নিরব সে,সূচনা পর্ব
সাদিয়া_সৃষ্টি
-গত আধঘণ্টা ধরে আপনি বসে আছেন কিছু বলবেন বলে। কিন্তু এখনো বললেন না। তাহলে কি আমি চলে যাব?
–আমি প্রেগন্যান্ট। আজই জানতে পারলাম।
বিয়ের আগের দিন নিজের হবু বরের সাথে ১ম দেখায় তাকে এই কথাটি বলল জিনিয়া। জিনিয়ার সাথে ওয়াফিফের এই প্রথম দেখা। এর আগে কখনো কোন প্রকার কথাও হয় নি তাদের মধ্যে। আজই প্রথম দেখা।
আজ জিনিয়ার গায়ে হলুদ। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ওর শরীর ঠিক লাগছিল না। বমি করা কিংবা খাবারের ঘ্রাণ সহ্য করতে না পারা এসব দেখে নিজেই অবাক হচ্ছিল। কিন্তু বিয়ে বাড়ি হওয়ায় সে কাউকে কিছু বলতেও পারছিল না। তাই নিজে থেকেই ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল সে। সবার গোপনে। আর সে ‘প্রেগন্যান্ট’ জানার পর সবার আগে ওয়াফিফকে ফোন করে দেখা করতে বলে। এটাই তাদের প্রথম দেখা।
দেখা হওয়ার পর শুধু একবার কথা বলে সিউর হয়ে নিয়েছিল যে সেই ওয়াফিফ কি না? তারপর শুধু একটা টেবিলে দুজন বসে পড়ে মুখোমুখি। জিনিয়া নিজেকে বারবার তৈরি করে চলেছিল যে সে এই কথা ওয়াফিফকে বলবে। কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না। টানা ৩০ মিনিট বসে থাকার পরও কোন কথা বলতে পারে না জিনিয়া। অন্যদিকে ওয়াফিফ আসার পর চেয়ারে বসে সেই যে ফোনে মুখ গুঁজে দিয়েছে, আর একটাও কথা বলে নি। সেই থেকে ফোনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা করে যাচ্ছিল নিজের মতো। জিনিয়া মাঝে কয়েক বার চেষ্টা করেও কি বলবে বুঝতে পারছিল না। ওর শুধু দরকার ছিল কেউ কথা শুরু করুক যার মধ্যে সে নিজের কথাও বলতে পারে।
ওয়াফিফ বুঝতে পেরেছিল কি না জানা নেই, তবে টানা ৩০ মিনিট পরও কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে হাত থেকে ফোন নামিয়ে নিজের পকেটে রেখে দেয়। জিনিয়ার দিকে তাকায় সে। জিনিয়া তখনও নিজের দৃষ্টি টেবিলে আটকে রেখেছে। টেবিলে কিছুই নেই। ক্যাফে হওয়ায় সেখানে আশেপাশে মানুষ আছে। তবে খুব কম। সময়টা দুপুর। সূর্য তির্যক ভাবে কিরণ দিলেও তাপ কমে নি এক বিন্দুও। উত্তাপের ফলে ওয়াফিফের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে আর সহ্য করতে না পেরে চোখ তুলে জিনিয়ার দিকে তাকায়। এতক্ষণে জিনিয়া যে তার দিকে ঠিক মতো তাকায় নি পর্যন্ত – সে বিষয় মাথায় আসতেই অবাক হয় সে। জিনিয়া যে আগামী আধঘণ্টায়ও কিছু বলবে না – এমনটা ভেবে সে নিজেই শুরু করে। যাতে জিনিয়া বেশি নার্ভাস না হয়ে সরাসরি আসল কথা বলে দেয়, যে জন্য সে ওয়াফিফকে ডেকেছে। জিনিয়াও কিছু না ভেবেই কথাটা বলে ফেলে।
বলার প্রায় ১০ মিনিট পর্যন্ত কেউ কোন কথা বলে নি। জিনিয়ার দৃষ্টি তখন ক্যাফের ওই নীল প্লাস্টিকের টেবিলে আটকে আছে। টেবিলে কিছুই নেই। একেবারেই সাধারণ, না কোন নকশা, না কোন লেখা। যাকে বলে প্লেইন। সে আর দেরি না করে মাথা ধীরে ধীরে উপরে তুলে সামনে বসে থাকা ওয়াফিফের দিকে তাকায়।
ওয়াফিফের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভড়কে যায়। ওয়াফিফকে দেখে এখন একটুও মনে হচ্ছে না যে সে চমকে গিয়েছে বা অবাক হয়েছে। কারণ প্রথম দেখায় এই কথা শুরুতেই বলা স্বাভাবিক মানুষের কাজ না। এতক্ষণে হয়তো জিনিয়াকে সে পাগলের উপাধি দিয়েও বসতে পারে। কোন ঠিক নেই। কিন্তু তার হবু বউ প্রেগন্যান্ট এর মানে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না ওয়াফিফের। সে নিজের একজন ডাক্তার। কি করলে এমন হতে পারে সেটা সে জানে। তার মনে কি একবারও আসছে না যে তার হবু স্ত্রী কার সন্তান বহন করছে। স্বাভাবিক ঘটনা তখন ঘটত যখন ওয়াফিফ ওকে অপমান করে বিয়ে না করে দিত। জিনিয়া নিজেকে এইজন্যই তৈরি করছিল এতক্ষণ। কিন্তু ওয়াফিফের চুপ করে থাকা বা কোন রিয়েকশন না দেওয়াটা জিনিয়াকে অবাক করে দিচ্ছে।
–আপনি কি কিছু বলবেন না?
