#প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-১৫
#ফাবিহা_নওশীন
||
ফালাক টেবিলের উপর কনুই ভর দিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। রুহানি পানি খাচ্ছে। হটাৎই মনে হচ্ছিল শ্বাস আঁটকে মরে যাবে। পানি খেয়ে একটু ভালো লাগছে। রুহানি টেবিলের উপর গ্লাস রেখে ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক সোজা হয়ে বসল।
“সেদিনের পর থেকে আমার উপর ওর ভীষণ ক্ষোভ। এতদিন শুধু সুযোগ খুঁজেছে আর এই ট্যুরে এসে সে সুযোগ পেয়েও গেছে। জানি না এখন ও কি করবে। যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে বুঝতে পারছি না।”
রুহানির খুব টেনশন হচ্ছে। বাবা-মার কানে যদি যায় মাতাল হয়ে সারারাত একটা ছেলের সাথে ছিল তবে কি হবে। রুহানি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। তবে তায়েফ যদি সত্যিই কিছু করে তবে ওর মার্ডার করে দিবে। তারপর যা হওয়ার হবে।
ফালাক আশ্বস্ত করে বলল,
“ডোন্ট ওরি! কিছু হবে না। আমি ওর সাথে কথা বলছি। এই বিষয়টায় আমিও জড়িয়ে আছি। যদিও ছেলে হওয়ায় সমাজ আমার উপর কোনরূপ দোষারোপ করবে না। তবুও আমি তোমার কিংবা আমার বদনাম হতে দেব না।”
রুহানি ফালাকের কথায়ও আশ্বস্ত হতে পারছে না। ওর নিজেরই কিছু করতে হবে। রুহানির ফোন বেজে উঠল। ওর মা ফোন করেছে। ফালাক ওর ফোন বাজতে দেখে বলল,
“আমি আসছি।”
রুহানি ফালাককে বিদায় দিয়ে ফোন রিসিভ করে নিল।
.
তায়েফ কানে হেডফোন গুজে ফোনে স্ক্রল করতে করতে হাঁটছে। হটাৎই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। হাতের ফোনটা ছিটকে দূরে পড়ে গেল। ফালাক ওর সামনে বসে বলল,
“আহারে! কি করে পড়লে? ফোনের ভেতর ঢুকে থাকলে এমন তো হবেই।” ( পড়ে থাকা ফোনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে)
ফালাক তায়েফকে না তুলে ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,
“এত দামী ফোনটা এভাবে মাটিতে পড়ে থাকা মানায়?”
তায়েফ নিজে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে রাগে গর্জে উঠে বলল,
“ল্যাং মারলেন কেন? ফেলে দিয়ে আবার নাটক করছেন?”
“আরে কুল! এগুলো তো তোমাদের কাছেই শেখা।”
তায়েফ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ফোন দিন।”
ফালাক ফোনটা পকেটে রেখে বলল,
“ওয়েট, এত পাগল হচ্ছো কেন?”
তায়েফ ফালাকের আচরনে খানিকটা অবাক হচ্ছে। কি করতে চাইছে আর কেনই বা ওর কাছে এসেছে।
ফালাক ওর আরেকটু কাছে এসে দু-হাত ভাজ করে বলল,
“রুহানির ড্রিংক চেঞ্জ করেছিস কেন?”
ফালাকের কথা শুনে তায়েফ ঘাবড়ে গেল। তারপর কনফিডেন্সের সাথে বলল,
“ফালতু কথা বলবেন না। আমি কেন ওর ড্রিংক চেঞ্জ করব?”
