পরিণীতা,পর্ব ২,৩

পরিণীতা,পর্ব ২,৩
নাহিদা ইসলাম
পর্ব ২

৪.
চোখ খুলে নিজে হাসপাতালে আবিষ্কার করলাম। হাত পা নাড়াতে পারছিনা।শরিরে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম আমার থেকে বয়সে একটু বড় হবে একটা মেয়ে।আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন লাগছে এখন।
আমি এখানে আসলাম কেমন করে।

আরে রিলাক্স এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেনো। মুহুর্তে ই একটা নার্স এসে বললো আপনার বোনকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন উনার তেমন কোনো বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। ডক্টর ঔষধগুলো লিখে দিচ্ছে আপনি একটু ঠিকমত খাইয়ে দিবেন।

নার্স চলে যাবার পর মেয়েটা আমার পাশে। আমার নাম ইলা। তুমি উপর থেকে গাছের ডাল ভেঙ্গে আমার গাড়ির উপর পড়লে।সুইসাইড করতে গেছিলে বুঝি। আত্মহত্যা মহা পাপ জানো তো। আর নিজেকে শেষ করে দিলো তো কোনো সমস্যা ই সমাধান হতো না।

উনার এমন প্রশ্ন কী বলবো বুঝতে পারছি না। আমাকে এতো ভাবতে দেখে কথা অন্যদিকে নিয়ে গেলো।

আমাকে উনার ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো তোমার বাবা মাকে কল দেও।

এবার নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারিনি। জোরে কেঁদে উঠলাম।

আমার পৃথিবীতে কেউ নাই।

আরে তুমি কান্না করছো কেনো। আজ থেকে তুমি আমার সাথে ই থাকবে। ছোট বোন হয়ে আমার ও বাবা মা কেউ নাই। আমি তোমার সব। হসপিটালের ই কী সব কথা শেষ করে ফেলবে নাকি চলো বাসায়।

সব ঔষধ কিনে। ডক্টরের সাথে কথা বলে নেয় ইলা। পরীকে নার্স কিছু ঔষধ খাইয়ে দেয়। ব্যাথা অনেকটা কমে গেছে।

৫.
পরী গাড়ি থেকে নেমে দেখলো বিশাল রাজপ্রাসাদ এর মতো বাড়ি।খুব সুন্দর করে ভেতরটা সাজানো, বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথে কাজের লোকগুলো এসে আমাকে একটা রুমে নিয়ে আসলো। সাথে ইলা আপু ও এসেছে।

আচ্ছা শুনো। তোমার নামটা ই তো জানা হলো না। আমার নাম পরিণীতা সবাই পরী বলে ই ডাকে।

তুমি তো বললে তোমার কেউ নেই। আচ্ছা যা ই হক আমি রহিমা আর অনিমেষ কে বলে দিবো তোমার সব খেয়াল রাখতে।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। উনি চলে গেলো।যতটুকু বুঝলাম রহিমা আর অনিমেষ কাজের লোক। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে আমি তো বেচে গেলাম কিন্তু আমার বাচ্চাটা ঠিক আছে তো। আমার ভালোবাসার শেষ অস্তিত্ব। যদি বাচ্চাটার কিছু হয়ে যায় আমি বা বেচে থেকে কী করবো। নিজের যা ই হক একটা ঠিকানা পেলাম। এখন কী আপুকে বলা ঠিক হবে আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম।পরে যদি আমাকে বাসা থেকে বের দেয় সবার মতো আপু ও ভুল বুঝে। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো পরী।

সকালে কারো চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম। খুব সুন্দর একটি ছেলে। পড়নে একটা পেন্ট নেভি কালারে শার্ট চুলগুলো খুব সুন্দর করে এক সাইড করে রেখেছে। দেখতে লম্বা বেশ। আমার দিকে তাকিয়ে ই চুপ হয়ে যায়। একনজরে তাকিয়ে আছে।কে তুমি অপরুপসী।

অর্ণব ও পরী কালকে ওর কথা ই তোকে বলেছিলাম। আর পরী ও হচ্ছে আমার ভাই অর্ণব পড়ালেখা শেষ হয়েছে আমার সাথে অফিস দেখাশুনা করছে।।।

