নেকড়ে_মানব,পর্ব:- ১২

#নেকড়ে_মানব,পর্ব:- ১২
#আমিনা_আফরোজ

বাঘাইছড়ির একটি এলাকার নাম সাজেক ভ্যালি। বাঘাইছড়ি উপজেলা বাংলাদেশের পূর্ব- দক্ষিণাংশের সর্ব উওরে সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা। জেলা সদর হতে এর দূরত্ব ১৪৬ বর্গমাইল। বাঘাইছড়ির ০৬ টি ইউনিয়ন এলাকা উপত্যকা তথা সমতল, বাকি ৬০০ বর্গমাইলের সাজেক ইউনিয়নন উঁচু পাহাড় তথা সাজেক ভ্যালি নামে পরিচিত। সাজেক ভ্যালির এলাকায় বেশির ভাগ মানুষ জুম চাষ করে। পূর্বে জেলা সদরের সাথে নৌ পথই ছিল একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। বর্তমানে বাঘাইছড়ি- দিঘীনালা সড়ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সড়ক পথেও যোগাযোগ করা যায়। বাঘাইছড়ি এলাকা আগে একটি রিজার্ভ ফরেস্ট ছিল। এর অধিকাংশ এলাকা কাচলং আর মাচালং নামে পরিচিত। লোকমুখে শোনা যায়, এ উপজেলার কাচলং এলাকা গভির অরন্যে ঢাকা ছিল বলে এখানে একসময় বাঘের উপদ্রব বেশি ছিল। এছাড়া এ উপজেলায় বিভিন্ন পাহাড় ছড়া অবস্থায় থাকায় এই অঞ্চলটির নামকরণ করা হয়েছে বাঘাইছড়ি।

সাজেক ভ্যালির একটার পাহাড়ের পাদদেশে এসে দাঁড়ালো নিলয়েরা। পাহাড়টা খুব একটা উঁচু নয় আবার খুব একটা ছোটও নই। পাহাড়ের গায়ে উপজাতিরা জুম চাষ করেছে। পাহাড়ের চূড়ায় দেখা যাচ্ছে এক ছোট্ট কুঠরী। নিভৃত নিলয়, অন্তু আর রমজান মিয়াকে নিয়ে এগিয়ে গেলে সেই ছোট্ট কুঠিরের দিকে। ঘন্টাখানেক পরে ওরা চারজনে গিয়ে পৌঁছালো সেখানে। আরো আগে আসতে পারতো ওরা কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে এভাবে ট্র্যাকিং করার অভ্যাস ওদের নেই। তাই কিছুক্ষণ হাঁটার পর হাঁপিয়ে বসে পড়ছিল সবাই। ছোট্ট অন্তুর অবশ্য তেমন একটা অসুবিধে হয় নি। অন্তু পাহাড়ি ছেলে। ছোট বেলা থেকেই পাহাড়ের কোলে মানুষ সে। তাই এতটুকু পাহাড় বেয়ে উঠা ওর কাছে তেমন একটা কষ্টের কিছু নয় । তবে অবস্থা নাজেহাল হয়েছিল বাকি তিনজনের। ঘামে নেয়ে একাকার অবস্থা। পাহাড়ের চূড়ার যখন ওরা পৌঁছাল তখন তিন জন রিতিমত হাঁফাচ্ছিল। নিজেদের একটু ধাতস্থ করেই ওরা টোকা দিল কাঠের দরজায়। মিনিট খানেক পরেই নিঃশব্দে খুলে গেল দরজার দুখানা পাল্লা। পাল্লা দুইটির মাঝে তাড়িয়ে থাকতে গেলো এক মধ্যবয়ষ্ক লোককে। লোকটির গায়ে আদিবাসীদের পোশাক জড়ানো, মুখে ঘন দাড়ি যেন অনেকদিনের অযত্নে বেড়ে উঠেছে সেগুলো। মধ্যবয়ষ্ক লোকটি নিভৃতদের দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হলেন না যেন তিনি আগে থেকেই জানতেন যে নিভৃতরা আসবে তার কাছে। নিভৃদদের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বলে উঠলেন,

