#প্রেমোত্তাপ #মম_সাহা [৯]

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

[৯]

আজ শুক্রবার। নুরুল সওদাগরের জন্মদিন উপলক্ষে আজ বাড়িতে কিছুটা খুশির আমেজ। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন চলছে। সেটা অবশ্যই রান্নাবান্নার দিক দিয়ে। আর আশ্চর্য রকম ভাবে আজ চিত্রারও জন্মদিন। বাবা-মেয়ের একই দিনে জন্মদিন। রান্নাঘরে ব্যস্ত সকল রমনীগণ। উপর থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্র সংগীত। খুব সম্ভবত তুহিনের রুম থেকে গানটা বাজানো হচ্ছে। ছেলেটা বেশ গান প্রিয়। ধীর আওয়াজে রবীন্দ্র সংগীত শুনবে সবসময়। কোনো ক্লান্তি নেই। সময়টা আজ খুব বেশি না। মাত্রই সাতটা বাজে। মৃন্ময়দের, বাহারদের, চিত্রার ফুপুর পরিবারকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে বিধায় রান্নাবান্নার আজ চাপটা বেশি। বাড়ির এই তিন নারী বাদে সবাই ই মোটামুটি ঘুমে। ছুটির দিনে সবাই একটু বেলা করে উঠতেই পছন্দ করে।

মৃন্ময় সকালেই উঠে গোসল সেরে নিয়েছে। শুভ্র রঙের একটা পাঞ্জাবি শরীরে চাপিয়ে বাহিরের বের হয়ে এলো। এই সময় রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকে। হাঁটতে বেশ দারুণ লাগে। আর শুক্রবারে তুহিনের সবচেয়ে পছন্দের কাজই হলো সকাল বেলা হাঁটতে বের হওয়া।

বিল্ডিং পেরিয়ে রাস্তায় নামতেই বনফুলের হাসি হাসি মুখটা চোখে পড়লো সাথে নোঙরও আছে। তুহিন ক্ষীণ হেসে ভ্রু কুঁচকালো। কোমল কণ্ঠে বললো,
“বনফুল যে! এখানে কী?”

মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো, “তোমার সাথে হাঁটতে যাবো। নিবে?”

তুহিন হাসলো। মেয়েটা কেবল আজ না, প্রায় সবসময়ই এই বায়না টা করে। তবে আজ ভিন্নতা আছে। আজ মেয়েটার হাসির বিস্তৃতি বেশি। চঞ্চলতা বেশি। সাথে আবার আরেকজন মেয়েও আছে। খুব বেশি ভুল না হলে এটা বাহার ভাই এর সেই বান্ধবী যাকে নিয়ে বাড়িতে টুকটাক কথা শুনেছিল।

তুহিনকে চুপ থাকতে দেখে বনফুল আবার বললো,
“নিবে না আমায়?”

“নিবো না কেন! চলো।”

বনফুল ঘাড় কাত করলো। নোঙর এর হাতটা শক্ত-পোক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করলো বনফুল। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ অতিক্রম হওয়ার পর বনফুল তুহিনকে বলে উঠলো,

“তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই চলো, এটা নোঙর আপু, আমাদের অতিথি। আর নোঙর আপু এটা চিতাবাঘের বড়ো ভাই, তুহিন।”

নোঙর বিনীত কণ্ঠে বললো, “আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”

তুহিনও সুন্দর করে সালামের জবাব দিলো। আবারও হাঁটতে শুরু করলো। নোঙর এবার প্রায় ফিসফিস করেই বনফুলকে বললো,
“আচ্ছা বনফুল, একটা কথা বলো তো?”

বনফুল প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কী আপু?”

“তুহিন ভাইয়া চিতাবাঘের ভাইয়া, কিন্তু তোমার কী বলো তো?”

বনফুল থেমে গেলো। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো নোঙরের দিকে। খানিকটা লজ্জাও পেলো৷ আমতা-আমতা করে বললো,
“কি, কি বলছো?”

“না না, কিছু বলি নি। আমরা তো কিছু বুঝিই না।”

বনফুল লজ্জায় লাল হয়ে গেলো আর নোঙর তা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতির মাঝে প্রেম অন্যতম বোধহয়।

_

দুপুর হতেই জমজমাট আয়োজন চলছে। টেবিল জুড়ে সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে ভরে গেছে চারপাশ। অথচ চিত্রা শাড়ি পরে পড়ার টেবিলে বসে আছে। কারণ আজকের দিনেও বাহার ভাই নামক লোকটা তাকে পড়াতে এসেছে। কী অদ্ভুত! চিত্রা পা দুলাতে দুলাতে বাহার ভাই এর দিকে তাকালো। কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো,
“বাহার ভাই, মা বলেছে আজ আমার সাথে ভাত খেতে।”
চিত্রার কথায় ভ্রু কুঁচকালো বাহার৷ চিত্রার রুম থেকে যেতে নিয়েও ফিরে তাকালো, বেশ কিছুটা অবাক হয়েই বললো,
“কেন? তোমার সাথে ভাত খাবো কেন? আমাদের বাড়িতে কী ভাতের টান পড়েছে?”

