প্রেমময়_বসন্তের_আগমন #পর্বঃ৪ #বর্ষা

#প্রেমময়_বসন্তের_আগমন
#পর্বঃ৪
#বর্ষা

জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ওয়াজিহার।রাতে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফেরার পর দেখতে পায় বাড়িতে কেউই নেই। এমনকি তার বারান্দায় দরজাটাও ভেতর দিয়ে আটকানো।দারোয়ান চাচা গেটে বসে বিড়ি টানছেন আর এদিক ওদিক দেখছেন।বড় সাহেবের ভয়েই হয়তো। কিছুক্ষণের মাঝেই ঝুম বৃষ্টি নামে।ভিজতে থাকে সে। হঠাৎ মাথাটা যখন আবারো ব্যথা করা শুরু হয় ,সে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না।বৃষ্টির মাঝেই নিজ বারান্দায় যাওয়ার আম গাছটার নিচে কাঁদার মাঝে বসে পড়ে।বৃষ্টি কিছুটা কমে আসতেই গাছ ধরে উঠে দাঁড়ায় সে। কাঁধের ব্যাগ ভিজে চুপচুপে।গাছও পিচ্ছিল।পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকা সত্ত্বেও বারান্দায় যাওয়ার জন্য রিস্ক নিলো সে।পড়তে পড়তে কোনো মতে বারান্দায় পৌঁছালো।দরজা বাইরে থেকে এক ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ওয়াজিহা ভাবতে লাগলো তবে কেন তার মনে হলো যে দরজা ভেতর থেকে লাগানো।আর যদি ভেতর থেকে লাগানো নাই থাকে তবে বৃষ্টিতে তো দরজা খুলে চারপাশ ভিজে যাওয়ার কথা। ওয়াজিহার সন্দেহ হয় কেউ আছে।তবে তা প্রকাশ না করেই ওয়াশরুমে চলে যায় সে।তার পূর্বে দরজার লকের দিকে তাকিয়ে দেখে। দরজাটা এখনো নড়ছে হালকা।এর মানে…!আর ভাবে না ওয়াশরুমে চলে যায়।

গোসল করে চুলগুলো হেয়ার ড্রায়ারে শুকিয়ে নিচে নামে ওয়াজিহা।তবে তার পূর্বে দরজা লক করে আসে।চাবিটা হুডির পকেটে রেখে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দেখে নেয়। রান্নাঘরে যেতেই চমকে ওঠে সে।কেউ যে বাসায় আছে তার প্রামাণ্য হলো চুলার গরম করা তরকারি। ওয়াজিহা চুলো বন্ধ করে তরকারি নামিয়ে একপাশে রেখে দেয়।ফ্রিজ থেকে সবজি,ডিম এনে রাখে।সবজি ভালোমতো ধুয়ে কেটে নেয়।আর চাউল আর ডাল ধুয়ে কাটা তরকারিগুলোর সাথে মিশিয়ে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে চুলোয় বসিয়ে দেয়।রান্না বসিয়ে ফোন হাতে চুলের থেকে একটু দূরে বসে পড়ে সে। এলার্ম সেট করে ফেসবুকে ঢোকে।ঠিক এলার্ম বাজার সাথে সাথেই চুলো বন্ধ করে দেয় সে।প্রায়ই একই খাবার রাখতে রাখতে সময়জ্ঞান তার হয়ে গেছে।

ডিম ভাজা আর খিচুড়ি নিয়ে রান্না ঘরে বসেই খেতে শুরু করে সে। হঠাৎ লোডশেডিং হয়। সাধারণত লোডশেডিং দেখা যায় না এই এরিয়ায়। ওয়াজিহা জাস্ট একটু হাসে। অনুভূত করে ওর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে। হঠাৎ কেউ ওর চোখ দুটো ধরে ফেলে। ওয়াজিহা বলে,

”দেরি করে ফেললেন যে বারোটা বেজে দু’মিনিট এখন!”

”আমি তো আগেই এসেছিলাম।তবে কে জানতো আপনি কলিংবেল না বাজিয়ে বাইরে বৃষ্টিতে ভিজছেন!আমি যদি বারান্দায় না যেতাম তবে তো আপনার কথা জানতেই পারতাম না!”

”আমার কমনসেন্স বলেছে যে ফাঁকা বাসায় দরজা খোলার জন্য কেউ বসে নেই।”

পুরুষটা মাথা চুলকায়।তার তো মনেই ছিল না সহজ এই কথাটা। ওয়াজিহার চোখ ছেড়ে দিয়েছে লোকটা।সামনে এসে ওয়াজিহার সামনের চেয়ারটায় বসেছে সে। ওয়াজিহা মুচকি হেসে খিচুড়ি খাইয়ে দিতে নেয় তাকে।সেও চুপটি করে খেয়ে নেয়।তারপর নিজেও ওয়াজিহাকে খাইয়ে দেয় ওয়াজিহা।তারপর ওয়াজিহার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,

