নেকড়ে_মানব,পর্ব:- ১৩

#নেকড়ে_মানব,পর্ব:- ১৩
#আমিনা_আফরোজ

জ্যোৎস্না প্লাবিত রাত। আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মত মেঘের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে পূর্নিমার গোল থালার ন্যায় রুপোলি চাঁদ। দক্ষিণা জানালার কাঠের শিক গলে অন্ধকার কুঠুরিতে ঢুকছে চাঁদের স্নিগ্ধ রুপোলি আলো। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো ঘরের ভেতরটা। ঘরের দক্ষিণা জানালা বরাবর টেবিলের কাছটায় এগিয়ে আসলো এক মানবমূর্তি। টেবিলের উপরে ঠিক মাঝখানটায় পুরোনো এক পুঁথি রাখল মানবমূর্তিটি। তারপর ক্ষনকাল নিরবতা। রুপোলি চাঁদের আলোর নরম স্পর্শ এসে আলতো করে ছুঁয়ে দিল পুঁথিখানা । এবার চাঁদের দিকে মুখ করে রুপোলি আলোতে পুঁথিখানা মেলে ধরলেন আগুন্তক। প্রায় কয়েক শতাব্দী পুরোনো এই পুঁথি। পুঁথির প্রতিটি পাতায় পাতায় লেখা আছে নানা অজানা তথ্য আর রহস্য। রাত বাড়ছে, সেই সাথে বদলে যাচ্ছে বাহিরে রহস্যময় প্রকৃতি। ধীরে ধীরে অশান্ত হয়ে ওঠছে সে। তান্ডব নৃত্য চালাচ্ছে সমগ্র নেকড়েটিলা জুড়ে। গুমোট হচ্ছে বাহিরের আবহাওয়া।

কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভেঙ্গেছে ডক্টর আয়মানের। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধের প্রভাবে সারাটা দিন প্রায় ঘুমিয়েই কেটেছে ওনার। সকালে নিলয়দের সাথে কথা বলার পরেই ঘুম পারানো হয়েছিল ওনাকে তাই সারাদিনে আর কারো সাথে কথা হয় নি ডক্টর আয়মানের। ডক্টর আয়মান চোখ তুলে দেয়ালের দিকে তাকালেন। দেয়ালের ঘড়িতে তখন রাত দুটো বাজে। চারিদিকে শুনশান, নিস্তব্ধ। হাসপাতালের প্রতিটি ঘরের বাতি নেভানো। নিস্তব্ধ পরিবেশ। কোথাও কোন প্রানের সাড়া নেই। ডক্টর আয়মানের দৃষ্টি মাথার উপরে ঘূর্ণায়মান সেলিং ফ্যানের দিকে। চোখদুটো খোলা। চোখে আপাতত ঘুমের কোন লেশ নেই ওনার। হঠাৎ ডক্টর আয়মানের কানে মৃদু শব্দ ভেসে এলো। শব্দটা অনেকটা দেয়ালে আঁচড় কাটার মতো। মনে হচ্ছে কেউ ধারালো কিছু দিয়ে দেয়ালে আঁচড় কাটছে। ডক্টর আয়মান খানিকটা দ্বিধায় পড়লেন। এত রাতে কে দেয়ালে আঁচড় কাটবে? তার থেকেও বড় কথা তার বেড সংলগ্ন দেয়ালে আঁচড় কাটতে আসবে কে ? প্রথমবার ডক্টর আয়মান ভাবলেন হয়তো এইটা ওনার মনের ভুল। আমরা যাকে “হ্যালুসিনেশন” বলি। এইসময় হ্যালুসিলেশন হওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দুর্বল শরীরে হ্যালুসিলেশন হতেই পারে। কিন্তু হ্যালুসিলেশন কি পরপর তিন-চার হয় ? নিজের মনকেই প্রশ্ন করলেন ডক্টর আয়মান।

