত তুলে লম্বা আঙুলের স্পর্শে উষ্ণ পরশে কপাল থেকে চুল গুলো আস্তেধীরে একটা একটা করে সরিয়ে দিল মেহরাজ। এতটুকু অধিকারেই যেন মনের গহীনে সুখানলের তান্ডব শুরু হয়, প্রকৃতির ন্যায় বিশাল স্বর্গীয় তৃপ্তিতে ভরে ওঠে অন্তঃস্থল। ক্লান্ত মুখখানার দর্শনে আসক্তিতে অবচেতন হয়ে ওঠে সমস্ত কায়া। বুকের ভেতরে কোনো এক সুপ্ত, গোপন জায়গা থেকে বারংবার অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে সূক্ষ্ম শব্দের কতটি লাইন, মনে মনেও মেহরাজ অসংখ্য বার আওড়ালো

” আমার প্রিয়তমা, প্রাণসঞ্চারিকা ! আপনি আমার কোমল আলোকিত চাঁদ, মৃত্যু অবধারিত জেনেও পতঙ্গ যেভাবে ছোটে আগুনের পানে, তার চেয়েও অধিক পিপাসু হৃদয়ে আমি মরিয়া হয়ে ছুটি আপনার হৃদয়ের কোণে একটু জায়গা পাবার তরে। আমার এক জীবনের প্রেম, ঐশ্বর্য, স্বর্গীয় মাদকতা আমার চন্দ্রাবতী আজীবন আমৃত্যু আমি শুধুই আপনার। যদি কখনো, কোনো ভাবে, কোনো কারণে একটা বার মনে চাই শুধু একবার ডাকবেন, এই অধম শুধু তারই অপেক্ষায়। ”

নড়েচড়ে উঠলো মোহর। ঘুমেও ঘোরেই টের পেল শরীরে একটা উষ্ণ স্পর্শের পরশ। যান্ত্রিক শীতলতায় শিথিল হয়ে আসা শরীর আরেকটু ওমের লোভে সরে এলো নিকটে।
সম্পূর্ণ নিজের চেতনের অজান্তেই মেহরাজের বুকের মাঝখানে মুখ গুঁজে দিল, এক হাতে খামচে ধরলো প্রচণ্ড বেগে কম্পমান মাংশল পিণ্ডটাকে আবৃত চামড়ার উপরে। আধো অবচেতনেই শুনতে পেল প্রবল কম্পমান যন্ত্রটার ধুক ধুক শব্দ। ভ্রু কুচকে এলো ঘুমের মাঝেই।
ওর তর্যমায় বর্ণনা করলে হয়তো হার্টবিট প্রচণ্ড ফাস্ট, হৃদস্পন্দনের স্বাভাবিক রেট সিক্সটি টু হান্ড্রেড কে ছাড়িয়ে হয়তো ওয়ান থার্টি পর্যন্ত ওঠেছে,যেটা মোটেও নিয়মমাফিক শমিত নয়

খানিক নড়েচড়ে হাতড়ে হাতটা এদিক ওদিক সরাতে হাতের নরম তালুতে ধারালো কিছু বিঁধলো। ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে ঘুমের রেশ। অর্ধ নিমজ্জিত আঁখিযুগল একটু একটু করে খুলতেই নিজের চেয়ে মাত্র ইঞ্চি তিনেক দূরত্বে আবিষ্কার করলো শুভ্র,গৌড়বর্ণের মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন একটা চেহারা। ঘুমে ঢুলু ঢুলু লালাভ চোখের অর্ধ প্রসারিত দৃষ্টিতে একধীমে তাকিয়ে আছে তার পানে।
ধারালো চোখের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চাহনির প্রখরতা আজ বড়ই বিলুপ্তিত, ধূসর বর্ণা চোখে যেন মোহর আজ অন্যরকম নেশা, অনুরক্তির তীব্র ছাপ দেখতে পেল । ঠিক কতক্ষণ নিষ্পলক চাহনি স্থির রইলো তা মোহরের হিসেবের বাহিরে। নিজের হাত, পা, দেহের অবস্থানটুকু উপলব্ধি করতে পারলো না অপার্থিব মায়ায় মজে।
মিনিট খানেক বাদে ধপ করে হুঁশ ফিরলো মোহরের, ভয়ার্ত সংকুচিত চাহনিতে একবার মাথা উপর নিচ করে নিজ দেহখানির অবস্থান টুকু অনুভব করতেই অদ্ভুত শিহরণ কম্পিত করে তুললো সমস্ত দেহাবয়ব। ঝিমঝিম করে কোনো একটা প্রখরত্ব অনুভূত হলো, বিদ্যুতের ঝলকানির ন্যায় ঝলসে উঠে সরে এলো মোহর।
উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ফিরে তাকালো। উঁচু বিছানার পায়ার কাছে ফ্লোরে লুটিয়ে আছে মাঝখানে রাখা বালিশ দুটি। বালিশ দুটির অবস্থান তার দিকেই তার মানে নিশ্চয় ও নিজেই ফেলে দিয়েছে ঘুমের ঘোরে, তবুও অস্বস্তির গলায় খানিক তেজ মিশিয়ে বলল