”বড্ড বেশী ভালোবাসি লাবণ্যময়ী ”

ওয়াজিহা হাসে। খিলখিলিয়ে হাসে।বছরে এই একটা দিনই যে সে হাসে।রাত বারোটা পেরিয়েছে মানে আজ ১৭ ই ডিসেম্বরে পা রেখেছে।১৬ ই ডিসেম্বরে ভার্সিটিতে আয়োজন ছিল বিশাল তবে ওয়াজিহা থাকেনি।এমনকি ওর বন্ধুরা ওকে আটকায়নি থাকতে।তাইতো অভিমানী কন্যা পার্কে বসেছিলো।আজ ওয়াজিহার জন্মদিন অর্থাৎ বিশেষ দিন। পিতা-মাতার হয়তো এই দিনটা মনে নেই তবে তার প্রিয় মানুষটা এই বছর দুয়েক ধরে তাকে সারপ্রাইজ দিতে চলে আসে। অবশ্য সকলের অগোচরে।আর সেদিনটা সবাই কেন জানি বাড়ির বাইরেই কাটায়। অবশ্য গত দুই বছর ধরেই এমন হচ্ছে।শুনেছিলো বড় সাহেবের বন্ধুর মেয়ের জন্মদিন উদযাপনের লক্ষ্যেই তাদের যাওয়া।

”তাসকিন আপনিও কি সবার মতো আমাকে ভুল বুঝে হারিয়ে যাবে?”

”তোমাকে ভুল বোঝা আদৌ সম্ভব কিনা জানিনা কেননা যেই মেয়ে আপনি তুমি একত্রে বলতে পারে তার হৃদয়ে অনন্ত ছলনার মতো কিছু থাকতে পারে না!”

ওয়াজিহা নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে।এই ভুলটা সে এখনো সুধরাতে পারেনি।তার ডাক্তার সাহেবের সামনে গেলে প্রায়ই সে গুলিয়ে যায় একান্তে। হঠাৎ করেই তাসকিন একটা রিং হাতে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।

”উইল ইউ বি মাই ওয়াইফ?”

ওয়াজিহাও হাঁটু গেড়ে বসে।জড়িয়ে ধরে তাসকিনের হাত দুটো।গালে চুম্বন করে।দুজনের মাথাই একত্রে আনে।তাসকিন বলে উঠে,

”চলো আজ বিয়ে করে নেই!হলো তো দুই বছর।এখনো কি তুমি তোমার অনুভূতির সাথে পরিচিত না?”

”বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে!”

”লাবণ্যময়ী…”

তাসকিন কিছুক্ষণ থেমেই চিল্লিয়ে বলে উঠে যে লাবণ্যময়ী তুমি রাজি ভাবতেই আমার ভালো লাগছে।আমার লাবণ্যময়ী আমার হতে রাজি।আজই আমরা বিয়ে করবো চলো।বৃষ্টি আর কিভাবে রুখবে আমাদের! তাসকিনের কথায় মুচকি হাসিটা গাঢ় হয় ওয়াজিহার মুখে। ওয়াজিহার চোখগুলোও যেন হাসছে ওর সাথে।

বছর দুই পূর্বে ওদের দেখাটা ছিল কল্পনাময়।তাসকিন ওর বন্ধুর বোনের সাথে রুড বিহেভিয়ার করা মানুষগুলোকে শায়েস্তা করতেই কলেজে এসেছিলো সেদিন।ধাক্কা খেয়েছিলো ওয়াজিহার সাথে।ওয়াজিহা মুখ শক্ত করে কথা শুনিয়ে ছিল সেদিন তাসকিনকে।তাসকিনও কম যায়নি সেও শুনিয়েছিলো অনেক কথা।তারপর প্রায়ই তাসকিনকে কলেজে দেখা যেতো।কথা কাটাকাটি হতো দুজনের অযৌক্তিক কারণে।তারপরই ধীরে ধীরে উভয় দিকেই ভালোবাসার ফুল ফুটলো।তাসকিনকে ওয়াজিহা শর্ত জুড়ে দিলো যদি সে ওয়াজিহাকে অনুভব করাতে পারে তার ভালোবাসা তবেই সে তাসকিনকে বিয়ে করবে, ভালোবাসবে।

তাসকিন ঘন্টা দুয়েক থেকে পেছনের গেট দিয়ে চলে যায়। ওয়াজিহা প্লেট ক্লিন করে উপরের রুমে চলে যায়।যাওয়ার সময় দেখতে পায় রাহমির রুমের দরজা খোলা।ভেতরে প্রবেশ করেই আঁতকে ওঠে।অর্ধবস্ত্রহীন রাহমি কারো সাথে ভিডিও চ্যাটে মত্ত। ওয়াজিহা ঠাঁটিয়ে চড় মারতেই হুঁশে ফিরে রাহমি‌।ভীত চেহারা কিঞ্চিত সময়েই প্রফুল্লতায় ভরে ওঠে। ওয়াজিহাকে ধাক্কা মেরে বলে,

”তোর সাহস কি করে হলো আমার রুমে আসার?আমার মারার?কে দিলো তোকে সেই অনুমতি?বেরিয়ে যা আমার রুম থেকে!”