ডক্টর আয়মানের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ বিকট শব্দ করে ভেঙ্গে গেলো ডক্টর আয়মানের বিছানা সংলগ্ন থাইগ্লাসটা। আকষ্মিক কাঁচ ভাঙ্গার ঝনঝন শব্দে সম্ভিত ফিরলো ডক্টর আয়মানের। তিনি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ঘুরে তাকালেন ভেঙ্গে যাওয়া জানালার দিকে। কিন্তু জানালার ওপাশটায় কাউকেই দেখতে পেলেন না। শুধু আকাশে পূর্ণিমার গোল চাঁদখানা দেখতে পেলেন তিনি। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে বাহিরটা। ডক্টর আয়মান এবার মুখ ফিরিয়ে আবারো তাকালেন মাথার উপরের সেলিং ফ্যানটার দিকে। কিছুক্ষণ আগে যে এতো বড়ো একটা অঘটন ঘটে গেল ওনার ঘরে তা নিয়ে যেন বিন্দুমাত্র চিন্তা হচ্ছে না ওনার। ডক্টর আয়মান যেন ডুবে আছেন অন্য এক ভাবনায়। ডুবে আছে নেকড়ে মানবের সেই গল্পটার মাঝে। মিনিট পাঁচেক পর ডক্টর আয়মানের মনে হলো ওনি যেন হাওয়ায় ভাসছেন। নিজেকে বড্ড হালকা মনে হলো ওনার। মাথার ওপরের সেলিং ফ্যানটাকেও বড্ড কাছে মনে হলো ডক্টর আয়মানের।
একসময় সেলিং ফ্যানটা দৃষ্টির বাহিরে চলে গিয়ে চোখে দৃশ্যমান হলো পূর্ণিমার রুপোলি গোল চাঁদ খানা। ঝিরিঝিরি মৃদু হাওয়ায় দুলছে ডক্টর আয়মানের শরীর। ডক্টর আয়মান এবার তাকালেন পাশের দিকে। দেখলেন লোমশ এক দৈত্যকার শরীর হেঁটে চলছে সামনের দিকে। দৈত্যকার লোমশ শরীরের সেই অদ্ভুত প্রাণীটির শক্ত হাতের মুঠোতেই বন্দি হয়ে আছেন ডক্টর আয়মান। এক নিমিষেই অজানা এক আতঙ্কে পাংশু হয়ে গেলো আয়মানের মুখখানা। মৃত্যু ভয় জেগে বসলো ওনার বুকের মাঝখানটায়। ছটপট করতে শুরু করলেন তিনি। ডক্টর আয়মানের ছটপট দেখে ঘুরে তাকালো প্রাণীটি। ইটের ভাঁটার মতো জ্বলছে প্রাণীটির দুখানা চোখ, হিংস্র পশুর মতো গর্জন করে দ্রুত গতিতে ছুটতে লাগলো সামনের দিকে। ডক্টর আয়মান তখনো ঝুলছে প্রাণীটির শক্ত হাতের মাঝে।

রাত তিনটে চল্লিশ। হাসপাতালের করিডরে দাঁড়িয়ে আছে নিলয়। সাথে নিভৃত আর রমজান মিয়াও আছে। আজও নাইট ডিউটি ছিল নিলয়ের। তাই সেই সুবাদেই আজকেও নিলয়কে থানাতেই থাকতে হয়েছে। হঠাৎ দুটো কুড়িতে নিলয়ের ফোনে কল আসে মিস নিলার। কল রিসিভ করে পুরো ঘটনাটা শুনে মিনিট পাঁচেক চুপ করে বসে ছিল নিলয়। এমন ঘটনার সম্মুখে জীবনে আর কখনো পড়ে নি ও। এমন অবস্থায় কি করা উচিত তা ভেবে পেলো না নিলয়। তাই কল দেয় নিভৃতকে। নিভৃতের উপস্থিত বুদ্ধি প্রকট‌। যেকোন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে সঠিক সিন্ধান্ত নিতে পারে ও। নিলয়ের কাছ থেকে ঘটনা শুনেই নিভৃতই নিলয়কে গাড়ি তৈরি রাখতে বলে । তারপর মিনিট কুড়ির মধ্যেই তিনজন মিলে বেরিয়ে পড়ল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। হাসপাতালে পৌঁছেই নিলয়রা প্রথমেই চলে এলো স্পটে। মাঝারি ঘরের ভেতরটা আগের মতোই সাজানো আছে। একমাত্র থাইগ্লাসটা ছাড়া আর কোথাও ভাঙচুরের চিহ্নমাত্র নেই‌ । শুধুমাত্র বিছানাটা ফাঁকা।মানুষটা যেন হাওয়ায় উবে গেছে নিমিষের মাঝে। নিলয় আর নিভৃত দুজনেই বেশ খুঁটিয়ে দেখল ঘরটা কিন্তু কোন সন্দেহজনক কিছুই পেল না ওরা। জানালার ভাঙ্গা থাইগ্লাসটার কাছে গিয়ে দূর সীমান্তে দৃষ্টি ফেলল নিলয়। বাহিরেও কোন সন্দেহ জনক কিছু খুঁজে পেলো না। হতাশ হয়ে এইবার নার্সকে জেরা করা শুরু করল।

–” তো মিস….

