দৃষ্টির অগোচরে,৭ম_পর্ব,৮ম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
৭ম_পর্ব
নুশরাতের বুঝতে বাকি রইলো না কেস কোথায় যাচ্ছে। একটা পর্যায়ে বিচারক রবিনকে তার পক্ষ রাখতে আদেশ দেন। রবিন একটা ছোট নিঃশ্বাস ছাড়ে তারপর বলে,
– জনাব, এই খুনটি নিতান্ত একটি রোবারি কেস, একজন চোর চুরি করতে এসে ধরা পড়েছে। নিজেকে বাঁচাতে মালিককে ছুরি মেরেছে।
– অবজেকশন মাই লর্ড, আমার উকিল বন্ধুটি এতোটা নিশ্চিত কিভাবে হচ্ছেন, এটা সামান্য চুরির জন্য খুন!
বিপক্ষের উকিল হুংকারের সাথে কথাটা বলে উঠে। রবিন একটু হাসে, তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
– কারণ আমার কাছে প্রমাণ আছে। আমার প্রথম প্রমাণ যে চুরিটি আমার বিপক্ষের উকিল বন্ধু পেস করেছেন সেই ছুরিটি দিয়ে খুন হয় নি। এই ছুরি দিয়ে খুন হওয়া সম্ভব নয় কারণ ছুরিটি নিতান্ত ধারহীন। আমি প্রমাণ করার জন্য আমার মাননীয় আদালতের কাছে অনুমতি চাচ্ছি।
– অনুমতি দেওয়া হলো।
বিচারক সাহেব একটু চিন্তা করে কথাটা বললো। রবিন তার এসিসট্যান্ট কে কাঠগড়ায় হাজির হবার আহ্বান জানালো৷ ছুরির ধার পরীক্ষা করার জন্য একটি আপেল কাঁটতে বলা হলো তাকে। কিন্তু সেই আপেলটি কাঁটা তো দূরে থাক একটু আঁচড় ও লাগে নি আপেলের গায়ে। রবিন এর পর বললো,
– স্যার আমার দ্বিতীয় প্রমাণ একজন সাক্ষী। তিনি আর কেউ নন, বরং এই কেসের ইনচার্জ উত্তরা থানার ওসি তৌহিদুর রহমান। আমি তাকে কাঠগড়ায় আনার অনুমতি চাচ্ছি।
– অনুমতি দেওয়া হলো।
বিচারকের অনুমতি পেয়ে পেসকার তৌহিদকে কাঠগড়ায় ডাকে। তৌহিদ কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। নুশরাত এই এক সপ্তাহ পর তৌহিদকে দেখছে। চোখের নিয়ে গাঢ় কালি, শ্যামবর্ণ চেহারা আরো কালো লাগছে। চুলগুলো উশকো খুসকো হয়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কত নির্ঘুম রাত না জানি তার কেটেছে। তৌহিদকে নুশরাত ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে। লোকটাকে তার কাছে অনুভূতিহীন জড় পদার্থের ন্যায় মনে হয়৷ যে বয়সে সাধারণত ছেলে মেয়েরা বাউন্ডেলেগিরি করে সেই বয়সে একটা পরিবারের ভরণপোষণ সামলানো টা কম সাহসের কাজ নয়। হুট করে বাবা মারা যাওয়ায় একটা সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে নেমে আসে। সেই সংসারটাকে আজ অবধি আগলে রেখেছে তৌহিদ৷ তাই তো এতো বয়স হয়ে যাবার পরও বিয়ে নামক অধ্যায়ের সূচনা সে ঘটায় নি তার জীবনে। নুশরাত এক দৃষ্টিতে তৌহিদকে দেখে যাচ্ছে। সে নির্বিকারচিত্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখে ভীতির ছাপ রয়েছে যদিও, কিন্তু নুশরাত তার কারণ ঠাহর করতে পারছে না। ক্ষমতার চাপে বিচারক অবধি বিপক্ষের উকিলের হ্যা তে হ্যা মিলাচ্ছে অথচ তৌহিদ অকপটে রবিনের সাক্ষী হতে রাজী হয়ে গেছে। তার কি চাকরির মায়া নেই! নাকি এটাও মঈনুদ্দিন সাহেবের কোনো ছক! রবিনের আত্নবিশ্বাস অটল, সে বেশ জড়তাবিহীন ভাবেই তৌহিদকে প্রশ্ন করলো,
– তো তৌহিদ সাহেব, আপনি কি আদালতকে জানাবেন একসপ্তাহ আগে আপনি বিল্ডিং এর পরিত্যাক্ত অংশ থেকে কি পেয়েছিলেন?
