দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয় অধ্যায়,১০ম_পর্ব,১১তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১০ম_পর্ব
পুনরায় নুশরাতকে উদাস হতে থেকে তার সামনে তুড়ি বাজায় স্বর্ণ। নুশরাত তার দিকে তাকালে হাসিমুখে বলে,
“আপনার কেসের সমস্যার সমাধান আমার কাছে আছে। আমার মতে এই পন্থা অবলম্বন করলে আপনি খুব সহজে এই কেস জিতে যাবেন!”
স্বর্ণের কথা শুনে অবাক কন্ঠে নুশরাত জিজ্ঞেস করে,
“কি পন্থা?”
“কিন্তু তার আগে বলুন, এর বিনিময়ে আমি কি পাবো?”
“কি চান আপনি?”
স্বর্ণের মুখে বিস্তৃত হাসি। এই হাসির কারণ কি সেটা জানা নেই নুশরাতের। লোকটা কি চাইবে তার কাছে? হঠাৎ স্বর খাদে নামিয়ে বলে,
“বললে দিতে পারবেন তো?”
“শুনি, শুনতে তো দোষ নেই”
স্বর্ণ খানিকটা এগিয়ে এসে বললো,
“আমার আপনাকে চাই”
স্বর্ণের শান্ত গলার বলা কথাটি শুনে পিলে চমকে উঠে নুশরাত। ফাজলামির একটা মাত্রা থাকা উচিত। সর্বদা ফাজলামি কেউ ই পছন্দ করে না। রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠে,
“আমার কলিগ না হলে জুতো খুলে মারতাম। নিতান্ত কলিগ বিধায় ভদ্রভাবে বলছি। আমার অহেতুক মজা করা এবং মজা করা পাবলিক দু চোখে সহ্য হয় না। আগামীবার একটু ভেবে কথা বলবেন।“
নুশরাতের চোখজোড়া রক্ত বর্ণ হয়ে আছে। তার গা রাগে কাঁপছে। অথচ বেহায়া লোকটির লজ্জা নেই। হো হো করে হাসছে। তার হাসিতে ঘরটা অবধি কাঁপছে। কোনো মতে হাসি থামিয়ে বললো,
“আমি সত্যি মজা করছিলাম, আপনি যে মজা পছন্দ করেন না তা জানা ছিলো না। আমার আপনাকে চাই মানে আপনার সময় চাই। আমার সাথে কফি খেতে যেতে হবে। শুধু এটুকুই।“
“বেশ, তাহলে সমাধানটি বলুন।“
“খুব সোজা, উনাদের ফ্যামিলি ডক্টর। যদি কোনোভাবে তার কাছ থেকে এটা নিশ্চিত করা যায় যে ইতি হাই প্রেসারের রোগী ছিলেন। এবং তিনি সাক্ষ্য দিতেও রাজী হয় তবে আমরা একটা হোপ পাবো।“
“ধন্যবাদ”
বলেই উঠে দাঁড়ায় নুশরাত। নুশরাত ব্যাগটা নিতে গেলে অবাক কন্ঠে স্বর্ণ জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“বসে বসে তো আর ফ্যামিলি ডাক্তারকে পাবো না। তাই কাজ করতে বের হচ্ছি।“
“আমাদের কফি?”
“কেসটা আগে জিতি?”
“ইট ইজ আনফেয়ার। আমি আইডিয়া দিলাম আড় আপনি আমাকেই ডিচ করছেন।“
“আইডিয়া দিলেই তো কেস সল্ভ হয় না। আগে কেসটা জিতি। তারপর না হয় কফি পর কফি খাওয়া যাবে।“
“অল দ্যা বেস্ট”
নুশরাত উত্তর দিলো না। হনহন করে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। স্বর্ণ বাঁকা হাসি দিলো। তারপর তার মোবাইলের নোট প্যাড অন করে কিছু লিখলো। তারপর উঠে থাই গ্লাসের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জানালাটি থেকে নিচের রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়। স্বর্ণ সুগাঢ় নয়নে পিচ ডালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার ঠঁটের কোনায় বাঁকা হাসিটি এখনো লেগে রয়েছে।
বিল্ডিং থেকে বের হতেই চমকে উঠলো নুশরাত। বাহিরে বাইকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তৌহিদ। সাদা শার্ট, কালো জিন্স। শার্টের হাতা ফল্ড করা। কপালের উপর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে। চোখে কালো সানগ্লাস। আজ তাকে ক্রিমিন্যালদের পেছনে ছোটা পুলিশ কম, কোনো সিনেমার নায়ক বেশী লাগছে। নুশরাতের বেশ কৌতুহল জাগলো। এই সময়টা তৌহিদের থানার থাকার কথা। অথচ সে এখন তার কর্মস্থলের নিচে বসে আছে। নুশরাত এগিয়ে গেলো তার কাছে। নুশরাতকে দেখেই নড়ে চড়ে উঠলো তৌহিদ। তৌহিদ তার কালো গ্লাসটি খুলতেই নুশরাত ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আজ অফিস নেই?”