– আ আপনি আমার জায়গাতে কেন এসেছিলেন? কেন ধরেছেন আমাকে?

মেহরাজের স্থৈর্য দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটলো নাহ। কনুইয়ে ভর করে উঠে বসলো। হাঁটুতে কিঞ্চিৎ ভাঁজ করে তার উপর হাত রেখে ঘাড় বাকিয়ে মোহরের দিকে তাকিয়ে বলল

– আসলেই কি আমি ধরেছি?

উহু! মোটেও নাহ। মোহর ঘুমে বুদ হয়ে কখন নিজের মাথার অবস্থান টা বালিশ থেকে পরিবর্তন করে মেহরাজের বুকে চাপিয়েছে, নিজের চিকন আঙুলের ভারি দৃঢ়মুষ্টিতে আঁকড়ে ধরেছে স্বামী নামক পুরুষটির বক্ষস্থলের বাঁ পাশের পোশাকের একাংশ সেটুকু ওর ও বোধগম্যের বাহিরে৷
নিজের ভুল টা বুঝতে পেরে হের যাওয়া হরিণীর ন্যায় টানা টানা আঁখির অবিন্যস্ত নজরে বাঁকা চাহনি দিয়ে বলল

– আমি জানি নাহ

বলে ধুপধাপ পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল সশব্দে। মেহরাজ শুষ্ক অধর ছড়িয়ে অকৃত্রিম মায়াভরা এক হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বলল

– জানতে হবে নাহ, শুধু রোজ একটা বার করে বুকের মাঝে ওই হাতের অস্তিত্ব টুকু ছুঁইয়ে দিয়েন, বেহায়া মন আর কিচ্ছু চাইবে নাহ

.

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোলে মেহরাজ কে ঘরে না দেখতে পেয়ে স্বস্তি পেলেও কেমন একটা কৌতুহল জাগলো। ঘাড় ঘুরিয়ে উঁকিঝুকি দিল বারান্দার দিকে। দীর্ঘাকার লম্বাটে শরীর অবয়ব টা বারান্দায় মৃদু রোশনাইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে। ফর্সা ঘাড়ে লাল টুকটুকে ছোট্ট তিলতুল্য ছোট বিন্দুটি চোখ ধাধানোর মতো চিকচিক করছে। মোহরের মনে অদ্ভুত সব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো।
আচ্ছা লোকটার সবকিছু এতটা নিখুঁত কি করে? নাকি কৃত্রিম? ছেলেরা কি প্রাকৃত ভাবেই এতো সুন্দর হয়! মোহরের মনে হয় আজ অব্দি মেহরাজের মতো সুদর্শন পুরুষ ও কোথাও দেখেনি। সরু, সুতনু মুখাবয়ব। ছয় ফিট্ এর অধিক উচ্চতা, কাটকাট অভ্যাসের পরিসীমা, স্ট্রেইট কাট বাচনভঙ্গি এতকিছুই কি পারফেক্ট হয়?

