নিরব সে,১০ম পর্ব,১১

নিরব সে,১০ম পর্ব,১১
সাদিয়া_সৃষ্টি
১০ম পর্ব

সকাল থেকেই ওয়াফিফ বাড়িতেই আছে। ঘুম থেকে উঠে দেখে জিনিয়া তখনও ঘুমিয়ে । জিনিয়ার ওর আগে কোন দিন ঘুম থেকে উঠতে পারল না। ওকেই ডেকে তুলতে হয় রোজ। অবশ্য জিনিয়ার বাড়ি থাকাকালীন জিনিয়াকে এতো সকালে ঘুম থেকে উঠাবে না সেটাই ভেবে রেখেছে ওয়াফিফ। ওর মাথায় এখনো চিন্তা একটাই। কবে জানাবে বাড়িতে যে জিনিয়া প্রেগন্যান্ট। অবশ্য এখনই জানানোর কোন প্ল্যানিং নেই। ওদের বিয়ের ২ সপ্তাহ হয়ে চলেছে। এখন চাইলেই জানিয়ে দেওয়া যায়। তবে এতো দ্রুত প্রেগন্যান্ট হওয়া সম্ভব হলেও জানতে পারা সম্ভব না। আবার অনেকের বুঝতেই অনেক দিন লেগে যায়। কিন্তু জিনিয়া বিয়ের ২ সপ্তাহ আগে থেকেই প্রেগন্যান্ট। তাই কখন কিভাবে বলবে সেটা বুঝতে পারছে না। দীর্ঘ ৩১ বছরের জীবনে এই ১ম সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে যেন। নিজের পেশেন্টের রোগের চিকিৎসার সময়ও সে এতো ভাবে নি। কিন্তু কোন একটা বিষয় লুকানো সহজ কাজ ও নয়। ওয়াফিফ জিনিয়াকে প্রটেক্ট করতে চায়। বিশেষ করে এই সিচুয়েশনে। মেয়েটা যাই হোক, ১ বার তো ধোঁকা পেয়েছে। বড় কোন বিষয় একা সামলাতে পারবে না। আর যদি গভীর ভাবে ভেবে দেখা হয় তাহলে বেশির ভাগ মেয়েরা এই কথা সামনে আনলে তাদের যেই পরিস্থিতিত্র মুখোমুখি হতে হয় সেটা সামলাতে না পেরে অনেক সময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। হাসপাতালে এমন কেস ওয়াফিফ অনেক দেখেছে। অনেকে এই ক্ষেত্রে মেয়েদের ই দোষ দেয়। কিন্তু মেয়েদের যে দোষ একেবারেই নেই সেটা বলা হচ্ছে না। কিন্তু তারা তো জেনে শুনে এই স্টেপ নিয়ে নেয় না। ইচ্ছা করেই প্রেগন্যান্ট হয় না। কোন না কোন পরিস্থিতিতে পড়েই এমন করে, সেটা কেউ ভেবে দেখে না। বিয়ের আগেই প্রেগন্যান্ট হওয়ায় আত্মহত্যা করেছে – এমন শোনার পর সবাই এটাই বলে – ঠিকই হয়েছে। কেন গিয়েছিল মান সম্মান খোয়াতে? কিন্তু যেই মানুষটা এমন পরিস্থিতিতে পড়ে, তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে একবার ও ভেবে দেখে না। তাই হয়তো তার সমস্যা বুঝতে পারে না। যেই মানুষটা প্রথমে বিশ্বাস অর্জন করে আর পরে ধোঁকা দেয়, তার পরের পরিস্থিতি কারোর হাতে থাকে না। এমন এক পরিস্থিতিতে জিনিয়াও পড়েছে।