–” একি নিভৃত বাবু যে। কি সৌভাগ্য আমার। তা এভাবেই বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি, আসুন ভেতরে আসুন।”

লোকটার কথায় ছোট্ট কুঠিরের ভেতরে এলো ওরা চারজন। ঘরটা ছোট, কাঠের তৈরি। ঘরের মেঝেটাও কাঠের। ছোট্ট সে ঘরে তেমন কোন আসবাবপত্র নেই। একখানা মাঝারি টেবিল, একটা কাপড় রাখবার আলনা আর একখানা ছোট্ট বিছানা। লোকটি নিভৃতদের তার সেই ছোট বিছিনায় বসার জন্য ইশারা করে বলতে লাগলেন,

–” এই গরিবের কুঠুরিতে আপনাদের স্বাগতম। আমি জানি আমার এই ছোট্ট ঘরটায় মানিয়ে নিতে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। এ কারনে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।”

ভদ্রলোকের কথার জবাবে নিভৃত বলল,

–” দয়া করে আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমারা ঠিক আছি। আপনি বরং আমাদের সাথে বসুন। আপনার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা ছিল আমাদে।”

লোকটি টেবিলের পাশ থেকে কাঠের চেয়ারটা টেনে নিভৃতদের সামনে বসলেন। স্থির দৃষ্টিতে নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–” আমি জানি আপনারা কেন এসেছেন আমার কাছে।”

নিভৃত অবাক হয়ে বলল,

–” আপনি জানেন?”

লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,

–” হুম জানি।”

–” তাহলে দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন।”

লোকটি এবার গম্ভীর মুখে বললেন,

–” ঠিক আছে, বলুন কি সাহায্য চান আপনারা?”

এইবার নিভৃতকে থামিয়ে নিলয় বলে উঠলো,

–” প্রথমে আপনার পরিচয় জানতে চাই। আপনি কে ? কোথায় থাকেন আর এই পাহাড়ি দুর্গম এলাকাতেই বা কেন এসেছেন আপনি?”

নিলয়ের কথা মৃদু স্বরে হেসে ফেলেন ভদ্রলোক। তারপর ধীর গলায় বলেন,

–” আপনার প্রশ্ন শুনে এতক্ষনে আপনাকি পুলিশ অফিসার বলে মনে হচ্ছে আমার। আসার পর থেকে আপনাকে অতিথি বলেই মনে হচ্ছিল। সে যাগ গে। আসল কথায় আসি। আমি সৌমিক চ্যাটার্জি। ঢাকার সুনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় আছি। তাই কর্মসূর্ত্রে এখন ঢাকাতেই থাকি। আমার গ্রামের বাড়ি ফেনী শহরে। প্রায় অনেক বছর থেকেই আমি নেকড়েদের উপর গবেষনা চালাচ্ছি। নেকড়েদের বিষয়ে অনেক অজানা তথ্যও জানি। এখানে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক খুনের কথা জেনেই এখানে এসেছিলাম। আগেই থেকেই অনুমান করেছিলাম যে এতে নেকড়ে মানব জড়িত। এখানে আসার পর এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত আমি।”

নিলয় সৌমিকের কথার ফাঁকে বলে উঠল,

–” আপনি এতটা নিশ্চিত হলেন কি করে যে, বরকলে ঘটে যাওয়া খুনগুলোর সাথে নেকড়ে মানবই জড়িত।”

সৌমিক চ্যাটার্জি হাসলেন। তারপর বলতে লাগলেন,

–” আচ্ছা নিলয় আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো, বরকল গ্রামের খুনগুলো কি তোমার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে? তোমার কি মনে হয় এমন বিভৎস,নির্মম হত্যাকান্ড কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব?

নিলয় ক্ষনকাল ভাবল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–” না।”

–” তাহলে এখন ভাবো মানুষ নাহলে এ কাজ কে করতে পারে?”