– জ্বী, অবশ্যই। আমি বৃহস্পতিবার রাতে পুরো বিল্ডিং টা আরো ও একবার বেশ ভালো করে খুঁজি। প্রথম সোফা থেকে যে ছুরিটা পাওয়া গিয়েছিলো তার ধারটা পরীক্ষা আমাদের করা হয় নি। যখন আমরা ছুরির ধার পরীক্ষা করেছিলাম তখন জানতে পারি ছুরিটির ধার কোনো মানুষ খুন করতে যথেষ্ট নয়। তারপর যখন বিল্ডিং টা খোঁজা হয় তখন আমি এই পলিথিনটা পাই। এই পলিথিনে একজোড়া গ্লাভস এবং একটি ধাঁরালো ছুরি পাওয়া যায়। ফোরেন্সিক টেস্টে জানা যায় ছুরিটা দিয়েই মাহির চৌধুরীকে খুন করা হয়েছে। গ্লাভসে যার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে সে একজন চোর যার নাম সাদ্দাম। তার ক্রিমিনাল রেকর্ড ফাইলে রয়েছে। কিন্তু আফসোস আমরা সাদ্দামকে ধরতে পারবো না। কারণ বিগত বৃহস্পতিবার ওভারড্রাগের কারণে তার মৃত্যু হয়। বনানী থানা লাশটি উদ্ধার করে।
কোর্টে ফিসফিসানি শুরু হয়। তৌহিদে সাক্ষ্য যেনো কেসের দিক পালটে দিয়েছে। যেখানে বিচারক তৈরি ছিলো নুশরাতকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করবে সেখানে এখন তাকে নির্দোষ ঘোষণা করতে হবে। রবিন হাসি মুখে বলে,
– আমার মক্কেল নির্দোষ, তাকে শুধু হয়রানি করবার জন্যই এই মিথ্যে মামলাতে জড়ানো হয়েছে। সেদিন রাতে সাদ্দাম আমার মক্কেলের বাসায় চুরি করবার উদ্দেশ্যে এসেছিলো। আমার মক্কেল কিছু কেনাকেটা করবার জন্য বাহিরে গিয়েছিলো। তার সাক্ষী আমি নিজে। আমাদের ফোনালাপ শুনলে আদালত নিশ্চিত হয়ে যাবেন। সাদ্দামের চুরির সময় ই মাহির বাসায় ফিরে। সাদ্দাম কি করবে ভেবে না পেয়ে অন্ধকারে অতর্কিতে মাহিরকে ছুরি মেরে পালিয়ে যায়। ঘর থেকে আমার মক্কেলের কিছু গয়না এবং টাকাও হারানো গিয়েছিলো সেই রাতে। কিন্তু মাহিরের মৃত্যুতে তিনি এতোটাই ভয় পেয়ে যান যে ব্যাপারটা তার মাথায় ছিলো না। আমার মাননীয় আদালতের কাছে নিবেদন, আমার মক্কেলকে এই অভিযোগ থেকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হোক। দ্যাটস অল ইউর ওনার।
কোর্টে পিনপতন নীরবতা, বিচারক তার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ চিন্তায় রয়েছেন। কিন্তু তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একজন নির্দোষকে সে কখনোই শাস্তির ঘোষনা করতে পারেন না। তাই অনেক চিন্তার পর শেষমেষ আদালত নুশরাত কে নির্দোষ ঘোষণা করলো। আদালতের এমন রায়ের পর, মঈনুদ্দিন সাহেব কোর্টরুম থেকে রেগে বের হয়ে গেলেন৷ পারভীন বেগমের চোখে অশ্রু, তার মেয়ে আজ দশদিন পর জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছে৷ রবিন ফোওওস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো৷ দুদিন আগ অবদি ও চোখে অন্ধকার দেখছিলো সে। কিন্তু সেই রাতে দেবদূতের ন্যায় তৌহিদের আগমণ ঘটে তার বাসায়।
