গল্পঃ #নিরবতার_ছুটি (৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
আদীলকে কাছাকাছি পাওয়ার জন্য নিঃসন্দেহে এটা উনার নতুন কোনো ফন্দি!
কিন্তু অন্তি দেখছে এই মূহুর্তে শায়লা আঞ্জুম চোখ খুলছেনা। তাই সেও চুপ করে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আদীল হাসপাতালের সামনে এসে অন্তিকে অপেক্ষা করতে বলে দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো, কয়েক মিনিট পর কিছু নার্স এসে উনাকে ইমারজেন্সি চিকিৎসার জন্য তারাহুরো করে ভেতরে নিয়ে গেলো।
এদিকে আদীল অন্তির কাছে এসে বললো,
___ সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, আজকে তো আম্মুর সাথে দেখা করানো সম্ভব না। এদিকে আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিতেও পারবোনা, কারণ ভেতরে পেসেন্টের যদি আবার কোনো কিছুর দরকার পড়ে। আচ্ছা আমাদের ড্রাইভারকে ফোন করছি।
___ না না আমি চলে যেতে পারবো। আপনি থাকুন উনার কাছে। হয়তো উনি বেশিই আঘাত পেয়েছেন।
বেশি দূর না আমার বাসা, চলে যেতে পারবো। আমাদের ড্রাইভারকে ফোন দিলে আবার বিষয়টা বাবা জেনে যাবে। তাই রিকশা করেই চলে যাবো।
___তোমার বাবার নাম কি? আর তুমি তখন কিছু বলতে চেয়েছিলে? আমার সেদিনের মেয়ে দেখার বিষয়ে নাকি? তুমি সেটা কি করে জানো?
___ এসব নিয়ে পরে কথা হবে নাহয়। আপনি খোঁজ নিয়ে উনার আত্মীয়দের খবর দিন, তারপর যা যা করার লাগে করুন। আজ আসছি আমি। ফোনে বাকি কথা হবে।
বলেই অন্তি চলে যাচ্ছে, আদীল এসে তাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আবার ভেতরে গেলো। ইতোমধ্যে উনার আঘাত পাওয়া অংশগুলো রিফ্রেশ করা হয়েছে, কিছু জায়গায় ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিয়েছে।
আদীলকে দেখেই ডক্টর বলে উঠলো,
___আপনার মা একদম ঠিক আছে। বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি এগুলো তারাতাড়ি ক্ষত সারানোর জন্য। যাওয়ার সময় নিয়ে যাবেন।
আদীল কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় বললো,
___উনি আমার মা না, রাস্তা পার হতে গিয়ে কি করে যেন আমার গাড়ীর সামনে এসে পড়েছেন। আচ্ছা দেন আমি ঔষধগুলো আনিয়ে উনাকে পৌঁছে দিবো।
ডক্টর চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেও আবার দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
___এটা কি করে সম্ভব! একি চেহেরা আপনাদের, আর উনার চোখ!
বলেই মাথা নাড়াতে নাড়াতে চলে গেলেন।
আদীল পেছনে তাকিয়ে সেও চমকে গেলো, সে নিজের চোখের উপর হাত রেখে মনে মনে এটাই ভাবলো,সত্যিই তো উনার চোখ একদম তার মতো।
আর এই চেহেরাটা ভীষণ পরিচিত লাগছে, যেন আগেও দেখেছে কোথাও! আস্তে আস্তে এসে সে পাশে বসে বসলো। শায়লা আঞ্জুম এই অবস্থাতেও একটু মুচকি হেসে উঠে বসলেন। আদীল পাশে বসতেই উনি কাঁপা কাঁপা হাতে তার হাতের উপর হাত রাখলেন। আদীল উনার দিকে তাকিয়ে বললো,
___আপনার বাসার কারোর নাম্বার দিন, আপনাকে নিয়ে হয়তো চিন্তা করবে।
শায়লা আঞ্জুমের চোখ ছলছল করে উঠলো, অস্পষ্ট স্বরে বললো,
___আমাকে নিয়ে চিন্তা করার মতো কেউ নেই বাবা।
___ সেকি আপনার সন্তানেরা কোথায়?
শায়লা আঞ্জুম আদীলের কাঁধে নিজের হাতটা রেখে কেঁদে ফেললো এবার। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
___ছেলের কাছে মা হওয়ার অধিকার হারিয়ে এখন এক দূর্ভাগা নারী আমি! এই শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিলো।
___আপনি কাঁদবেন না প্লিজ। চলুন আমি আপনাকে পৌঁছে দিবো। আর কোনো কিছু দরকার হলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন। আসলে বুঝতে পারছি না এর ক্ষতিপূরণ কি করে করবো? আমার বেখেয়ালের জন্য আপনার এতো বড় ক্ষতি হলো!