ফালাক মুচকি হাসল।
“আমার কাছে প্রুভ আছে। তুই যার সাহায্যে করেছিস সেই বলেছে। বারবার ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ বলে দিয়েছে এলকোহল এলাও না। তবুও এনেছিস। আর তারপর একটা মেয়েকে ছলনা করে খাইয়েছিস। এই পর্যন্ত মানা যেত তারপর ওকে আমার রুমের সামনে পাঠিয়েছিস, ভিডিও করেছিস। এখন সেটা ভাইরাল করার জন্য হুমকি দিচ্ছিস। তোর কি মনে হচ্ছে ফালাক তোর হাড়-গোড় ভাঙবে না? তোকে ছেড়ে দিবে? আমি যথেষ্ট ভদ্র একটা ছেলে কিন্তু কতটা ডেঞ্জারাস তুই তো দেখিস নি। বাবা-মার একমাত্র ছেলে হওয়ায় সব সময়ই আদুরে। কেউ কখনো আমার একটা চুলও স্পর্শ করতে পারে নি। এইবারেও পারবি না। ভার্সিটিতে কমপ্লেইন তো অবশ্যই করব পাশাপাশি মানহানীর মামলা ঠুকে দেব। আমি ইয়ং বিজনেসম্যান। নিজের পরিচিতি গড়ার আগেই তোর জন্য সেটা নষ্ট হতে দেব? আমার ক্যারিয়ারের উপর কারো আঁচড় আমি সহ্য করব না। রেডি থাক তোর এই অপরাধের শাস্তি খুব দ্রুতই পাবি।”
তায়েফ ফালাকের রাগী কন্ঠের কথাগুলো শুনে ঘাবড়ে গেল। রুহানির সাথে যে ফালাকও জড়িয়ে আছে সেটা ভুলে বসেছিল। কিন্তু এতদিনে এমন একটা সুযোগ পেয়েছে রুহানিকে শায়েস্তা করার জন্য সেটা ভয় পেয়ে হাতছাড়া করে দিবে? আর কি এমন মূখ্যম সুযোগ আসবে? কিন্তু ফালাকের সাথে যদি নতুন করে কোন ঝামেলা হয়? ফালাকের হিংস্র চোখ-মুখ বলছে ফালাক ওকে ছেড়ে দিবে না। তায়েফ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
ফালাক রুহানির জন্য এটা করলেও নিজের নাম ভাঙ্গাচ্ছে যাতে তায়েফ ভয় পায়। যাতে না বুঝে রুহানিকে বাচানোর জন্য এসব করছে।
ফালাক তায়েফের দিকে চেয়ে আছে। ওর ভাব মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। বাট ফালাক এটা ভেবে নিশ্চিন্ত যে ফোনটা ওর হাতে।
তায়েফ আড়চোখে ফালাককে দেখল। তারপর বলল,
“আমার ফোনটা দিন। আমি এসব কিছু করি নি। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।”
তায়েফের কথা শুনে ফালাকের মাথায় যেন ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। ফালাক ওর দিকে চোখ মুখ শক্ত করে তাকাল। হাতের মুঠে ফোনটা এমন ভাবে ধরেছে যেন ভেঙে চুরমার করে দিবে। ফালাক ফোনটা পাশের পুকুরে ছুড়ে মারল। তায়েফ চোখ বড়বড় করে তাকাল। তারপর চিৎকার করে বলল,
“আমার ফোন!”
ফালাক ওর কলার চেপে ধরে বলল,
“যা তুলে নিয়ে আন তোর ফোন। ভালো কথায় মন ভরে নি এখন শোক কর। বেশি বাড়াবাড়ি করবি মেরে পুতে দেব। রুহানির থেকে একশো হাত দূরে থাকবি। নয়তো ও একাই যথেষ্ট তোকে মেরে গেড়ে দিতে। দেখ তোর জন্য ও কি ভেবে রেখেছিল। আমি হয়তো তোর ফোন ফেলে তোকে বাঁচিয়ে দিলাম। ধন্যবাদ দে।”
তায়েফ ফালাকের দিকে আগুন চোখ নিয়ে তাকাল। যেন এই আগুনে ওকে ঝলসে দিবে।
“আর ইউ ম্যাড?”
