প্রতিশোধ নাকি ভালোবাসা সিজন 2 পর্বঃ ০২

প্রতিশোধ নাকি ভালোবাসা
সিজন 2
পর্বঃ ০২
জাহান আরা

ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না রাফি,অনিতা কে অন্য কেউ তুলে নিয়ে গেছে।



চোখ মেলতেই দেখি অন্ধকার কোনো ঘরে পড়ে আছি।
মাথা খুব ঝিমঝিম করছে,কোথায় আমি???

কিছুক্ষণ পরে মন পড়লো সব কিছু,হাসান সাহেব আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে???

হঠাৎ করেই কেমন অজানা ভয়ে আমি শিউরে উঠলাম। হাসান সাহেব আমাকে কেনো নিয়ে এসেছে,তার উদ্দেশ্য কি???

মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হয়,অন্যদের হয় কিনা জানি না কিন্তু আমি বেশ ভালো তীক্ষ্ণ।
আমি বুঝতে পারছি হাসান সাহেবের মতলব কি!!!

আমার খুব কান্না পাচ্ছে কেনো জানি। আশেপাশে অনেক বোতল পড়ে আছে কাচের,একটা বোতলের সাথে হঠাৎ করেই আমার পা কেটে গেলো,এখানে এতো বোতল কিসের???

বিছানা থেকে উঠে দরজার কড়া নাড়ছি অনবরত। এখন দিন না রাত???
অনেকক্ষণ পরে হাসান সাহেব এসে দরজা খুলে দিলেন।
হাসান সাহেবের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে,উনি নেশা করে এসেছেন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।তারমানে এগুলো সব মদের বোতল।যেখানে পা কেটে আমার রক্ত বের হচ্ছে।

হাসানঃ আরে ভাবী,জ্ঞান ফিরেছে আপনার???
সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছি,আপনার তো জ্ঞানই ফিরার নাম নেই,এদিকে আমি কতো পেগ খেয়ে ফেললাম আপনার অপেক্ষা করতে করতে……..




রাফি কি করবে উপায় খুঁজে পায় না,থানায় গিয়ে জিডি করিয়ে এলো,রাফিকে দেখে ওসি সাহেব তখনি নেমে গেলেন অনিতাকে খুঁজে বের করতে।

সন্ধ্যা হয়ে এলো এখনো অনিতার খোঁজ পাচ্ছে না।
হঠাৎ করেই রাফির মাথায় এলো একটা আইডিয়া,রিকশাওয়ালা মামা কে আবার ডেকে আনলো।
বিয়ের ফটোগ্রাফ সব দেখাতে লাগলো রিকশাওয়ালা মামাকে।

একটা গ্রুপ ফটো দেখি জিজ্ঞেস করলো এখানের কেউ কিনা।
অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকার পর রিকসাওয়ালা মামা চিনতে পারলো হাসান কে,তখনি দেখিয়ে বললো মামা,এই সাবেই আছিলো যে আপামনিরে লইয়া গেছে।

রাফি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো, তার কোনো বন্ধু এরকম করতে পারে তা রাফির চিন্তাভাবনা তে ছিলো না,
রাফি সাথে সাথে ওসি সাহেব কে কল দিলো,তারপর ওসি সাহেবের সাথে দেখা করে রাফি ছবি দেখালো,হাসানের এড্রেস দিলো।
ওসি সাহেব ও সব পুলিশ নিয়ে রাফি গিয়ে দেখে হাসানের বাসায় হাসান নেই।
হাসানের স্ত্রী জানায় সকাল থেকে ফিরে নি হাসান।

রাফির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে,এখন কি হবে।

ওসি সাহেব হাসানের বৌকে সব খুলে বলে শুনেই উনি কান্না শুরু করে।

ওসিঃ কান্না করার সময় এটা না,আপনি প্লিজ হাসান সাহেবের নাম্বার দিন আমরা ওনার লোকেশন ট্রেস করবো।

হাসানের ফোনের লোকেশন ট্রেস করে জানা গেলো হাসান অনিতাকে নিয়ে তার বাংলোতে আছে,এখান থেকে প্রায় ৯০ মাইল দূরে।

রাফি এবার কান্না করে দিলো,বার বার আল্লাহ কে বলতে লাগল অনিতা যাতে সুস্থ থাকে।
ওসি সাহেব পুরো পুলিশ ফোর্স নিয়ে রাফিকে নিয়ে রওনা হলেন বাংলোর উদ্দেশ্যে।



লাইট অন করে হাসান সাহেব পায়ে পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো,এগিয়ে আসতে আসতেই হুট করে পড়ে গেলো,তারপর জানি না কি হলো,হাসান সাহেব বার বার দেয়ালে বারি খাচ্ছে,আমি কিছুই বুঝতেছি না কেনো এমন হচ্ছে,দেয়ালে বারি খেতেই লাগলো।
কই থেকে যেনো সেই মিষ্টি ঘ্রাণ টা ভেসে আসতে লাগলো।

