#প্রেম_ফাল্গুন
#পর্ব_২
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)
“আপনি তো রুমের ভেতরেই থাকবেন। আপনার সামনে আমি শার্ট পড়ে ঘুড়তে পারব না।”
ববি বেশ ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,,
“তা ঠিক। তবে সবটাই ডিপেন্ড করছে নজরের উপর। আমার নজর কিন্তু রাস্তার ছেলেদের মতো নিম্নমানের না। যথেষ্ট মানসম্মত।”
লিলি মাথাটা নিচু করে ছোট আওয়াজে বলল,,
“ঠিক আছে। তবে মনের মাঝে তো খচখচানি থেকেই যায়।”
“ওকে ফাইন। আপনার যেহেতু এতোই দ্বিধা। আমি এক কাজ করছি, আপনার শাড়িটা নিয়ে গ্যাসে যাচ্ছি৷ আগুনের নিম্ন তাপে শাড়িটা শুকিয়ে আনছি৷ বড়জোড় ঘন্টা খানিক সময় তো লাগবেই। এরপর শুকনো শাড়িটা আপনি আবার পড়ে নিবেন। তখন আর শার্ট পড়ে ও আমার সামনে আপনাকে ঘুড়তে হবে না। সিম্পল।”
লিলি চোখে, মুখে উদ্বিগ্নতা নিয়ে বলল,,
“গ্রামে থাকতে আমি শুনেছি, শহরের বাসা বাড়ির লোকরা এমন শাড়ি, কাপড় গ্যাসে শুকাতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের দূর্ঘটনার শিকার হয়। জান মালের অনেক ক্ষতি ও হয়। দূর্ঘটনার তো কোনো হাত, পা নেই তাই না? কখন কি থেকে কি হয়ে যায়। এজন্যই তো আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। আমার মনে হচ্ছে আপনার এই আইডিয়াটা আমাদের জন্য হেল্পফুল হবে না। উল্টে ক্ষতিকর হতে পারে।”
ববি মাথা চুলকিয়ে কিছুটা তিক্ত হয়ে বলল,,,
“তাহলে আপনি কি চাইছেন? কি করতে চাইছেন? নাকি এভাবেই ভেজা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছেন?”
লিলি ছোট ছোট চোখে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আপনার মায়ের একটা শাড়ি হবে? যদি যোগাড় করে দিতেন।”
“হাউ স্ট্রেন্জ্ঞ লিলি। আমি এখন মায়ের রুমে যাবো কিভাবে? মা তো আমাকে দেখে নিবে। আর আমি যদি কোনো ভাবে ধরা পড়ে যাই তাহলে পারবেন তো আপনি, বাড়তি ভেজাল সামলাতে?”
লিলি কিছু বলল না৷ মাথা নিচু করে মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে আছে৷ ববি সামনের চুল গুলো টেনে লিলির কিঞ্চিৎ সামনে এগিয়ে এসে বলল,,
“প্লিজ ট্রাস্ট মি লিলি। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি আপনার দিকে বাজে নজরে তাকাবো না। ইনফেক্ট আমি তো আপনার সামনেই আসব না। এই যে আমি রুম থেকে বের হচ্ছি সোজা ব্যালকিনতে যাচ্ছি। ব্যালকনির দরজাটা ঐ পাশ থেকে বন্ধ করে দিবো। এমনকি জানালার থাইটা ও। দরকার হলে জানালার পর্দা গুলো ও লাগিয়ে দিবো৷ তখন তো আর কোনো অবকাশ থাকবে না, জানালা দিয়ে আপনার দিকে তাকানোর। বিশ্বাস করুন, কোনো ভাবেই আমি আপনার দিকে তাকাবো না। আই শাপাথ।”
লিলি এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ববির শর্তে সে ঘোর নারাজ। তার মধ্যে অপারগতার কোনো চিহ্ন ই নেই। মনের মাঝে প্রবল জড়তা কাজ করছে৷ হুট করেই ববিকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যা হয়তো আগে থেকেই তার ব্যক্তিত্বে মিশে আছে। ববি ভীষন হাইপার হয়ে কপাল ঘঁষে ক্ষীণ কন্ঠে লিলিকে বলল,,
“ওকে ফাইন। আমার কাছে আর একটা অপশন আছে। আপনি চাইলে আমার শার্টের উপর আরেকটা সিঙ্গেল ব্ল্যাঙ্কেট মুড়িয়ে রাখতে পারেন। তখন কোনো ভাবেই আপনার বডি দেখা যাবে না। আই হোপ এই অপশনটা আপনার চয়েজএ্যাবল হবে।”
লিলি মাথা উঠিয়ে ম্লান হেসে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“হুম। এই অপশনটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
ববি পর পর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,
“থ্যাংকস গড। শেষ পর্যন্ত এই অপশনটা আপনার মনে ধরেছে।”
হম্বতম্বি হয়ে ববি আলমারি থেকে সিঙ্গেল একটা ব্ল্যাঙ্কেট বের করে লিলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,,
“এই নিন ব্ল্যাঙ্কেট। দাঁড়ান শার্ট ও দিচ্ছি।”
আলমারির হ্যাঙ্গার থেকে একটা হোয়াইট শার্ট বের করে ববি লিলির হাতে তুলে দিয়ে বলল,,
“শার্টটা ও নিন। আর সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে যান।”
“আপনি কি এখানেই থাকবেন?”