“ছুটি নিয়েছি”
“বেশ হাত ফাঁকা মনে হচ্ছে!”
“হাত ফাঁকা, কথাটা ভুল। হাতটা আজকের জন্য ফাঁকা করেছি।“
“কেনো?”
“আজকে বিশেষ দিন তাই। তাই দিনটা সারাদিন তোমার সাথে কাটাবো! কোথায় যাবে বলো?”
“আমার তো আর আপনার মতো হাত ফাঁকা নয়। তাই আপনার সাথে ঘোরার সময় নেই আমার। কাজে বের হচ্ছি।“
বলেই হাটা ধরলে তৌহিদ হাটটা টেনে ধরে বলে,
“আমি তো ঘোরার কথা বলি নি। বলেছি একসাথে কাটাবো। তুমি তোমার কাজ করবে। আমি শুধু তোমার সাথে থাকবো।“
নুশরাত কিছুক্ষণ বেকুবের মতো তার দিতে তাকিয়ে থাকলো। লোকে শুনলে বলবে, লোকের ভীমরতি হয়েছে। বুড়ো বয়েসে প্রেমিক ভং ধরেছে। লজ্জায় মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো নুশরাতের। সে মৃদু কাশি দিয়ে বললো,
“বনানী থানায় যাবো।“
“থানায় কেনো?
“আমার সামনের সপ্তাহের কেসটার কাজে। কিছু জানার আছে।“
“বেশ তবে চলুন ম্যাডাম, আপনার রথ এবং চালক দুই আপনার সামনে।“
নুশরাত হেসে উঠলো। কাল রাতের ত্রাশটা হালকা হয়ে এসেছে। কেউ তার সাথে মজা করেছে। অহেতুক ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে। তৌহিদ সাথে থাকলে এসব ভয়ের সাথে লড়াই করাটা কোনো ব্যাপার ই নয়। নুশরাতের মনের জং ধরা ভালোবাসাটার তালাটা খুলতে শুরু হয়েছে। এক অজানা ভালোলাগা তার মনে দোলা দিচ্ছে। হয়তো নীল ভালোবাসা এর ই নাম। বাইক স্টার্ট দেওয়া হয়েছে। চলছে আপন মনে পিচঢালা কালো রাজপথে। গন্তব্য বনানী থানা।
হাসপাতাল থেকে বের হলো তৌহিদ এবং নুশরাত। আতিয়ার সাহেব লোকটি মাত্রাতিরিক্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। তার ধারণ সে কখনো এই জেল থেকে বের হয়তে পারবেন না। সারাজীবন জেলেই পঁচে মরতে হবে তাকে। প্রেসার, পালস বেড়ে একটা একাকার অবস্থা তার। কাস্টেডিতে জিজ্ঞেসাবাদের সময় বমি টমি করে একাকার অবস্থা। এখন তাকে রাখা হয়েছে বনানীর একটা হাসপাতালে। দুজন পুলিশ তাকে নজরদারিতে রেখেছে। তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। তৌহিদ এবং নুশরাত বনানী থানার ইন্সপেক্টর আহসানের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিয়েছে। ফলে পনেরো মিনিটের জন্য তারা কথা বলতে পারবে আতিয়ার সাহেবের সাথে। কিন্তু এতো ঝামেলা করে কোন লাভের লাভ হলো না। কারণ যখন হাসপাতালে তারা পৌছালো তখন আতিয়ার সাহেব গভীর ঘুমে। অতিরিক্ত বাজে বকার জন্য ডিউটি ডাক্তার তাকে ওভারডোজ ঘুমের ঔষধ দিয়েছেন। রাগের মাথায় রাস্তায় পড়ে থাকা ক্যানে সজোরে লাথি মেরে দিলো নুশরাত। সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারছে না সে। তঊহিদ ধীর গলায় বললো,
“চা খাবে?”