ওয়াফিফ নিজে ডাক্তার। এমন কেস অনেক দেখেছে। বিশেষ করে এদের কারণ জেনেছে। তাই সে চায় না আরেকটা প্রাণ যাক কোন ভুল সিদ্ধান্তে। প্রথমে মায়ের ব্ল্যাকমেইল করার কারণে বিয়েতে রাজি হলেও পরে জিনিয়াকে বাঁচাতে সে রাজি হয়েছে। এমন তো না সে একাই সমাজ এর চিন্তা ধারা বদলাতে পারবে। কিংবা এমন ও নে যে একসাথে ১০০ টা বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু যদি এক জনকে সঠিক পথ দেখাতে পারে তাহলে ক্ষতি কোথায়? এক জনই হোক সে। এসব ভেবেই সে সেদিন ক্যাফে তে চুপ ছিল। কিছু সময়ের মধ্যে সব ভেবেই শান্ত ছিল। জিনিয়া নিজে কতটা সাহস করে আর বিশ্বাস করে ওয়াফিফকেই প্রথমে বলেছিল সেটা ওয়াফিফ বুঝতে পেরেছিল। আর যে নিজের সন্তানের বাবার আগে ওয়াফিফ কে বলেছে, তাহলে সে হয়তো এমন পরিস্থিতিতেই আছে, যেখানে হয়তো অপর পক্ষ রাজি নয়। তাই জিনিয়ার প্রতি তার এক আলাদা মায়া জন্ম নিয়েছিল সেই মুহূর্তেই। জিনিয়া দেখতে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার ভিতরে যে ঝড় চলছিল সেটার আভাস পেয়ে ওয়াফিফ জিনিয়াকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। আজও সে জিনিয়ার স্বাভাবিক আচরণ করে । তবে এটা ভালোবাসা না। দায়িত্ববোধ। জিনিয়াকে বিয়ে করেছে, তারপর তাকে তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিবে না, অবহেলা করবে- এমন মানুষ ওয়াফিফ নয়। এতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীন সে নয়। জিনিয়াকে খুশি রাখার দায়িত্ব তার। আর নিজের মনের কোণে কখনো জায়গা দিতে পারবে কি না – সেটা সময় ই বলে দিবে। এখন ও তো তার মনে আরেকজন সেই ৬ বছর ধরে জায়গা দখল করে আছে। অবশ্য এ দিক থেকে জিনিয়ার মনে জাবির আছে ৩ বছর ধরে। তাই সে জিনিয়াকেও জোর করবে না বা করার কোন কারণ নেই।

ভাবতে ভাবতে ওয়াফিফ আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল বৃষ্টিতে। অবশ্য এটা বৃষ্টি না। তবে ওয়াফিফের কাছে বৃষ্টি মনে হল। চোখ পিটপিট করে খুলতেই বুঝল এটা জিনিয়ার চুলের পানি যেটা তোয়ালে দিয়ে ঝাড়ার ফলে তার উপর পড়ছে। সে ঘুম ঘুম কণ্ঠেই বলে উঠল,

–জিনিয়া, এই বৃষ্টি বন্ধ করো।

জিনিয়া বৃষ্টির নাম শুনে অবাক হল। বাইরে কড়া রোড। গেলেই পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা শত ভাগ। সেখানে ওয়াফিফ বৃষ্টি পেল কি করে? সে জিজ্ঞাসা করল,

–বৃষ্টি কোথায়? এখন তো রোদ পড়ছে। আপনি বৃষ্টি কোথায় পেলেন?

–আগে তুমি চুল ঝাড়া বন্ধ করো, বৃষ্টি আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাবে।

জিনিয়া হা করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথায় তখনও ঢুকে নি আসলে বৃষ্টি কোথায় হচ্ছে। সে ওয়াফিফের কাছে গিয়ে মাথার হাত রাখল। গালে আর গলায়ও হাত রেখে দেখল ওয়াফিফের জ্বর এসেছে কি না? কিন্তু সব স্বাভাবিক।

ওয়াফিফ বলল,

–তুমি ডাক্তারের উপর ডাক্তারি খাটাচ্ছ?

–আপনি কি তাহলে পাগল হয়ে গেলেন?