“কারণ আজ চিত্রার জন্মদিন। আর চিত্রা চায় বাহার ভাই তার পাশে বসুক, একসাথে খাবার খাক।”

বাহারকে কথাটা বলার পরও বিশেষ হেলদোল দেখা গেলো না লোকটার ভেতর। বরং সে বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই উত্তর দিলো,
“না, পারবো না খেতে। আমার জন্য আমার আম্মু হয়তো ভাত নিয়ে বসে আছেন। তুমি খেয়ে নেও। আমার আরেকটা টিউশনিও আছে এখন।”
“আজ আমার জন্মদিন, বাহার ভাই। অন্তত আজকের দিনটা তো আমার কথা রাখতেই পারেন!”
“ধনীর দুলালি বলে আজ জন্মদিন তোমার কাছে যতটা জাঁকজমকপূর্ণ মনে হচ্ছে, আমার কাছে ঠিক ততটাই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে৷ পড়াটা পড়ে রেখো।”

চিত্রা কিছু বলার আগেই লোকটা গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো। এক রাশ হতাশা আর মন খারাপ নিয়ে টেবিলেই মাথাটা নামিয়ে নিলো সে। তার বুকে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সে অভ্যস্ত এসবে। সে জানে বাহার ভাই এমন, আর তার এই এমন বাহার ভাই এর প্রতিই এক আকাশ সমান টান।

_

ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীর টা নিয়ে যেই না বাহার খাবার টেবিলে বসেছে, ঠিক সে মুহূর্তে কোথা থেকে ছুটে এসে ধপ করে তার সামনের চেয়ারে বসে পড়লো গোল গাল, ফর্সা মিষ্টি চেহারার চিত্রা। আরামে বসে পা নাড়াতে নাড়াতে রান্নাঘরের ভেতরে থাকা বাহারের মায়ের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
“ চাচী, খাবারও দেও, আমি এসেছি।”

রান্নাঘর থেকে তৎক্ষনাৎ ডালের বড়ার প্লেটটা নিয়ে বেরিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখলো বাহারের মা আয়েশা খাতুন। অবাক কণ্ঠে বললো,
“কিরে, আজ না তোর জন্মদিন? তোদের বাড়িতে দেখলাম ভালো মন্দ রান্না হলো। বনফুলও তো তোদের বাড়িতে। আর তুই কিনা এখানে এসেছিস ডাল-ভাত খেতে!”

“আমি যদি না আসি তবে তোমার ডালের বড়াটা কে খাবে শুনি? আমার পছন্দ বলেই তো বানিয়েছ। দেও দেখি তাড়াতাড়ি, আমার খিদে পেয়েছে তো।”

আয়েশা খাতুন বেশ যত্নের সাথে দু’জনকে ভাত বেড়ে দিলেন। তারপর আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন ডিম ভাজতে। চিত্রার ডিম ভাজাও বেশ প্রিয়। বাহার ততক্ষণে ভাত মাখিয়ে মুখে নিয়েছে। চিত্রা ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
“আমাকে এক লোকমা খাইয়ে দেন না।”
“কেন! তোমার প্লেটে নাই খাবার?”

বাহারের সন্দিহান দৃষ্টি চিত্রার দিকে। চিত্রা মন খারাপ করে বললো,
“একটু খাইয়ে দিলে কী হয়?”
“আমার হাত খসে পড়ে যাবে। হয়েছে শান্তি? এবার নিজে খাও।”
“আপনার মতন মানুষ আমি বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠিতে দেখি নি।”
“দেখবে কীভাবে? তোমার বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠিতে সব গুলো একেকটা অকাজের মানুষজন।”
“একদম খারাপ কথা বলবেন না ওদের নিয়ে। খান আপনার খাবার আপনি। আজ আপনার সাথে খাবো বলে নিজের বাসা থেকে লুকিয়ে এসেছি আপনার বাসায়। নিজের মনের ইচ্ছে নিজে পূরণ করি আমি। আর আপনি কিনা এত পাষাণ! আল্লাহ্ ভুল করে আপনাকে মনের জায়গায় ইট বোধহয় দিয়ে দিছে।”
“আর তোমাকে ব্রেইনের জায়গায় গোবর।”

বাহারের খোঁচা মারা কথায় চুপ হয়ে গেলো চিত্রা। সে সত্যি সত্যিই আর খাবার গুলো ছুঁয়ে দেখলো না। খাবার প্লেট সামনে নিয়ে বসে রইলো থম মেরে। চোখে অশ্রু টলমল করছে। বাহারের খাবারও প্রায় শেষদিকে। পাষাণ লোকটার এমন কাঠিন্যতা মেনে নিতে না পেরে যেই না চিত্রা উঠতে নিবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ভেসে এলো মানুষটার গম্ভীর কণ্ঠ,
“খাবার ফেলে রেখে কোথায় যাচ্ছো? এগুলো আমার ঘুষের টাকার খাবার না, কষ্টের টাকায় রোজগার করা। চুপচাপ খাও।”