– আপনি চাইলে কাছ থেকেও দেখতে পারেন, চুরি করে নজরদারি করার দরকার নেই

চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকালো মোহর। মেহরাজ বাঁকা হেসে ডান পাশে রদ্দুরে ছায়া টার দিকে তাকিয়ে বলল

– এখানে আপনি ছাড়া দ্বিতীয় জন নেই মোহ। আসতে পারেন

মোহর এ পর্যায়ে ভীষণ অপ্রস্তুত হলো। তার চেয়েও বেশি বিরক্ত। এই লোকটার কি পেছনেও দুটো চোখ আছে? বুঝলো কি করে? এখন বুঝেই যখন ফেলেছে পালিয়ে আর কি করবে। অগত্যা গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরাজের পাশে কাঁচের রেলিং ঘেঁষে।
মেহরাজের হাতে মাঝারি সাইজের একটা সিজার। টবের ছোট ছোট গাছগুলোর নেতিয়ে যাওয়া পাতা গুলো ছেটে স্টিলের একটা ঝাঁঝরি তুলে পানি দিতে থাকলো। মোহর আশপাশে তাকিয়ে কৌতূহলী গলায় বলল

– বাগানে এতো গুলো বিদেশি ফুলের মাঝে একটা মাত্র হলুদ গোলাপ গাছ কেন?

ঝাঁঝরি টা হাত থেকে নামিয়ে একটা স্প্রে বোতল হাতে নিল, পাতায়, ফুলে স্প্রে করতে করতে বলল

– যেমন অনেকগুলো পছন্দের মাঝে একটা মাত্র প্রিয় থাকে ঠিক তেমন।

– মানে হলুদ গোলাপ আপনার প্রিয় বলছেন?

মোহরের সকৌতুক স্নিগ্ধ চেহারাটায় এবার মেহরাজ পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে তাকালো। শরতের মলিন বাতাসে তখন শিউলির নরম ঘ্রাণ, চুলগুলো উপচে উড়ছে এদিক ওদিক। খানিক যান্ত্রিক নজরে চেয়ে থেকে আবারও নিজের কাজে মনোনিবেশ করে বলল

– উহু, হলুদ গোলাপের সাথে প্রিয় একটা জিনিসের মিল খুঁজে পাই।

– গোলাপের সাথে মিল মানে?

মেহরাজের অধরে তখন রহস্যময়ী হাসির রাজত্ব। মোহরের দ্বিধাদ্বন্দে ভরা চেহারাটাকে আরেকটু বিব্রত করে দিয়ে মেহরাজ মন্থন কণ্ঠে বলল

– হ্যাঁ মিল। গোলাপের নরম পাপড়ি, সুমিষ্ট ঘ্রাণ, নির্মল রূপে কোনো একটা মানুষের সূক্ষ্ম প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। যেন মানুষটার প্রতিকী স্বরূপ গোলাপটাকেই শুধু মানায়

মোহরের ললাটে বিস্তর ভাঁজ পরলো। না চাইতে ভেতরে কেমন তীব্র একটা ক্ষোভ জাতীয় অনুভূতির অনুপস্থিতি টের পেল। মেহরাজ নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের কথা বলছে? তাহলে মোহরের ধারণাই সত্য? মেহরাজের কোনো প্রেমিকা ছিল? তার স্মরণেই এখনো ফুলগুলো কে তারই প্রতিকী বলছে? না চাইতেও কেমন একটা অসূয়া খলবলিয়ে উঠলো মানষিক চিত্তে।

– ওহ। আচ্ছা আসছি

বলেই সংক্ষিপ্ত বাক্যে নিজের দ্বেষ টুকু স্পষ্টরূপে বুঝিয়ে দিয়েই প্রস্থান করলো। তবে মোহর কথাটা বলেও মুহূর্ত খানেক অপেক্ষা করছিল যেন মেহরাজ ওকে থামিয়ে আরও কিছু বলবে। কিন্তু মোহরের সেই প্রত্যাশায় জল ঢেলে ফুলগাছে জল ঢালতে থাকলো মেহরাজ, এমনকি প্রত্যুত্তরের বদলে একবার ঘুরেও তাকালো নাহ।কোন্দল প্রবর্তক চিত্তে গটগট পা ফেলে বেরিয়ে এলো মোহর। সকাল করেই মন মেজাজ কেমন বিগড়ে গেল। যার কোনো সুস্পষ্ট হেতু বোধগম্য হলো না ওর নিজের ও।

রেডি হয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্য নিচে নেমে এলো মোহর। এখনো ক্লাস শুরু হতে ঘন্টা সময় দেরি। কিন্তু ও ঘরে থাকার নূন্যতম ইচ্ছে করছিল না বলেই নিচে নেমে এসে কাউচে বসে রইলো।

কাকলি বেগম সোফাতে বসে তাথই এর বাচ্চা অর্থাৎ তোয়াকে কোলে করে দোলাচ্ছে। শাহারা পাশেই বসে তসবিহ গুণছে।

– অরুন এসেছিল কাল?

কথাটা তাথইয়ের উদ্দেশ্যে নিঃসৃত হলেও তাতে যে ওর কোনো রা নেই তা ওর নির্লিপ্ত ভাবে রুটি ছিড়ে মুখে পুরার অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট। কাকলি বেগম হয়তো আগে থেকেই জানতেন এরূপ অভিব্যক্তিই পাবে মেয়ের কাছ থেকে, তাই বিরক্তি হীনাই পুনরাবৃত্তি করলো

– অরুন এসেছিল কাল? তোকে নিতে এসেছিল?

মৃদু ঘাড় নাড়ালো তাথই। কাকলি বেগম অবিলম্বেই আবারও জিজ্ঞাসা করলেন

– তোদের মাঝে কি হয় বল তো? কিসের এতো রেষারেষি? আমি তো অরুন ছেলেটার কোনো দোষ দেখি না। বরং ও ভদ্রছেলে বলেই তোর এতো তেজ সহ্য করেও বারবার তোকে নিতে আসে, তবুও এতো কিসের গড়িমা বল তো। নিজের বাচ্চাটাকে তো ওর ও দেখতে ইচ্ছে হয়

কাকলির কথায় মোহরের নিকট স্পষ্ট হলো যে কাল সকালে কলিং বেল বাজানো ব্যক্তিটি তাথই এর স্বামী ছিল। যাকে অরুন বলেই মন্তব্য করছে কাকলি।

– হ্যাঁ তো দেখতে তো আমি নিষেধ করিনি?

– নিষেধ করিস না বলিস ও তো না। আজ তো ছেলেটার জন্মদিন শুনলাম। অন্তত ওকে বাড়িতে ডেকে কিছু রান্না করেও তো খাওয়াতে পারিস

তাথইয়ের কথার পৃষ্ঠে আবারও বললেন কাকলি বেগম। সাঞ্জে চুপচাপ ফোন দেখছে আর খাচ্ছে। তাথই এবার বেশ বিরক্ত গলায় বলল

– ও তো কোনো বাচ্চা নয় যে পায়েস রেধে জন্মদিন পালন করবো আমি! বাড়িতে কি খাইনা? আর তুমি ইনিয়েবিনিয়ে কি বলতে চাও? আমাকে ওর বাড়িতে পাঠাতে চাও তাই তো? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো আমি আশরিয়া তাথই, এই বাড়ি আমারও। আমি যতদিন না চাই ততদিন আমাকেও কেও বের করতে পারবে না কেও না

বলে খাবারের প্লেট টা সরিয়ে দিয়ে উঠে সিড়ির দিকে গেলেই মেহরাজের সামনা-সামনি পড়লো। মেহরাজ তাথইয়ের অস্থির রক্তচক্ষু চেহারা দেখে ভ্রু কুচকালো, কৌতুহল ভরা গলায় বলল

– আশু? কি হয়েছে?

ভাইয়ের এইটুকু স্নেহপূর্ণ কথায় যেন পাথর মন তড়বড় করে গলে গেল। মিইয়ে গেল সুরত, কণ্ঠে ভার করলো হাজারো অশ্রু।
বোনের অশ্রু টলমল চোখ দেখে মেহরাজ ওর দুগালে হাত রেখে বলল

– ভাইয়া কে বল কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই? কে কি বলেছে তোকে?