“মজা নিচ্ছেন?”
“এ বাবা, তোমার মাথার রগ ফুলে গেছে তাই বললাম।“
“আমার যেভাবে হোক, এটা প্রমান করতে হবে ইতির মৃত্যুটা এক্সিডেন্ট। যে মানুষ পুলিশ কাস্টেডি থাকতে পারে না সে কিভাবে কারোর খুন করতে পারে। কিন্তু আমার হাতে কিছুই নেই।“
হতাশ কন্ঠে বলে উঠলো নুশরাত। তৌহিদ এক মনে নুশরাতকে দেখতে থাকলো। খর রোদ্রে মেয়েটার মুখটা লাল হয়ে আছে। নাকের উপর এক বিন্দু ঘাম জমেছে। তার উপর সূর্যকিরণ পড়ায় তা চকচক করছে, যেনো কোনো মুক্তদানা। যা তার সৌন্দর্য্য বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। বলতে ইচ্ছে করছে,
“ওহে কন্যে তোমার ঘর্মাক্ত মুখখানায় মরতেও রাজী আমি”
কিন্তু তা আর বলা হলো না তৌহিদের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ইতির বাড়িটা কোথায়?”
“তা দিয়ে কি হবে?”
“তল্লাশি দিবো।“
“ভাবটা এমন যেনো আমি গেলেই দারোয়ান ঢুকতে দিবে যেনো!”
“তোমাকে দিবে না, আমাকে তো দিবেই। পুলিশ বলে কথা।“
তৌহিদের মুখে দুষ্টু হাসি। হাসির মর্মার্থটা বুঝতে বাকি রইলো না নুশরাতের। হতাশা যেনো হুট করে উধাও হয়ে গেলো। এক অন্য উদ্দীপনা কাজ করছে। অনেকদিন পর খোরাফাতি কিছু করার উৎসাহ কাজ করছে নুশরাতের মাঝে। ঝট করে বলে উঠলো,
“বনানী ক্লাবের পাশে”
তৌহিদ আবার বাইক স্টার্ট দিলো। অবশেষে তারা ইতির বাসায় গিয়ে পৌছালো। বিশাল জায়গা নিয়ে একটি ডুপ্লেক্স বাসা। আতিয়ার সাহেব জেলে থাকায় কেয়ারটেকার আলম সব দেখা শুনা করে। তৌহিদ তাকে ঝাঝালো কণ্ঠে কিছু জিজ্ঞেস করতেই সে দরজা খুলে দিলো বাসার। সেই সুবাদে নুশরাত এবং তৌহিদ ও ঢুকে পড়লো বাসায়। বাসায় যে জায়গায় ইতির মৃত্যু ঘটে যেই জায়গাটাও ভালো করে পর্যবেক্ষ্ণ করলো নুশরাত। ইতির কাবার্ড খুজে তার প্রেসক্রিপশন ও পেলো সে। সে ডা. বিধান চন্দ্রকে দেখাতেন। প্রেসক্রিপশনে তাকে ওলমেসন ২০ সকাল এবং রাতে খাবার জন্যো বলা হয়েছে। এতেই বোঝা যায় তার হাই প্রেসার এর সমস্যা আছে। প্রয়োজনীয় সব জিনিস নেবার পর তৌহিদকে ইশারা করলো নুশরাত। ফলে তৌহিদ, কেয়ারটেকারকে ২০০ টাকার নোট ধরিয়ে বললো,
“দরজা আটকে দাও, আর আমার আসার কথা কাউকে বলেছো তো খব আছে।“
তারা বেরিয়ে গেলো বাসাটি থেকে। পেনড্রাইভে বাড়ির গেটের সিসি টিভির ফুটেজ ও নিয়ে নিলো ইতি। ভাগ্যিস ফুটেজটা ডিলেট হয় নি। হাসি মুখে বাইকে উঠে বসলো নুশরাত। কৃতজ্ঞ কন্ঠে বললো,
“আপনি না থাকলে কিছুই সম্ভব হতো না। ধন্যবাদ।“
“বউ এর জন্য এটুকু করা যেতেই পারে।“
গলা খাঁদে নামিয়ে কথাটা বললো তৌহিদ। তাই কথাটা কান অবধি পৌছালো না নুশরাতের। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে নুশরাতের। ফোন রিসিভ করতেই মুখের ভাব বদলে যায় তার। চোয়ালটা শক্ত হয়ে যায়। তৌহিদ লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বলে,
“কে ফোন করেছিলো?”