অহ আচ্ছা। তুমি ড্রেস চেঞ্জ করোনি কেনো পরী।
আসলে আপু আমার সাথে তো কোনো ড্রেস নাই। ওহ আচ্ছা তাহলে আমার ড্রেস পড়ো। আমি রহিমাকে বলে দিচ্ছি।

শাড়িতে ই কিন্তু উনাকে সুন্দর লাগে আপু। এটা বলে অর্ণব চলে গেলো। ইলা আপু ও হাসতে হাসতে নিজের রুমে চলে গেলো।

রহিমা খালা আমাকে আপুর ড্রেস দিয়ে গেছে। কিন্তু বসে আছে শাড়িটা খুলতে ইচ্ছে করছে না। এতে যে আমার আদির স্পর্শ আছে। যাকে আমার নিজের জীবনের থেকে ও বেশি ভালোবাসি। আদির কথা মনে হতে ই আমার দুনিয়াতে আবার ঝড় উঠতে শুরু করলো। ফোনটা নিয়ে আদির নম্বরে কল করলাম। কয়েকবার কল করতে ই রিসিভ করলো,

আমি আর আমার হাসবেন্ড খুব সুখে আছি।তুই মাঝখানে ডিস্টার্ব না করলে খুব খুশি হবো। তুমি কী কথা বলো আমাকে দেও। ইরা আপুর কাছ থেকে আদি ফোনটা নিয়ে বলে। তোর মতো মেয়েকে আমি কখনো ভালোবাসিনি আমার রুচি এতেটা খারাপ না। যার বাবা মা নাই, যার কোনো নিজস্ব পরিচয় নাই তাকে বিয়ে করবো আমি এগুলো নিছক ই স্বপ্ন।
আদি প্লিজ আমাকে একটু বুঝো তোমার বাচ্চার মা হতে চলেছি আমি।
তোকে আমি স্পর্শ পর্যন্ত করিনি আমার বাচ্চা হবে কোথা। আমাকে মিথ্যা বুঝাতে আসবি না।
আদি বিয়ে করেছি আমরা বাচ্চাটা তোমার আমাকে দয়া করো। তুমি ইরা আপুকে বিয়ে করো আমার কোনো সমস্যা নাই শুধু বাচ্চাটাকে তোমার পরিচয়ে বড় করো।
অন্যের পাপ আমার ঘাড়ে চাপাতে বয়েই গেছে। তোর জন্য শান্তিতে থাকতে পারবো না তাই সিম বন্ধ করে দিচ্ছে।

আদি প্লিজ আমার কথা শুনো। কলটা কেটে দিলো। আমার ভালোবাসার মানুষটা অন্য করো সাথে আছে ভাবতে ই আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে।

৬.
হঠাৎ দরজায় নক করলো। আসতে পারি।
তাকিয়ে দেখলাম অর্ণব। হে আসুন।
হাতে অনেকগুলো ব্যাগ। এই ব্যাগগুলোতে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র আছে। আরো কিছু লাগলে আমাকে বলতে পারেন। আমাকে আর কোনো কথা না বলতে দিয়ে উনি চলে গেলেন।

ব্যাগগুলো খুলে দেখলাম। আমার অনেকগুলো ড্রেস, লিপস্টিক, চুড়ি, কাজল,চুল বাধার ক্লিপ। অবাক এতো কিছু লাগে অর্ণব জানে কীভাবে।

একটা রেড কালারের ড্রেস পড়ে বাহিরে গেলাম। খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে আপু জিজ্ঞেস করলো। পরী আমি তোমাকে এই ড্রেস দেইনি তাহলে এইগুলো কোথা থেকে তোমার কাছে ও তো কোনো ড্রেস ছিলো না।

আমি এনে দিয়েছি আপু।ওহ্ ভালো তো আমার কাজ কমে গেলো। দেখলি তো আমার সাথে শপিং এ গেলি আর কেমন উপরকার হলো। বউকে ও সব জিনিস কিনে দিতে পারবি। দুজন হাসতেছে।কিন্তু আমি ভাবতেছি যে করে ই হক আমাকে ডক্টরের কাছে যেতে ই হবে।।।