বিশাল মন খারাপের স্তূপ জমা হলো চিত্রার মনে। মাথা নিচু করলো সে। অশ্রু লুকানোর বৃথা চেষ্টা করলো, অথচ ভাতের পাতে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। বাহার ভাই আজও তার অভিমান বুঝলো না! কথাটা ভাবতেই কান্না ঠেলে আসলো চিত্রার। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার মুখের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে দিলো কেউ। চিত্রা অবাক চোখে তাকাতেই দেখলো বাহার ভাই কপাল কুঁচকে ভাত ধরে আছে তার মুখের সামনে। প্লেটের শেষ লোকমাটা।

চিত্রাকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাহার গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“নেও মুখে। খাবার পাতে কেউ কাঁদুক, তা আমার পছন্দ না।”
“এ্যাহ্, এতক্ষণে আসছে খাওয়াতে।”
“হা করবে নাকি আমি উঠে যাবো?”

চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে হা করলো। লোকটা অনভিজ্ঞ হাতে ভাত দিলো চিত্রার মুখে। কিছুটা খাবার লেপ্টে গেলো মেয়েটার ঠোঁট জুড়ে। খিলখিল করে হেসে উঠলো চিত্রা। তা দেখে বাহার গা-ছাড়া ভাবে বললো,
“অত খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমার পেট ভরে গিয়েছিল বলে দিয়েছি তোমায়।”

চিত্রা কথার বিপরীতে মুখ ভেংচি দিয়ে নিজের প্লেট থেকে খাবার খাওয়া শুরু করলো। বাহার হাত ধুতে গিয়ে মাকে আরেকটু তাগাদা দিলো জলদি করে ডিম ভেজে দেওয়ার জন্য। মেয়েটা ডিম ছাড়া খেতে পারে না। হাত মুছতে মুছতে যেই না বাহার নিজের ঘরে যাবে, ঠিক তখনই পেছন থেকে চিত্রার ডাক ভেসে এলো,
“বাহার ভাই।”
“কী?”
“আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি।”

বাহার হাসলো, ঠাট্টা করে বললো, “এ বয়সে যেটাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসা মনে হয়, প্রাপ্ত বয়সে সেটা কেবল পাগলামো মনে হবে।”
“তাহলে আপনি অপেক্ষা করুন, প্রাপ্ত বয়সেও যে আমি আপনাকে ভালোবাসবো, তা নাহয় দেখিয়ে দিবো।”
“নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তোমার বড্ড ঝোঁক, রঙ্গনা।”
“তাতে কী?”
বাহার স্মিত হেসে উত্তর দিলো, “জ্বলে যাবে রঙ্গনা”।
“আগুন যদি আপনি হন, আমি নির্দ্বিধায় পুড়তে রাজি।”

বাহার হাসলো, গুনগুন করে বললো,
“ভুল করেও ভুলকে নিও না বেছে,
খালি হাতে ফিরতে হবে দিনশেষে।”

_

চিত্রাদের ফ্লাটে যেন একটা আনন্দ উৎসব লেগে গেলো। পুরো ফ্লাট জুড়ে অতিথিদের মেলা। চিত্রা বাহারদের বাড়িতে খেয়ে আবার ছুটে এসেছে নিজের বাড়ি। সময়টা ঠিক বিকেল। আকাশ কমলা রাঙা রঙ জড়িয়ে আছে নিজের বক্ষ মাঝে। মৃন্ময়দের পরিবারের সকলে এসেছে কেবল শাহাদাৎ আর তার বউ বাদে কারণ তারা হানিমুনে গিয়েছে। অহি, চাঁদনী, চিত্রা, বনফুল, নোঙর, মৃন্ময় সহ বাকি বড়ো সদস্যরা ড্রয়িং রুম জুড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। চিত্রা বনফুলকে ঠাট্টা করে একেকটা কথা বলছে আর মেয়েটা লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছে। তন্মধ্যেই বাড়ির সবচেয়ে ভদ্র, ঠান্ডা ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একদম সোজা হয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ ঝলমলে হেসে বললো,
“আব্বু, বড়ো আব্বু আজকে আপনাদের একজনের সাথে পরিচয় করাবো যদি আপনারা অনুমতি দেন৷”

নুরুল সওদাগর ও তার বড়ো ভাই আফজাল সওদাগর তুহিনের দিকে চাইলো। আপাতত সে মধ্যমনি হয়ে গেছে। আফজাল সওদাগর হেসে বললেন,
“হ্যাঁ করাও পরিচিত। কে সে?”

সকলের কৌতুহল দৃষ্টি যখন তুহিনের দিকে তখনই দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। তুহিন মুচকি হেসে দরজা খুলতেই একটা অসম্ভব সুন্দর রকমের মেয়ে চোখে পড়লো সবার। তুহিন মেয়েটার হাত ধরে ভেতরে এসে হাসি প্রসস্থ করে বললো,
“ও নীরু, তোমাদের ছেলের প্রিয় মানুষ। তোমাদের বংশের হবু বউ।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here