–আমি কি বলব?
–আমি যে কথাটা বললাম, সেটা কিন্তু মজা করে বলি নি।
–আমি জানি। মজা করে বলার হলে আগেই বলে দিতে। এতো ভাবতে না। আর বলার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বলে আবার চোখ নিচে নামিয়ে নিয়ে আমার রিয়েকশনের অপেক্ষা করছিলে তুমি তাই তো?
জিনিয়া মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করল। আবার কৌতূহল বশত বলে ফেলল,
–আপনার কি মত এখন?
–আপনি কি কিছু খাবেন বা পান করবেন। এই গরমে কি কোন কোল্ড ড্রিংক অর্ডার করব আমি?
–আপনি কি আদৌ আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন?
ওয়াফিফ সম্মতি জানিয়ে বলে,
–হ্যাঁ শুনেছি।
–তাহলে এমন করছেন কেন?
–কেমন করছি?
–আপনার আচরণ স্বাভাবিক না। অন্যরকম কিছু হওয়ার কথা ছিল।
–কি হওয়ার কথা ছিল?
–এখন আপনার প্রশ্ন করা উচিত ছিল এসব কিভাবে হল? কিংবা আপনি বিয়েতে অমত জানাবেন – এটা স্বাভাবিক আচরণ।
–আমি কি আপনাকে ‘তুমি’ করে ডাকতে পারি?
–আপনি পারেন। কিন্তু আপনি এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছেন কেন?
–আচ্ছা, তাহলে বল, এসব কি করে হল? তাছাড়া তুমি তো বললে আজই এটা জানতে পারলে।
এই প্রশ্নে জিনিয়া আবার ভাবতে শুরু করল, এখন তার কি বলা উচিত?
সে কি সব বলে দিবে? বলার পর কি হবে? উনি কিরকম আচরণ করবেন?
নিশ্চয়ই অপমান। অবশ্য আর কি ই বা বাকি আছে। এখন এটা করা ছাড়া। সে আর কিছু না ভেবে বলতে শুরু করল।
–আমার সাথে তার সম্পর্ক ৩ বছরের। আমাদের দুজনেই আবেগে ভেসে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবেই এক দিন … তার ফলে এখন আমি প্রেগন্যান্ট। আমি নিজেও জানতাম না। আজ ডাক্তারের কাছ থেকে আনতে পারলাম যে আমি প্রেগন্যান্ট। এখনো বাবা মা কাউকেই বলি নি। শুধু জানেন আপনি। আপনাকে বলা উচিত তাই ভেবে আজ দেকেছিলাম। এখনো আমরা দুজন ছাড়া এই বিষয় আর কেউ জানে না। এই বাচ্চার বাবাও না। কি করে জানবে। সে গত ৩ মাস ধরে আমাকে কোন কারণ ছাড়াই ইগনোর করে চলেছে। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুই জানতে পারি নি। সে আমার সম্পর্কে সবই জানে। এমনকি কাল আমার বিয়ে এটাও। আমিই ওকে বলেছিলাম। কিন্তু ও পাত্তা দেয় নি। কিন্তু আমি জানতাম না যে সেদিনের জন্য আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যাবো। সে এখন আমার কিছুই না। ‘প্রাক্তন’ ও বলতে পারছি না তাকে। আগে বাব মায়ের কথা না শুনে নিজে ভুল করেছি, তাই এখন শুধু তাদের কথা শুনেই বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছি।
–ঠিক আছে।
ওয়াফিফের ‘ঠিক আছে’ শুনে জিনিয়ার নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। কিছু একটা রিয়েকশন তো দিবে, নাকি শক খেয়ে কোন কথা বলতে পারছে না। অবশ্য চেহারা দেখে যে শক খেয়েছে এটাও বলা যাচ্ছে না। জিনিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়াফিফ বলল,
–তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আর এই কথা কাউকে বলার দরকার নেই। আর এই অবস্থায় বেশি ভারী কাজ করার দরকার নেই। রেস্ট নেও। শুধু হলুদের অনুষ্ঠান আর কালকের বিয়ে ছাড়া আর বেশি কিছু নেই। এতে অনেক স্ট্রেন্থ এর প্রয়োজন হবে তোমার। তাই রেস্ট নেও। আর হ্যাঁ, আমার বাড়িতে বউ ভাতের অনুষ্ঠানে সমস্যা হবে, তাছাড়া আর কিছু না। নতুন বউ হিসেবে আমার বাড়িতে ২ দিন শুয়ে বসে থাকতে পারবা। এই দুই দিনে টুকটাক কাজ মায়ের কাছ থেকে শিখে নিও। ২ দিন পর এই টুকটাক কাজ করলেই আমার মা আর বেশি কিছু বলবে না। কোন সমস্যা হলে আমার নাম্বার এখন সেভ করে নেও। ফোন দিও। ফোন দিয়ে শুধু প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে নিবে। তোমার ফোনটা দাও তো।