–” কোন বন্য প্রাণীও তো হতে পারে।”

–” হতেই পারে। তবে এখানেও কয়েকটা প্রশ্ন থেকে যায়।”

–” কি রকম?”

–” যদি খুনগুলো কোন বন্য প্রাণী দ্বারা হতো তবে ওরা পুরো গ্রামবাসীদের এভাবে মারতে পারতো না। দ্বিতীয় তাদের হত্যাকান্ড শুধুমাত্র বনের আশেপাশে হবার কথা কিন্তু ওরা বন থেকে দূরের শহরগুলোতেও আক্রমন করছে । কীভাবে? ”

কথাগুলো বলেই ভদ্রলোকটি সিগারেট জ্বালেন। মুখ দিয়ে ধুঁয়া ছেড়ে এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন নিলয়ের দিকে। মুখে তার ঈষৎ হাসি। নিলয় ভদ্রলোকের কথার জবাবে আর কিছু বলল না। শুধু মনে মনে অঙ্ক কষতে লাগল। এইবার নিভৃত বলে উঠলো,

–” স্যার আপনি নেকড়ে মানবের সম্পর্কে যা যা জানতেন যদি আমাদের বলতেন তবে বড় উপকার হতো।”

–” বেশ শুনো তবে। নেকড়ে মানবেরা খুবই হিংস্র হয়ে থাকে। পুরোনো পুথিতে বলা আছে যে, পূর্নিমার রাতে যদি কোন নেকড়ে মানব কোন স্বাভাবিক মানুষকে কামড়ায় তবে সে লোকটিও নেকড়ে মানবে পরিনত হয়। তবে সেসব নেকড়ে মানবের শক্তি প্রথম নেকড়ে মানবের থেকে কিছুটা কম হয়। নেকড়ে মানব শক্তিশালী হলেও তার দুর্বলতা রয়েছে। নেকড়ে মানবের দুর্বলতা হলো রুপোর তৈরী বুলেট। কেবল এই রুপোর তৈরী বুলেটেই ওকে মারা সম্ভব । তবে তা রাতের বেলা। কেননা দিনে ওকে তোমরা কোথাও খুঁজে পাবে না। পূর্ণিমার রাতে গহিন অরণ্যে পাবে ওদের।”

–” রুপোর তৈরী বুলেট ? এটা গড়তেও তো সময় লাগবে? এর মধ্যে ঐ শয়তানটা সব শেষ করে দিবে।”

–” রুপোর বুলেট তৈরি করতে সময় লাগবে। তবে প্রথমে অল্প কিছু বুলেট নিয়ে যেতে পারো। এই ধরো পাঁচশো বুলেট। কিন্তু সে জন্য আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।”

নিলয় বলল,

–” সে আমি ঠিক করে করে নিবো।”

–” তাহলে তো হলোই। তুমি আজকের মধ্যে আইনী কাজটা করে রেখো। আগামীকাল রুপোর বুলেট তৈরির কাজ শুরু হবে তারপর হবে ওদের সাথে মোকাবেলা। আমাকেও একটা জিনিস সংগ্রহ করতে হবে। ঐটা ছাড়া কিছু হবে না।”

–” কোন জিনিস?”

–” কিতাব।”

নিলয় উঠে দাঁড়ালো। তারপর ধীর গলায় বলল,

–” আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা তবে এবার আসি। অনেক কাজ বাকি।”

–” ঠিক আছে এসো। আমি আগামীকাল তোমাদের সাথে দেখা করবো ঠিক আছে। এসো এবার।”

নিলয়রা প্রফেসর সৌমিক চ্যাটার্জির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে নামতে লাগল। প্রফেসর সেদিক পানে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলেন তারপর নিজের ঘরের দরজা এঁটে খাটের নিচ থেকে একটা ট্রাঙ্ক বের করলেন। ট্রাঙ্কের মুখ খুলে ভেতর থেকে বের করে আনলেন এক সাদা রঙের পুটলি। পুটলির মুখ খুলতেই দৃষ্টিগোচর হলো এক পুরোনো ধুলো পরা পুঁথি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here