দুদিন পূর্বে,
হাজারো খোঁজার পর ও ছুরি কেনো কোনো একটা সুতাও বিল্ডিং থেকে পায় নি রবিন। নিজেকে বড্ড অকেজো মনে হচ্ছে। নুশরাতকে যেভাবে অক্টোপাসের ন্যায় ধরা হয়েছে তাতে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করাটা শুধু কঠিন নয় অসম্ভব। কফির মগ খালি হচ্ছে কিন্তু উপায় মাথা আসছে না। টেবিলে সজোরে থাবা মারে রবিন। এতোটা অকেজো সে নয়, তার যেভাবেই হোক নুশরাতকে এই জঞ্জাল থেকে মুক্ত করতে হবে। হঠাৎ তার দরজার কলিংবেলটা বেজে উঠে। দরজা খুলতেই রবিনের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। দরজার ওপাশে তৌহিদ দাঁড়িয়ে রয়েছে। রবিনের দৃষ্টি যখন তাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত, তখন তৌহিদ হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠে,
– সিগারেট হবে!
– আপনি সিগারেটের জন্য আমার বাড়ি এসেছেন?
– উহু, সিগারেট থাকলে কথা বলতে সুবিধা হয়।
রবিন কিছু বললো না। সে তৌহিদ কে ভেতরে আসতে বললো। একটা বেনসনের প্যাকেট এবং একটা লাইটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
– এবার বলুন এতো রাতে আমার কাছে কি মনে করে?
তৌহিদ সিগারেটটা ধরালো, একটা সুখটান দিয়ে ভনীতা ছাড়াই বলে উঠলো,
– ওরা নুশরাতকে নির্দোষ প্রমাণ করতে দিবে না। মঈনুদ্দিন সাহেব তার ক্ষমাতার অপব্যবহার করছেন।
– সেটা আমিও জানি। কিন্তু আমার কাছে কোনো ক্লু নেই। একটা উপায় যদি পেতাম
– একটা উপায় অবশ্য আছে।
– কি সেটা?
– আমাকে সাক্ষী হিসেবে আপনি কোর্টে পেস করুন। বাকিটুকু আমি সামলে নিবো।
– সাক্ষ্য দিয়ে কিছুই হবে না, প্রমাণ ও লাগবে। আমার কাছে তো যা দিয়ে খুন করা হয়েছে সেটাও নেই।
– আমার কাছে আছে।
বলেই একটা কাগজ পকেট থেকে বের করলো তৌহিদ। কাগজটা দেখে রবিনের বুঝতে বাকি রইলো না কেনো সে ছুরিটা হাজারো খোঁজার পর ও পায় নি। দুয়ে দুয়ে চারটা খুব সহজেই মিলে গেলো। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
– আচ্ছা কোনো চোর কি দু-তিন আঘাতে একটা মানুষকে খুন করে ফেলতে পারে?