জিনিয়ার কোন রেসপন্স না পেয়ে ওয়াফিফ আবার বলল,
–কি হল? ফোন দেও।
ওয়াফিফের উঁচু আওয়াজে সে হুড়মুড় করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ওয়াফিফের হাতে ধরিয়ে দেয়। ওয়াফিফ নিজের নাম্বার সেভ করে ওর ফোন দিয়ে নিজের নাম্বারে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যায় না। জিনিয়ার ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। তাই দেখে সে আবার একটু জোরেই বলে ওঠে,
–তোমার নাম্বারটা বল।
জিনিয়াও ভদ্র বাচ্চার মতো নাম্বার বলে দেয়। ওয়াফিফ নিজের ফোন দিয়ে সেই নামারে কল করে দেখে জিনিয়ার ফোনে রিং হচ্ছে। তখন ফোন কেটে দিয়ে জিনিয়ার কাছে ওর ফোন ফেরত দেয়। জিনিয়া আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়াফিফ আবার ওকে আটকে দিয়ে বলে উঠে,
–আর প্রশ্ন থাকলে বিয়ের পর সারাজীবন সময় পাবে জিজ্ঞেস করার। এখন রেস্ট নেও। আর এই গরমে বাইরে থাকা ঠিক হবে না। আর তুমি এখন জানতে চাচ্ছ আমি এমন কেন করছি? এক বাক্যে বলছি, আমি তোমার আর তোমার বেবির দায়িত্ব নিতে রাজি, যদি তুমি এই বিয়েতে রাজি থাক। আর বেশি মেন্তাল প্রেশার না নিয়ে এখন বল, একাই বাসায় যেতে পারবে না কি আমি পৌঁছে দিব?
–আমি একাই যেতে পারব, এখান থেকে আমার বাসা দূরে না।
–তাহলে আমি এখন আসি। আমার শিফট আবার শুরু হয়ে যাবে। আমাকে হাসপাতালে যেতে।
জিনিয়া ঠিক আছে বলে উঠে দাঁড়ায়। ওয়াফিফ ওকে ক্যাফের বাইরে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে নিজে হাসপাতালের দিকে চলে গেল। জিনিয়া ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে এই মানুষটাকে খুব করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছে ওর।
কিছু না ভেবে ও হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা চেনা মুখ নজরে পড়ায় ওর চোখের কোন জলে ভরে গেল। চোখ ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইল। আজ সব ঠিক থাকলে ওয়াফিফের জায়গায় এই চেনা মুখের থাকার কথা ছিল। কিন্তু আজ সে নেই। জিনিয়ার সাথে তার চোখাচোখি হতেই সে মুখ ঘুরিয়ে নিল আর এমন ভাব করল যেন কিছুই হয় নি। জিনিয়া তখনও এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে হাজার আকুল আবেদন। কিন্তু সেই আবেদন খেয়াল করল না সে। পাত্তা না দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। জিনিয়া জানতো এমন ই হবে। প্রতিবার দেখা হলে এই ঘটনাই ঘটেছে গত ৩ মাসে। শুধু এর মাঝে একবার দেখা হয়েছিল। যার জন্য সেদিন আবেগে ভেসে গিয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল তার কাছে। কিন্তু যার জন্য এতো কিছু, দিন শেষে সে শুধু সরি বলেই চলে গিয়েছিল। বলেছিল – ভুলে যাও সব। এসব জিনিয়ার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
মাথার উপরে সূর্যের উত্তাপ বেড়েই চলেছে। তার জন্য এটা ভালো না ভেবে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। মাথার উপর ছাতা আছে। কিন্তু সেটা কতটা বাঁচাতে পারবে , জানে না জিনিয়া। মাইগ্রেনের ব্যথাটা আবার উঠবে হয়তো। তাছাড়া বিয়ে বাড়ি। নিজেকে কি করে সামলাবে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলল সে। বেশি দেরি করলে তো বাড়ির আত্মীয় রা হাজার কথা শুনাবে তাকে। হাজার প্রশ্ন করবে, যার উত্তর সে দেওয়ার অবস্থায় নেই সে। এই অল্প রাস্তা হাঁটতেও তার যেন বেশ কষ্ট হচ্ছে।
চলবে।