জিনিয়ার মুখ দেখে এবার হাসি আসলো ওয়াফিফের। মেয়েটা নিজেই পাগল। একটু পেচিয়ে কথা বললেই সব মাথার উপর দিয়ে যায় যেন। এই কথায় কত মেয়ে গলে যেত, ক্রাশ খেত আর এই মেয়ে এখনো বুঝেই নি যে কি বলেছি। সে আবার বলল,

–আমি পাগল হই নি আর আমার জ্বর ও আসে নি। একদম ফিট এন্ড ফাইন আছি। তুমি চুল ঝাড়ছিলে যার জন্য পানি আমার উপর পড়ছিল সেটা বন্ধ করতে বলেছি শুধু।

–তাহলে বৃষ্টি?

–বৃষ্টির কথা বাদ দাও। আগে এই কাজ বন্ধ কর।

–শুনুন।

–বলুন।

–আপনি এখনো বাসায়?

–জ্বি। আজ আমার জায়গায় আরকজনকে প্রক্সি দিয়ে এসেছি। আজ ছুটি কাটাব। যাও বিবি সাহেবা। আমার জন্য এক কাপ গরম গরম চা নিয়ে এসো।

–তাহলে আজ আপনি বাসায় থাকবেন?

–এতক্ষণে বুঝলে? এবার আমাকে ঘুমাতে দাও।

বলেই নিজের পাশ থেকে বালিশ নিয়ে সেটা মাথার উপর দিয়ে মুখ লুকাল ওয়াফিফ। জিনিয়া কিছু না বুঝতে পেরে নিচে চলে গেল চা বানাতে। তার কাছে ওয়াফিফের মতো গজ্ঞানী মানুষ একটাও নেই। ওয়াফিফ হল তার সমস্যার সমাধানকারক। ওর কাছে সমাধান নেই এমনটা হতেই পারে না। তাই সব সময় তার সব কথাই মানার চেষ্টা করে জিনিয়া। সে নিজের ফোন হাতে নিয়ে সোজা আফিয়া রহমান কে ফোন করতে করতে নিচে চা বানাতে চলে গেল। আফিয়া রহমানের সাথে কথা বলতে বলতে চা বানানোও শেষ করে সেটা নিয়ে উপরে চলে এলো। একন্তু অবাক করার বিষয় একটাই। সারিকা কখনো দুপুর ১২ টা – ১ টার আগে ঘুম থেকে উঠে না। সেখানে সকাল ৮ টায় সারিকা ঘুম থেকে উঠেছে আর ডাইনিং রুমে বসে মায়ের সাথে গল্প করছে । এটা বিশ্বাস করতে পারল না। সে ভাবল হয়তো রিতিকা আপুকে সারিকা আপু ভেবেছে। কয়েক বার চোখ দুই হাত দিয়ে ঘষেও যখন সারিকাকেই দেখল, তখন হা করে নিজের রুমেই চা নিয়ে চলে গেল। আর গিয়ে দেখল ওয়াফিফ আবার ঘুমিয়ে গিয়েছে। সবার আগে ঘুম থেকে উঠা মানুষ ও যে এতো ঘুমাতে পারে – সেটা জিনিয়ার জানা ছিল না। সে ওয়াফিফ কে জাগাতে চায়। অন্তত চা যে দিয়ে গিয়েছে সেটা জানাতে চায়। কিন্তু কিভাবে জাগাবে সেটা বুঝতে পারছে না।

কয়েকবার ডাক দিল ধীরে ধীরে। কিন্তু কথাটা এতো ধীরে ছিল যে জিনিয়া নিজেই শুনতে পারল না মনে হয়। সে সাহস নিয়ে ওয়াফিফের কাঁধে হালকা ধাক্কা দিল। এতেই কাজ হল। ওয়াফিফ সহজেই জেগে উঠল। জিনিয়ার চুল থেকে তখনও পানি পড়ছিল। ওয়াফিফের জন্য ঠিক করে মুছতে পারল না তখন। জিনিয়া ধীর গলায় বলল,

–আপনার চা।

জিনিয়া তখনও ওয়াফিফের দিকে ঝুকে ছিল। ওয়াফিফ ঘুমের ঘোরেই জিনিয়াকে ভুল দেখে সে বলল,

–ছবি, আই লাভ ইউ।

–কি বললেন?

