নিরুদ্দেশ ২য় খন্ড,অন্তিম পর্ব
জীবনে কি হতে চেয়েছিল, আর কি হয়েছে? স্বামী মারা গেলেও পেছনে ফিরে আসেনি লতা। লড়াই করেছে। নিজের সবটুকু দিয়ে ছেলেকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে। ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু ছেলে কী করলো? শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবলো! একবারের জন্যও পেছনে ঘুরে মায়ের কথা ভাবলো না। ছেলে তো ছোটবেলা থেকে বাবা বাবা করে বেড়ায়। মায়ের মুল্য তার কাছে কখনই ছিল না। আজ বা থাকবে কেন? কেউ বুঝলো না তাকে। এ পৃথিবীতে যে মানুষটা তাকে বুঝতো ঈশ্বর সর্বপ্রথম তাকে কেড়ে নিয়েছেন। অভাগার কেউ নেই। চারিদিকে শুধু মরীচিকা। এই বয়সে মানুষের উপর কি আর রাগ হয়? অভিমান জন্ম নিতে পারে? নিজের বাড়িতে নিজেকে মূল্যহীন মনে হয়। তাই কারোর প্রতি কোনো অভিযোগ না রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে তো এসেছে, কিন্তু এখন কোথায় যাবে? বাবা-মার কাছে? তাই ভালো। নিজের বাড়িতে পৌঁছে হতাশ হলো। বাবা-মা কেউ নেই। অনেক বছর আগে মারা গেছেন। স্বাভাবিক বিষয়। এত বছর বেঁচে থাকার কথা নয়। তবুও বিষয়টি কেন মাথায় আসলো না? চোখ দুটো ভিজে গেল। বাবা-মার মৃত্যুসংবাদ কেউ তাকে দিল না? একবার অন্তত জানাতে পারতো। কেন জানাবে? বিয়ের পর সে কি একবারের জন্যও বাবা-মার খোঁজ করেছিল? করেনি। তাহলে তারা কেন করবে? শেষ জীবনে এসেও লতা কারোর উপর আশা প্রত্যাশা রেখেছে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠলো। যে হাসি সচরাচর দেখা যায় না। যতই ভাবুক কারোর প্রতি কোনো আশা-প্রত্যাশা রাখবে না। তবুও আপনি-আপনি আশা-প্রত্যাশা তৈরি হয়ে যায়। আশা-প্রত্যাশা না নিয়ে হয়তো জীবনে এগোনো যায় না। এগুলো আছে বলে মানুষ কষ্ট পায়। আর কষ্ট মানুষকে শিক্ষা দেয়। একটু খোঁজ নিয়ে জানলো তাদের বাড়িতে অনেকদিন থেকে কেউ নেই। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর এ বাড়ির সকলে অন্য কোথাও চলে যায়। তাদের আর দেখা যায়নি। বছরে একবার কিংবা দু-বার আসে। কিছু দিন থেকে আবার ফিরে যায়। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ঠিকানা চাইলে হয়তো পেতে পারতো কিন্তু লতা চাইলো না। বাবা-মা তো নেই। অন্যদের কাছে গিয়ে কি হবে? নিজে থেকে সরে এলো। একটু খেয়াল করে দেখলো তার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। বাবা-মা চলে গেছে। ছেলে পর হয়ে গেছে। তার আর কেউ নেই। আপন বলতে শব্দটি আছে শুধুমাত্র। তবুও তার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। কোনো ভয় হচ্ছে না। হয়তো সবকিছু সয়ে গেছে। বারবার চোখের সামনে ময়ূরের মুখমন্ডল ভেসে উঠছে। সে কি করে করতে পারলো? মায়ের কথা একবারও ভাবলো না। একবারও ভাবলো না মায়ের জীবনটা কিভাবে কেটেছে? শেষ জীবনে একটু শান্তি পেলো না। হাঁটতে হাঁটতে সে অনেকটা পথ চলে এসেছে। কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না। যেদিকে মন চায় সেদিকে চলে গেল। তার হুঁশ ফিরল রেল গাড়ির শব্দ শুনে। আশেপাশে কোথাও রেলস্টেশন রয়েছে। সে সেদিকেই গেল। মেচেদা রেলওয়ে স্টেশন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। ট্রেনে উঠে দূর-দূরান্তে চলে যাবে। ফিরেও এদিকে আর কখনো আসবে না। কখনো নিজের ছেলের সামনে দাঁড়াবে না। থাকুক তাদের সংসার নিয়ে। কারোর সংসারে বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। আবার চিন্তা হলো, তার ছেলে মাকে ছাড়া থাকতে পারবে তো? সে যে ছোট। অনেক কিছুই জানে না। তাকে তো শিখিয়ে দিতে হবে। বাবার কথা মনে পড়লে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তখন তাকে সান্ত্বনা কে দেবে? বাবার কথা মনে পড়লে খাবার খায় না। এত বড় ছেলেকে খাবার খাইয়ে দিতে