আমি চমকে উঠলাম,সে আছে,সে এখনো আছে আমার আশেপাশে। আমাকে বাঁচাতে চলে এসেছে সে।

আমার খুব কান্না পাচ্ছে খুশিতে,এযে আনন্দের কান্না।
এই আনন্দ আমি কাকে বুঝাই????
পায়ের দিকে তাকাতেই দেখি খুব রক্ত বের হচ্ছে, তখনি মনে পড়লো এতো সে না,আমার রক্ত থেকে তার ঘ্রাণ আসছে,সে যে আমার রক্তে মিশে ছিলো,আমার আনন্দ মুহুর্তেই বিষাদে রূপান্তরিত হলো।

কিছুক্ষণ পরেই হাসান সাহেব জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো।
আমি দরজা খুলে বের হয়ে গেলাম।

কোথায় আছি আমি জানি না,এখন রাত কয়টা তাও জানি না,কোথায় যাবো আমি তাও জানি না,এরকম অনিশ্চয়তার মাঝেই বের হয়ে এলাম।

আমি কই যাবো এখন???

ছুটতে ছুটতে পায়ের ব্যথাটা যেনো বেড়ে গেছে,আর পারছি না ছুটতে,একটা মসজিদ সামনে পেয়ে সেখানে বসে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।




পুলিশ নিয়ে রাফি হাসানের বাংলোতে এসে দেখে হাসান রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে,কিন্তু অনিতা নাই কোথাও।
অনিতা কোথায় গেলো,রাফির বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে,অনিতাকে কি হারিয়ে ফেললো এই জনমের মতো???

পুরো বাংলো সার্চ করে পুলিশ ভিডিও ক্যামেরা পায়,হাসান সব কিছু ভিডিও করে রাখার জন্য ব্যবস্থা করেছে।অনিতা কোথায় গেছে এটা দেখলেই বুঝা যাবে।

ভিডিও প্লেয়ারে ভিডিও প্লে করতেই দেখা যায় অনিতা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে,হাসান পাশে বসে বসে মদ খাচ্ছে,হাত থেকে পড়ে একটা বোতল ভেঙে গেছে,ভিডিও টেনে টেনে দেখতেই দেখে একসময় অনিতার জ্ঞান ফেরে,অনিতে পা কেটে ফেলে ভাঙা বোতলে,তারপর হাসান আসে রুমে,যা কথোপকথন হয় সবই শুনে তারা।

তারপরের দৃশ্য দেখেই সবাই শিউরে ওঠে, একি!!!
এটা কিভাবে সম্ভব!!!
কোন অদৃশ্য শক্তি হাসান কে বার বার দেয়ালে নিয়ে ফেলছে,অনিতা সামনে দাঁড়িয়ে আছে অথচ,একসময় হাসান জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো, অনিতা ছুটে পালায়,অনিতার পায়ের রক্ত লেগে আছে,রাফি আর দেরি না করে তখনি লাইট নিয়ে অনিতার পায়ের রক্ত দেখতে দেখতে যেতে থাকে,একটু পরেই দেখে একটা মসজিদের সামনে এসে রক্ত আর নেই,অর্থাৎ এখানেই অনিতা থেমে ছিলো,কিন্তু এখান থেকে অনিতা কই গেলো????




রাবেয়া বেগম তার মেয়েকে নিয়ে প্রতিদিনের মতো আজও বেরিয়েছে তার হারানো মেয়েকে খুঁজে বের করতে।
তার জমজ দুইটা মেয়ে হয়,৭ মাসের সময় অসুস্থ হওয়াতে দুজনকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাসপাতালেই একজন চুরি হয়ে যায়,আজ ২১ বছর পরেও তিনি মেয়ে হারানোর শোক ভুলতে পারেন নি,তার এক মেয়ে রাত্রি আরেক মেয়ে নিশি,রাত্রি আছে কিন্তু নিশি নাই,নিশিকে হারিয়ে রাবেয়া বেগম প্রায় পাগলের মতো হয়ে যান,তার নিশির জন্মদাগ ছিল ঘাড়ে,রাত্রির ছিলো গলায়,এই জন্মদাগ দিয়েই ২ জনকে চিহ্নিত করতে পারতো সবাই।
২১ বছর ধরে রাবেয়া বেগমের স্বামী ইমরান খান দেশে ফিরলে তাকে নিয়ে প্রতি দিন একবার রাতে একবার বের হয় হারানো মেয়েকে খুঁজতে,যেদিন না বের হয় সেদিন রাবেয়া বেগম খুব অস্বাভাবিক হয়ে যান,তাই তাকে সুস্থ রাখার জন্য বের হতেই হয়।

আজকে ইমরান সাহেব আসতে পারে নি তাই রাত্রি এসেছে সাথে,মসজিদের সামনে একটা মেয়েকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে রাত্রি নেমে যায় গাড়ি থেকে,মেয়েটার খোলা চুলে মুখ ঢেকে আছে,পা থেকে রক্ত বের হচ্ছে,মা আর রাত্রি ধরাধরি করে মেয়েটাকে গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে আসে।
বাড়ি এসে মেয়েটার মুখ থেকে চুল সরিয়ে মুখের দিকে তাকাতেই রাত্রি চিৎকার করে উঠে,এ কি!!!
এই মেয়ে যে পুরো তার কার্বনকপি,এ কিভাবে সম্ভব!!!