“না। আমি এখনি ব্যালকনীতে চলে যাচ্ছি। ভয় নেই আপনার। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ববি কোনো মেয়ের জন্যই ক্ষতিকর নয়।”
লিলি মাথাটা নিচু করে আমতা আমতা করে বলল,,
“আপনার দিকে তাকাতে আমার খুব দৃষ্টিকটু লাগছে। এই প্রথম উদোম গাঁয়ে কোনো ছেলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমি ও তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
ববি হালকা হেসে বলল,,
“ওকে স্যরি। আমি শার্ট পড়ে নিচ্ছি। আর আপনার সামনে থেকে ও লিভ নিচ্ছি।”
রুমের টিউব লাইট অফ করে ববি ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো। লিলি হকচকিয়ে উঠে বেডের একটা কর্ণারে এসে দাঁড়ালো৷ কাঁপা কাঁপা স্বরে লিলি ববিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
“লালালাইট টা অফ করলেন কেনো?”
“ডোন্ট ওরি লিলি। আপনি এতো ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেনো? আপনার ক্ষতি করার কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই। আমি লাইটটা অফ করেছি কারণ, বলা যায় না আমাদের বাড়িতে যদি হঠাৎ কেউ ঘুম থেকে জেগে যায়, আর যদি কোনো ভাবে দেখে নেয় যে আমার রুমের লাইট জ্বলছে, তখন উনারা নির্ঘাত কিছু সন্দেহ করবেন, দরজা ধাক্কাবেন, জানতে চাইবেন এতো রাত অব্দি আমার রুমের লাইট জ্বলছে কেনো? তখন আমি তাদের কি জবাব দেবো? এর চেয়ে ও বড় পয়েন্ট হলো উনারা রুমে ঢুকলেই আপনাকে দেখে নিবে। বেঁধে যাবে আরেক কেলেঙ্কারি। পারবেন তো তখন এতো বড় কেলাঙ্কারি সামলাতে?”