রবিন অকপটে প্রশ্নটি ছুড়ে দেয় তৌহিদের দিকে। তৌহিদ বাঁকা হাসি হাসে৷ তারপর বাহিরের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
– আপাতত নুশরাতকে বাঁচানোটাই বেশি জরুরি। বেশি ঘাটাঘাটি করার সময় এখন নয়।
রবিন আর প্রশ্ন করলো না। তৌহিদের কথার যুক্তি রয়েছে। এখন যদি রহস্য উম্মোচনে মন দেওয়া হয় তবে নুশরাতকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ব্যতীত কোনো লাভের লাভ হবে না। তৌহিদ সিগারেটে সুখটান দিতে ব্যাস্ত। তার মাথায় কি ছক চলছে তা সে ব্যাতীত কেউ জানে না______
বর্তমান,
নুশরাতকে জড়িয়ে ধরেছেন পারভীন বেগম। তার মেয়েকে এতোদিন পর বুকে নিতে পেরেছেন তিনি৷ সুখের অশ্রু চোখ থেকে মুক্তি পাচ্ছে৷ নুশরাত মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। মৃদু হাসি দিয়ে বললো,
– বলেছিলাম না মা, কিছু হবে না আমার।
পারভীন বেগম মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নাড়ালেন। রবিন তাকে অভিনন্দন জানালো। কিন্তু নুশরাতের চোখ তৌহিদকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাকে ধন্যাবাদ দেওয়া হয় নি। লোকটা তার হয়ে সাক্ষী না দিলে আজ তার মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ছিলো। কিন্তু তৌহিদের কোনো ছায়াও দেখতে পেলো না নুশরাত। হয়তো লোকটা বেড়িয়ে গেছে। ব্যাপার না পরে তাকে ধন্যবাদ দেওয়া যাবে। এখন বাসায় যাবে নুশরাত। একটা লম্বা ঘুম দিবে সে। অবশেষে তার নির্দোষিতা প্রমাণ হয়েছে। কোর্টরুম থেকে বের হচ্ছিলো নুশরাত তখনই তার পা জোড়া আটকে যায়৷ হন্তদন্ত হয়ে আশেপাশে দেখতে থাকে নুশরাত। খুনি মারা যায় নি বরং বেঁচে আছে। নুশরাত কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ পাগলের মতো খুঁজতে থাকে সে। তখনই………
চলবে
দৃষ্টির অগোচরে
৮ম_পর্ব
কোর্টরুম থেকে বের হচ্ছিলো নুশরাত তখনই তার পা জোড়া আটকে যায়৷ হন্তদন্ত হয়ে আশেপাশে দেখতে থাকে নুশরাত। খুনি মারা যায় নি বরং বেঁচে আছে। নুশরাত কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ পাগলের মতো খুঁজতে থাকে সে। তখনই বেশ কয়জন সাংবাদিক জোকের মতো নুশরাতকে ঘিরে ধরে। একের পর এক নানা প্রশ্ন করছে তারা। তাদের কৌতুহলী প্রশ্নের ভিড়ে নুশরাত খিল হারিয়ে ফেলে। রবিন কোনোমতে নুশরাতকে সেই ভিড় থেকে বের করে আনে। পারভীন বেগম এবং রবিন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নুশরাতের দিকে। নুশরাত যেনো নিজের মাঝেই নেই। তার কপালের ভাঁজ জানান দিচ্ছে তার মস্তিষ্ক গভীর চিন্তায় মগ্ন। রবিন নুশরাতকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে প্রশ্নের সুরে বলে,
– সব আছে তো?
-……
– নুশরাত, ইজ এভ্রিথিং অলরাইট?
– খুনি সাদ্দাম নয়, খুনি অন্য কেউ! আর সে বেঁচে আছে। আমার আশেপাশেই আছে।
অন্যমনস্কভাবেই কথাটা বলে নুশরাত। নুশরাতের কথা শুনে ভ্রুযুগল সামান্য কুঞ্চিত হয় রবিনের। তার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নুশরাতকে পর্যবেক্ষণ করছে। রবিন কন্ঠ নামিয়ে বললো,
– তুই যা ভাবছিস তা নিছক কল্পনা মাত্র।
– মোটেই না। এটা মোটেই কোনো কল্পনা নয়। আমি শতভাগ নিশ্চিত।
– তার কারণটা জানতে পারি?