পরের দিন সকালে পার্সটা নিয়ে চুপিচুপি বেড়িয়ে পড়লাম। অর্ণব আর ইরা আপু অফিসে গেছে এটা ই আমার কাছে বেস্ট সুযোগ বলে মনে হয়েছে।

হসপিটাল এসে একটা নার্সকে অনেক রিকোয়েস্ট করে শুধু একটা টেস্ট করালাম বাচ্চাটা আছে নাকি নাই দেখার জন্য। ডক্টর দেখানোর মতো টাকা আমার কাছে নেই।।।

নার্সটা টেস্টের রিপোর্ট দেখে বললো রেজাল্ট নেগেটিভ। মানে বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে। যে বাচ্চাটার জন্য এতো কিছু এখন বাচ্চাটা ই হারিয়ে ফেললাম। ঐদিন আল্লাহ কেনো বাচিয়ে রেখেছিলো আমার বাচ্চা নেই তো আমার ও বাচার কোনো অধিকার নেই।

হঠাৎ পিছনে কারো স্পর্শ পেলাম। ঘুরে তাকাতে ই দেখলাম ইলা আপু। ভয় হচ্ছে খুব এখন কী উওর দিবো আমি আপুকে।

চলবে

পরিণীতা
নাহিদা ইসলাম
পর্ব ৩

৭.
এ বাসায় এসেছি কেটে গেলো সাতদিন। ঐদিন ইলা আপু ডক্টর দেখিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছিলো। শরির খারাপ এর বাহানা দিয়ে বেচে গেলাম ঐদিন। কিন্তু একদিন তো সব জানতে পারবে কারন সত্য কখনো চাপা থাকে না। এতো আপন করে নিলো মানুষগুলো তাদের ভালোবাসার মূল্য রাখতে পারবো তো। বার বার এই প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে উকি দিচ্ছে।।।

আরে আপামনি আপনি এইখানে।

রহিমার কন্ঠ শুনে আটকে উঠলাম। আরে রহিমা আপা এতো জোরে কেউ ডাকে নাকি। আপামনি কতো দিন না করলাম আপনে আমারে আপা বইলা না ডাকতে, আমি তো আপনের ছোট।
আচ্ছা ঠিক আছে মুচকি হেসে উওর দিলাম।
আপামনি আপনাকে ইলা আপামনি যাইতে কইছে।

আচ্ছা যাও আসতেছি।
না আপনাকে সাথে করে নিয়া যাইতে কইছে।
আচ্ছা চলো।
আপামনি আমি আর উনি কালকে আসবো না।
কেনো রহিমা আর উনিটা কে।
এই খাটাশ অনিমেষ। একটু সমস্যা আপামনি তাই আরকি।
ওহ আচ্ছা।
দুজনে কথা বলতে বলতে ইলা আপুর রুমে গেলাম।

আরে পরী চলে এসেছো। কতক্ষণ যাবৎ আমি আর অর্ণব তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। শুনো কাল থেকে তুমি অর্ণব এর সাথে অফিসে যাবে।

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কেনো আপু?আর আমি তো বেশি লিখাপড়া করিনি মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি।

হে সমস্যা নাই সামনে ভর্তি হয়ে নিবে ভার্সিটিতে। এখন তো অফিসে যেতে কোনো সমস্যা নাই। অর্ণব এর পি.এ হয়ে তো থাকতে পারবে।

এই চিকনেচামিলি আমার পি.এ হবে??