কথাটা শেষ হতে না হতেই শায়লা আঞ্জুম বলে উঠলেন,
___তুমি আমাকে মা ডাকবে?
হঠাৎ এই কথায় আদীল চমকে উঠে। শায়লা আঞ্জুমের চেহেরায় তাকানোর পর থেকে তার মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনূভব হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো মানুষটা তার খুব চেনা। সাথে ভীষণ অস্বস্তিও লাগছিলো। কিন্তু এই মূহুর্তে উনি যে আবদারটা করে বসেছেন এটা তাকে আরো বাকরুদ্ধ করে দিলো। আদীল তার দিকে তাকিয়ে কোনো কথা বলতে পারছিল না। তাই উঠে দাঁড়িয়ে একটু সরে গিয়ে বললো,
___আমি একজনকেই মা ডাকি, এর আগেও আমার কাছে মা বলতে কেউ ছিল না। মা শব্দটাতে আমার প্রচুর এলার্জী, কিন্তু যিনি আমাকে মানুষ করেছে শুধুমাত্র তার অধিকার আছে এই মা ডাক শোনার। এরপর শাশুড়ীকে বউয়ের খাতিরে ডাকা লাগতে পারে, এছাড়া আমি কাউকে মা ডাকবোনা। যদি আপনার এটা ছাড়া অন্য কোনো চাওয়া থাকে বলতে পারেন। আমি নিরাশ করবোনা।
শায়লা আঞ্জুম চোখভর্তি পানি নিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে বললো,
___ মানুষ নিজের মা ছাড়া আর কাউকে মা ডাকতে পারেনা? আমাদের আশেপাশে তো এমন অসংখ্য পাতানো সম্পর্ক আছে।
আদীল কিছুটা রাগী সুরে বললো,
___জন্ম দিয়েও মানুষ মা হতে পারে না, সেখানে পাতানো মা? আমি খুব ছোট বেলা থেকেই মা শব্দটাকে একদিকে ভালোবাসি আর অন্যদিকে প্রচুর ঘৃণা করি। তাই এটাকে যেখানে সেখানে ব্যবহার করি না। আচ্ছা এবার আপনি আসুন, আপনাকে পৌঁছে দিবো, আমার অনেক কাজ আছে।
বলেই আদীল উনার দিকে তাকালো। তাকিয়ে দেখলো উনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আদীলের খারাপ লাগছে বিষয়টা, সত্যিই কি উনার আবদারটা ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হয়েছে? কিন্তু এটা ছাড়াও কোনো উপায় নেই। সে ছোট বেলা থেকেই কেউ যদি মা ডাকতে বলতো সে রেগে যেতো।
আদীল উনার হাত ধরে আস্তে আস্তে দাঁড়াতে বললো, কিন্তু শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত বের হওয়ার শরীরে পূর্ণ শক্তি পাচ্ছিলোনা। আদীল উনাকে একটু বসতে বললো, তারপর হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে, লিখে দেওয়া ঔষধগুলো নিয়ে এসে উনাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ীতে বসালো। বাসার এড্রেস জেনে নিয়ে উনার বাসার দিকে যেতে লাগলো। গাড়ীতে পুরো সময়টাই উনি কেঁদেছে, আদীল এটা খেয়াল করেছে। তার খুব খারাপ লাগছে, তারপরও সে এই আবদারটা মানতে নারাজ। আবার অনেকগুলো প্রশ্ন তাকে ভীড় করেছে, একে তো উনার সাথে খুব মিল, তার উপর মা ডাকার জন্য বাচ্চাদের মতো বায়না। কেন করছেন উনি এসব এটা আদীলের মাথায় যাচ্ছেনা।
বাসায় পৌঁছে কলিং বেল চাপতেই একটা ৯-১০ বছর বয়সী মেয়ে এসে দরজা খোলে দিলো। আদীলের দিকে মেয়েটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তারপর শায়লা আঞ্জুমকে এমন অবস্থায় দেখে জোরে বলে উঠলো,
___আদীল ভাইয়া মা’য়ের কি হয়েছে?
আদীল কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
___তুমি আমাকে কি করে চিনো?
মেয়েটা কিছু না বলে শায়লা আঞ্জুমের রুম দেখিয়ে দিলো। আদীল উনাকে নিয়ে বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
___আমি এখন যাচ্ছি, যদি কোনো দরকার…
আদীল দেয়ালে তাকিয়ে থেমে গেলো। এদিক ওদিক চারদিকে তাকিয়ে সে মেয়েটার দিকে তাকালো একবার তারপর শায়লা আঞ্জুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
___সারা রুমে আমার ছবি, মানে কি? তাছাড়া আপনি বলেছিলেন আপনার কেউ নেই, তাহলে এই মেয়েটা কে?
শায়লা আঞ্জুম দেয়ালে আঙুল দিয়ে বললো,
___দেয়ালে যাকে দেখছো সে আমার ছেলে। আর মেয়েটাও আমার, তবে মেয়েটা আমার পেটের সন্তান নয়।
মেয়েটাকে আমি দত্তক এনেছিলাম,আর ছেলেটাকে দিয়েছিলাম।
চলবে…..