–” জি নিলা রহমান আমার নাম।”

–” জি জি মনে আছে আপনার নাম। তো আপনি ঠিক কখন দেখলেন যে ডক্টর আয়মান অর্থাৎ রুগী তার ঘরে নেই?”

–” আসলে আজ আমার নাইট ডিউটি ছিল। তাই হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে আমাকে। রাতে সবার বেডে রাউন্ট শেষ করে আমি গিয়েছিলাম একতলার ১৬ নম্বর রুমে। সেখানকার একজন রুগী খুব গুরুতর অসুস্থ। সেই রুগীর সেবা শুশ্রূষার তত্ত্বাবদায়নে আমিই ছিলাম। তো রাত আনুমানিক দুইটা বিশ-ত্রিশ মিনিটে আমি একটা চিৎকারে ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে আসি । তারপর শব্দ অনুসরন করে এ ঘরে এসে দেখি রুগী উধাও‌ । বিছানা, ফল ঔষধ সব সেভাবেই পড়ে আছে শুধু রুগী নেই। ”

নার্স নিলা নামের মেয়েটির কথা শুনে নিলয় আবারো চুপ করে রইল। তাই এবার নিভৃত নিজেই প্রশ্ন করল নার্সটিকে। বলল,

–” আচ্ছা মিস নিলা রহমান যখন এই ঘটনাটা ঘটে ঠিক সেই সময় আপনি কি কোন শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন? দেখুন ঘরের থাই গ্লাসটাতো ভাঙ্গা । এর অর্থ আততায়ী এই থাই গ্লাসটা ভেঙ্গেই ঘরে ঠুকেছে । এ নিয়ে তো কোন সন্দেহ নেই। আর আপনিও বলছেন রাতে ডিউটিতে ছিলেন তো স্বাভাবিকভাবেই কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ আপনার শুনতে পাওয়ার কথা। একটু ভেবে বলবেন?”

নিলা নামের মেয়েটি নিভৃতের কথা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল,

–” না , আমি কোন কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ পাই নি তবে চিৎকার শুনেছি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল চিৎকারটা জানালার ওপাশ থেকে আসছিল। ”

–“ঠিক আছে। আর কেউ কি শুনেছিল সেই চিৎকার?”

–” আমরা কয়েকজন নার্স আজ রাতে ডিউটিতে আছি। আমার মনে হয় আমার মতো তারাও শুনেছে।”

–” ওনাদের ডাকুন তবে, জিঙ্গাসাবাদ করতে হবে ওনাদের।”

নিলা রহমান আর কোন কথা না বলে নিঃশব্দে বাহিরে চলে গেল। ঘরে মাত্র তিনজন প্রানী। নিভৃত,নিলয় আর রমজান মিয়া। নিভৃত ঘরের চারিদিকে পুনরায় দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে গেল জানালার দিকে। জানালার বাহিরের দিকটা কিছুটা অন্ধকার। বুনো লতা পাতায় ঝোপালো। তার থেকে কিছুটা দূরেই ঘন বন। বন্যার নাম নিভৃত জানে না। কি একটা ভেবে নিভৃত নিলয়কে বলল,

–” চল, এই সমস্যার সমাধান একজনই করতে পারবে। আমাদের সেখানেই যেতে হবে। ”

নিলয় এতক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবছিল। নিভৃতের কথা শুনে বলল,

–” কে?”

–” সৌমিক চ্যাটার্জি। এই লোকটা ডক্টর আয়মানের বিষয়ে সবটা জানে। ”

নিভৃতেই কথা শুনে নিলয়ের মনে এই প্রথম সৌমিক চ্যাটার্জির নামটা উদয় হলো। এই নামটা নিলয়ের মাথা থেকে একপ্রকার উধাও হয়েই গিয়েছিল ঠিক ডক্টর আয়মানের মতো। নিলয়েরও মনে হলো লোকটা সব জানে । তাই বাকিদের জেরা করার দায়িত্বটা রমজান মিয়ার ওপর দিয়ে দুই বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লো সাজেক ভ্যালির সেই ছোট্ট কামড়ার বাড়িটার উদ্দেশ্যে। ঐখানেই মিলবে ওদের সব প্রশ্নের উত্তর।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here