ফালাক মুচকি হাসল। তারপর বলল,
“ইয়া আ’ম ম্যাড। তবে কিসের জন্য সেটা এখন বুঝবি না। বাচ্চা মানুষ।” (কলার ঠিক করতে করতে)
ফালাক আবারও আলতো হেসে চলে যাচ্ছে। তায়েফ ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ফালাক পেছনে ঘুরে বলল,
“নিউ ফোন পেয়ে যাবি টেনশন করিস না।”
ফালাক আবারও হাসছে। এই প্রথম কারো জন্য এমন পাগলামি করল, কাউকে হুমকি দিল। সব সময় নিজের জন্য অন্যের সাথে লড়েছে আর আজ রুহানির জন্য। যে কি-না ওর বন্ধু, আত্মীয় নয়।
রুহানি তায়েফকে খুঁজছে। ও কারো হেল্পও নিতে পারছে না। কারণ বন্ধুরা কেউ জানেই না গতকাল রাতের ঘটনা আর না জানাতে চায়। ও একাই দেখে নিবে। তায়েফকে খুঁজে পেলেই ইচ্ছে মতো মারবে তারপর ফোন কেড়ে নিবে। আগের মুডে চলে এসেছে, তায়েফ বাধ্য করল।
“বাঘিনী শিকার খুঁজতে বের হয়েছে বুঝি?”
ফালাকের কন্ঠস্বর শুনে রুহানি ডান দিকে তাকাল। ফালাক দাঁড়িয়ে আছে। ফালাক ওর কাছে এগিয়ে আসতেই রুহানি বলল,
“ওকে আমি আমার পরিবারের সম্মান নিয়ে খেলতে দেব না। ওকে একবার পাই।”
“ডান!”
রুহানি চমকে ওর দিকে তাকাল। ওর ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি।
“ডান মানে?”
“বেচারা হাঁটতে হাঁটতে টাইপিং করছিল। তারপর সুযোগ বুঝে ল্যাং মারলাম যেমনটা তুমি করেছিলে। ও পড়ে গেল ওর ফোন তুলে নিলাম। ইচ্ছে মতো হুমকি দিলাম। ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এলকোহল এনেছে, তোমার ড্রিংক চেঞ্জ করেছে তার প্রমাণ আছে আমার কাছে। যদিও নেই। এছাড়া ইচ্ছে করে তোমাকে আমার রুমে পাঠিয়েছে আমার বদনাম করার জন্য। তাই আমি ওর নামে মামলা করব, ভার্সিটি কর্তৃপক্ষকে জানাব ব্লা ব্লা হুমকি দিয়ে ওর ফোন…”
রুহানি চট করে বলল,”ডিলিট করে দিয়েছো?”
“আরে না, ফোন নিয়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছি। ঠিক পুকুর না, নর্দমা টাইপ পুকুর।”
রুহানি ফালাকের কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এটা ফালাক তো! ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল।
“ফেলে দিয়েছ? মাই গড! তোমাকে কিছুতে আছড় করেছে?”
“হ্যা, রুহানি!”
রুহানি ওর কথা শুনে ভরকে গেল। ফালাকও মুখ ফসকে কি বলতে কি বলে ফেলল। ফালাক কথা ঘুরানোর জন্য বলল,
“না মানে, তোমার টেকনিক ব্যবহার করেছি, মানে তোমাকে অনুসরণ করে ওকে শায়েস্তা করেছি তাই বললাম রুহানি। এছাড়া আর কি করার ছিল। আমার মানসম্মানও তো জড়িত ছিল। তাই না?”
তারপর রুহানির দিকে তাকাল।
রুহানি ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
“হ্যাঁ”
ফালাকের দিকে আরেকবার আড়চোখে তাকাল। ফালাক কেমন অদ্ভুৎ আচরণ করছে।
রুহানি একটা টেনশন থেকে রক্ষা পেল। বাকি একটা দিন খুব সাবধানে কাটাল।
.
রুহানির মা ওর বাবাকে ওষুধ খেতে দিলেন। তারপর পাশে বসে রইলেন চুপ করে। রুহানির বাবা ওর মাকে উদাস দেখে বলল,
“কি হয়েছে?”