কে চিকনেচামিলি একটু জোরে ই বললাম।

দেখলে তো আপু যার কথা তার গায়ে ঠিক ই লাগেছে।
কী আমি চিকনেচামিলি।
অন্য কেউ এখানে আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। যেই চিকন কবে জানি বিড়াল মাংসের পিস ভেবে কামড়ে নিয়ে যায়।

এইটুকু বলে হাসতে হাসতে অর্ণব রুম থেকে চলে যায়। পরীর মুখটা দেখার মতো অবস্থা ছিলো।। ইলা দুজনের কান্ড দেখে হাসতেছে।

৮.
রোজ রাতে ই অদিকে কল দেয় কিন্তু আদির ফোন অফ। সিম বন্ধ করে রেখেছে। যে আদি পরীর সাথে কথা বলার জন্য কনকনে শীতের মধ্যে ও বাসার সামনে রাত দুইটা পর্যন্ত দাড়িয়ে ছিলো ঐ আদি আজ কথা না বলার জন্য ফোন অফ করে রেখেছে। ভাবতে ই কতো কষ্ট পাচ্ছে পরি। নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে অন্য মেয়েকে দেখা পৃথিবীর সব থেকে বড় কষ্ট মনে হয়। নাহ্ এসব ভাবলে আর চলবে না ঘুরে দাড়াতে হবে পরীকে আল্লাহ তো বাচিয়ে রেখেছে। একটা সুযোগ ও দিয়েছে নিজেকে তৈরি করার জন্য উচিত শিক্ষা দিবে আদিকে। কিন্তু চাইলে ও কী ভুলা যায় নিজের অতীতকে।
.
সকাল বেলা উঠে রেডি হতে হবে আর আজকে রহিমা অনিমেষ, আসবে না। ইলা আপু কোনো রান্না পারে বলে ও মনে হচ্ছে না তাই উঠে নিজে ই যা পারি রান্না করে নেই।
কিচেনে ডুকতে ই দেখি অর্ণব ও কিচেনে।

কী হলো আপনি কিচেনে যে।
আফিসের মিটিং আছে।দ্রুত রেডি হয়ে নিন।
আপনি কী রান্না করতে পারেন নাকি কিচেনে আসছেন যে।
না পারলে ও আপনার থেকে ভালো পারি চিকনেচামিলি।
এই আপনি আমাকে আবার চিকনেচমিলি বলছেন।
হে তো কি হইছে। বস হই আপনার মনে রাখবেন।
কী খাবেন বলুন আমি রান্না করে দিচ্ছি।
আমি নিজের কাজ নিজে করতে জানি।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে। ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে বেজে নিলাম। ডিমটা প্লেটে রাখার সাথে সাথে অর্ণব নিয়ে নিলো।
এই আপনি আমার ডিম নিলেন কেনো।
আমি জানতাম মুরগির ডিম হয়। আপনার ও যে ডিম হয় তা জানা ছিলো না।
রাগে প্লেটা টান দিয়ে নিয়ে আসলাম। এভাবে দুজন টানাটানি করতে করতে প্লেট এর খাবার নিচে পড়ে গেলো। দুজন ই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি।
কী করলেন এটা খাবারটা ফেলে দিলেন।
আপনি ই তো টেনে ফেলে দিলেন।আমাকে রেগে থাকতে দেখে অর্ণব বাহিরে চলে গেলেন। আমি ও আর রাগে খাবার না খেয়ে ই রেডি হয়ে নিলাম।
বেশ কিছু ক্ষন পর দরজায় নক করতেছে কেউ মনে হচ্ছে তাই দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেখলাম অর্ণব।

-সরুন এতো মোটা হয়ে দাড়িয়ে আছেন কেনো

-আমাকে কী রুমে ডুকতে দিবেন না।

-আরে আজব তো মোটা হয়ে আবার দাড়িয়ে থাকে কীভাবে।

-এই যে খাবার আনলাম। খেয়ে নিন।
আমি খাবোনা।

-তাহলে অফিসে ও নিয়ে যাবো না। ইলা আপুকে বলবো আপনি যেতে চাননি।

-আমি কখন যেতো চাইনি।
-তাহলে খেয়ে নিন।
.
অফিসে আসার পর সবার সাথে ই পরিচিত হয়ে নিলাম। অর্ণব অফিসে অনেক রাগি মোড নিয়ে থাকে দেখে ই বুঝা যাচ্ছে।

হঠাৎ ফোনে মেসেজ আসলো, আদির নম্বর থেকে মেসেজ দেখে কাউকে কিছু না বলে ই বেড়িয়ে পড়লাম একটা রিক্সা নিয়ে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here