জিনিয়া নামটা ঠিক করে শুনতে না পারলেও লাভ ইউ কথাটা শুনল। তাই খুব জোরেই প্রশ্নটা করে বসল। ওয়াফিফের ঘুম এবার জিনিয়ার আওয়াজে পুরোপুরি ভেঙে গেল। নিজে কি বলেছে সেটা বুঝতে পেরে সে সামাল দিতে বলল,

–কি আর বলব? বললাম, জিনিয়া, চা দেও।

–তাই?

–কেন? তুমি কি শুনেছ? তোমার কানে কোন প্রবলেম হয় নি তো? হলে আগে আমাকে বল, আমার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

–আপনি এতো ভাবছেন কেন? আমি কিছুই শুনি নি। আপনি ঘুমের ঘোরে কিভাবে বললে, কথা জড়িয়ে জড়িয়ে আসছিল, তাই জিজ্ঞেস করলাম। এই নিন চা।

বলেই চায়ের কাপটা ওয়াফিফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিনিয়া দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ওয়াফিফ সেখানে বসে চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে ভাবল সে এতক্ষণে ঘুমের ঘোরে কি বলে ফেলতে যাচ্ছিল। ছবির কথা সে এখন জিনিয়াকে জানাতে চায় না। পরে সময় আসলে এক সময় জানানো যাবে। অবশ্য না জানালেও কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু যেহেতু তার সাথে জিনিয়ার জীবন জড়িয়ে আছে তাই সব জানার অধিকার জিনিয়ার আছে। আর সে জিনিয়াকে বলবেও। কিন্তু সেটা এখন না। আর এভাবে না। এতে জিনিয়ারর উপর প্রেশার পড়লে জিনিয়ার ক্ষতি হবে।

নিজে হাত মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল খাবার খেতে। বের হয়ে আসতেই দেখল জিনিয়া তার মায়ের সাথে কথা বলছে। সাথে সারিকা আর রিতিকাও আছে। রিতিকা আর জিনিয়া দুজনে মিলে সবজি কাটছিল আর সারিকা বসে ছিল। আর ওরা সবাই মিলে কথা বলছিল। জিনিয়ার বাবা জাকির হোসেন ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। জারিফ নেই। হয়তো ঘুমাচ্ছে। ছুটির দিন হওয়াই। সে গিয়ে জাকির হোসেনের কাছে বসে পড়ল আর সালাম দিল। উনিও হাসি মুখে জবাব দিয়ে ওয়াফিফের সাথে কথা বলতে থাকল।

চলবে।

”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
১১দশ পর্ব

জিনিয়া ড্রয়িং রুমে বসে বসে একটা হাঁড়ির ভিতর হাত নাড়াচ্ছে। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। বাড়ি এলে ভেবেছিল সারাদিন ঘুমাবে। কিন্তু একটু নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুতে নিলেই মা এসে তাকে বকা দিয়ে যাচ্ছে বার বার। তবুও সে তখনও হার মানে নি। কিন্তু শেষ বার যখন সে ঘুমাতে গেল, তখন মা এসে বলে গেল আর যেন সে নিজের ঘরে না ঢুকে। বাসায় ওয়াফিফ ও নেই। সে হাসপাতালে। গতকাল বাসায় ছিল। কিন্তু আজ আবার যেতে হয়েছে তাকে। যাওয়ার আগে জিনিয়ার দুঃখী দুঃখী মুখ দেখে ওয়াফিফ বলেছিল,

–কি হয়েছে? এভাবে বসে আছো কেন? কিছু লাগবে?

জিনিয়া উত্তরে উপর নিচ মাথা নাড়ে। ওয়াফিফ তারপর জিজ্জাসা করে আবার,

–কি লাগবে? বল, আমি যাওয়ার আগে কিনে দিয়ে যাচ্ছি।

–আইডিয়া।

–আচ্ছা, এখানে দোকান কোথায়? সেখানে থেকে আমি আইডিয়া কিনে দিচ্ছি … দাড়াও? কি কিনব? আইডিয়া? নতুন কোন প্রোডাক্টের নাম না কি?