“আম্মু, ইশরা এখনো বাসায় পৌছায় নি। তার কলেজের দারোয়ান বলেছে সে নাকি ঘন্টা খানিক আগেই কলেজের গেট থেকে বেড়িয়ে গেছে…………………
চলবে…
দৃষ্টির_অগোচরে
দ্বিতীয়_অধ্যায়
১১তম_পর্ব
নুশরাত কৃতজ্ঞ কন্ঠে বললো,
“আপনি না থাকলে কিছুই সম্ভব হতো না। ধন্যবাদ।“
“বউ এর জন্য এটুকু করা যেতেই পারে।“
গলা খাঁদে নামিয়ে কথাটা বললো তৌহিদ। তাই কথাটা কান অবধি পৌছালো না নুশরাতের। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে নুশরাতের। ফোন রিসিভ করতেই মুখের ভাব বদলে যায় তার। চোয়ালটা শক্ত হয়ে যায়। তৌহিদ লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বলে,
“কে ফোন করেছিলো?”
“আম্মু, ইশরা এখনো বাসায় পৌছায় নি। তার কলেজের দারোয়ান বলেছে সে নাকি ঘন্টা খানিক আগেই কলেজের গেট থেকে বেড়িয়ে গেছে। অথচ বাসায় পৌছায় নি।”
নুশরাতের কন্ঠে উৎকন্ঠা। তার দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত। তরতর করে ঘামছে৷ তাকে বিচলিত হতে দেখে তৌহিদ তার কাধ আলতো করে ধরলো। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“ও হয়তো ওর কোনো বান্ধবীর বাসায় গিয়েছে। আরে ও তো বাচ্চা মেয়ে নয় যে হারিয়ে যাবে।”
“এটাই তো ও তো বাচ্চা মেয়ে নয়, যে হারিয়ে যাবে। তাহলে কেনো ও এখনো বাড়ি ফিরে নি।”
কাঁপা স্বরে নুশরাত কথা গুলো বলে। তার মনের সুপ্ত ভয়টি এখন আর মনের কোনে লুকিয়ে নেই। সে বেরিয়ে এসেছে। এবং ধীরে ধীরে নুশরাতের চিন্তাশক্তিকে অকেজো করে দিচ্ছে। ভোর রাতের সেই হুমকি পত্রের ফল কি তবে এই ইশরার হারিয়ে যাওয়া! নুশরাত হুট করেই ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
“আমি যাবো। প্লিজ বাড়ি নিয়ে চলুন আমায়।”
তৌহিদ কোনো কথা বললো না, নির্বাক দর্শকের ন্যায় নুশরাতের পাগলামি দেখতে লাগলো। সে জানে নুশরাত এখন থামবে না। যতক্ষণ না ইশরাকে খুজে পাওয়া যাবে তার উৎকন্ঠা কমবে না। তৌহিদ ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো৷ নুশরাতকে বললো,
“শক্ত করে বসো। ইনশাআল্লাহ ইশরার কিছু হবে না।”
পারভীন বেগম মুখে আঁচল গুজে কাঁদছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো মেয়ে তার বাড়ি ফিরে নি। ইশরার কোনো বান্ধবীর বাসায় সে যায় নি। সকল বান্ধবীর বাসায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে। দারোয়ানের ভাষ্য সে একাই গেট থেকে বেড়িয়েছিলো। তৌহিদ সব থানায় এবং ট্রাফিক পুলিশের কাছে ইশরার মিসিং হবার খবরটি জানিয়ে দিয়েছে। তৌহিদকে গত রাতের হুমকি পত্রটি দেখায় নুশরাত। তৌহিদের মুখ খানিকটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠে, এই হুমকিপত্রের মানে কি! তখন কাউন্টডাউন ঘড়িতে 09:08:45 দেখাচ্ছিলো। তারমানে এই নয় ঘন্টার মধ্যে যেভাবে হোক ইশরাকে খুজে বের করতে হবে তাকে। তৌহিদ ধীর কন্ঠে বলে,
“তুমি এই চিঠিটার কথা আমাকে বলো নি কেনো?”