তাথই মেহরাজের আদরভরা কথায় নিস্তেজ হয়ে গেল। কান্না গুলো উগড়ে এসে কণ্ঠনালিতে ভর করলো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মেহরাজ বোনকে দুহাতে আগলে ধরে শান্ত চোখের ধারালো নজরে তাকালো উপস্থিত মানুষ গুলোর দিকে।
আজহার মুর্তজা ঘর থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছিলেন, এহেন দৃশ্যে তিনিও থেমে গেলেন। কাকলি বেগম মেহরাজের রুষ্ট চাহনি দেখে বলল

– তোমার বোনকে কে বা কি বলবে? ওকে কিছু বলা যায়? এতদিন হলো এ বাড়িতে এসেছে না ও বাড়িতে যায় নাইবা কারো সাথে যোগাযোগ করে, কিছু বলতে গেলে তো ঝাঝের তুবড়ি ছোটে।

মেহরাজ বুক থেকে তাথইকে তুলে ওর চোখ মুছে দিল। এক হাতে জড়িয়ে ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমের মাঝ বরাবর এগিয়ে এসে বলল

– আমার বোন যতদিন চাই যেভাবে চাই যেখানে চাই সেখানেই থাকবে। ওর যদি সারাজীবন ও এখানে থাকতে ইচ্ছে করে তবে তাই থাকবে। এ নিয়ে যেন এতো সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না তো?

আম্বি বেগম নিশ্চুপ থাকলেও মেহরাজের এরূপ কথায় সায় দিতে পারলেন নাহ। প্রতিবাদ স্বরূপ গলায় বলল

– তা বললে কি করে হয় বাবু। বোনকে বিয়ে দিয়েছি যখন ওকে তো শ্বশুড়বাড়ি থাকতেই হবে। এখানে আসতে বা থাকতে তো কেও নিষেধ করেনি। কিন্তু এভাবে কারো সাথে যোগাযোগ, সহবত, কথাবার্তা ভুলে ঘরে বসে থাকলে, রুক্ষ মেজাজ করলে কি করে হবে? দিন দিন ওর আচরণ অনেক বেশিই দৃষ্টিকটু হয়ে যাচ্ছে না? ওর শ্বশুড়বাড়িতে কি জবাব দেব আমরা? ওর তো আমাদেরকে সমস্যা টা স্পষ্টভাবে জানানো উচিত

মেহরাজ তাথই কে হাত ধরে এনে খাবার টেবিলে আবারও বসালো। নিজে হাতে নতুন করে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলল

– উপযুক্ত সময়ে ওর সমস্যা বা মতামত টা তো কেও স্পষ্টভাবে জানতে চাওনি? তাহলে আজ কেন?

থমকে গেল আম্বি বেগম, কাকলি বেগম ও কথার পৃষ্ঠে কিছু বলল না। আজহার এগিয়ে এসে টেবিলে বসে বলল

– আমাদের মেয়েদের মতামত তো আমরা সবসময়ই মেনে নেই। ওদের কোনো অসুবিধা তো হতে দেই না তাহলে..

– তাহলে থাক। এবার ওদের ব্যাপার টা আমায় দেখতে দাও। আপাতত আমি চাইনা তাথই কে কেও কোনো ভাবে বিরক্ত করুক। অরুনের সাথে আমি কথা বলে নেবো

বলে চুপচাপ খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো। মোহর খেয়াল করলো বাকিদের মুখে আধার নামলেও শাহারা বেগমের মুখে সন্তুষ্টির ছাপ, ওদের কথাবার্তা অনেকটাই জড়ানো পেচানো। তবে এটুকু মোহরের মস্তিষ্ক খুব সূক্ষ্ম ভাবেই ধরতে পারলো যে তাথই হয়তো ওর বৈবাহিক সম্পর্কে খুশি না বা বিয়েতে ওর মত ছিল না। এমন কিছু।