– পারফিউম। একটা খুব অন্যরকম একটি পারফিউমের সেন্ট। সাধারণত ছেলেদের পারমিউমগুলো খুব তীব্র হয়। এটা তীব্র নয়। এটা আমি এই নিয়ে তিনবার পেয়েছি৷ একবার যখন বিল্ডিং এর গেটে ঢুকছিলাম তখন পেয়েছি। দ্বিতীয়বার আমার বাসায় ঢোকার সময় আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি ততটা পাত্তা দেই নি। আজ আবারো পেয়েছি। আজ বেশ ভালো করে আমার নাকে গন্ধটা লেগেছে। একদম আমার পাশ দিয়ে লোকটা গিয়েছে। আমি মুখটা দেখতে পারি নি। ক্যাপ পড়া ছিলো।
নুশরাত একমনে কথাগুলো বলছে। একটা সময় খেয়াল করলো রবিন তার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে৷ এই দৃষ্টিতে অবিশ্বাস, সন্দেহের রেশ রয়েছে। নুশরাত চুপ করে গেলো। তার কথার বিশ্বাস এখানে কেউ করছে না এটুকু বুঝতে তার বাকি রইলো না। রবিন ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো তারপর ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– আন্টি নুশরাত ক্লান্ত। দশ দিন কম ধকল যায় নি ওর উপর৷ আপনি ওকে বাসায় নিয়ে যায়। আমিও বাসায় যাবো। কালকে আমার হাজিরা আছে কোর্টে। আসলাম রে। আর বেশি চিন্তা করিস না। এই কেসটাকে এখানেই ক্ষান্ত দে।
বলেই হাটা দিলো সে৷ রবিনের ভ্রুক্ষেপহীন আচারণ দেখে নুশরাতের মনটা বসে গেলো।।তার ইন্সটিন্ক্ট বলছে খুনি বেঁচে আছে। লোকটা তার আশেপাশেই আছে। কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। নুশরাত পারভীন বেগমের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে বললো,
– মা, বাসায় চলো। শরীরতা ভালো লাগছে না।
পারভীন বেগম মলিন হাসি হাসলেন৷ এই পুরো ঘটনাটা নুশরাতের মনে গভীরভাবে ছাপ রেখেছে, এই ছাপ হালকা হতে সময় লাগবে। তাই পারভীন বেগম চান না তার মেয়ে বারবার এই ঘটনাগুলো স্মরণ করে ছাপটা গাঢ় করুক। থাক না কিছু ঘটনা মনের গহীনে বদ্ধ________
পরদিন,
সকাল ৯টা,
তৌহিদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে নুশরাত। বিগত পনেরো মিনিট যাবৎ তার কেঁচিগেটের বাহিরে পায়চারি করছে। কিন্তু গেট পার হবার যেনো সাহস অয়াচ্ছে না সে৷ লোকটির সাথে তার সম্পর্কটা এতোও ভালো নয়। যখনই নুশরাতের সাথে তার দেখা হতো বেশ কটাক্ষের দৃষ্টিতে তাকাতো সে। যেনো নুশরাতের উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করছে। কিন্তু লোকটা তাকে সাহায্য করেছে। কোর্টে ধন্যবাদ দিতে পারে নি সে। তাই আজ বাড়ি অবধি আশা৷ একবার ভেবেছিলো থানায় যাবে, কিন্তু সেই চিন্তার গুড়েবালি কারণ নুশরাতের কোনোই ইচ্ছে নেই অহেতুক হাবীবের মুখখানা দর্শন করার। লোকটাকে দেখলেই রাগে গা রি রি করে তার। রাস্তার পড়া একটা কোকের ক্যান পা দিয়ে নাড়াচড়া করছে নুশরাত। ভেতরে যাবে কি যাবে না বাছাই পর্ব চলছে মনে। এর মধ্যেই তৌহিদের ছোট বোন তামান্না বেড়িয়ে আসে। নুশরাতকে গেটের বাহিরে দেখে বেশ অবাক হয় সে। কারণ পারভীন বেগম কিংবা ইশরা তাদের বাড়ি প্রায় আসা যাওয়া করে কিন্তু নুশরাত তাদের বাসায় আসে না বললেই চলে৷ অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– নুশরাত আপু, কেমন আছো?
তামান্না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো নুশরাত। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ, তুই কেমন আছিস?
– এইতো আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কি কোথাও যাচ্ছো?
– না না, আসলে তোদের বাসায় ই আসছিলাম
– তাহলে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো যে?
– বুঝতে পারছিলাম না, এতো সকালে যাওয়া উচিত কি না!