হয়। নিজের যত্ন নিতে পারবে তো? ভয় হল। তবুও ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করল না। মনকে শক্ত করে তুলল। তার কাছে টিকিট নেই। কোথায় যাবে? তার আবার টিকিট দরকার নাকি? তার তো কিছুই নেই। পরের ট্রেন আসতে ট্রেনে উঠে পরল। দেখলো না ওটা কোথায় যাচ্ছে। কামরার মধ্যে ঠাসা লোক। ভিড় অতিক্রম করে ভেতরে যাওয়ার মতো শক্তি নেই। তাছাড়া তার তো সিট নেই। ভেতরের দিকে গিয়ে কি হবে? বাইরেই ঠিক রয়েছে। আরও কিছুটা সময় পর খেয়াল করলো কামরার ভেতরে অনেক মানুষ দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় কথা বলছে। ট্রেন যে দক্ষিণ ভারতের দিকে যাচ্ছে তা আর বুঝতে অসুবিধা হলো না। দূরপাল্লার ট্রেন দীর্ঘ যাত্রার ব্যাপার। প্রায় দুদিন ধরে ট্রেনে বসে থাকতে হবে। বড় করুন অবস্থা। ঘন্টা চারেকের বেশি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না লতা। একটু ফাঁকা হতে ভেতরের দিকে গেল। না ভেতরে কোনো বসার জায়গা নেই। সবার রিজার্ভেশন টিকিট। তাদের জায়গায় সামান্য বসতে কেউ দিল না। ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে লতার। খুব ছোটবেলায় দূরপাল্লার ট্রেনে চড়ে ছিল। তখন নিজেদের রিজার্ভেশন টিকিটে কাউকে বসতে দিত না। আজ অন্যরা তাকে কেন বসতে দিবে? নিরুপায় হয়ে আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে এলো। বাথরুমের পাশের কোনোরকম বসে পড়লো। সেখানেও থাকার উপায় নেই। বারবার মানুষ নামছে উঠছে। তাছাড়া রয়েছে বাথরুমের দুর্গন্ধ। সহ্য করতে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে। একে ঘুমহীন ক্লান্ত শরীর কোনো খাবার নেই তার ওপরে দুর্গন্ধ। সবটা মিলিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে সে। আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। নিজের মৃত্যু কামনা করলো। ট্রেন থেকে নামলো তৃতীয় দিন ভোরে। স্টেশনে বেশিক্ষণ রইল না। বাইরে বেরিয়ে এলো। হালকা শীত করছে। বাংলায় গরম থাকলেও এখানে সবসময় শীত থাকে। তাছাড়া ট্রেনে ঠান্ডা বাতাস গায়ে লেগেছে। একটু বেশি শীত লাগছে তাকে। শীতের বস্ত্র নেই। হাতে মাত্র কয়েকটা টাকা আছে। ওই টাকা দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এতদূর তো চলে এলো। এবার কোথায় যাবে? রোডের ও-পাশে এক যুবক ইডলি আর ধোসা বানাচ্ছে। খুব লোভ হলো। ছোটবেলায় কত খেয়েছে। বর্তমানে পেটের খিদেও খুব জোরালো। লোভ সামলাতে পারল না। হাতে কয়েকটা টাকাও আছে…
দুদিন ধরে মাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছে ময়ূর। আশানুরূপ কিছু করতে পারেনি। মাকে হারিয়ে ফেলেছে সে। সকালে উঠে আবার বেরলো মাকে খুঁজতে। দুপুরে খালি হাতে ফিরে এলো। মাকে হারিয়ে আর কোনো কিছুতে মন নেই তার। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এভাবে মা যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সে কখনো বুঝে উঠতে পারেনি। মাকে দেখে মনে হয়েছিল তার বিয়ে মেনে নিয়েছে। কিন্তু বুকের মধ্যে অভিমানটা বুঝতে পারেনি। বাড়িতে এসে যখন পোশাক-আশাক বদলে বসে পড়ল তখন তাকে বড় উদাস লাগলো। সুমিত্রা কাছে এসে বসলো। কী বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারল না। কাঁধে হাত রাখল। ময়ূর ঘুরে সুমিত্রাকে দেখলো। চোখ দুটো ছলছল করছে। মুখে লাবণ্য ভরপুর। চোখের নিচে কালি জমেছে। ঘর্মাক্ত শরীর। তাকে গ্রীষ্মের তীব্র রোদে দীর্ঘ পথ হাঁটা পথিকের মতো দেখালো। সুমিত্রা শান্তকণ্ঠে বলল,’এত দুশ্চিন্তা করছো কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুদিন অপেক্ষা করো।’
‘কিচ্ছু ঠিক হবে না সুমিত্রা। আর কোনোদিন কিচ্ছু ঠিক হবে না।’
‘এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। তুমি যদি ভেঙে পড়ো তাহলে মাকে কি করে খুঁজবে?’
‘তুমি আমার মাকে কতটুকু জানো।’
‘যতটুকু বলেছো ততটুকু।’
‘তাহলে? এমন প্রশ্ন আর করো না। মা ছোটবেলা থেকে কিচ্ছু পায়নি। নিজের জন্য কিছু চায়নি। আমাদের জন্য সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে। আর আমি কি করলাম? আমার বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতো। চোখের আড়াল হতে দিত না। নিজের চিকিৎসা না করিয়ে আমার ভবিষ্যতের জন্য টাকা রেখে গিয়েছিল। আর আমি! বাবার সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে কষ্ট দিলাম। আমার ঈশ্বর আমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না। কতটা স্বার্থপর আমি।’
‘এভাবে বলো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দুইজনে মিলে মাকে ঠিক খুঁজে বের করবো।’ ময়ূর হেসে উঠলো। বিদ্রুপ হাসি মাখা কন্ঠে বলল,’সম্ভব নয়। আমার মা খুব অভিমানী। মায়ের বাবা-মা মায়ের বিয়ে মেনে নিয়েছিল না। পালিয়ে বিয়ে করেছিল। তারপর বাবা কত চেষ্টা করেছিল মাকে বাপের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। একবার মুখোমুখি হতে চেয়েছিল। বাবা বিশ্বাস করতো,তারা সবাই একসাথে মুখোমুখি হলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। মা কখনো রাজি হয়নি। যেখান থেকে একবার ফিরে এসেছে সেখানে কখনো দ্বিতীয়বার ফিরে যায়নি। এরপরও কি মনে হয় মা ফিরে আসবে? কখনো আসবে না।’ সুমিত্রা চুপ করে গেল। নতুন বিয়ে হয়েছে। এই মুহূর্তে তাদের কত আনন্দ হওয়ার কথা। সুন্দর সময় কাটানোর কথা। কিন্তু এসব কি হচ্ছে? কাউকে কষ্ট দিয়ে কখনো ভালো থাকা যায় না। এটাই যেন তার দৃষ্টান্ত। খুব খারাপ লাগল তাদের। নিস্তব্দে কেটে গেল আরও কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর সুমিত্রা বলল,’এভাবে বসে থাকবে? খাবার খাবে এসো।’ ময়ূর মাথা নাড়াতে সুমিত্রা উঠে গেল। খাবার বাড়লো। খেতে বসে বসে ময়ূর বলল,’অনেকদিন ধরে কাজে যাওয়া হচ্ছে না। কত কাজ পড়ে রয়েছে। আমাকে আবার শহরে ফিরতে হবে।’
‘কবে যাচ্ছো?’
‘কয়েক দিনের মধ্যেই চলে যাবো।’
‘আমি এখানে একা থাকবো তো?’ ময়ূর স্ত্রীর দিকে তাকালো। কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। লাবণ্যময়ী মুখশ্রী দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারল না। বড় কষ্ট হল। সে যেন সবাইকে কষ্ট দিয়ে চলেছে। একদিকে মা অন্যদিকে স্ত্রী! তার যে দুজনকে প্রয়োজন। কিন্তু দু’জনে দুই মেরুর মানুষ। দুজনের মিল হওয়া অস্বাভাবিক। শান্ত কন্ঠে বলল,’না, এখানে একা থাকতে হবে না। আমার সঙ্গেই যাবে।’ ময়ূর যেন মন থেকে বলল না। সুমিত্রা তাই বলল,’থাক না। আমি এখানে একা থেকে যেতে পারবো।’ ময়ূর জবাব দিল না। বুঝতে পারল তার স্ত্রী অভিমান থেকে বলছে কথাগুলো। কি করবে কি করবে না কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। মায়ের কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। খাবার খেতে পারল না। উঠে চলে গেল। ঠাঁয় ভাবে বসে রইল সুমিত্রা। সেও খাবার খেলো না। সব পুকুরে ফেলে দিল।
পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নামছে। চারিদিকে হালকা অন্ধকার। বৃষ্টির পূর্বাভাস দেখা দিচ্ছে। দ্রুত গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে এগিয়ে আসছে এক ভদ্রলোক। তাকে দেখলেই বোঝা যায় ভীষণ ব্যস্ত সে। হয়তো কোনো কাজে তাড়া রয়েছে। নয়তো কাজ সেরে দ্রুত বাড়িতে ফিরছে। কেউ হয়তো তার অপেক্ষায় আছে। কিছুটা আশার পর তার মোটরসাইকেলের গতি কমলো। ফুটপাতের দিকে তাকালো। সকালে কাজে যাওয়ার সময় এই ভদ্রমহিলাটিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে গেছে। ফেরার সময়ও তাকে দেখতে পেল। তবে এবার সে বসে নেই শুয়ে পড়েছে চাদর মুড়ি দিয়ে। মহিলাটি কে? বড় করুণা হল তার। ফুটপাথে কত মানুষ পড়ে থাকে। তাদের দিকে কে বা তাকায়! তবে ভদ্রলোকটির খুব দয়া হল। মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে মহিলাটির কাছে গেল। কি বলবে ভেবে পেল না। যদি বৃষ্টি আসে তাহলে সারা রাতে তাকে ভিজতে হবে। কি যে অবস্থা। তাকে দূ-একবার ডাকার পরও সাড়া দিল না। এবার তার মাথায় হাত দিয়ে নাড়ালো। লতা বিরক্ত প্রকাশ করলো। এদেশে ফুটপাতেও কি শান্তি নেই? কেউ না কেউ এসে ঠিক বিরক্ত করছে। ভালো লাগছে না। কারোর ক্ষতি করেনি তবুও কেন বিরক্ত করছে মানুষ! নড়েচড়ে বিরক্তভাব তীব্রভাবে প্রকাশ করল। চাদরের আবরণ থেকে বেরিয়ে এলো মলিল মুখশ্রী। চোখ মেলে ভদ্রলোকটিকে দেখলো। দুজনে চমকে উঠলো। একে অপরের থেকে চোখ ফেরাতে পারলো না। এক অন্যরকম খুশি জেগে উঠলো মনে। সবকিছু ঠিক দেখছে তো? লতা আমতা আমতা করে বলল,’সংকেত! তুমি?’
সংকেত কথা বলতে পারলো না। একটু সংযত বোধ করলো। তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো। কাছে বসে বলল,’বৌঠান, তুমি! এখানে! এভাবে!’ লতা কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারল না। অদ্ভুত ভাবে সাক্ষাৎ হয়েছে। এভাবে তো দেখা হওয়ার কথা ছিল না। এত বছর পর দেখা হলেও চিনতে অসুবিধা হয়নি। সংকেত সম্পূর্ণ বদলে গেছে। নিয়মিত শরীরচর্চা করার তার শরীরে এখনো বার্ধক্যের আঁচ কাটেনি। তবে বয়স হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। মাথায় সাদা কালো চুলে ভর্তি। বড় করে গোঁফ রেখেছে। লতা মৃদু স্বরে বলল,’সে-ই রাতে যে হারিয়ে গেলে। আর খুঁজে পাওয়া গেল না। আমরা সবাই মিলে তোমার কত খোঁজ করেছি জানো! কোথাও তোমাকে পাইনি।’
‘বৌঠান, আমি বুঝতে পারছি না তুমি এখানে কি করে এসেছো। এই মুহূর্তে শোনার মতো সময়ও নেই। এখন তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে চলো। এভাবে রাস্তায় কেন?’ লতা যেতে চাইলো না। কারোর দয়ায় থাকতে চায় না। সংকেত না নিয়েও যাবে না। অনেক পীড়াপীড়ি করার পর লতা রাজি হলো। সংকেত তাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে গেল।
বেশ ছোট একটা পাকা বাড়ি। চারিদিকে গাছগাছালিতে ভর্তি। বেশ নির্মল জায়গা। এখানে আরও বেশি শীত অনুভব করলো। শহরের বুকে এমন একটা জায়গা দেখে বুকটা উৎফুল্লতায় ভরে উঠলো। একদম গ্রাম্য বাড়ির মতো বাড়ি। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। দেখে মনে হলো এই বাড়িতে অনেক মানুষজন রয়েছে। যারা সবসময় বাড়ির দেখাশোনা করে। তবে কি সংকেত আবার বিয়ে করেছে? এটা কি করে সম্ভব? তৃধাকে সহজে ভুলতে পারবে না। তবুও নতুনভাবে জীবন শুরু করাটা অস্বাভাবিক নয়। ভেতরে লতাকে বসতে বলে সংকেত কোথায় চলে গেল। সে খেয়াল করে দেখল বাড়ির মধ্যে একটা বড় ছবি রয়েছে যেখানে সবুজ সংকেত আর সূর্যময় আছে। স্বামীকে দেখে চোখ দুটো আবার ভিজে গেল। সংকেত বন্ধুদের কত ভালবাসে ! তার সবকিছু জুড়ে রয়েছে বন্ধু। অনেকক্ষণ বসার পরও কাউকে আসতে দেখলো না। বাড়িতে কোনো কোলাহল নেই। সংকেত যদি সত্যি সত্যি বিয়ে করে থাকে তাহলে কাউকে না কাউকে দেখাতে পারতো। কিন্তু কেউ নেই। কিছুক্ষণ পর সংকেত শরবত নিয়ে এলো। লতা হেসে উঠলো। বলল,’আমি কি অথিতি? এসবের কি দরকার?’
‘অথিতি তো নও। কিন্তু শরীর ঠিক থাকবে।’ লতা পান করলো। সংকেত বলল,’তুমি বিশ্রাম করো। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি। সারাদিন কাজ সেরে রাতে আর রান্না করি না। খাবার কিনে আনি।’ লতা বাধা দিল। বাড়িতে যেগুলো আছে সে-গুলোই খেয়ে নেবে। খাবার আনার প্রয়োজন নেই।
‘টাকা-পয়সার ভয় পাচ্ছো? একা মানুষ। আমার টাকাপয়সার কি হবে? খরচ করলে কিচ্ছু হবে না।’ সংকেত বিদায় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল পেছন থেকে লতা ডাকায় দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল,’একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’ মাথা নাড়তে বলল,’তুমি আর বিয়ে করোনি?’
‘তোমার কি মনে হয়?’
লতা হেসে উঠলো। প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে ফিরে এলো। সঙ্গে তার জন্য দুটো শাড়ি এনেছে। তার পরার জন্য কিছু ছিল না। সংকেত খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরে গেছে। লতার খুব খারাপ লাগলো। এভাবে অন্যের উপর নির্ভর হতে চাইল না। আবার মুখের উপর কিছু বলতে পারলো না। সে ভাবল সংকেত হয়তো জিজ্ঞেস করবে, এখানে কি করে এলো? সূর্যময় কেমন আছে? কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। বাড়িতে দুটো ঘর রয়েছে। একটা ঘরে লতার জন্য বিছানা তৈরি করল।
‘বৌঠান তোমার মনে হয়তো অনেক প্রশ্ন জাগছে। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার শরীর তো ভীষণ ক্লান্ত। তুমি খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক সময় আছে পরে সব শুনবো।’ ক্লান্ত শরীরে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না লতা। খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিন্তু ঘুম এলো না। নানা চিন্তা মনে বাসা বেঁধেছে। সংকেত কত বদলে গেছে। কতগুলো বছর একা রয়েছে। কেউ নেই। শুধুমাত্র স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে রয়েছে। বদলে যায়নি সে। একা কিভাবে বাঁচা যায় তার কাছে শেখার আছে। তার সহজ সরল ব্যবহার সকলের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা আজও অটুট রয়েছে। সে বদলে যায়নি। এত বছর পর বৌঠানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। মায়ের মতো স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করছে। ঘুম ধরতে অনেক রাত হয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠে জানালার দিকে চোখ রাখতে দেখতে পেল বড়ো একটা সূর্য উঠেছে। চতুর্দিকে আলোয় ঝলমল করছে। সংকেত অনেক আগে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। গাছে জল দিচ্ছে। লতা বিছানা ছেড়ে উঠে পরলো। নিজেকে অনেকটা ফ্রেশ লাগছে। ভালো লাগছে। নিজের ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়েছে। বাইরে বেরিয়ে এলো। লতাকে দেখে সংকেত বলল,’কেমন লাগছে নতুন দেশ?’