রাবেয়া বেগম আর ইমরান সাহেব রুমে এসে অনিতাকে দেখে থমকে যায়,এই মেয়ে কে???
এ যে পুরো রাত্রির মতো।
তাহলে কি এই মেয়েই তাদের হারিয়ে ফেলা নিশি????
রাবেয়া বেগম ছুটে এসে ঘাড়ের চুল সরিয়ে তাকাতেই মাথা ঘুরে পড়ে যায় তিনি।

সেই জন্মদাগ,সেই চেহারা,এই তার হারিয়ে ফেলা নিশি।

কিছুক্ষণ পরেই রাবেয়া বেগমের জ্ঞান ফিরে,উনি নিশিকে জড়িয়ে ধরে রাখে।

রাত্রিঃ মা ছাড়ো তো,দেখছো না ওর শাড়িতে ময়লা,ওর ড্রেস চেঞ্জ করে দিই ছাড়ো।

রাবেয়া বেগম এই ২১ বছরে একবার ও ভুলে নি নিশির কথা,রাত্রির জন্য যতো কিছু বানিয়েছে নিশির জন্য ও তা বানিয়েছে।নিশির জন্য আলাদা আলমারিতে নিশির সব গয়না,জামাকাপড় রাখা আছে।

হারানো বোনকে খুঁজে পেয়ে রাত্রির ও খুব আনন্দ হতে লাগলো,অনিতাকে নিজের গায়ের জামার মতো একটা জামা পরালো।

রাবেয়া বেগম অনিতার মাথার পাশে বসে রইলেন।
রাত্রি পায়ের কাছে,ইমরান সাহেব তো আনন্দে কথা বলতে পারছে না,আজ তার জীবনের সবচাইতে খুশির দিন।




রাফি অযু করে মসজিদে ঢুকে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো,আজ আল্লাহ ছাড়া তার কেউ নাই সাহায্য করার মতো।
অনিতাকে ফিরিয়ে দিতে শুধু আল্লাহই পারে।
রাফি বাকি রাত কাটিয়ে দিলো সেখানেই।

ফজরের আজানের সময় মুসুল্লি রা মসজিদে আসে,নামাজ পড়ে অচেনা এক ছেলেকে দেখে সবাই এগিয়ে আসে তার কান্নার কারন জানতে।
ইমাম সাহেব কে রাফি সব খুলে বলে।

অনিতার ছবি বের করে দেখাতেই সবাই চিনতে পারে।

একজন বলে,”আরে এ-তো খান বাড়ির মেয়ে রাত্রি,খান সাহেব মেয়ের বিয়ে দিলো কবে??”

রাফিঃ না এই আমার বৌ,ওর নাম অনিতা।

~না ভাই,এই আপার নাম রাত্রি,এলাকার সবাই এই আপারে চিনে,আমাদের এলাকার সবচেয়ে ধনী পরিবার তাদের,সবাই আমেরিকা থাকে,প্রতি ৬ মাস পর পর দেশে আসে।
এখন দেশেই আছে ওনারা।

রাফিঃ আমাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবেন তাদের বাড়ি।
একজন এসে রাফিকে নিয়ে এলো।

বাড়ির গেইট খোলা ছিলো,কলিংবেলে চাপতেই কেউ একজন দরজা খুলে দিলো।

অনিতাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাফি নিজেকে সামলাতে পারলো না,জড়িয়ে ধরলো অনিতাকে,কিন্তু রাফি বুঝতে ও পারলো না এই অনিতা না এই রাত্রি।

রাত্রিঃ আরে কে আপনি কি করছেন,ছাড়েন।

রাফিঃ অনিতা,আমার অনিতা,কতো খুঁজেছি তোমায়,এখানে কেনো তুমি।

রাত্রিঃ আপনি ভুল করছেন আমি অনিতা না আমি রাত্রি,অনিতা আছে ভিতরে,আপনি আসুন।

রাত্রির কথা শুনে রাফি বুঝতে পারে,ভয়েস কিছুটা পার্থক্য আছে অনিতার সাথে তার।
তাড়াতাড়ি রাত্রি কে ছেড়ে দেয়।




চোখ মেলে তাকাতেই দেখি কেউ একজন আমার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে, মায়ের মতো লাগছে।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই চমকে গেলাম।

এ কি!!

এই মেয়ে কে???

সামনের মেয়েটা তো আমি!!!

কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব!!!

একই রকম জামা পরে আছি আমি আর মেয়েটা,কে এই মেয়ে???
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
একপাশে রাফি বসে আছে, আরেক পাশে এক লোক।

আমি কিছুই বুঝতেছি না,আমি এই কোথায় এলাম???

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here