” আমি ভেবেছি কেউ মজা করছে আমাদের সাথে।”
“নুশরাত কেউ মজা করছে না। বরং খুব বাজে কিছু ঘটতে চলেছে। তুমি বাড়ি থেকে বের হবে না। আমি থানায় যাচ্ছি। কিছু জানলে তোমাকে ফোন দিচ্ছি।”
বলেই বেরিয়ে পড়ে তৌহিদ। ফোরেন্সিকে আবার বক্সটি পাঠিয়েছে তৌহিদ, যদি কোনো ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া যায়। ইশরার মোবাইলটা বন্ধ। বন্ধ হবার আগে শেষ জিপিএস লোকেশন তার কলেজ দেখাচ্ছে। ব্যাপারটি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। হাতে সময় কম অথচ কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না মেয়েটি কোথায়! নুশরাত পারভীন বেগমের পাশে বসে রয়েছে। তৌহিদ তাকে বাসা থেকে বের হতে মানা করেছে। কিন্তু হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকাটা অসম্ভব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে পড়েছে নুশরাতের জন্য। পারভীন বেগম কেঁদে উঠলেন,
“আমার মেয়েটা না জানি কি অবস্থায় আছে!”
“মা তুমি চিন্তা করো না। দেখো একটা খবর ঠিক আসবে থানা থেকে।”
“কখন আসবে? সেই দুপুরে তৌহিদ বেড়িয়েছে। এখনো কোনো খবর তো আসে নি।”
নুশরাত কি উত্তর দিবে তার জানা নেই। সত্যি বলতে চিন্তা তার ও হচ্ছে। ভয় তারো লাগছে। কিছু দুঃচিন্তা মাথায় জেকে বসেছে। কেউ তার সাথে শত্রুতা ইশরার উপর তুলবে না তো। কিন্তু এই শত্রুটি কে! কে তার এতো বড় ক্ষতি করতে চাচ্ছে! রবিন! হুট করেই রবিনের কথাটা মাথায় খেললো তার। পারভীন বেগমকে বললো,
“মা, তুমি কেঁদো না। আমি একটু থানা হয়ে আসছি।”
বলেই উঠে দাঁড়ালো নুশরাত। অনেক প্রশ্ন জমেছে তার মনের গভীরে। এই মূহুর্তে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া খুব প্রয়োজন। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো নুশরাত।
হেড অফিসে বসে রয়েছে তৌহিদ। তার কপালে ভাজ পড়েছে। তার সামনে গত রাতের কাউন্টডাউন ঘড়িটি। ঘড়ির সময় কমছে। কিছুদিন পূর্বের বক্সটি এবং এই বক্সের চিরকুটের হ্যান্ড রাইটিং সেম। ব্যাপারটা আরো ভাবাচ্ছে তৌহিদকে। চিরকুটটি বারবার পড়ছে সে,
“শূন্য ঝুলি আজিকে আমার;
দিয়েছি উজাড় করি
যাহা-কিছু আছিল দিবার,
প্রতিদানে যদি কিছু পাই
কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা
তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই
পারের খেয়ায় যাব যবে
ভাষাহীন শেষের উৎসবে”
এই কবিটাতির অর্থ কি! কবিগুরুর এই কবিতাটি দিয়ে কি বুঝাতে চেয়েছে সেই লোক।
“পারের খেয়ায় যাব যবে
ভাষাহীন শেষের উৎসব”
এই শেষের উৎসব কি! মৃত্যু! এখানে কি কারোর মৃত্যুকে বোঝানো হয়েছে! কার মৃত্যু! ইশরার? এর সাথে কি কানা বসিরের কোনো যোগসংযোগ আছে। কিন্তু কানা বসির মারা গেছে, তাহলে কে এই ব্যাক্তি যে কানা বসিরের ল্যাগাসি ফলো করছে। সে কিসের প্রতিদান চাচ্ছে? এই কবিতার মাধ্যমে কি সে কানা বসিরের মৃত্যুর কথা বলেছে! কিন্তু এই ব্যাক্তিটি কে? কোনো ভক্ত? হতেই পারে। বিখ্যাত খুনি টেদ বন্ডির মৃত্যুর পর তার ও অনেক পাগল ভক্ত দেখা গিয়েছিলো। যারা টেড বন্ডিকে গুরু বা আদর্শ ভাবতো। কানা বসিরের ব্যাপারটা তখন খবরে বেশ আলোড়ন তুলেছিলো। একেরপর এক মোট সাতটি ফুলের মতো মেয়েকে নৃশংসতার সাথে হত্যা করে সে। তাকে শুট করার পর তার ময়না তদন্ত ও হয়। সেই রিপোর্টটা খুজে বের করেছে আলিফ। রিপোর্টটা ডাক্তার শহীদুল ই করেছিলো। তাহলে এই রিপোর্টে কোনো ভুল নেই বলা যেতেই পারে। তৌহিদকে প্রচন্ড চিন্তিত দেখে হাবীব বললো,
“টাকার জন্য কেউ এখনো ফোন করে নি, তাহলে একটা কলেজ স্টুডেন্টকে কিডন্যাপ করার উদ্দেশ্য কি!