লিলি হাঁফ ছেড়ে বেঁচে চোখে, মুখে স্বস্তির ছাপ ফুটিয়ে বলল,,
“তাহলে ঠিক আছে। লাইট টা বন্ধ ই থাকুক। চাইলে আপনি ড্রিম লাইটা টা ও বন্ধ করে দিতে পারেন।”
“না এবার একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। অন্ধকারে আপনি নিশ্চয়ই ভয় পাবেন।”
“তা ঠিক। আচ্ছা আপনি যান৷ আমি ওয়াশরুমে যাবো। শাড়িটা দ্রুত পাল্টাতে হবে।”
ববি মাথা নাঁড়িয়ে আলমারি থেকে একটা শার্ট, প্যান্ট সহ বেডের উপর থেকে একটা বালিশ আর ব্ল্যাঙ্কেট নিয়ে সোজা ব্যালকনীতে চলে গেলো। আর ঠাস করে ব্যালকনীর দরজাটা লাগিয়ে দিলো। পালা ক্রমে সে ব্যালকনীর পাশের জানালার থাইটা ও লাগিয়ে দিলো। জানালার পর্দা ও মেলে দিলো। প্যান্টটা চেইঞ্জ করে গাঁয়ে একটা ব্ল্যাক শার্ট জড়িয়ে নিলো৷ কম্বলটা ফ্লোরে বিছিয়ে ববি বালিশ মাথায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
চোখ বন্ধ করে মৃদ্যু হেসে ববি লিলির কথা ভাবছে। লিলির ভেজা চুল, নেশাক্ত চোখ, মলিন হাসি, শুকনো ঠোঁট, কুঁড়ে ভাব, নরম স্বরে কথা বলা সব ববিবে বড্ড ভাবাচ্ছে। গ্রামের মেয়েদের আত্নসম্মানবোধ বরাবরই বেশি। যা ববি লিলিকে দেখে টের পেলো৷ লিলি যে খুব সহজে ববিকে বিশ্বাস করতে পারছে না তা ববি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তবে ববির মনে হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। এতো সহজে কাউকে বিশ্বাস করা মানে তো বোকার স্বর্গে বাস করা। মন থেকে কারো বিশ্বাস অর্জন করা এতোটা ও সহজ নয়।
কিছু একটা মনে পড়তেই ববি হঠাৎ করে ধরফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখে, মুখে খানিক উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটিয়ে সে বিড়বিড় করে বলল,,
“ইসস লিলি হয়তো সকাল থেকে এই পর্যন্ত কিছু খায় নি। এজন্যই উনাকে দেখতে কেমন শুকনো শুকনো লাগছিলো। কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
হম্বিতম্বি হয়ে লিলি ব্যালকনির দরজাটা খুলে রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল। রুমে লিলিকে দেখতে না পেয়ে ববি স্বস্তির একটা শ্বাস ছেড়ে দৌঁড়ে ডেস্কের দিকটায় চলে এলো। ডেস্কের দু নম্বর ড্রয়ারটা খুলে সে দুটো টাইগার বিস্কিটের প্যাকেট বের করে বেডের এক পাশে প্যাকেট গুলো রেখে মনে মনে বলল,,
“বিস্কিট ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। রান্নাঘরে এই মুহূর্তে আমি যেতে পারব না। আশা করছি এই দুটো বিস্কিকেই লিলির হয়ে যাবে।”
ববি আবার তাড়াহুড়ো করে ব্যালকনীতে চলে এলো। ব্যালকনীর দরজাটা লাগিয়ে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বলল,,
“থ্যাংকস গড। লিলি কিছু টের পায় নি। টের পেলে কি না কি ভাবত গড নৌজ! এবার শুধু উনার ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার অপেক্ষা।”
ব্যালকনীর গ্রীল ধরে ববি অধীর আগ্রহ নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খোলার অপেক্ষা করছে। খানিক ক্ষন বাদে লিলি শাড়ী পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই ববি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে খানিক চেঁচিয়ে লিলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
“বেডের উপর বিস্কিট রাখা আছে লিলি। প্লিজ খেয়ে নিবেন।”
লিলি ভেজা শাড়ি হাতে নিয়ে চোখে, মুখে খানিক আতঙ্ক নিয়ে বেশ চেঁচিয়ে বলল,,
“এই, আপনি আমাকে দেখছেন?”
“এই না। একদম না। আমি আপনাকে দেখছি না। আমি আপনার উল্টো দিকে আছি। দেখুন জানালার থাইটা ও বন্ধ। জানালার পর্দা ও টানা। আপনাকে দেখার কোনো স্কোপ নেই।”
লিলি নিশ্চিন্ত হয়ে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল,,
“ঠিকাছে। কিন্তু আপনি এখনো ঘুমোন নি কেনো?”