রুহানির মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুঝতে পারছি না কি করব। বাঁচব কি করে। টাকা পয়সা সব শেষ। যা বাজার আছে তাতে ৪-৫দিন চলবে। তারপর! তারপর কি করব?”
রুহানির বাবা মাথা নিচু করে নিলেন। উনার নিজেরও জানা নেই কি করবে। ছেলে-মেয়েদের না খেয়ে মরতে দেখবেন? নিজের উপর রাগ হচ্ছে। ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু করতে পারছেন না বরং তাদের বোঝা হয়ে আছেন। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে আত্মবিসর্জন দিতে কিন্তু তারও উপায় নেই। কি করে ছেলে-মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিবে?
রুহানি গলায় হাত দিয়ে জামার ভেতর থেকে লকেটটা বের করল। তারপর হুক খুলে হাতে নিল। হীরের লকেট। গত জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছিলেন। এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে সব সময় গলায় পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবারের এমন মুহুর্তে এটাই রুহানির শেষ সম্বল। বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু বাবার দেওয়া উপহারটা বিক্রি করে দিবে? রুহানি চেয়ার টেনে বসে পড়ল। কি করবে ভাবছে। একদম সাধারণভাবে বসবাস করতে চাইলেও মাসে ওর ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে। ভাগ্যিস বাড়ি ভাড়াটা কম দিতে হয়। কেননা যারা ওদের ভাড়া দিয়েছেন তারা নিজেরা বাড়ি দেখভাল করার জন্য নিয়েছিলেন। আর এখন মালিককে না জানিয়ে ভাড়া দিয়েছে। যা পাবে তাই লাভ। বাড়ি ভাড়া, বাবার ওষুধ-পথ্য, ভাইয়ের পড়ার খরচ, সংসার খরচ সব কিছু মিলিয়ে ত্রিশ হাজারে চলা মুশকিল। আর সেখানে ওর হাতে কোন টাকা নেই বললেই চলে।
রুহান ওর পাশে এসে বসেছে। কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না। রুহানি ওর চোখ মুখ দেখে বুঝে গেল।
“কিছু বলবি?”
রুহান তখনও চুপ। বলতে চেয়েও বারবার আঁটকে যাচ্ছে। কিন্তু বলতে তো হবেই।
“আপু মা’কে বলতে গিয়ে বারবার ফিরে এসেছি। আমি তো জানি সংসারের কি অবস্থা। কি করে এই মুহুর্তে এই কথা বলব? সাহস হয় নি। তোমাকেও বলতে পারছি না।”
রুহানি ওকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“বল, আমি সমাধান করার সর্বাত্মক চেষ্টা করব।”
“আপু মাস শেষ। স্কুলের বেতন দিতে হবে আর কোচিং-এও অনেক টাকা বাকি পড়ে আছে। কিন্তু মা’কে বলতে পারছি না। আমার পড়াশোনা কি এখানেই শেষ?”
রুহানের কথা শুনে ওর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।
“না রুহান, আমি আছি তো। তুই পড়াশোনা করবি। পড়াশোনা করে অনেক বড় হবি। আমাদের দুঃখ লাঘব করবি। আমি তোর টাকার ব্যবস্থা করছি। একদম চিন্তা করিস না।”
রুহানি উঠে দাঁড়াল। ছাদে গিয়ে পাইচারি করছে। হাতের ফোনটা নিয়ে ভাবছে কাকে ফোন করা যায়। কার কাছে সাহায্য চাইবে?
তারপর হটাৎ খেয়াল হলো হাতের ফোনটাই বিক্রি করে দিবে। এত দামী ফোন দিয়ে কি করবে? যখন নিজেকেই কম দামী মনে হচ্ছে।
.
নুশা রুহানির সামনে হাসিমুখে বসে আছে। কারণ রুহানি নিজেই অনেক খুশি। রুহানির খুশি দেখে ও নিজেও খুশি।
চলবে……