–নাহ, ঘোরে বসে বসে বোর হচ্ছিলাম। মা ঘরের ভিতরেও যেতে দিচ্ছে না আবার রিতিকা আপু বার বার ডাকছে , ঘরের বাইরেও যেতে পারব না। অনেক গরম। তাই কি করব সেটাই ভাবছিলাম।

–ওহ, এই ব্যাপার। এটা সরাসরি বললেই তো হয়। সময় কাটানোর জন্য কি করা যায় এটা বলতে। আমি বলে দিতাম।

–তাহলে বলুন।

–তোমাদের রান্না ঘরে চল আমার সাথে।

বলেই হাত ধরে টানতে টানতে ওয়াফিফ জিনিয়াকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল।

–এখানে ডাল আর চাল বের করো।

জিনিয়া ওয়াফিফের কথামত চাল আর ডাল বের করে দিল। তারপর ওয়াফিফ ২ টা হাড়ি চাইল। সেটা বের করে দিলে ওয়াফিফ জিনিয়াকে নিয়ে আবার ড্রয়িং রুমে চলে গেল।

তারপর চাল আর ডাল একটা হাঁড়িতে মিশিয়ে জিনিয়ার কাছে ধরিয়ে দিল আর বলল,

–এখান থেকে একটা একটা করে চাল আর ডাল আলাদা করে বাকি ২ টা হাঁড়িতে রাখবে। আমি এখন গেলাম , দেরি হয়ে যাবে না হলে।

বলে জিনিয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।

জিনিয়া কিছু না ভেবে তাই করা শুরু করে দিল। কিন্তু এতে তার হাত ব্যথা করছে। তাই এতগুলো ডাল আর চাল যদি একটা একটা করে আলাদা করতে হয় তাহলে তার হাত আর হাতের অবস্থায় থাকবে না। এখন তার নিজের মায়ের উপর রাগ হচ্ছে। যেই না ঘরে ঢুকছিল জিনিয়া, বার বার কেউ না কেউ ওকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিল। আর তারপর নিজেই হারিয়ে যাচ্ছিল। মা যেই কয়বার ডেকেছে, প্রতিবার নিজেই হাওয়া হয়ে গিয়েছে। বার বার বলছিল,

–এতদিন পর এলি, আবার কবে আসবি কি না ঠিক নেই, আমাদের সাথে একটু সময় কাটাবি কি না পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস? যা, তোর আপুদের সাথে সময় কাঁটা, আবার ওই ঘরে ঢুকে দরজা আটকাতে দেখলে পা গুড়ো করে দেব। যাহ্‌।

বলে জিনিয়াকে ঘর থেকে বের করে নিজেই আবার রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। বাসায় সে আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে খুঁজছিল। বাবা কিছু কাজে বাইরে গিয়েছে। আর সারিকা আপুর কোন খবর নেই। কাল তো ঘরের বাইরেও ছিল সারা দিন। কি সুন্দর হেসে হেসে ওয়াফিফের সাথে কোথা বলছিল। সারাদিন জিনিয়াকে ধরে ধরে পুরো ঘর ঘুরেছে। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ছাদে বসে পুরো পরিবার মিলে কোথা বলল। কিন্তু আজ ঘর থেকে বের হওয়ার নাম ই নিচ্ছে না। ওয়াফিফ যাওয়ার আগেও ২-৩ বার বের হয়েছে। কিন্তু তারপর আর তার দেখা মিলে নি। রিতিকা ২ বার ডেকেছিল। কিন্তু ওর কাছে যাওয়ার পর ও নিজেই বএ দিয়েছে যে ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছে। ওয়াফিফ ও হাসপাতালে। রান্না ঘরে গিয়ে একবার উঁকি দিয়ে এসেছে। কিন্তু এতে কোন কাজ হয় নি। উল্টো মায়ের বকা শুনতে হয়েছে। কাজের সময় কেন তাকে জ্বালাচ্ছে সেই নিয়ে।