“এই তো এখনি ঘুমুবো। কোনো কিছুর দরকার পড়লে আমাকে ডেকে নিবেন প্লিজ।”
“জ্বি, আচ্ছা। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন।”
“আপনি ও।”
বড় একটা হাই তুলে ববি ফ্লোরে শুয়ে পড়ল৷ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মৃদ্যু হাসি ফুটিয়ে সে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে আজ তার ঘুমটা বেশ মজার হবে। উপলক্ষ্যটা তার ঠিক জানা নেই।
লিলি উসখুস করে এক হাতে ভেজা শাড়ি আর অন্য হাতে গাঁয়ে পড়ে থাকা ববির শার্টটাকে পর পর টানছে। শার্টটা তার কাঁধ বেয়ে পড়ে যাচ্ছে। হাত, বডি সব দিক থেকেই ঝুলে আছে শার্টটা। এই মুহূর্তে লিলিকে দেখে মনে হচ্ছে হ্যাঙ্গারে কোনো শার্ট ঝুলে আছে। ববির সুঠাম দেহের সাথে লিলির দেহটা পিঁপড়ে আর হাতির মতোন আকাশ বিস্তর তফাৎ হবে। চোখে, মুখে চরম বিরক্তি নিয়ে লিলি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। শার্ট টা পড়ে সে কোনো দিক থেকেই কমফোর্টেবল ফিল করছে না। কেমন উদোম উদোম লাগছে। তবে শার্টটা থেকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে। যে ঘ্রাণটা লিলির শরীরে কাঁটা দিয়ে তুলছে। লিলি বেশ বুঝতে পারছে এটা ববির শরীরের ঘ্রাণ। এই প্রথম ই সে কোনো ছেলের শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণ নিলো।
মুগ্ধতার সাথে এক রাশ তিক্ততা নিয়ে সে হাতে থাকা নিংড়ানো শাড়িটা প্লাস্টিকের একটা চেয়ারের উপর রাখল। চুলে বাঁধা টাওয়ালটা খুলে সে ছেলেদের লুঙ্গির মতোন কোমড় থেকে পায়ের টাকনু অব্দি তোয়ালে দিয়ে শরীরটা ঢেকে নিলো। তার উপর আবার সিঙ্গেল ব্ল্যাঙ্কেট টা ও আপাদমস্তক জড়িয়ে নিলে। কিছুটা শাড়ির মতোন। নড়তে চড়তে বেশ অসুবিধে হলে ও সে নিশ্চিন্ত। মৃদ্যু হেসে লিলি ভেজা শাড়িটা হাতে নিয়ে সাদা টাইলসে মোড়ানো ফ্লোরে শাড়িটা লম্বা করে ছড়িয়ে দিলো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ববির সব গুলো পারফিউমের কৌটো নিয়ে সে শাড়ির প্রতিটা কিনারে খুঁটি হিসেবে রাখল। পাখার বাতাসে কিছুক্ষনের মধ্যেই শাড়িটা শুকিয়ে যাবে। পুরোটা না শুকোলে ও অর্ধেক অংশ তো শুকিয়েই যাবে।
ভেজা চুল গুলো হাত দিয়ে ঝেঁড়ে লিলি বেডের কর্ণার থেকে ছোট ব্যাগটা হাতে নিলো। ব্যাগটা থেকে তার সমস্ত স্কুল সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন কার্ড এক এক করে বের করল। সব গুলো প্রয়োজনীয় কাগজই বৃষ্টির পানিতে অনেকটা ভিজে গেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে লিলি তাড়াহুড়ো করে বিছানার উপর সব গুলো কাগজ মেলে দিলো। পাখার বাতাসে কাগজ গুলো এদিক সেদিক উড়ে যাচ্ছে। মাথায় একটা দুর্দান্ত বুদ্ধি এঁটে লিলি বেডের উপর থেকে বিস্কিটের প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে প্যাকেট গুলো একটা একটা করে খুলে প্রতিটা বিস্কিট কাগজগুলোর দুপাশে খুঁটি হিসেবে রাখল। খুঁটি পেয়ে কাগজগুলো উড়ে যাওয়ার জোর হারিয়ে ফেলল। মলিন হেসে লিলি হাতে থাকা একটা বিস্কিট মুখে দিতেই মুখে হাত চেঁপে ধরে হু হা করে কেঁদে দিলো। মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ছে তার। সে আদৌ জানে না, তাকে ছাড়া তার মা-বাবা কোন পরিস্থিতিতে আছে, গ্রামের লোকজন আদৌ তার মা-বাবাকে কথা শুনাতে ছেড়েছে কি না, তাদের এক ঘরে করে দিয়েছে কিনা, তার মা-বাবা এখনো পর্যন্ত কিছু খেয়েছে কিনা, তাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছে কিনা, তারা ভালো আছে কিনা, সুস্থ আছে কিনা, কিচ্ছু জানে না লিলি কিচ্ছু না।