– আরে ধুর! চলো তো। আমরা আমরাই তো। আসলে আমি ইশরার কাছে যাচ্ছিলাম, একটা বই ওর কাছে থেকে গেছে। ব্যাপার না পড়ে নিয়ে নিবো। তুমি আসো আমার সাথে।
– আচ্ছা তৌহিদ ভাই কি থানায় চলে গেছেন?
আমতা আমতা করে প্রশ্নটি করে নুশরাত। নুশরাতের প্রশ্নে খানিকটা মিয়ে যায় তামান্না। মলিন হাসি দিয়ে বলে,
– ভাইয়ার ট্রান্সফার হয়ে গেছে। ভাইয়া চেষ্টা করছে যাতে তার ট্রান্সফারটা ঢাকাতেই হয়।
– হঠাৎ ট্রান্সফার? উনি তো কিছুদিন ই হয়েছে উত্তরা থানাতে এসেছেন।
– হু একবছর, কিন্তু তাও ভাইয়ার ট্রান্সফারের খবর শোনা যাচ্ছে। ভাইয়া প্রতিদিন কমিশনার স্যারের অফিসে যাচ্ছেন। দোয়া করো যাতে ঢাকার মধ্যেই ট্রান্সফারটা হয়।
নুশরাত কিছু বললো না। উচ্ছ্বাসিত মনের আঙ্গিনায় কালো মেঘেরা ভিড় করেছে তার। এক আকাশ গ্লানি তাকে ভেতরে ভেতরেই কুড়ে খাচ্ছে। মঈনুদ্দিন সাহেবের ক্ষমতা সম্পর্কে সে অজানা নয়। নুশরাতকে সাহায্য করার ফল তো পেতেই হতো তৌহিদকে৷ বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নুশরাতের। বাসায় ঢুকতেই তামান্না তার মা শাহানা বেগমকে ডাকতে ছুটে গেলো। নুশরাত বসার ঘরের সোফাতে বসলো। তৌহিদদের ঘরটা বেশ সিমসাম করে সাজানো। বসার ঘরের একপাশে বড় একটা সেগুন কাঠের বুকশেলফ রয়েছে। তাতে আইনের বই এর পাশাপাশি গল্পের বই ও উঁকি দিচ্ছে। একা একা বসে থাকার চেয়ে একটু বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটা মন্দ হবে না বলে মনে করলো নুশরাত। বুকশেল্ফে আইনের মোটামোটা বইগুলোর মাঝে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “চোখের বালি” বইটি দেখা যাচ্ছে। নুশরাত বইটা হাতে নিলো। পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখে পড়লো কিছু লাইন,
“যাহা যথার্থ গভীর এবং স্থায়ী, তাহার মধ্যে বিনা চেষ্ঠায় , বিনা বাধায় আপনাকে সম্পূর্ণ নিমগ্ন করিয়া রাখা যায় বলিয়া তাহার গৌরব আমরা বুঝিতে পারি না – যাহা চঞ্চল ছলনামাত্র , যাহার পরিতৃপ্তিতে লেশমাত্র সুখ নাই , তাহা আমাদিগকে পঞ্চাতে উর্ধ্বশ্বাসে গোড়দৌড় করিয়া বেড়ায় বলিয়াই তাহাকে চরম কামনার ধন মনে করি”
নুশরাত মৃদু হাসি হাসলো। এর মাঝেই কানে এলো,
– আজ হঠাৎ এখানে কি কাজ তোমার?
পেছনে তাকাতেই দেখলো তৌহিদ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাদা টিশার্ট এবং কালো থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরিহিত শ্যামবর্ণের পুরুষটি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। নুশরাত ধীর কন্ঠে বললো,
– আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম
– কেনো? হঠাৎ সকাল সকাল আমার কাছে কি মনে করে?
– ধন্যবাদ বলার ছিলো। গতকাল বলা হয় নি। তাই
– বলা হয়ে গেলে যেতে পারো!