পরিবারের সাথে সময় কাটাতে বলেই পরিবার ই হাওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন মায়ের কোথা ভেঙে ঘরে গিয়ে ঘুমাতেও পারবে না। আজকাল তার ঘুম বেশি আসছে। প্রচুর ঘুমাতে ইচ্ছে করে তার। ভালো এক দিক দিয়ে। ওয়াফিফ অন্তত তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দেয়। নাহলে তার ঘুম ভাঙত কি না তার কোন ঠিক নেই। জিনিয়ার মনে পড়ছে, তার যখন অতিরিক্ত ঘুম আসতো তখন ওয়াফিফ কি করে।

দুপুরে ওয়াফিফ বাসায় ফিরে খাওয়ার সময় দেখে জিনিয়া ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে। যেন খুব কষ্টে নিজেকে জাগিয়ে রেখেছে। তাই সে খাওয়ার পর জিনিয়াকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে ঘুমাতে বলত আর নিজে হাসপাতালে যাওয়ার আগে ওকে ডেকে তুলত। যাতে কেউ জানতে না পারে। জিনিয়াও এতে নিজেকে ফ্রেশ অনুভব করত। সারাদিন বেশি কাজ না করলেও শাশুড়ির পিছনে ঘোরা সহজ ব্যাপার না। এতে আফিয়া রহমানের মন জয় করা গেলে জিনিয়া এটাও করতে রাজি। কিন্তু নতুন বউ কাজ ছেড়ে ঘুমায় এই কথা একটা বড় বাঁধা। তাই সে দুপুরে আর বিকালে ঘুমাতে পারতো না। ঘুমাতে গেলেও চিন্তায় আর ঘুম আসতো না। তাই ওয়াফিফ ওর সমস্যার একটা সমাধান বের করে দেয়। গত ২ সপ্তাহ ওয়াফিফ যেভাবে জিনিয়ার সাহায্য করেছে, সেটা জিনিয়াকে ওয়াফিফের প্রতি আরও নির্ভরশীল করে তুলেছে। এখন জিনিয়া হয়তো নিজেকে সামলাতে পারতো না যদি ওয়াফিফ না থাকত। এটাই মনে হয় জিনিয়ার। আর প্রতি মুহূর্তে ওয়াফিফের প্রতি তার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়।

হাতের পাশাপাশি ইজের পিঠে ব্যথা শুরু হলে ভাবনায় ছেদ ঘটে জিনিয়ার। এক ভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকায় পিঠে ব্যথা শুরু হয়েছে তার। তাই সে সেই কাজ রেখে সেখান থেকে উঠে নিজের রুমে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল। মা বিছানায় শুতে মানা করেছে। কিন্তু নিজের রুমে দাঁড়াতে তো মানা করেন নি। সে জানার কাছে যেদিকে ছায়া আছে সেদিকে গিয়ে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে সূর্য আকাশের উপরে উঠতে উঠতে আবার এক সময় গিয়ে নিচে নামতে শুরু করবে। উত্তাপ তখন একটু হলেও কমবে। তখন জিনিয়া ঘর থেকে বের হয়ে আবার সেই মাঠে। যাবে। বাড়িতে মানুষ থাকলেও কোন কাজ পাচ্ছে না জিনিয়া। আর না পেয়েছে ঘুমানোর অনুমতি। তাই সোজা মাঠে চলে যাবে বিকালে। সেখানে চুপচাপ বসে থাকতে বেশ ভালো লাগে জিনিয়ার। সেখানে বসে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় অতিক্রম করতে পারবে।