‘মন্দ নয়। কিন্তু আমার অনেক কিছু জানার আছে।’
সংকেত লতার দিকে তাকিয়ে হাসলো। কি আর জানতে চাইবে? সে কেন সবাইকে ছেড়ে দূরে রয়েছে? বন্ধুদের সাথে কেন যোগাযোগ করেনি? কেন নিজের বাড়িতে ফিরে যায়নি? সংকেতের কাছে আহামরি তেমন কোনো উত্তর নেই। লতা হয়তো ভেবে নিয়েছে সংকেত কি উত্তর দেবে। সংকেতের ভাবনার মতো লতা প্রশ্নগুলো করলো। সংকেত যথাযথ জবাব দিল। সে জীবনে সবচাইতে বেশি ভালবাসতো নিজের বন্ধুদের। তাদের মধ্যেই একজন তার জীবনটাকে নরক করে দিয়েছে। নষ্ট করে দিয়েছে সব কিছু। মানতে পারছিল না। খুব রাগ হচ্ছিল। কিন্তু ভালোবাসার কাছে তার রাগ হেরে গেছে। পারেনি বন্ধুকে শাস্তি দিতে। পারেনি বন্ধুকে ক্ষমাও করতেও। তার সর্বনাশের কথা ভাবতেই পারে না। তাই নিরবে সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল পুরনো কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা করবে না। পুরনো কোনো স্থানে ফিরে যাবে না। স্মৃতিগুলো তাকে বাঁচতে দেবে না। তীব্র অভিমানে ঘর ছাড়ে। চলে আসে দক্ষিণ ভারতে। প্রায় দু-বছরের মতো মানসিক ভারসাম্যহীন ভাবে বেঁচে ছিল। তারপর একটু একটু করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। নিজেকে শক্ত করেছে। একটা কাজ জোগাড় করেছে। তারপর স্মৃতি আঁকড়ে কাটিয়ে দিয়েছে একটার পর একটা বছর। বিয়ে করা আর হয়নি। তৃধাকে ছাড়া কাউকে কল্পনাতে আনতে পারে না বাস্তব তো অনেক দূরের। কাউকে আর গ্রহণ করেনি। একাকী ভাবে কাটিয়ে ফেলেছে অনেকগুলো বছর। আগে অনেক কষ্ট হতো। এখন আর কষ্ট হয় না। দিব্যি আছে। দীর্ঘ বক্তব্য রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সংকেত। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানতে চাইলো লতার কাহিনী। জীবনে কি এমন ঘটে গেল যে তাকে পথে নেমে আসতে হলো। লতা প্রথমে মুখ বিকৃতি করে হাসলো। তার জীবনে তেমন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেনি। শুধুমাত্র স্বামী ছাড়া আর কারোর কাছে মাথা নিচু করতে শেখেনি। মূল্যহীন ভাবে বেঁচে থাকার মেয়ে সে নয়। তাই তার জীবনে এমন করুণ পরিণতি নেমে এসেছে। সংক্ষেপে সংকেতের চলে আসার পর সমস্ত ঘটনা সংকেতের সামনে তুলে ধরলো। সংকেত বেশি অবাক হলো না। শুধু নীরবে দূরে সরে গেল। চোখ থেকে জল ঝরে পড়লো। লতা বাধা দিল না। কাঁদতে দিল। ছেলেটা কান্না করুক। তার কান্নার প্রয়োজন আছে। নিজেকে হালকা করুক। সবকিছু শুনে খুব একটা অবাক হইনি সংকেত। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। জানতে পেরেছিল বন্ধুর ক্যান্সার হয়েছে। বেশিদিন বাঁচবে না। এতদিন পর যখন বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছলো তখন তো তার চোখে জল আসবে। অঝোরে কেঁদে গেল কয়েক মিনিট। মনে পড়ে গেল কিছু রঙিন মুহূর্ত। অগ্রহায়ণের শেষে নতুন ধান বাড়িতে উঠে এলেও তাদের আর দেখা হবে না। গ্রীষ্মে গরমের ছুটি পড়বে কিন্তু একসঙ্গে পুকুরে সাঁতার কাটা হবে না। একে অন্যের কথা বহুবার ভাববে তবুও একবারের জন্য কাছাকাছি বসে গল্প হবে না। দূরে থেকে তাদের মঙ্গল চাইবে কিন্তু কাছে থেকে তাদের ভালো রাখতে পারবে না। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিল। চোখের জল মুছে লতার কাছে আবার ফিরে এলো। হাসিমুখে বলল,’তোমার সূর্যময়ের কথা মনে পড়ে? কষ্ট হয় না!’
‘ হয় তো। কখনো কখনো মন ভীষণ ভারী হয়ে যায়। মনে হয় আমার সঙ্গে কেন এমন হলো! কিন্তু পরের সামলে নিই। আমার মতো এমন কত মানুষের সঙ্গে হয়। সবকিছু কি আর ভাবলে চলে? সব তো আর মনের মতো হয় না। মনের মতো সবকিছু হলে স্বর্গে আছি মনে হবে। কিন্তু আমি তো স্বর্গে নেই।’