এর মাঝেই হুট করে কলিং বেলের ধাতব শব্দটা নিস্তব্ধ পরিবেশে বিকট শব্দ তুললো। মোহর নিজে থেকেই উঠে গিয়ে দরজা টা খুললেও ওর স্বাভাবিক মুখাবয়বের প্রবল পরিবর্তন ঘটলো। কোনো বিস্ময় বা খুশি না বরং সামনের চেহারা টা দেখেই সেদিনের অপমান, নোংরা কথা গুলো মন মেজাজে নিমিষেই রুষ্টভাবাপন্ন বিরক্তি ঢেলে দিল

– কে এসেছে?

আম্বি খাতুনের কথায় মোহর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, দরজা ছেড়ে সরে এসে আগের জায়গাতে বসে পরলো। সকলের কৌতুহলী দৃষ্টিতে একঝাঁক দূরকল্পনার রেশ ঢেলে ছোট খাটো একটা স্যুটকেস হাতে প্রবেশ করলো তিয়াসা।
ব্লু জিন্স আর পাইন গ্রীন রঙের একটা টপস পরিহিত শরীরের মুখ জুড়ে ছোট হাসি। তবে তা বিস্তর নয়। ওকে দেখে অন্যেরা বিস্মিত হলেও কাকলি খাতুন পূর্বোবগতের ন্যায় হেসে বললেন

– তিয়াসা আসো আসো। দেরি করলে যে!

– আসলে ঘুম থেকে উঠতে একটু লেট হয়ে গেছে।

বলে আরও দুকদম এগিয়ে এলো। আম্বি খাতুন টেবিলের কাছ থেকে সরে এসে বললেন

– তিয়াসা তুমি হঠাৎ

– কেন আন্টি আমি কি আর এ বাড়িতে আসতেও পারিনা?

– কেন পারবে না, অবশ্যই পারবে। এসো আমার কাছে বসো

বলেই কাকলি বেগম সকলের উদ্দেশ্যে বলল

– তিয়াসার বাবা মা দুজনেই শহরের বাইরে গেছে। অত বড়ো বাড়িতে মেয়েটা একা থাকবে তাই আমিই ওকে ডেকেছি। সাঞ্জেও আছে ভালো লাগবে সবার

– তোমার লাগতে পারে, আর কারো লাগবে না

মুখ ভেংচে বিড়বিড় করে বলল সাঞ্জে। তিয়াসা ওর মেকাপের প্রলেপে ঢাকা কৃত্রিম চেহারায় মৃদু হেসে বলল

– আমি আসাতে হয়তো কেও খুশি হয়নি। এই জন্যেই আমি আসতে চাইনি। আপনি শুধু শুধু আমাকে ডাকলেন আন্টি

কাকলিকে উদ্দেশ্য করে বললেও। আজহার মুর্তজা এবার বললেন

– না না। কি বলছো।তুমি তো এ বাড়িতে আজ নতুন আসছো না। কাকলি ভালই করেছে। তোমার বাবা মা না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকো তুমি

তিয়াসা সামান্য হাসলো। সকলের দৃষ্টির অগোচরে মোহাচ্ছন্ন নজরে তাকালো একদম সম্মুখ বরাবর পুরুষটির দিকে, এসে থেকে একটা বারের জন্যেও যার নজরে আসতে পারেনি। ডিপ গ্রে শার্ট, কনুই অব্দি গুটানো হাতা, সিলভার ওয়াচটার চিকচিক করা আলোর থেকেও ফর্সা হাতের লোমগুলো বেশি চোখ ধাধাচ্ছে।
তিয়াসার এই ঘোর লাগা দৃষ্টি সকলের চক্ষু এড়াতে পারলেও পারেনি একজনের চোখে আড়াল হতে। সদা সর্বদা শান্ত চোখের স্বভাব উগড়ে দিয়ে ধারালো হলো দৃষ্টি। রেষপূর্ণ, তীর্যকভাবে একবার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে একবার মেহরাজকে অবলোকন করলো মোহরের তীক্ষ্ণ চাহনি
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here