মুখ চেঁপে কাঁদতে কাঁদতে লিলি ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। সে এখনো অব্দি জানে না, যে আশা নিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে এই অচেনা শহরে এসেছে সে আশা তার আদৌ ফলবে কিনা, তার চাচা, চাচী তাকে আশ্রয় দিবে কিনা, তার স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করবে কি না, এই শহরই তার অস্তিত্ব রক্ষার শেষ গন্তব্য হবে কি না, তার চোখ ভর্তি স্বপ্ন তার জীবিকা অর্জনের মুখ্য কারণ হবে কিনা! ভবিষ্যতে তার জন্য ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে কিনা তা ও জানে না লিলি। ভবিষ্যতটা এখন তার কাছে পুরোপুরি অন্ধকার। ধোয়াশায় ভরা। মনে হাজারো অসম্ভাবনা, প্রশ্ন, কৌতুহল আর দ্বিধা নিয়ে লিলি কাঁদতে কাঁদতে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিলো। বিস্কিটের আর একটা কণা ও তার পেটে গেলো না। না খেয়েই সে অভুক্ত হয়ে আস্ত একটা দিন, রাত কাটিয়ে দিলো।
চারদিকে ফজরের আযান পড়তেই লিলি হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চোখের শুকনো জল গুলো মুছে সে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো একটা একটা করে খুব সাবধানে ছোট ব্যাগটায় পুড়ে নিলো। ফ্লোর থেকে শাড়িটা উঠিয়ে সে গাঁয়ের শার্ট আর তোয়ালেটা খুলে শাড়িটা গাঁয়ে জড়িয়ে নিলো। ওয়াশরুম থেকে অযু করে বের হয়ে সে বিছানার উপর দাঁড়িয়ে নামায আদায় করে নিলো। নামাযের মোনাজাতে কিছুক্ষন ঢুকড়ে কেঁদে সে নামায শেষ করে প্রায় অনেকক্ষন দো’আ দুরুদ পড়ল। পূর্ব পাশের থাই গ্লাসের দিকে তাকাতেই সূর্য্যের এক ফালি রশ্মি রুমে ঢুকল। সূর্য্যের লাল কিরণটা লিলির চোখে, মুখে আশার আলো দেখাচ্ছে। এক রাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে লিলি তাড়াহুড়ো করে ব্যালকনীর দরজাটা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ছোট আওয়াজে বলল,,
“ববি ভাই শুনছেন? সকাল হয়ে গেছে।”
অনেক বার ডাকার পরে ও ববি কোনো টু শব্দ করল না। সে নাকে টেনে পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে। লিলি গলা উঁচিয়ে ডাকতে ও পারছে না। যদি বাড়ির বাকি সদস্যরা জেগে যায় তাই। পেরেশান হয়ে লিলি উপায় খুঁজছে কি করে ববির ঘুম ভাঙ্গানো যায়। ব্যালকনীর পাশের থাই গ্লাসটা চোখে পড়তেই লিলি তাড়াহুড়ো করে জানালার পর্দা সরিয়ে থাই গ্লাসটা খুলে ব্যালকনীর ফ্লোরের দিকে তাকালো। ববি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হাত, পা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গৌরবর্ণের চেহারাটা বালিশের নিচে চাঁপা পড়ে আছে। ফ্লোরে নাক, মুখ ঠেকিয়ে সে মাথায় বালিশ চাঁপা দিয়ে শুয়ে আছে। কান গুলো বালিশের নিচে চাঁপা পড়ে আছে। এই জন্যই ডাকাডাকির আওয়াজ তার কানে পৌঁছায় নি। লিলি খু্ব উতলা হয়ে প্রায় অনেক বার ডাকাডাকি করে বেশ বিরক্ত হয়ে শেষ বার ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে বলল,,
“ববি ভাই শুনছেছেছেছেন।
শেষ ডাকটা ববির কানে পৌঁছালো। বালিশটা মাথা থেকে সরিয়ে সে পিটপিট চোখে জানালার থাই দিয়ে তাকালো। লিলির নেতিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে ববি হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখ কচলে ববি লিলির দিকে তাকাতেই লিলি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,,
“ভোর তো হয়ে গেছে ববি ভাই। আমাকে এক্ষনি এই বাড়ি ছেড়ে বের হতে হবে।”
ঘুম জড়ানো কন্ঠে ববি লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আপনাকে এতো শুকনো দেখাচ্ছে কেনো লিলি? রাতে ঘুমোন নি আপনি?”
চোখে ভাসা ভাসা জল নিয়ে লিলি বলল,,
“যতোক্ষন না আমি চাচার কাছে যেতে পারব আমার শান্তিতে ঘুম হবে না ববি ভাই। আমি একটা নিরাপদ আশ্রয় চাই।”
ববি বসা থেকে উঠে ব্যালকনীর দরজাটা খুলে লিলির মুখোমুখি দাঁড়ালো। লিলি নাক টেনে কেঁদে বলল,,
“যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে এ বাড়ি থেকে বের করার চেষ্টা করুন প্লিজ। আপনার বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা জাগার আগেই!”
দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ববি দেখল সকাল ছয়টা বাজছে। সামনের এলোমেলো চুল গুলো পেছনের দিকে ঠেলে ববি লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,,
“একটু দাঁড়ান আপনি। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
ববি ওয়াশরুমে চলে গেলো। লিলি ছোট্ট ব্যাগটা বুকে আঁকড়ে ধরে রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ববি ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে লিলির দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,,
“চলুন। আপনার নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেই।”
লিলি গলা ধরা স্বরে ববির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,,
“আপনার এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না ভাইয়া। আমি ভাগ্যবতী বলেই আপনার মতো একজন ভালো মানুষকে এই বিপদের সময় পাশে পেয়েছি। আপনি এই শহরের সব্বার থেকে আলাদা। খুব ভালো মনের মানুষ আপনি। একটা একা মেয়ে আপনার সাথে এক ঘরে রাত কাটিয়েছে অথচ আপনি তার ক্ষতি না করে উল্টে তাকে নিরাপদে রেখেছেন, তার খেয়াল রেখেছেন। আমি আপনার এই ঋণ আজীবন মনে রাখব ববি ভাই।”
ববি ম্লান হেসে বলল,,
“মানুষ মানুষের জন্যে লিলি। আমি মনে করি, এই প্রবাদটা যদি পৃথিবীর প্রতেকটা মানুষ তার মনে ধারণ করে তাহলে হয়তো একজন মানুষ কখনো আরেকজন মানুষের বিপদে নিজের গাঁ বাঁচাতে চাইবে না বা সেই মানুষটার দুর্বলতার সুযোগ নিবে না৷”
ববি অল্প সময় থেমে আবার বলল,,
“এবার চলুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
দরজার খিলটা খুব সাবধানে খুলে ববি লিলিকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলো। রাতের আঁধারে লিলি বাড়িটাকে ঠিক ভাবে দেখতে পারে নি। তাই এইবার সে ভালো করে চোখ বুলিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো। ববিদের এই বাড়িটা লিলির কাছে মান্ধাতার আমলের রাজা বাদশাদের বিরাট সামাজ্র বলে মনে হচ্ছে। প্রাচীনতার ছাপ আছে বাড়িটাতে। বাড়ির প্রতিটা বিল্ডিংয়ে কেমন শেওলা ধরে আছে। কিছু কিছু জায়গা আবার খোদাই করা। সম্পূর্ণ বাড়িটা এল সিস্টেমের। দু তলা বিশিষ্ট বিশাল এক ভবন। এক তলা, দু তলা সমানভাবে গড়া। রুমের চেয়ে ও বারান্দা গুলো ইয়া বড় বড়। বারান্দার চারিদিকে রকমারি ফুলের টব। প্রতিটা টবে বিভিন্ন ধরনের ফুল ফুটে আছে। বাড়ির আঙ্গিনায় বিশাল এক দোলনা। পাশেই আবার বড় বড় আম গাছ, জাম গাছ, পেয়ারা গাছ, কাঁঠাল গাছ, নারকেল গাছ, সুপারি গাছ। পুরো বাড়িটা বিশাল বিশাল গাছের ছএছায়ায় আছে। আলাদা করে আবার বাড়ির এক কোণায় সবজির বাগান ও আছে। দূর থেকে লাউ গাছ, সিম গাছ, চিচিঙ্গা আর বেগুন গাছ গুলো ও দেখা যাচ্ছে। এতো বাড়ি আর বিশাল আঙ্গিনার রাজকীয়তা দেখে লিলি ঠিক বুঝে গেছে ববি খুব ধনী পরিবারের ছেলে!