‘আসলে কি জানো বৌঠান, পুরো জীবনটা একটা বইয়ের অধ্যায়ের মতো। কোনো অধ্যায়ের প্রথম অংশ পড়তে তো ভালো লাগে তারপর শুরু হয় বিষন্নতা। সবকিছুই কঠিন লাগে। টেনেটুনে কোনোরকম ভাবে শেষ করে ফেলি। তারপর শেষে আসে অনুশীলনী। অনুশীলনী করতে গিয়ে আমাদের আবার পেছন ফিরতে হয়। ছেড়ে যাওয়া অংশগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হয়। তাদের অর্থ খুঁজে বের করতে হয়। প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় মনে হয় যদি অধ্যায়টা ভালো করে পড়তাম তাহলে আজ অনুশীলনী গুলো খুব সহজে হয়ে যেত। এত পরিশ্রম করতে হতো না। আবার কিছু প্রশ্নের উত্তর ওই অধ্যায়ের মধ্যে পাওয়াও যায় না। আমাদের জীবনটাও কিন্তু একটা বইয়ের অধ্যায়ের মতো। জীবনের প্রথম দিন গুলো খুব হাসি খুশিতে কাটিয়ে ফেলি। তারপর জীবনের একটা পর্যায়ে একাকীত্ব চলে আসে। ঝামেলায় জর্জরিত হয়ে পড়ি। কোনো কিছু ভালো লাগে না। কখনো অলস ভাবে, আবার কখনো ভ্রমণ করে, আবার কখনো ব্যস্ত শহরে হারিয়ে জীবন কাটিয়ে ফেলি। নিজে কি করলে খুশি হবো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় পরিবারের সদস্যরা কোনটাতে খুশি থাকবে সেটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তারপর আসে শেষ জীবন। মাথায় উঁকি দেয় অজস্র প্রশ্ন। সে-সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের আবার জীবনের প্রথমের দিকে ফিরে যেতে হয়। তখন মনে হয় ওটা এমনটা, সেটা তেমনটা না করলে ভালো হতো। জীবনটা আরও অনেক সহজ হয়ে যেত। কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকে না, যা হওয়ার তা অনেক আগে হয়ে গেছে। আবার কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। আমি তৃধাকে খুব ভালোবাসতাম। সেও আমায় খুব ভালোবাসতো। কিন্তু আমি কখনো তাকে প্রশ্রয় দেইনি। কখনো তার আবেগ অনুভূতি তার ভালোলাগা খারাপলাগাকে গুরুত্ব দেইনি। সবটা ছিল আমি। আমি মানে আমি। আর কেউ নেই। এই ছোট ছোট দিক গুলোই আমাদের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কাছাকাছি থেকেও অনেক দূরে ছিলাম। আমি ওকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসতাম। কিন্তু কখনো বলতে পারিনি। এ যে আমার জীবনে বড় আফসোস। এখন মনে হয় কেন বললাম না? বলে দিলে কি ক্ষতি হতো? আমার কাছে উত্তর নেই। অনেক খুঁজেও এর উত্তর পাই না। হয়তো কোনোদিন পাবো না।’
‘সংকেত, পুরনো দিনের কথা ভেবে নিজেকে আর ভারী করো না। এগিয়ে চলো।’ সংকেতের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। একটু অসংযতভাবে বলল,’তুমি কি করবে বলো? কোথায় যাবে?’
‘আমি কিচ্ছু জানি না। যা মন চায় তাই করবো।’ সংকেত চুপ করে রইলো। একটু ভেবে বলল,’ কোথাও যেতে হবে না। তুমি আমার কাছে থেকে যাও।’ লতা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,’না না,তা সম্ভব নয়। আমি কারোর উপর নির্ভর হয়ে থাকতে পারবো না।’
‘আমি বলছি না আমার উপর নির্ভর হতে। এই বয়সে তুমি কোথায় থাকবে বলো? তোমাকে কে কাজ দেবে? আর কাজ দিলে তুমি পারবে বুঝি? শেষ জীবনে একটু তো ভালো থাকো।’
‘সম্ভব নয় সংকেত। আমি পারবো না।’
‘জানো বৌঠান, আমি ছোটবেলা থেকে মাকে পাইনি। দিদি কেমন তা জানি না। তোমরাই ছিলে আমার সবচেয়ে আপন। তোমাদেরকে নিয়েই আমার জীবন।এতগুলো বছর পর যখন মায়ের সমান বৌঠানের সেবা করার সুযোগ পেলাম তখন আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। থেকে যাও না! সকালে না হয় মাকে প্রণাম করে কাজে বেরিয়ে যাবো। আবার ফিরে এসে মায়ের সাথে গল্প করবো। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে কারোর সাথে মন খুলে গল্প করিনি। তুমি থাকবে তোমার ছেলের কাছে?’ লতার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরলো। সবকিছু শেষ হয়েও যেন আবার নতুন করে শুরু হতে চলেছে। তবুও মন সায় দিলো না। ইচ্ছে তো করছে থেকে যেতে। শেষ বয়সে একটু শান্তি চায়। আর কোনো অশান্তি নয়। আনন্দে কয়েকটা বছর কাটাতে চায়। তবুও কিন্তু কিন্তু ভাব থেকে যায়। সংকেত লতার কিন্তু কিন্ত ভাবটি বুঝে ফেলল। বলল,’আমি বুঝতে পারছি তুমি কেন থাকতে চাইছো না। তুমি সমাজের কথা চিন্তা করছো। সমাজের কথা ভাবছো? নিশ্চয়ই সমাজ আমাদের দিকে আংগুল তুলবে। অনেকে অনেক কথা শোনাবে। কিন্তু শেষ জীবনে তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনটা মনের শান্তি না সমাজ? যখন তোমার সবকিছু হারিয়ে গেছিল তখন কি তোমার পাশে সমাজে কেউ ছিল? কেউ হাত বাড়িয়েছিল? আমি তোমায় জোর করবো না। তোমার ইচ্ছা।’