হঠাৎ জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই সেই চেনা মুখ যেটা সে দেখতে চায় না, সেটাই দেখল। জাবির তার দিকেই তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। পলক ফেলছে। জাবিরকে দেখে জিনিয়াও কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল। এই সময় আর এখানে নিজের বাড়ির সামনে জাবিরকে সে একদম আশা করে নি। যেই মানুষটা এতো দিন ধরে তাকে ইগনোর করে গিয়েছে, সে নিজে থেকে তার বাড়ির সামনে এসে তার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। যে কেউ দেখলে বলতে পারবে যে জাবির তারই অপেক্ষা করছে। কিন্তু এটা কেন হবে। কয়েকমাস আগেও তো তাদের মধ্যে সব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখন তো আর স্বাভাবিক নেই। সেটাকে অস্বাভাবিক জাবির নিজেই করেছে।

গত বছরেও সে এভাবে তার জন্য জানালার দিকে তাকিয়ে জাবির দাঁড়িয়ে থাকত। হঠাৎ করে রাতের আধারে এসে জিনিয়াকে ফোন করে এই জানালার কাছে এসে দাঁড়াতে বলত। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানেই দাঁড়িয়ে জিনিয়াকে দেখত। কম পাগলামি করে নি জাবির। একবার জিনিয়ার জন্মদিনে সে রাত ১২ টায় ম্যাসেজের মাধ্যমে জিনিয়াকে এখানে ডেকে ছিল জাবির। তারপর জিনিয়া ঘুম ঘুম চোখে এসে দাঁড়ালে জাবির কয়েকটা বেলুন একটা লম্বা দড়ি দিয়ে বেঁধে সেটা জিনিয়ার জানালার কাছে পাঠায়। সেটা হাতে নিতেই জিনিয়া দেখে সেখানে এক জোড়া কানের দুল আর একটা চিঠি ছিল। নিচে থেকে দড়ি ধরে থাকায় বেলুন অন্যদিকে চলে যায় নি। বলতে হবে, দড়ি ভালোই বড় ছিল। মাঝে মাঝে জিনিয়া জাবিরের উপর রাগ করলে সেখানে ফুচকা ওয়ালা মামাকে বেশি টাকা দিয়ে নিয়ে আসতো আর কান ধরে ক্ষমা চেয়ে তারপর জিনিয়াকে নিচে নামাতে পারতো। জিনিয়াও এই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে জাবিরকে কান ধরে থাকতে দেখত। কিন্তু এখন সব অতীত। কিছুই আর আগের মতো নেই।

জিনিয়াকে জাবির কে দেখেও না দেখার ভান করে সেখান থেকে চলে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে আবার মাকে বলল,

–মা, ও মা।

–কি হয়েছে?

–আমি কি করব?

–সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে? বাইরে ঘোড়া রাখার আছে। সেটার জন্য ঘাস কেটে নিয়ে আয়।

–ঘোড়া কবে আসলো?

–আরে মাথা মুটি, কোন ঘোড়া নেই।

–তাহলে ঘাস কাটব কেন?

–ঘাস কাটবি কেন তুই?

–তুমিই তো বললে।

–আরে তোর কোন ঘাস কাঁটা লাগবে না। যা, রিতিকার সাথে গল্প কর।

–কিন্তু ওরা তো ব্যস্ত ওদের কাজে।

–তাহলে ঘুমা।

–কিন্তু তুমিই তো ঘরে ঘুমাতে মানা করলে।

–সেটা তো জামাই যখন ঘরে থাকবে তখনের জন্য।

–এই কোথা তুমি আগে বলবে না মা?

–এখন তো বলছি। এখন যা।

–জারিফ স্কুল থেকে কখন ফিরবে?

–বিকালে।

–ঠিক আছে। আমি গেলাম ঘুমাতে।

–যাহ্‌।

জিনিয়া চলে যেতে নিলে আবার ফিরে এসে মাকে পিছন থেকে একবার জড়িয়ে ধরে আবার চলে গেল। জিনিয়ার মা নিজের মেয়ের এমন আকস্মিক কাজে অবাক হয়ে আবার হেসে ফেললেন। জিনিয়া নিজের বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম তার চোখে এসে পড়ল। আজকাল ঘুম একটু বেশিই আসে তার। প্রেগন্যান্সির কারণে কি না কে জানে?