”এক চড় কম ছিলো তোর জন্য?কি করছিস তুই এগুলো? তুই না বাইরে পর্দা করে বের হোস!আর সেই তুই নগ্ন হয়ে ছিঃ..”

”আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করবো তোর কি?বের হো আমার রুম থেকে ”

”নিজের পরিবারের মান-সম্মান তো রক্ষা করতে পারবি না। অন্তত পক্ষে পর্দা করাটা ছেড়ে দে।নয়তো তোর এই অশ্লীলতার খেলায় পর্দাকে অপমান করিস না।ভালো হয়ে যা”

”নিজে তো পর্দা করিস না।আর এসেছিস আমাকে জ্ঞান দিতে.. হাহ ”

”আমি পর্দা না করলেও তোর মতো অশ্লীলতার খেলায় মত্ত না!”

বেরিয়ে আসে ওয়াজিহা।বড় ম্যাডামকে ফোন দেয়। নিজের চাচু,চাচী সে এই নামেই ডাকে।তার অধিকার নেই তাদের বড় মা,বড় বাবা বলে ডাকার। ওয়াজিহার কল কেটে দেন তিনি‌। ওয়াজিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজ রুমে চলে আসে।

সকালে ডাইনিং টেবিলে যেতেই ওয়াজিহার বড় চাচ্চু ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

”কাল কে বাসায় এসেছিলো ওয়াজিহা?”

ওয়াজিহা একবার চাচুর দিকে তাকিয়ে রাহমির দিকে তাকায়।নির্লজ্জের মতো মেয়েটা ওয়াজিহার নামে আবারো পরিবারে লাগিয়েছে। ওয়াজিহা সবার দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বলে,

” আমার উডবি এসেছিলো।”

ওয়াজিহার হাসি আর ওর কথাটা যেন পরিবারে হঠাৎ বজ্রপাতের মতো ছিলো। ওয়াজিহা নিশ্চিন্তে খেতে খেতে ফোন লাগায় তাসকিনকে।এতোদিন সে কাউকেই কিছু জানায়নি কেননা কেউ জানতে চায়নি। ওয়াজিহার নামমাত্রিক পিতা রুকন খান চেঁচিয়ে ওঠে বলে,

”বেয়াদব মেয়ে তোমাকে কি আমরা কোনো শিক্ষাই দেয়নি? নিজের বিয়ে নিজেই ঠিক করে ফেলেছো!”

ওয়াজিহার নামমাত্রিক মাতা মোহনা জুবায়ের খ্যাচখ্যাচে মেজাজে বলেন,

”আমার নাক ডোবাতে এই মেয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।দেখো গিয়ে কোনো মাতাল খোরকে নিজের উডবি বলছে!”

ওয়াজিহা শোনে। মুচকি মুচকি হাসে। ওয়াজিহার চাচাতো বড় ভাই তায়েফ ধমকের সুরে বলে,

”ওয়াজিহা তুমি হাসছো কেন?কথা বলো”

”কি শুনতে চান আপনারা?আর মিষ্টার রুকন খান আপনাদের শিক্ষায় আমি বড় হয়নি।আমি বড় হয়েছি নিজের মতো নিজের ভালোবাসায় নিজের নিয়মে‌‌। আপনারা জাস্ট আমার ওপর ইনভেস্টমেন্ট করেছেন‌‌।যার প্রতিদানে আমি আপনাদের গোল্ড মেডেল পর্যন্ত এনে দিয়েছি! মিসেস মোহনা রুকন খান আমার সামনে আমার উডবিকে নিয়ে কোনো বাজে কথা আমি সহ্য করবো না,এমনকি আমার পেছনেও না!সো কি বলছেন ভেবে বলবেন!”

ওয়াজিহা খাবার টেবিল থেকে উঠে যায়।রুকন খানের বড় ভাই রাকেশ খান ধমক দেন সবাইকে। চুপচাপ খেতে বলেন এবং রুকন খান এবং মোহনা জুবায়েরকে বলেন ওয়াজিহাকে সময় দিতে।আগলে রাখতে।মেয়েটা দূরে সরে গেছে পরিবার থেকে।এর সুযোগ হয়তো প্রতিপক্ষ নেবে।

ওয়াজিহা ঘরে এসে উপলব্ধি করে এখনো জ্বরটা যায়নি। তাসকিন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরপরই গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিলো তার।ঔষধ খেয়ে কম্বল মুড়ে ঘুমিয়ে ছিলো।বৃষ্টির মৌসুম না হওয়ার পরও বৃষ্টির এতোটা প্রাদুর্ভাব সাক্ষী ইহা ঠান্ডা বাড়ানোর জন্য প্রাদুর্ভীত!

চলবে?

পূর্ববর্তী পর্বঃ
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/926136399108133/?mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here