‘আমি সমাজকে ভয় পাচ্ছি না। আমি নিজেকে বিশ্বাস করি। নিজেকে কারোর কাছে সঠিক প্রমাণ করার মতো সময় আমার কাছে নেই। নিজে জানি নিজেই সঠিক। আর কি? নিজে নিজের কাছে পরিষ্কার থাকলেই হলো। ঈশ্বর জানে আমি ভুল কাজ করছি না ঠিক কাজ করছি।’
‘তাহলে এত চিন্তা কিসের? থেকে যাও এখানে। আমার আরও একটা ঘর আছে ওখানে তুমি থাকবে। আজ থেকে ওটা তোমার ঘর।’ লতা রাজি হলো। শেষ জীবনে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে নেই। মাথার উপর একটা ছাদ আর কথা বলার জন্য একটা মানুষ। আর কি চাই? জীবনে এর চেয়ে আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। সংকেতও খুশি হলো। আর সবসময় একা একা বসে থাকতে হবে না। অন্তত কারোর সঙ্গে মন খুলে গল্প করতে পারবে। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর লতা বলল,’আমাকে একবার হোয়াইটফিল্ডে নিয়ে যাবে?’ নামটা শুনে সংকেত একটু চমকে উঠলো। এখানকার একটা বিখ্যাত শহর হোয়াইটফিল্ড। লতা তার নাম কি করে জানলো? সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো। লতা সংক্ষেপে ঘটনা বলল। সে বাঙালি নয়। তার জন্ম এখানেই। বাবা বদলি হয়ে যাওয়ার পর তারা সবাই বাংলায় চলে যায়। তারপর আর ফেরেনি। এখানে তাদের বাড়ি রয়েছে। নিজের মাতৃভূমিতে যেতে চায়। ঠিকানা মনে আছে। পরেরদিন সংকেত কাজে গেল না। বৌঠানকে নিয়ে তাদের বাড়িতে গেল। অনেকদিন মানুষের যাওয়া-আসা নেই। ধুলো ময়লায় ভরে গেছে। আগাছায় পরিপূর্ণ। তবুও ভেতরে গেল। অনেক দিনের পর মাতৃভূমির স্পর্শ পেয়ে খুব খুশি হলো লতা। ছোটবেলার কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এখানে কাটিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর। কি করে সবকিছু ভুলে যাবে? প্রতিটা দেওয়ালে রয়েছে স্মৃতি। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করলো। তারপর সংকেত লতার কাছে এসে বলল,’এবার ফেরা যাক।’
‘কোনো কাজ তো নেই। আর কিছুক্ষণ থাকি। আমার ভালো লাগছে এখানে থাকতে।’ সংকেত বুঝতে পারল না এই পোড়া বাড়ির মধ্যে কি খুঁজে পাচ্ছে লতা। এত ভালো লাগার কিছু কি আছে? তবুও বাধা দিল না। তাকে থাকতে দিল। নিজের বাড়ি। সুখটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। সংকেত নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এলো। লতার খুশি দেখে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। তারও ঘর রয়েছে, পুকুর আছে, বাগান আছে, বন্ধুবান্ধব সবাই রয়েছে তবুও সে নিরুদ্দেশ। চোখের সামনে আবার একবার ফুটে উঠলো ছোটবেলার রঙিন মুহূর্তগুলো। চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পরলো। যদি এক ঘন্টার জন্য ফিরে পাওয়া যেত ওই দিনগুলো সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে ছুটে যেত মাতৃভূমিতে। মাতৃভূমি ডেকে পাঠায়। মাতৃভূমির টানে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু…..। যেতে পারে না। তার আর ভালো লাগে না। বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে। তাদের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত কৃষকের ঘামের মতো দামি। কিন্তু তাদের আর কোনো দিন দেখা হবে না আর কোনো দিন কথা হবে না।
তারা আর কবুতরির বুকে ফিরেনি
‘মা’ বলে আর কাউকে ডাকেনি।
কথা ছিল তারা হবে কৃষকের ঘাম
হয়েছিল কৃষক আর শ্রমিকের ঘাম।
তবুও তারা অভিমানে গন্তব্যে ফেরেনি
হয়েছিল দূর-দূরান্তে নিরুদ্দেশ নিরুদ্দেশ..।
______________ সমাপ্ত ______________
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাথে থাকার জন্য সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। আপন মানুষ গুলোকে খুশি রাখুন।।