বিকালে জারিফ স্কুল থেকে এসেই একটু হাত মুখ ধুয়ে আবার নিজের ব্যাট নিয়ে ঘর থেকে চলে যেতে নিলে জিনিয়া ওকে আটকায়।

–এই জিরাফ।

–আমি জিরাফ না।

–আমি তোকে জিরাফ বলেই ডাকব।

–নাম ভাঙ্গানো পাপ কাজ।

–আমি তো তোর না ভাঙ্গাই নি। আমি শুধু তোকে নতুন নাম দিয়েছি। একটা ছাগলের অভাবে সেই নামের আকিকা দিতে পারি নি শুধু। আর বড় বোন ভালিবেসে একটা নাম দিয়েছে। কোথায় খুশি হবি কি না?

–আচ্ছা, কি বলবি বল।

–মাঠে যাচ্ছিস?

–হ্যাঁ।

–চল, আমিও যাবো।

–মা বকবে না?

–নাহ, আগেই চলে আসবো। এখন চল।

বলেই দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। জিনিয়া ভাবছে মা তো বকবে যখন ওয়াফিফ ঘরে থাকবে তখন ঘরে না থাকলে। ওয়াফিফ আসার আগেই সে ঘরে চলে আসবে। তাহলে আর মা বকবে না। ভেবেই ঘর থেকে বের হল ও।

মাঠে গিয়ে সে নিজের জায়গায় বসে পড়ল। আর জারিফ চলে গেল নিজের বন্ধুদের সাথে খেলা করতে।

–জান।

আবার সেই একই ডাক। কিন্তু শুনে আর পিছনে ঘুরল না জিনিয়া। পিছন থেকে জাবির সামনে এসে জিনিয়ার কাছে বসে পড়ল। সাথে সাথে জিনিয়া দূরে গিয়ে বসে পড়ল। জাবির জিনিয়ার এমন ব্যভারে অবাক হল। সে বলল,

–কি হয়েছে জান? এমন করছ কেন?

–কে জান? আমি জিনিয়া। দয়া করে আমার নাম ধরে ডাকবে জাবির। নাহলে আর ডাকবে না।

–এখনো রাগ করে আছো আমার উপর?

–না। আমি রাগ করি নি।

–তাহলে এভাবে কথা বলছ কেন যেন আমি কোন অচেনা মানুষ তোমার কাছে।

–আমি ঠিক ভাবেই কথা বলছি জাবির।

–জান, আমার কথা তো শো…

–নিজের কথা ঠিক করে বল। আমি জিনিয়া। আমি রাগ করি নি। আমি এখন ম্যারিড। তোমার আমার মধ্যে সম্পর্ক আগের মতো নেই। এখন আমরা শুধুই বন্ধু ছাড়া কিছু না।

–আবার মজা করছ? তুমি একসাথে কয়টা কাজ করতে পারো? আমার উপর রেগেও আছো। আবার আমার সাথে মজাও করছ।

বলেই হালকা হাসল জাবির। এতে জিনিয়ার বেশ রাগ হল। সে উঠে দাঁড়াল আর বলল,

–আমি বিবাহিত এটা বিশ্বাস করা, না করা তোমার ব্যাপার। কিন্তু নিজের লিমিটের মধ্যে থেকে কথা বলবে। আর আমাকে ডাকলে আমার নাম ধরেই ডাকবে। অকারনে কথা বলতে আসবে না দরকার ছাড়া।

বলেই আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই সে জারিফের কাছে গেল। আর তাকে জানিয়ে বাড়ি ফিরে গেল জিনিয়া। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেই মাটিতে বসে কেঁদে ফেলল। হাঁটু ভেঙে বসে দুই হাঁটুর মাঝে নিজের মাথা গুঁজে দুই হাতূ দিয়ে মাথা চেপে ধরে কাঁদতে থাকল সে। হঠাৎ নিজের সামনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে মাথা তুলল জিনিয়া।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here