দুজনই খুব দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির পেছনের গেইট দিয়ে রাস্তায় চলে এলো। ববি জানে তার পরিবারের মানুষরা এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠে না। একেক জন সাতটা, আটটা, নয়টা বাজে উঠে। তাই লিলিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার মনে কোনো ভয় বা উৎকন্ঠা কাজ করে নি।
মেইন রাস্তায় আসতেই ববি পিছু ফিরে লিলির দিকে তাকালো৷ লিলি খুব আশ্চর্যিত চোখে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আপনাদের এতো বড় বাড়ি?”
ববি ভ্রু উঁচিয়ে বলল,,
“কেনো? অবাক হচ্ছে?”
লিলি মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। ববি ফিক করে হেসে বলল,,
“চেয়ারম্যানের বাড়ি। বড় তো হবেই।”
“চেয়ারম্যানের বাড়ি তো রাস্তার বিপরীত পাশে।”
“চেয়ারম্যানের দু দুটো বাড়ি। বুঝলে?”
“আপনি চেয়ারম্যানের কি হন?”
“ভাগ্নে। চলো এবার।”
“চলুন।”
রাস্তাঘাট পুরো ফাঁকা। লোকজনদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। শুধু কয়েকটা বড় গাড়ি কিছুক্ষন পর পর শোঁ শোঁ বেগে রাস্তা দিয়ে পাড় হয়ে হচ্ছে। ফুটপাতের মুদি দোকান গুলো ও বন্ধ। শুধু একটা হোটেল দোকান খোলা আছে। কয়েকজন লোক সমবেত হয়ে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁচের গ্লাসে করে চা খাচ্ছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনারা কোনো কল, কারখানার শ্রমিক হবেন। রাস্তার চারিপাশে শুধু কাঁদা আর পানি। গতকাল রাতের বৃষ্টিটা পুরো শহরকে প্যাঁকপ্যাঁকে করে গেছে। চতুর্পাশে কেবল স্যাঁতস্যাঁতে মাটির গন্ধ। বৃষ্টির স্নিগ্ধ আমেজ পেয়ে শহরের লোকরা নাক টেনে ঘুমুচ্ছে। ঘুম ভেঙ্গে যেনো উঠতেই চাইছে না। আজ অবশ্য ছুটির দিন ও আছে। পুরো সপ্তাহ ঘুড়ে শুক্রবারের দিনটাতেই শহরের লোকরা বেশ আয়েশ করে ঘুমায়। এছাড়া আর স্বস্তি, বিশ্রাম নেই তাদের।
ফুটপাত ঘেঁষে বৃদ্ধ বয়সী লোকরা জগিং স্যুট আর কেটস পড়ে জোরে জোরে জগিং করছে। অনেকে আবার রিলেক্স মোডে হেঁটে হেঁটে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। পূব দিকে সূর্য বেশ বিশালতা নিয়েই আকাশে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছে। মনে হচ্ছে আজ আর বৃষ্টি, বাদল হবে না৷ সূর্য কিছুতেই আজ বৃষ্টির আড়ালে নিজেকে ঢাকবে না। একদম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে আছে সে। সূর্যের আলোতে ফুটপাতে জমে থাকা কাঁদা আর পানি গুলো মুক্তোর মতোন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। দেখতে অবশ্য ভালোই লাগছে।
ফুটপাত ধরে আনমনে হেঁটে চলছে ববি এবং লিলি। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। দুজনের মধ্যেই ব্যাপক মৌণতা। একটা বাড়ি পাড় করে সামনের বাড়িটাই স্বপ্নছায়া মন্জ্ঞিল। লিলি খুব হাঁসতে হাঁসতে ববির আগেই স্বপ্নছায়া মন্জ্ঞিলের গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো। ববির দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে সে গেইটের দরজায় টোকা মারতেই গেইট খুলে কেউ বের হয়ে এলো। চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটাকে দেখেই লিলি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে বলল,,
“চাচাচাচা।”
#চলবে?