“অনেক কিছুই হতে পারে। ভয় দেখানো, ধর্ষণ করা অথবা খুন।”
“একটা নিস্পাপ মেয়েকে খুন করবে? কোনো মটিভ ছাড়া?”
“সাইকো কিলারদের খুন করার পেছনে কোনো মোটিভ থাকে না, থাকে শুধু তাদের পৈশাচিক আত্মতৃপ্তি। যদি তাই না হতো তবে কানা বসির ও এতো গুলো খুন করতো না।”
“স্যার, আমরা ভুল ট্রাকে যাচ্ছি না তো? কানা বসিরের কোনো সন্তান কিংবা আত্নীয় বলতে কেউ নেই। লোকটার চ্যাপ্টার তো ওইদিন ই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এমন তো নয়, কেউ ওর ভং ধরে আমাদের কনফিউজ করছে!”
তৌহিদ উত্তর দিলো না। সে গভীর চিন্তায় ব্যাস্ত। ঢাকা শহরের রাস্তার সকল সি সি টিভি ফুটেজ তারা বের করেছে। কিন্তু কোথাও ইশরার কোনো সন্ধান পায় নি তারা। ইশরার ফোন ট্রেস করা হচ্ছে। তার কল রেকর্ড বের করা হয়েছে। লিস্টের মাঝে একটি নাম্বারে মিসিং হবার আগে সতেরো বার ফোন করা হয়েছে। নাম্বারটি কার! তৌহিদ হাবীবকে বলে,
“হাবীব এই নাম্বারের সকল ডিটেইলস বের করো। ফাস্ট। সময় কম হাতে।”
“জ্বী স্যার।”
বলেই হাবীব বেরিয়ে গেলো অফিস থেকে। হঠাৎ তৌহিদ উঠে দাঁড়ালো। একটি দশজনের টিম নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ফোন দিয়ে বললো,
“বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে কোনো কবরস্থান আছে কি? থাকলে লোকেশন সেন্ড করো। ফাস্ট। আর তোমরা ও সেখানে পৌছাও।”
অন্ধকার কামড়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নুশরাত। কামড়া টি শিক এবং জাল দিয়ে আটকানো। শিকে জং পড়েছে। ফিনাইলের বাজে গন্ধ নাকে আসছে। আশপাশের কোলাহল, আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। আর্তনাদ বাঁচার জন্য, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার জন্য। নুশরাতের ঠিক সামনে দেয়ালে কিছু লিখে যাচ্ছে শিকল বন্দী লোকটি। তার দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়। এলোমেলো চাহনী। চুলগুলো বেশ বড় হয়েছে, পরণে ময়লা জামা, হাতের নখগুলো দেয়ালে ঘষতে ঘষতে ক্ষয়ে গেছে। রক্ত বের হচ্ছে। এই চারদেয়ালের আধারে থাকতে চায় না সে। তার মুক্তি চাই। কিন্তু মুক্তি আদৌ পাওয়া সম্ভব। নুশরাত ধীর কন্ঠে বললো,
“রবিন…
চলবে…
মুশফিকা রহমান মৈথি