– আমি জানি আপনি আমার উপর চেতে আছেন, আমার জন্য আপনার চাকরীগত জীবনে ঝড় বইছে
– কোথাও ভুল হচ্ছে তোমার জন্য কিছুই হচ্ছে না। নিজেকে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভেবো না। যা হচ্ছে আমার নিজের সিদ্ধান্তেই হচ্ছে। আরেকটি কথা আমি তোমার জন্য কিছুই করি নি, মিথ্যেকে প্রশ্রয় দেওয়াটা আমার বিবেকে বাধছিলো তাই আমি কোর্টে সাক্ষী দিয়েছিলাম। যাক গে, এখন আসতে পারো তুমি।
তৌহিদের কটাক্ষ উক্তি শোনার পর আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে হলো না নুশরাতের। সে বইটা টি-টেবিলে রেখে বেরিয়ে যেতে নিলে তৌহিদ বলে উঠে,
– আশা করি আমাদের আর দেখা হবে না।
নুশরাত উত্তর দিলো না। হনহন করে বেরিয়ে গেলো। তৌহিদের বাসা থেকে বের হতেই ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে ছিলো, এখন সেই মেঘের জলটা বর্ষণ রুপে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। নুশরাত ভিজে যাচ্ছে, তবুও জোরে হাটার ইচ্ছে হচ্ছে না তার। কেনো যেনো আজ ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে! কত দিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় নি________
সময়ের ধারা আর নদীর ধারা কখনো সীমাবদ্ধ থাকে না। নদীর ধারার দিক পরিবর্তন করা যায় তবে সেটা থামানো যায় না, ঠিক তেমন ই সময়ের ধারাতে নিজের গতি বদলানো যায় কিন্তু সময়ের ধারাকে থামানো যায় না। নুশরাতের জীবনে ছয়টি মাস কেটে গেছে। মাহিরের সাথে ছাড়াছাড়ি, মাহিরের মৃত্যু ঘটনাগুলো এখন কেবল ই অতীত। নুশরাত নিজেকে বেশ সুন্দর করেই গুছিয়ে দিয়েছে। উত্তরার ফ্লাটটা তার নামে চলে আসলেও৷ সেখানে থাকে না নুশরাত। সে মিরপুরে একটা ছোট বাসা নিয়েছে। মার ওখানে থাকতে চায় না সে। স্বামীর খুনের দায়ে জেল খেটেছে সে। সুতরাং তার প্রতি কতোটা সম্মান দেখাবে লোকেরা বেশ ভালো করেই জানা আছে নুশরাতের। অবশ্য আরেকটি কারণ রয়েছে সেটা হলো তৌহিদ৷ সে তৌহিদের মুখোমুখি হতে চায় না। এতোটা ভীতু সে কখনোই ছিলো না। তবুও মাঝে মাঝে গ্লানি, অপরাধবোধ মানুষকে ভীতু করে ফেলে। রবিনের সাথে এখনো কাজ করা হয় তার। আজকাল বেশি কেস আসে না নুশরাতের কাছে। আসলেও সব অপরাধীর হয়ে লড়তে বলে। ভিক্টিমেরা তার কাছে আসতে চায় না। একটা কেস যদিও বেশ মন মতো পেয়েছে। সেটা নিয়েই আপাতত কাজ করছে সে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো সাতটা বেজে গেছে। অথচ এখনো চেম্বারেই রয়েছে সে। ফাইলটা বন্ধ করে ব্যাগটা ঘাড়ে নিলো নুশরাত। বাসায় যেতে হবে। অফিস থেকে বাসায় যেতে যেতে দেড় দু ঘন্টা তো লাগবেই। ঠিক তাই হলো ঘড়ির কাটা যখন নয়টার ঘরে এসে ভিড়েছে তখন বাসায় পৌছালো সে। দরজার লক খুলে অন্ধকার রুমে প্রবেশ করলো সে। লাইট জ্বালাতে যাবে তখনই বেশ অন্যরকম অনুভূতি হলো নুশরাতের। যেনো ঘরে সে একা নয়। বাহিরের ল্যাম্পপোস্টের আলো জানালা দিয়ে ঘরে আসছে। সেই আলো এবং সিড়িঘরের আলোতে তার ঘরের টেবিলের উপর রাখা একটা সাদা রঙ্গের বক্সটি দেখা যাচ্ছে। নুশরাত দরজাটি লাগিয়ে দিলো। লাইট জ্বালাতেই দেখলো……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি